#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-২৩
এই “ইট’স ওকে” বলামাত্রই হৃদয় নামের ছেলেটি ওমনি তরতর করে আমার দিকে তাকালো।আমি হালকা করে চোখমুখ ছোট্ট করে আনলাম।ছেলেটি আমাকে দেখে কেমন রিয়াকশন করলো জানি না।ম্যানেজার রাকীব মাহতাব বললো,
“হৃদয়,গত উইকে আমাদের কোম্পানির যেই ড্রয়িং বিজ্ঞাপন দিয়েছি সেটা ইনিই,মানে মিস পারিসা ম্যাম ডিজাইন করেছিল।”
“ওহ আচ্ছা।”
“ম্যাম,আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।এ আমার ফ্রেন্ড হৃদয় হাসান।আমরা দুজন একই ভার্সিটি থেকে পড়াশুনা শেষ করেছি।”
সৌজন্যতা রক্ষার্থে অনিচ্ছাসত্ত্বেও পাশ ফিরে তাকালাম।জোরপূর্বক হাসি টেনে বললাম,
“ওহ আচ্ছা।আমি পারিসা।”
হৃদয় কিছু বললো না।আমার কথায় আলতো শুধু মাথা নাড়লো।তারপর আবার মুখ ফিরিয়ে সোঁজা তাকালো। সেও আমাকে দেখে হয়তো অপ্রস্তুত!আমিও ত অনেক তা আপনারা দেখলেন ই।ম্যানেজার বললেন,
“হৃদয়,একটু স্টপ থাক, দোস।ম্যামের সাথে জরুরী কিছু কথা শেষ করে নিই।”
হৃদয় ওমনি উঠে দাঁড়ালো।বললো,
“আচ্ছা, কথা বল তাহলে।আমি বাইরেই আছি।”
“এখানেও বস।সমস্যা কোথায়? ”
“কিছু না।কথা বল।আমিতো আছিই।যাবো নাতো।”
বলে হর্ণ পায়ে বাইরে চলে গেলো।ম্যানেজার আমার দিকে ফিরলেেন।মৃদু হেসে বললেন,
“বন্ধুটা আমার একটু অন্য গোছের।কারো সাথে কথা বলার মাঝে থাকতে চায় না।ফর্মালিটিজ মেনে চলে আর কি।”
বলে ম্যানেজার আবারো হাসলো।আমিও তালে হাসলাম।
“ম্যাম,প্লিজ ভেবে দেখুন।কাইন্ডলি একটু জানাবেন প্লিজ?”
“আচ্ছা এখনতো সরাসরি ডিসিশন নিতে পারছি না।আমি বাসায় যাই।একটু ভাবি।তারপর আপনাকে ফোনে জানিয়ে দিব।”
“নিশ্চিত,ম্যাম।আপনি সময় নিন।”
বাসায় ফিরে খালামণির সামনে যেয়ে ধপসে বসে পড়ি।খালামণি টিভি দেখতেছিলেন তখন।আমাকে কিছুটা বিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখে বলে উঠেন,
“মন খারাপ লাগে তোর?”
“মন খারাপ না।নিজের উপর নিজের বির হচ্ছে।”
“কেন কি হয়েছে?”
“খালামণি বলো ত?আমার ক্ষেত্রে কেন এরকম হয়?”
“কীরকম?”
“যাদের এভয়েড করতে চাই সেই তারাই আমার সামনে এসে ঝাপটে বসে।ওদিন “ইকো কোম্পানিতে গেলাম ওখানে অভির সাথে দেখা হলো।আজ আবার নয়াপুরী টেক্সটাইল কোম্পানিতে গেলাম ওখানে আবার ওই হৃদয় নামের ছেলেটির মুখোমুখি হতে হলো!এসব কী?আমার সাথে কেন এরকম হয়,বলো ত?”
খালামণি হেসে উঠলেন।বললেন,
“মানুষের মনের সাথে মনের মিল হলে এরকমই হয়, পারিসা!”
“মানে?ওই হৃদয় ছেলেটির সাথে মনের মিল আবার কীভাবে?”
“তুই মনে না করলেও ও তোকে মনে করে।”
“যেমন…?”
