#আলো_আঁধার [৯]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
মুখের উপর পানি ঢেলে দিয়ে জ্ঞান ফেরানো হলো নাসিরের। জ্ঞান ফিরে শরীরে ব্যথা অনুভব করে সে। চোখ মেলে কোথায় আছে বুঝতে না পেরে উঠে বসতে চাইল। বাধা পেয়ে বুঝতে পারল তার হাত পা বাঁধা। কোথায় আছে সে? কে বা কারা ওকে নিয়ে এসেছে? মনে করার চেষ্টা করল সে। অফিস থেকে ফিরে গলিটা পেরুচ্ছিল। হঠাৎ পেছন থেকে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খায়। ছিটকে গিয়ে দূরে পড়ে চোখে অন্ধকার দেখে। চোখ খুলেও এখন আবিষ্কার করতে পারছে না সে কোথায়। ব্যথায় কাতর গলায় সে ডাকছে,
-” কেউ আছেন? আমি কোথায় আছি? কারা আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে? শুনছেন, কেউ আছেন কি?”
দীর্ঘ একটা ছায়া দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। ছায়াটা নাসিরের উপরে এসে পড়েছে। অন্ধকারের জন্য মানুষটার মুখ দেখতে পাচ্ছে না সে।
-” কে? এইযে ভাই শুনছেন? আমাকে কি হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে?”
-“হাসপাতালে যাওয়ার সময় এখনো আসেনি তোর। সময় হলে ঠিকই তোকে হাসপাতালে পাঠানো হবে।”
নাসির এখনো কিছুই বুঝতে পারছে না। সে নিজের জগতে বাস করে। তার যেমন বন্ধুবান্ধব নেই। তেমন শত্রুও নেই। তাকে কেউ কিডন্যাপ করবে এই কথা এখনো মাথায় আসছে না।
-“দেখুন ভাই, রাস্তায় আমার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। জ্ঞান হারিয়েছিলাম আমি। ডান হাতটা মনে হয় ভেঙে গেছে। নাড়াতে পারছি না, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমাকে কি একটু হাসপাতালে নিয়ে যাবেন?”
হাসছে লোকটা। তাচ্ছিল্যের সুরে বলছে,
-“ওই একটা হাতই তো ভেঙেছে। এখনো শরীরের বাকি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুলো বাকি আছে। আগে এক এক করে তোর শরীরের সব কয়টা হাড় ভাঙা হবে। তারপর তোকে হসপিটালে পাঠানো হবে।”
নাসির এবার কিছুটা ভয় পেল। সে লোকটার মুখ দেখতে না পারলেও লোকটার গলা শুনে মনে হচ্ছে না সে তার সাথে মজা করছে। লোকটার গলায় এমন কিছু আছে যে, তার কথাগুলো বিশ্বাস হচ্ছে। এবং ভয়ে গা শিউরে উঠছে। ভয়ার্ত গলা সে জিজ্ঞেস করল,
-“আমি আপনাদের কী ক্ষতি করেছি ভাই? আমার সাথে কেন এমন করছেন? আমার তো কোন শত্রু নেই। আমি কারো আগেও নেই, পিছেও নেই। জেনে-বুঝে কখনও কারো কোন ক্ষতি করিনি আমি।”
-“করেছিস। আমার সবথেকে বড় ক্ষতি তুই-ই করেছিস। এই পৃথিবীতে আমার যদি কোন শত্রু থেকে থাকে, তাহলে সেটা তুই। জেনে-বুঝে না করিস, নিজের অজান্তে তুই আমার যে ক্ষতি করেছিস তা কখনও পূরণ হবে না। আমি চাইলেও সব ভুলিয়ে দিয়ে তোকে মাফ করতে পারব না।”
নাসিরের কন্ঠে মিনতি ফুটে উঠল।
-” আমাকে যেতে দিন ভাই।”
-“না। অত সহজে তো তোকে যেতে দেওয়া হবে না। তোর সাথে আমার এখনো অনেক হিসাব বাকি। বেল্ট দিয়ে খুব ভালো মারতে পারিস তুই। তাহলে নিশ্চয় মার খেতেও পারিস। দেখি আজ তুই কতটা মার হজম করতে পারিস।
ওই কই রে তোরা? এদিকে আয়। কাজ শুরু কর। শালার গা থেকে সব কাপড় খুলে নিয়ে ওকে উল্টো লটকা।”
নাসির ভয়ে কেঁদে ফেলল। চিৎকার করে উঠল,
