আলো_আঁধার পর্ব ২১

#আলো_আঁধার_২১
#জেরিন_আক্তার_নিপা

আলোর চিন্তার শেষ নেই। দীপ্ত যেহেতু তাকে খুঁজে বের করে ফেলেছে, এত সহজে দীপ্ত এখন তার পিছু ছাড়বে না। আলো কী করবে ভেবে পায় না। দীপ্তকে কীভাবে শাস্তি দিবে সে? দীপ্ত তার সাথে যা করেছে তার পরও ওকে ছেড়ে দেওয়া যায় না।

-“কিন্তু আমি এতটাই দুর্বল, ওকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।’

শুভ্র কয়েকদিন ধরে আলোর কাছে আসে না। মাঝে মাঝে শুভ্রর কথা মনে পড়ে আলোর৷ আলো ভাবে কল দিয়ে জানবে শুভ্র ঠিক আছে তো।
তারপর একবার ভাবে, অনেকদিন খালাম্মার সাথেও দেখা হয় না। একবার ওবাড়ি গিয়ে দেখে আসলে কেমন হয়?
পরের দিনই আলো শুভ্রদের বাড়িতে যায়। গিয়ে দেখে শুভ্র বেচারা জ্বরে ভুগতে। হুঁশ নেই তার। মেডিসিন দিয়েও জ্বর কমানো যাচ্ছে না। আমিনা ছেলের চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। আলোকে দেখে তিনি বললেন,

-“শুভ্রর তো ভীষণ জ্বর। কোনোভাবেই জ্বর কমছে না। এখন কী করি বলো তো আলো?’

আলোও ভেবে পেল না। শুভ্র নিজে ডাক্তার। কিন্তু ও বেচারার জ্ঞান নেই। সে নিজে ডাক্তারি বিদ্যার কিছুই জানে না। তবুও বলল,

-“আপনি চিন্তা করবেন না খালাম্মা। শুভ্র ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তার কী বলেছে?’

-“ডাক্তারও বলেছে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক হওয়ার তো কোন লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। ছেলেটা কয়টা দিন ধরে কষ্ট পাচ্ছে। আমি কিছুই করতে পারছি না।”

আলো শুভ্রকে দেখার জন্য ওর ঘরে যায়। শুভ্রকে দেখে আলোরও খারাপ লাগে। বিছানার সাথে লেগে গেছে একেবারে। এত জ্বর ছিল অথচ আলো জানলোই না। শুভ্র সব সময় তার সব বিপদে পাশে ছিল। আজ সে-ই শুভ্রর খোঁজ নিতে ভুলে গেছে। আলো শুভ্রর পাশে গিয়ে বসল। কপালে হাত রেখে গায়ের তাপ পরীক্ষা করতে ইতস্তত করছে। শুভ্র শুধু তার বন্ধু হলে হয়তো এই ইতস্তত ভাব কাজ করত না। কিন্তু শুভ্র তাকে নিয়ে মনে মনে অনেক কিছুই ভেবে ফেলেছে। এটা জেনে আলো চেষ্টা করেও শুভ্রর সাথে সহজ হতে পারছে না।

-“কী সব ভাবছি আমি! ওর এখন হুঁশ আছে নাকি? অসুস্থ মানুষ টার কপালে হাত রাখতেও তোর কত ভাবনা আলো৷ তুই যখন অসুস্থ ছিলি তখন শুভ্র এসব ভেবেছে!’

আলো শুভ্রর কপালে হাত রাখল। ও বাবা! অনেক জ্বর। গা পুড়ে যাচ্ছে।

-“ডাক্তার কী ঔষধ দিয়ে গেছে হ্যাঁ! জ্বর কমছে না কেন? গা এত গরম কেন!’

আলো মনে হয় আজ প্রথম শুভ্রর দিকে ধ্যান ধরে দেখল। ঠোঁট শুকনো, চোখ বোজা। চুল গুলোও অগোছালো। এত কাছ থেকে এতটা খেয়াল করে আলো আগে কখনও শুভ্রকে দেখেনি। শুভ্র কম করে হলেও তার থেকে বছর পাঁচেকের তো বড় হবেই। কিন্তু আলোর কাছে শুভ্রকে তার থেকে ছোটই মনে হয়। বয়সের দিক থেকে না হোক জীবনের অভিজ্ঞতার দিক থেকে আলো শুভ্রর থেকে অনেক এগিয়ে। এই বয়সেই সে জীবনের আসল রূপ দেখে ফেলেছে। যা হয়তো শুভ্র আরও পাঁচ বছরে দেখবে না। আলোর বিয়েও হয়েছে। এক সন্তানের মা হয়েছিল সে। ডিভোর্স হয়েছে।

-“মানুষ যে কেন সব সময় ভুল মানুষের প্রেমে পড়ে! তুমি পুরো দুনিয়া জুড়ে ভালোবাসার জন্য আমাকেই পেলে! আমি তোমাকে কী দিতে পারব বলো? ভালোবাসাটাও তো পুরোপুরি দিতে পারব না। কোত্থেকে দেব বলো? আমার মনে যে আর ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই। যেটুকু ছিল তা কবেই ফুরিয়ে গেছে। তুমি খুব ভালো শুভ্র। তুমি এমন একটা মেয়েকে ডিজার্ভ করো, যে তার সবটা দিয়ে শুধু তোমাকেই ভালোবাসবে।’

শুভ্র ঘোরের মধ্যে থেকেও মনে হয় আলোর উপস্থিতি টের পেয়েছে। চোখ না খুলেও ক্ষীণ গলায় শুভ্র ডাকল,

-“আলো?’