“তিনমাস আগে হৃদয়কে তুই তোর সামনে না আসতে বারণ করেছিস।ছেলেটি তোর সামনে আর কখনো উপস্থিত হয়নি।অথচ দিনরাত্রি আমার মাধ্যমে তোর খবর নিচ্ছে।তুই কেমন আছিস,কি করিস,খাওয়াদাওয়া করছিস কিনা,মন ভালো কিনা হ্যানত্যান কথাবার্তা!”
“কি তোমার সাথে ওই ছেলেটির যোগাযোগ হয়?”
“জ্বী।”
“যোগাযোগ কেন করো ওর সাথে?”
“আমি করি নি তো। ও নিজেই করে।”
“তাই বলে তোমার কথা বলতে হবে?”
“একদৃষ্টিতে ধরলে তোর আঙ্কেলের রিলেটিভ।কথা না বললে খারাপ দেখায়।তাই বলি।”
“কিন্তু সে ত রিলেটিভ সম্পর্কে কথা বলছে না তোমার সাথে।কথা তো বলছে আমার সম্পর্কে। ”
“হ্যাঁ বলবে তো।তুই তো সাফ বারণ করে দিয়েছিস কথা না বলতে।সামনে না আসতে।এমনকি ফেসবুক,হোয়াটসঅ্যাপ, ফোন নাম্বার থেকেও ব্লক করেছিস।তাই আমার সাথে না বললে তোর খোঁজখবর কিভাবে নেবে?”
“ও কেন করে এসব?”
“কারণ ও তোকে ভালোবাসে,পারিসা।খুব ভালোবাসে।আমাকে এটাও বলেছে।তুই যেদিন বিয়ে করতে সম্মতি হবি সেদিন ও ওর মা-বাবাকে নিয়ে হাজির হবে তোর সামনে।”
“হাউ ফানি আন্টি!একটা ডিভোর্সি মেয়েকে কেউ এতসহজে ভালোবাসতে পারে?তোমার কি মনে হয় না তার এই ভালোবাসাটা হয়তো সুবিধা নেওয়ার জন্যেও হতে পারে!”
“সবাই তো আর এক না, পারিসা।সবাইকে অভির মতন কেন ভাবছিস?সবাইকে অভির মতন ভাবলে লাইফ চলবে?”
“হৃদয়ও যে ভালো তা কি তুমি সিউর দিয়ে বলতে পারবে?অভি কে তো বাবা ছোট্টোবেলা থেকে নাকি দেখে এসেছে।কতটা ভালো ছিল,সৎ ছিল।আর সে কি করলো…?পৃথিবীতে মানুষকে বিশ্বাস করা খুবই কঠিন।বর্তমান যুগ এমন এসেছে।ভালোদেরওকে খুঁজে বের করা কষ্ট হয়ে যায়।”
“আমি তোর সাথে একমত পারিসা।তবে ভালোদেরও খুঁজে বের করা সহজ হয়।তুই এখন ম্যাচিউরড। মানুষদের মনের কথা পড়তে বেগ পেতে হবে না আশা করি।”
“তা এখন তুমি চাচ্ছ হৃদয়ের প্রস্তাব মেনে নিতে?”
“নাহ।আমি চাচ্ছি সে যেহেতু এতটা পাগল তোর জন্যে।ওকে সময় দে।তুইও সময় নে।ওর সাথে ক’দিন চলাফেরা কর।কথা বল।ওকে বুঝ।সবকিছু যদি ওর উপর্যুক্ত মনে হয় তারপর নাহয় ডিসিশন নিস।কাউকে ভালোভাবে জানতে,বুঝতে তারসাথে অন্তত কিছুদিন চলতে হবে।এক দেখায়,এক কথায় মানুষকে কি বুঝতে পারবি?বা বিশ্বাস করতে পারবি??একদমই না।”
“তা জানি।”
“তাই ওর সাথে ক’দিন হাঁটাচলা কর।করলেই বুঝবি
অভি এবং ওর মাঝের পার্থক্য ।যদি দেখিস,নাহ ও অভি থেকেও ওতটা সুইটেবল না।তাহলে বাদ।আর ভালো মনে হলো তখন নাহয় একটা ডিসিশন নিবি।এভাবে কোনোকিছু হুটহাট রিজেক্ট করিস না মা।কারণ এভাবে লাইফ চলে না।মানছি ক্যারিয়ার ভালো তোর।নিজে চলার মতন ক্যাপাবিলিটি আছে।কিন্তু একাকীত্ব লাইফ কদিন?দেখলি ই তো অভি ডিভোর্সের সাতদিনের মাথায় আরেকটা মেয়েকে ঘরে নিয়ে এলো।সে যদি সব ভুলে সব শেষ করে আবার নতুন করে সংসার পাততে পারে তাহলে তুই কেন পারবি না?লাইফ কারো জন্যে থেমে থাকে না কেন বুঝিস না।”
“জানি,খালামণি জানি।আসলে আমি এরকম ভাবছি না।আমার ভাবছি হৃদয় আনম্যারিড এবং আমি ডিভোর্সি।একজন ডিভোর্সিকে কারো ভালোলাগতে পারে!”