-“আমার সাথে কেন এরকম করছেন? আমার অপরাধটা কী? আমি কার কী ক্ষতি করেছি। আমাকে যেতে দিন। ছেড়ে দিন আমাকে।”
দীপ্তর সাঙ্গপাঙ্গ এসে নাসিরের কাপড় খুলতে লাগল।
-” শালার বেল্টটা আমার হাতে দে। প্যান্ট খুলে উল্টো ঝুলিয়ে দে। মজা তো এবার হবে।”
জোড়াজুড়ি করেও নাসির একা চার পাঁচটা লোকের সাথে পেরে উঠল না। ডান হাতে আগে থেকেই ব্যথা। পা উপরের দিকে মাথা নিচে ঝুলিয়ে দিলে চোখে ঝাপসা দেখতে লাগল। মাথা ঘুরছে। নাসির বুঝতে পারছে দশ মিনিট এভাবে থাকলেই নাক দিয়ে রক্ত আসবে তার। লোকগুলো কে? কেন তার সাথে এমন করছে এই প্রশ্নের উত্তর এখনো পেল না সে। দীপ্ত জুতার শব্দ করে এগিয়ে এলো। নাসিরের সামনে এসে দাঁড়াল। বাম হাতে ওর মুখ টিপে ধরে বলল,
-” কি, মজা লাগছে? এখনো না লাগলে একটু পর থেকে লাগতে শুরু করবে।”
-” আমাকেও ছেড়ে দিন। যেতে দিন প্লিজ।”
তিক্ত হাসল সে।
-“এনজয় ব্রো।”
শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে হাতে থাকা বেল্টটা দিয়ে একের পর এক নাসিরের গায়ে আঘাত করতে লাগল দীপ্ত। প্রতিটা আঘাত গায়ে পড়ার সাথে সাথে নাসির আকাশ ফাটানো চিৎকার করছে। নাসিরের কাকুতিমিনতি শুনে দীপ্ত পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে। আরো বল প্রয়োগ করছে সে। নাসির আরও জোরে চিৎকার করছে। একসময় দীপ্ত ক্লান্ত হয়ে থেমে গেল। নাসির অনেক আগেই বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। এখন আর সে আঘাতের প্রতিত্তোরে চিৎকার করছে না। মার ওর শরীরে লাগলেও কোন অনুভূতি অনুভব করছে না। চোখ বন্ধ করে সামান্য গোঙাচ্ছে সে। জ্ঞান হারায়নি এখনো। দীপ্তকে একজন একটা চেয়ার এনে দিল। দীপ্ত সেটাই বসে ঘনঘন দম নিতে লাগল।
-“শালাকে তিন দিনের আগে ছাড়বি না। মার খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললে আবার জ্ঞান ফেরাবি৷ এক ডোজ দিয়ে হজম করতে সময় দিবি। বোধশক্তি ফিরে এলে আবার চালু করবি। এর মাঝে মরে গেলে তো গেলই। লাশটা বস্তায় ভরে বড় বড় কয়েকটা পাথরের সাথে বেধে নদীতে ফেলে দিয়ে আসবি। লাশ না পেলে কোন ক্যাচাল হবে না। লাশ পেলেই বরং পুলিশ মাথা ঘামাবে।”
-“জি বস।”
-” আমি এখন যাচ্ছি। বাকিটা তোরা সামলে নিস। আর সমস্যা হলে আমাকে কল দিস। আমি তো আছিই। ”
-” আপনি কোন টেনশন নিবেন না বস। আমরাই সামাল দিতে পারমু।”
-“গুড। আমি আবার কাল আসব।”
________________________________
আলো এই বাড়িতে আসার পর দীপ্তর চাচী ছাড়া আর একটা মানুষের সাথেও তার কথা হয়নি। কথা তো দূর দেখাই হয়নি বলা যায়৷ তার খাবার তিনবেলাই দীপ্ত ঘরে দিয়ে আসে। তাকেও বাইরে বের হতে হয় না৷ এই বাড়ির মানুষ গুলো কেমন সে বুঝতে পারে না। একটা মেয়ে এসে তাদের বাড়িতে থাকছে এ নিয়ে কারো একটু মাথা ব্যথা নেই! কেউ তাকে জিজ্ঞেস করল না, কেন এসেছ তুমি? কোথায় থেকে এসেছ? তুমি দীপ্তর কে কও? ওর সাথে তোমার কিরকম সম্পর্ক। কিছুই না। সামান্য কৌতূহলও এই বাড়ির লোকদের নেই মনে হয়। এক বাড়িতে থেকেও ওরা নিজেরা আলাদা আলাদা জীবন যাপন করে। কাউকে নিয়ে কারো আগ্রহ নেই। কে কি করলো তা দেখার সময় যেন কারো কাছেই নেই। আশ্চর্য বাড়ি!