আলো নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো। শুভ্রর ডাকে সাড়া দিয়ে বলল,

-“হ্যাঁ শুভ্র বলো। আমি এখানেই আছি।’

-“এসেছ তুমি?”

-“এলাম তো। তুমি নিজের কী অবস্থা করে রেখেছ বলো তো! রোগী হয়ে শুয়ে আছো। তোমাকে এভাবে দেখতে আমার একটুও ভালো লাগছে না। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো তো শুভ্র।”

আলোর কথা শুভ্র বুঝতে পারছে কিনা কে জানে। শুভ্র বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছে,

-“তুমি এমন কেন আলো। কঠিন, পাষাণ, নির্দয়।’

শুভ্র কী বলছে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে না আলো। তাই ওর কথা শোনার জন্য একটু ঝুঁকে শুভ্রর মুখের কাছে কান নিল। এখন কিছুটা বোঝা যাচ্ছে।

-“তুমি আমাকে কষ্ট দাও আলো। খুব কষ্ট দাও। আমার মন ভেঙে দাও তুমি। এত কষ্ট কেন দাও। তুমি এত কঠোর কেন? একটু কোমল হলে কী হয়? আমাদের বন্ধুত্বও রাখতে চাইছ না তুমি। আমি কি এতই খারাপ!’

আলো হেসে ফেলল। পাগল ছেলে জ্বরের ঘোরেও ভালোবাসার কথা বলে যাচ্ছে।

-“ভালোবাসার ভূত দেখা যাচ্ছে ভালো করেই মাথায় চেপেছে।’

-“কখনও কোন মেয়েকে আমি ভালোবাসিনি। তুমিই আমার জীবনে প্রথম মেয়ে যাকে আমি মন দিয়েছি। আর তুমি এরকম হৃদয়হীন প্রমাণ হলে। আমাকে ইচ্ছে করে কষ্ট দাও।’

আলো চুপ করে বসে শুভ্রর অস্পষ্ট, অসংলগ্ন কথাগুলো শুনে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে।
সেদিনের জ্বরের ঘোরে বলা কোন কথাই শুভ্রর মনে রইল না। কিন্তু সেই কথাগুলো অনেকদিন পর্যন্ত আলোর মনে রইল। ওকে ভাবাল। বলা যায় কথাগুলো গভীর ভাবে ওর মনে দাগ কেটে গিয়েছে।
শুভ্র কি সত্যিই তাকে ভালোবাসে? শুভ্র তাকে দয়া করছে না। সহানুভূতিও যে দেখাচ্ছে না তা তার সেদিনের কথাতেই বোঝা গেছে। শুভ্র তাহলে প্রকৃতপক্ষেই আলোকে ভালোবাসে।
আলো কয়েকটা দিন নিজেকে সময় দিল। শুভ্রকে নিয়ে আরও গভীর ভাবে ভাবল। কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারছে না সে। সবকিছু এলোমেলো লাগছে। নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। অনেক ভেবে আলো দ্বিতীয় বারের মত নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলল।
শুভ্র হাসপাতালে ছিল। প্রথম বার রিং হলে শুভ্র ফোন তুলতে পারল না। আলোর নাম্বার দেখে কল ব্যাক করল।

-“হ্যাঁ আলো বলো।’

-“মিস্টার শুভ্র! কল তুলতে দেরি হলো কেন? এখন থেকেই দাম দেখাতে শুরু করেছ নাকি?’

আলোর কন্ঠ আজ অন্যরকম শোনাচ্ছে। শুভ্র বলল,

-“না, না আলো। কী যে বলো। ব্যস্ত ছিলাম একটু।’

-“এখন থেকেই এত ব্যস্ততা! এখন তো আমার মনে হচ্ছে আমি তাহলে ভুল করে ফেললাম।’

-“কী বলছো আলো? কিসের ভুল? আমি না তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।”

আলো নিঃশব্দে হাসল। ভাবল, সে এখন যে কথা বলতে যাচ্ছে তা শুনে শুভ্রর ছোটখাটো স্ট্রোক হয়ে যেতে পারে। শুভ্রর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া চেহারা আলো ফোনের এপাশ থেকেই দেখতে পাচ্ছে যেন। গম্ভীর গলায় আলো বলল,

-“দেখো ডাক্তার সাহেব, যত কাজ, ব্যস্ততা দেখানোর এখনই দেখিয়ে নাও। বিয়ের পর তোমার এসব অজুহাত আমি একদম সহ্য করব না।’

-“বিয়ে!’