“ভালোলাগাটা দেখে,বুঝে,শুনে হয় নারে মা।হুটহাট যে কারো প্রতি কারো ভালো লাগা কাজ করে যায়।আর এই অদ্ভুত ভালোলাগাটার কাছেই পৃথিবীর সব তুচ্ছ হয়ে যায়। হয় সেটা ভালো বা মন্দ!”
এক মিনিটের মতন চুপ করে থাকলাম।তারপর বললাম,
“হৃদয় কী করে এখন খালামণি?আইমিন চাকরি নাকি বেকার?”
“বেকার কেন থাকবে?আরেহ ” শাহীন মডেল কলেজ”-এর নাম শুনেছিস না?”
“হ্যাঁ।”
“ও ওখানের কেমিস্ট্রি টিচার!”
“ওর বাসায় কে কে আছেন?”
“ওর বাবা,মা এবং একটা ছোট্টবোন।তবে সে হালকা মানসিক ভারসাম্যহীন!আর ভাবিস না সে তোকে পাগল বানিয়ে ছাড়বে!মেয়েটা যে কারো সাথে ভালো-মন্দ না বুঝে যখন তখন মিশে যায় এটাই ওর মানসিক সমস্যা!”
“ওর ফ্যামিলি মানবে আমাকে?আইমিন ওর মা-বাবা?”
“সেটা নাকি ও কনভেন্স করবে!”
“ওর মা-বাবা আমাকে মানবে না,দ্যাখো তুমি!আর ও আমার ডিভোর্স হওয়ার ব্যাপারটা জানে?”
“সব জানে পারিসা।সব!আমি ওকে সব বলেছি!”
চুপ থাকলাম।আসলে আমি আশ্বস্ত না।কিছুতেই আশ্বস্ততা না।খালামণি আবারো বলে উঠেন,
“তুই যদি ভরসা দিস তাহলে ও তোর সাথে কথা বলবে অন্য নাম্বার দিয়ে। ”
“তোমাকে বলেছে এ’কথা?”
“হ্যাঁ।”
“জানিস?আরেকটা কথা?ও তোর সম্মতির অপেক্ষায় থাকবে।আইমিন ওকে বিয়ে করার সম্মতি না।তুই যেদিন যে কাউকে বিয়ে করতে সম্মতি হবি।সেদিন ও আবারো ঠিকঠিক তোর সামনে হাজির হবে।”
“আজব সব..!”
“আজব কেন?”
এমন সময় বাসার কলিংবেল বেজে উঠে।খালামণি উঠতে উঠতে বলেন,
“বস। দেখি কে এসেছে।”
বলে খালামণি দরজার দিকে এগিয়ে যান।দরজা খুলেন।খুলতেই দেখি আমার বাবা দাঁড়িয়ে।সাথে মাও আছেন।আমি হতবাক বাবাকে দেখে।বসা থেকে দাঁড়িয়ে যাই!
#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-২৪
খালামণি কিছুটা অবাক হলেও পরক্ষণে হেসে উঠে বলেন,
“ভাই-আপা…? ”
“আসলাম সবাইকে দেখতে..!”(মা)
বলে মা চাপা হাসলেন।খালামণি বলেন,
” ভেতরে আসুন,ভেতরে আসুন?”
বাবা এবং মা ভেতরে ঢুকলেন।সোফার দিকে এগিয়ে আসতে বাবার আমার দিকে নজর গেলো।সরু চোখে তাকালেন ।কিছুটা ইতস্ততর চোখে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলেন,
“কেমন আছিস,পারিসা?”