হাঁটতে হাঁটতে আলো একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। দরজাটা একটু ফাঁক করা। ভেতর থেকে কারো কথা শুনতে পেল কি? না হয়তো মনে ভুল।
-” উঁহু, মনের ভুল হলে এরকম স্পষ্ট শোনা যেত নাকি? কেউ সত্যিই কথা বলছে। এটা কার ঘর? কে থাকে এই ঘরে?”
আলো ভাবছে ভেতরে গিয়ে সে দেখবে কি? না না। এটা অভদ্রতা। হুট করে কারো শোবার ঘরে ঢুকে পড়া যায় নাকি? ভেতরে স্বামী স্ত্রী একা থাকতে পারে। তার যাওয়া উচিত হবে না। তবুও আলো কেনই যেন চলে আসতে পারল না। দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল।
-” কে আছে ভেতরে? একটা মহিলার কণ্ঠ বোঝা যাচ্ছে। কার সাথে কথা বলছেন উনি?”
আলো আস্তে করে দরজা ঠেলে ভেতরে উঁকি দিল। মধ্যবয়স্ক একজন মহিলা। কারো সাথে কথা বলছে। হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন তিনি। দরজার শব্দ শুনে আলোর দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলেন। আলো অমায়িক হেসে বলল,
-“ভেতরে আসব?”
মহিলা উত্তর দিলেন না৷ একইভাবে আলোকে দেখছেন। আলো ভেতরে গেল। মহিলাকে দেখে মনে হচ্ছে না আলোর উপর রাগারাগি করবে। পুরো ঘরটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিল আলো। কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছে না সে। ঘরে উনি ছাড়া আর কেউ নেই। তাহলে কার সাথে কথা বলছিলেন উনি? একা একা?
-” কার সাথে কথা বলছিলেন আপনি? ”
মহিলা এবারও কিছু বলল না। আলো উনার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কিছু ভেবে একটু দুরত্ব রেখে বসল।
-” আপনি কারো সাথে কথা বলছিলেন। আমি দরজার বাইরে থেকে শুনেছি। কিন্তু ঘরে তো কেউ নেই।”
মহিলা হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেলল। হাসিটা কত স্নিগ্ধ! সরল মুখে কোমল হাসি। উনার হাসির কারণ আলো ধরতে পারল না। সে-ও মৃদু হাসল।
-” হাসছেন কেন আপনি? ”
-“তুমি এত বোকা! তুমি দিয়াকে দেখতে পাচ্ছ না?’
মহিলা এবার শব্দ করে জোরে জোরে হাসছেন। আলো কিছুটা হকচকিয়ে গেল। এরকম হাসির মত তো সে কিছু বলেনি। কপাল কুঁচকে গেল তার।
-“দিয়া!”
নামটা মনে পড়ল তার। সাথে সাথে এই নামের মানুষটার মুখও চোখের পর্দায় ভেসে উঠল। দিয়া! হাসি খুশি চটপটে সেই মিষ্টি মেয়েটা। এক সাথে কলেজে পড়ত তারা। দিয়ার সাথে তার বেশ ভালো বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। দিয়া দীপ্তর বোন ছিল। তার বিয়ে হয়ে যাবার পরে দিয়াও কোন খোঁজ রাখেনি সে। দীপ্তর সাথে সবকিছু ভুলিয়ে দেবার জন্যই দিয়ার সাথে বন্ধুত্ব রাখেনি। সত্যিই তো, এবাড়িতে আসার পর দিয়ার কথা একবারও মনে পড়েনি তার। দিয়া কোথায়? ও কি বাসায় নেই? বাসায় থাকলে আলোর সাথে অবশ্যই দেখা করত। দিয়ার কি বিয়ে হয়ে গেছে? শ্বশুরবাড়িতে আছে ও?
-” কোথায় দিয়া?”
মহিলা হেসে হেসে বলল,
-“তোমার সামনেই তো বসে আছে। এইতো তোমাকে দেখছে।”
আলো চমকে এদিক ওদিক দেখাল। কোথায় দিয়া? মহিলা দিয়াকে দেখতে পাচ্ছে। উনি বলছেন দিয়া ওর সামনেই আছে। তাহলে সে দিয়াকে দেখতে পাচ্ছে না কেন?
চলবে___