শুভ্রর মুখ থেকে কথাটা ছিটকে বেরিয়ে এলো। হতভম্ব হয়ে আলোর কথা বোঝার চেষ্টা করল শুভ্র।

-“কার বিয়ে আলো?”

-“তুমি এত বোকা কেন? তুমি না আমাকে ভালোবাসো। তা সারাজীবন এভাবে থাকার জন্যই ভালোবেসেছ? নাকি বিয়েটাও করবে? আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। এবার তুমি ভাবো কী করবে।”

শুভ্র কোন কথা বলতে পারল না। পাথর হয়ে ফোন হাতে বসে রইল। স্বপ্নে আছে সে? নাকি বাস্তবেই এসব ঘটছে! ফোনের ওপাশে কি আলোই আছে? নাকি অন্য কেউ। শুভ্রর বিশ্বাস হচ্ছে না। আলো নিজে থেকে তাকে বিয়ের কথা বলছে! এটাও সম্ভব? সে তো আশা ছেড়েই দিয়েছিল। আলোকে কখনও বিরক্ত করত না। নিজের ভালোবাসা নিজের মনেই রেখে দিত। আলো তাকে গ্রহণ করবে না কষ্ট হলেও মনকে এই কথা বোঝতে সক্ষম হয়েছিল।

আমিনা বিশ্বাস করতে পারছেন না। আলো সত্যিই তার ছেলের বউ হবে! মেয়েটার উপর প্রথম দিন থেকেই মায়া পড়ে গিয়েছিল। মনে মনে তিনিও চাইতেন আলোর মতো একটা মেয়ে যেন শুভ্রর বউ হয়। আলোর জীবনে অত কিছু না ঘটে গেলে হয়তো তিনি নিজেই আলোকে বিয়ের প্রস্তাব দিতেন।

-“আমি বিশ্বাস করতে পারছি না শুভ্র। আলো রাজি হয়েছে!’

-“হ্যাঁ মা। আমার নিজেরও বিশ্বাস হচ্ছে না। সবকিছু কেমন অবাস্তব লাগছে।’

আলো বিয়ের জন্য শুভ্রকে হ্যাঁ বলে দিলেও তার মন থেকে দ্বিধা দূর হচ্ছে না। শুভ্রকে কি সে ভালোবাসে? কেন বিয়ে করতে রাজি হলো? তার প্রতি শুভ্রর ভালোবাসা দেখে। শুভ্র তাকে ভালোবাসে এটা সত্যি। কিন্তু সে কি বাসে? আর ভালো না বাসলে বিয়ে করলে ওকে ঠকানো হবে না?
নিজের মনকে বুঝতে চায় আলো। শুভ্রর জন্য তার মনে অন্যরকম অনুভূতি জন্ম নিয়েছে। সেটাকে ভালোবাসার নাম দেওয়া যায় কিনা বলতে পারবে না।

সেদিনের পর দ্বিতীয় বার দীপ্ত এসে আলোর দরজায় হাজির হয়। দীপ্তকে দেখে আলো ভয় পায়। শুভ্রর কথা ভাবে। দীপ্ত যদি জানতে পারে সে বিয়ে করছে তাহলে কী করবে ও?

-“তোমাকে আমি এখানে আসতে মানা করেছিলাম। ভালোয় ভালোয় চলে যাও। নইলে কিন্তু খুব খারাপ হবে।”

-“এখনও তুমি রাগ করে আছো আলো? এবার রাগ ঝেড়ে ফেলে আমার সাথে চলো না। প্লিজ।”

-“তোমার সাথে যাব আমি! কোথায়? তুমি আমার সাথে কী করেছ এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে। তোমার জন্য আমার সন্তানকে হারিয়েছি আমি।”

-“যাক আপদ তাহলে গেছে।”

নিজের মৃত সন্তান সম্পর্কে এরকম একটা বাক্য শুনে আলো রাগে থরথর করে কাঁপতে লাগল। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে দীপ্তর কলার চেপে ধরল।

-“তোকে আমি খুন করে ফেলব। আমাকে কেন শান্তিতে বাঁচতে দিচ্ছিস না তুই।”

-“তোমাকে সুখে শান্তিতে রাখার জন্যই তো এতসব করেছি। আমার ভালোবাসা না বুঝে, তুমি উল্টো পালিয়ে এলে। এখনও আমাকে ভুল বুঝছো।”

আলো কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। কোনো অপমান, কোনো কথাই তো এই অমানুষের গায়ে লাগে না।
এর হাত থেকে কীভাবে মুক্তি পাবে আলো?

চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here