আমি বাবার দিকে সরাসরি তাকালাম না।অন্যদিকে দৃষ্টি রেখে বললাম,
“ভালো।”
বলে রুমে ফিরতে ব্যস্ত হয়ে যাই।আসলে ব্যস্ত না একদম।বাবার সাথে কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছে না তাই।রুমের দিকে পা ফেলতে বাবা পেছন থেকে বলে উঠেন,
“রুমে পরে যাস।তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
দাঁড়িয়ে গেলাম।ঘাড় ঘুরে আর উনার দিকে তাকালাম না!বাবা পেছন থেকে আমার সামনে এসে দাড়ালাম।মাথা টা কেমন নতজানু করেন।ব্যথিত গলায় বলেন,
“গত দেড় মাস ধরে তোর সাথে দেখা করতে বারবার চেয়েছি।কিন্তু নিজের উপর নিজের ঘৃণা হয় বলে তোর সাথে দেখা করার সাহসটুকু পাইনি।তোর মাকে জিজ্ঞেস কর।”
বলে বাবা একটু থামেন।তারপর আবার বলতে থাকেন,
“দেড় মাস হলো অভিকে এবং অভির বউকে দেখেছি।একটা অনুষ্ঠানে গেলাম।সেখানে অভিও এবং অভির বউও আমন্ত্রিত ছিল।তুই ই ঠিক ছিলি।ওই ছেলেটা আসলেই খুব খারাপ ছিল।আমি ওকে অন্ধের মতন বিশ্বাস করেছি। ভুল করেছি আমি।আমার উপর মা রাগ রাখিস না।বাবা বুঝতে পারি নি।”
কি আর জবাব দিব!জবাব দিতে গেলে আবার সেই পুরনো কথা টানতে হবে।পুরনো কথা আর মনে করতে চাচ্ছি না।চুপ করে রইলাম। জবাব দিলাম না।বাবা আরো ব্যথাতুর কথা বলতে থাকলেন তারপরও আমার মুখ থেকে একটু শব্দ বেরুলো না।বাবা বুঝলেন আমি বাবার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক না।বাবা আরো হতাশ হয়ে গেলেন,
“বাবা ভুল করেছি তার শাস্তি দিচ্ছিস, না মা?”
এত আবেগ জড়ানো মায়া জড়ানো কথা তখন বাবা কোথায় গেল আপনার?যখন চারপাশ থেকে আমি অসহায় তখন কেউতো আমাকে একটু মায়া-মমতা মাখানো কথা শুনায় নি।ভরসার হাত বুলায় নি।অথচ তখন কিনা এই টুকু কথাই আমার ভরসার হাত ছিল!কেউ আমার পাশে ছিল না।সবাই নিষ্ঠুর আর বেইমান ছিল!!সরাসরি তো আর বলতে পারি নি।নিরবে কথাগুলো গেঁথেছি!বাবা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।আমি আর দাঁড়ানোর প্রয়োজন বোধ করছি না।বাবাকে পাশ কেঁটে রুমে চলে এলাম।বিছানায় বসতে চোখজোড়া পানিতে জলে ভরে গেল।
কিছুক্ষণ এভাবে বসা থাকার মাঝে মা আসেন রুমে।এসে পাশে বসেন।বলেন,
“জানি তোর বাবার উপর খুব রাগ।আমারও তোর বাবার উপর রাগ!তারপরও নিজের ভুল যেহেতু বুঝতে পেরেছে মাফ করে দে বাবাকে।বাবা মানুষ।বাবাদের সাথে এভাবে রাগ করে থাকলে আল্লাহ কষ্ট পাবেন!”
“আর বাবা হয়ে মেয়েকে যে কষ্ট দিয়েছে সেটা কি আল্লাহ মাফ করে দেবেন!”
মা এবার আর কথা বলেন নি।আমিও আর চুপ থাকি নি,
” তুমি বাবাকে বলে দিও আমার কাছে এভাবে আর যেন না আসে।আমি এরকম দিন কোনোদিনই চাইনি কোনো বাবা তার মেয়ের কাছে এসে এভাবে মাফ চাইবে।আমার কপাল খারাপ যে বাবা এবং মেয়ের মাঝে এতটা ফাটল,এতটা রাগ,দুঃখ,কষ্ট।মা রুম থেকে যাও।একা থাকতে চাই আমি”
মা গেলেন না।চুপ করে ঠায় বসে থাকলেন।কিছুক্ষণ এভাবে কেঁটে যেতে এবার শব্দ তুললেন,
“তোর বাবা এসেছেন তার ভুল,তোর রাগগুলো ভাঙ্গিয়ে তোকে বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।এখানেই থাকবি?বাসায় ফিরবি না, মা?”
“আর কথা বলতে ভাল্লাগতাছে না!একটু একা থাকবল প্লিজ!”
মা এবার আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন।তারপর আর কিছু বললেন না।উঠে আলতো হেঁটে বাইরে বেরিয়ে গেলেন।
৩৫.
দুপুরের শেষ প্রহরে মা-বাবা দুজনেই ফ্যাকাশাভ মুখে বাসায় ফিরে যান।খালামণিদের বাসায় এসেছেন মূলত আমাকে বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। আমি যাই নি!যাবোই বা কেন,বলুন?যখন থাকতে চেয়েছি, তখনতো থাকতে দেয়নি।এতিম বাচ্চাদের মতন ছেড়ে দিয়েছে।এখন তাহলে কেন ফিরে যাবো?ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না!অসময়ে খালামণির কাছে ঠাই পেয়েছি এখানেই থাকবো।এখানেই!আবারো জল গড়িয়ে পড়লো!
৩৬.
রাতে খাবার শেষ করে রুমে আসি।বিছানার উপর বসে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকি।ভাবতেছি খালামণির কথা!খালামণি ভুল বলেননি।হৃদয়কে আসলেই একবার সুযোগ দেওয়া উচিত।পৃথিবীর সব তো আর অভির মতন না।তাছাড়া হৃদয়ের সাথে ক’দিন চলাফেরা করলে বুঝতে পারবো ওকে।তারপর আরো অনেককিছু ভাবলাম।ভেবেটেবে টপ করে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকল ফোনটা হাতে নিই।।ব্লক লিস্টে ঢুকি।সবার প্রথমে হৃদয়ের আইডিটা সামনে পড়লো।ব্লক থেকে হৃদয়লে আনব্লক করি।মন যদিও একটু একটু ইতস্ততা বোধ করলো তারপরও মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে এমন দুঃসাহসিক কাজটা করে ফেলি।পরক্ষণে আবার আরেকটা দুঃসাহসিক কাজও করে ফেলি।হৃদয়কে মেসেজ পাঠাই।লিখি,
“লাইনে থাকলে একটু রেসপন্স করবেন।”
পাঠিয়ে ফোনটা একদম বসা থেকে দুইহাত দূরে ছুঁড়ে মারি।ভেতরটা কেনজানি উসখুস লাগছে।কাজটা ঠিক করলাম মেসেজটা করে?আবার “বেহায়া’ভেবে বসবে নাতো?যদি সত্যিই বেহায়া বলে?উহহ…!!!এগিয়ে টপ করে ফোনটা আবার হাতে নিলাম।মেসেজটা ডিলিট করে দিব ।তারপর আবারো ব্লকে পাঠাবো!ভাবনার সুতো ছিঁরে মেসেন্জারের “টুন করা” শব্দে।স্ক্রিনে তাকিয়ে একটা বান্ধবীর মেসেজ।লেখা,
“দোস, তোকে কল দিচ্ছিরে।তোর সাথে আমার আর্জেন্ট কথা আছে।”
সিন করা মাত্রই ওপাশ থেকে বান্ধবীর কল ছুটে এলো।রিসিভ করলাম।রিসিভ করতেই ভে ভে করে কেঁদে উঠলো।
“কাঁদছিস কেন?বাচ্চা হইবো নাকি?”
“আশা তো ছিল বাচ্চা হইবো।একটা সংসার হইবো।আর ওই বাদাইম্মার বাচ্চা বাদাইম্মা আমার সব স্বপ্ন মাটির সাথে পিষিয়ে দিয়ে চলে গেলো।”
বলে আবারো ভে ভে করে কেঁদে উঠলো।
“আরেহ কান্না থামা!শান্ত হ।আমারে ভালো করে বুঝিয়ে ক কি হইছে?”
বান্ধবী এবার কান্না থামায়।ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলে,
“শাওন আমার লগে ব্রেকাপ করছে।আমার লগে আর প্রেম করবো না।”
“কেন?”
“আমি নাকি মুটকি! ”
“তোরে আমি ভার্সিটিতে থাকতে বারণ করেছি ওই রকম রাস্তার পোলাপানগো লগে পিরীত করতি না।এবার লও ঠেলা!যাক যা হবার হয়ে গেছে।গেছে গা ভালো হইছক।ও তোকে মন থেকে ভালোবাসে নি।বেসেছে শরীরকে।যার মনের ভালোবাসা নেই সে মানুষ না।রোবট!ভুলে যা ওই রোবটকে।সেই সুবাধে এবার একটা ব্রেকাপ পার্টি কর!আমরা সবাই আসবো।”
“মজা করতেছিস আমার লগে?”
“মজা কেন করবো?সত্যি কইতেছি!”
এমন সময় ফোনে আবার “টুন করে” শব্দ হয়।কান থেকে ফোনটা নামিয়ে হৃদয়ের মেসেজ!হৃদয় মেসেজ করেছে।ইয়া আল্লাহ মেসেজটা সে দেখে ফেলেছে!আমার খবরও নাই ডিলিট করতে!রাগ বেড়ে গেলো বান্ধনীর উপর!
“ওই মুটকি,তোর জন্যে আমার আত্মসম্মানের তেরোটা বাজলো!কল ক্যান দিলি!উফস!”
“তুইও শেষপর্যন্ত মুটকি কইলি!দেখিস এক সপ্তাহের ভেতর স্লিম ফিগার বানামু।আর তোদের গ্লেমার করমু!”
আমি আর ওর কথা কানে নিলাম না।ফোনটা তরতর করে কেঁটে দিলাম।ঢুকলাম হৃদয়ের মেসেজে।লেখা,
“দুঃখিত,সেই কখন মেসেজ করলেন রেসপন্স করতে পারিনি।আসলে আমি ফোনের কাছে ছিলাম না।স্টুডেন্টদের এক্সাম খাতা দেখেছিলাম।”
আমি মেসেজটির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ঠাই বসে থাকলাম!ছেলেটির এরমাঝে আরেকটা মেসেজ এলো,
“কিছু বলবেন?”
এবার সাথে সাথে উত্তর করি,
“জ্বী।”
“জ্বী বলেন?”
“আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই।দেখা করতে পারবেন আমার সাথে?”
সাথে সাথে উত্তর এলো না।তার দুই মিনিট বাদে উত্তর এলো,
“হঠাৎ দেখা?কোনো রিজন আছে?”
“থাকতে তো পারে।মেসেজ তো তাহলে দেওয়ার কথা না,তাই না?”
“কোথায় দেখা করতে চান?”
“আগের সেই রেস্টুরেন্টেই!”
“রেস্টুরেন্টে দেখা করছি না।”
“কেন?”
“আপনি সেদিন কিছু না খেয়ে উঠে গেলেন।আপনাকে খামোখা রেস্টুরেন্টে নিয়ে লাভ নাই। তারচে বাইরে রোদ দেখা করবো এটাই ভালো।”
ছেলেটির এই মেসেজটা দেখে খুব হাসি চলে এলো।লিখলাম,
“আচ্ছা ঠিক আছে।কাল খেতেও পারি।সো রেস্টুরেন্টই।”
হাসির ইমোজি এলো।
৩৭.
রেস্টুরেন্টে আসা মাত্রই দেখি হৃদয় আগেভাগে হাজির।ওকে দেখে আমার কেনজানি কিছুটা লজ্জা লজ্জা লাগছিল।নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম।জোরপূর্বক হাসলাম।বসলাম।সে ওমনি বলে উঠলেন,
“কি খাবেন?ওয়েটার?ওয়েটার?”
ওয়েটার সাথে সাথে হাজির।আমি হা হয়ে তাকিয়ে রইলাম।ওয়েটার খাবারের ম্যানু শিটটা নিচে রাখলো,
“ম্যাম খাবার সাজেস্ট করুন।”
বসে থাকলাম ওভাবে ই।ওয়েটার তাড়া দিতে থাকলো,
“ম্যাম,তাড়াতাড়ি করুন, কাইন্ডলি।”
অগত্যা খাবার সাজেস্ট করলাম।ওয়েটার চলে গেলো।আর ওপাশে বসা ব্যক্তি নিচের দিকে তাকিয়ে মুচমুচে হাসছে!কী চালাক!সে হাসি থামিয়ে এবার আমার দিকে ফিরলো,
“সরি!তাগাদা না দিলে সেদিনকার মতন আপনি হয়তো আজও আমাকে বোকা বানিয়ে না খেয়ে চলে যেতেন।সো অগত্যা তাগাদা না করে পারলাম না।রাগ করেছেন!?”
“রাগ করিনি!অবাক হয়েছি।খালামণি এবং আপনার ফ্রেন্ড রাকীব স্যারের থেকে শুনলাম আপনি খুব ভদ্র ধাচের আমার চোখে আপনি তা মোটেও নন।আপনি একটা দুষ্টুর হাড্ডি!”
সে ফিক করে হেসে দিলো।বললো,
“দুঃখিত, আর দুষ্টমি করবো না।খাওয়ার জন্যে এই দুষ্টমিটা করতে বাধ্য হয়েছি।”
তারপর খাওয়াদাওয়া শেষ হলে হৃদয়কে কিছু বলতে নিজেকে যথেষ্ট প্রস্তুত করি।ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলি,
শুনলাম আপনার সাথে আমার খালামণির ফোনে যোগাযোগ হয়?”
“হ্যাঁ।”
“যোগাযোগ কেন করেন?”
হৃদয় ফোনটা সামনে থেকে নিচে নামিয়ে ফের আমার দিকে ফিরে।বলে,
“যোগাযোগ না রাখলে আমি কীভাবে জানবো উনি বিয়েতে মত হয়েছে।”
“আচ্ছা,এটা কি আপনার পাগলামি মনে হয়না?”
“কেনো পাগলামি মনে হবে?কাউকে যদি কখনো মন থেকে ভালোবেসে থাকেন তাহলে পাগলামীর কারণটা ঠিকই বুঝবেন।”
“কখনো কাউকে পছন্দ করিনি।এবং ভালোও বাসি নি।আর স্বামীকে বাসতে চেয়েছি তা কপালে সহায় হয়নি।”
“কপাল না।কপাল বলে কোনো কথা নেই।যাকে চেয়েছেন সে হয়তো চায়নি।এই যেমন আমি আপনাকে চাচ্ছি আপনি রাজি হচ্ছেন না এরকম!মানুষের মন ভীষণ অদ্ভুত,পারিসা!মন কখন কি চায় বলা যায় না।”
“আপনি এসব বলে কি আমার মন গলানোর চেষ্টা করতেছেন?”
“চেষ্টা করলে আপনাকে অনেকভাবেই পটাতে পারতাম।ওরকম আমি নই।আজ আপনি বলাতে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি।নাহলে কখনোই আপনার সামনে উপস্থিত হতাম না।”
চুপ করে থাকলাম।এই ছেলেটার সাথে কথার ফাঁদে বারবার যেন আমি কথা বলার খেই হারিয়ে ফেলতেছি। খানিক্ষন চুপ করে থাকলাম।তারপর আবারো ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে বললাম,
“আপনার মা-বাবা মানবে না।”
“মা-বাবা বাসা থেকে প্রচন্ড বিয়ের চাপ দিচ্ছেন।এমনো বলেছেন কেউ পছন্দের থাকলে তার বাসার এড্রেস দিতে।তাকে দেখবেন।হতভাগা কপাল আমার। জীবনে যাকে প্রথম পছন্দ করলাম সে আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে।মা-বাবাকে বলতেও পারছি না পছন্দের কেউ আছে।”
“মা-বাবা যদি শুনে আপনার পছন্দের সে ডিভোর্সি!?”
সরাসরি প্রশ্ন।হৃদয় সরু চোখে আমার দিকে তাকালো।মৃদু হাসলো।বললো,
“পৃথিবীতে একজন ভালো মনের মানুষ পাওয়া খুবই কঠিন,পারিসা!কারণ তার মানসিকতার কাছে অন্যসব তুচ্ছ!”
নিচের দিকে তাকালাম।নাহ এই ছেলের সাথে আর একটা কথাও বলবো না!এ মন চুরি করতে চাইছে!এই পারিসা এত সহজে কাউকে মন দেবে না।পারিসা এখন ছোট্ট না।সে যথেষ্ট ম্যাচিউরড।আগে যে ভুল করেছে।সামনে তা করবে না।আবেগ দিয়ে চলবে না।বিবেক দিয়ে চলবে।প্রয়োজনে সময় দীর্ঘ হউক।এই ছেলেটাকে দূরত্বে রাখতে হবে।আরো দূরত্বে।
চলবে….