#আসক্তি২
পর্বঃ০৯
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম
গ্রীষ্মকালীন ছুটি শেষে স্কুল খুলেছে ইনায়াহ্’র।সকাল বেলা শান নাস্তার এক ফাঁকে আব্দুল্লাহ্ ডেকে বলে, “চাচা ইনায়াহ’কে স্কুলে দিয়ে আসবেন।ওর স্কুল খুলেজে প্রিন্সিপালের কল এসেছিলো কাল রাতে”
“আচ্ছা বাবা”,শানের করা আদেশে সম্মতি জানায় আব্দুল্লাহ।
ইনায়াহ্ মলিন মুখে বলে,”আমি মুন সাইনের সাথে যাবো।”
শান ভ্রুকুচকে তাকায় ইনায়াহ্’র দিকে ।তাকিয়ে বলে,”তুমি না গুড গার্ল। আগের মতো স্কুলে যাবা, আবার রাফি চাচ্চুর সাথে বাড়ি চলে আসবা।ব্যাস!”
শানের কথায় ইনায়াহ্ একরোখা কন্ঠে জবাব দেয়,”না,মুন সাইন সাথে যাবে।”
গাল ফুলিয়ে ইনায়াহ্ অভিমানী সুরে বলে,”আমার সব ফ্রেন্ডসদের মা আসে তো।সারাক্ষন থাকে।ছুটির সময় আবার চলে যায়”
শানের ভিতর টা মোচর দিয়ে ওঠে ইনায়াহ্’র কথায়।শান্ত ভঙ্গিতে বলে,”মাম, এতো জিদ করতে নেই মাম।ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।প্লিইইজ!”
“নো “,ছলছলে চোখে বলে পাখির কোমড় জড়িয়ে কেঁদে ফেলে ইনায়াহ্।
এতোক্ষন পাখি চুপ থাকলেও আর নিজেকে চুপ রাখতে পারছে না।হাঁটু গেড়ে নিচে বসে দুহাতে ইনায়াহ্’র চোখের পানি মুছিয়ে বলে,”এতোটুকুর জন্যে কেউ কাঁদে?যাব তো আমি”
খুশিতে গদগদ হয়ে ইনায়াহ্ পাখির গলা জড়িয়ে ধরে।পাখি শানের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে শানও ওর দিকে তাকিয়ে আছে।নজর সরিয়ে পাখি বলে,”বেবি,এবার তাহলে কী করতে হবে আমাদের বলো তো?ঝটপট রেডি হতে হবে তো নাকি!”
ইনায়াহ্ খুশি খুশি বলে,”ওকে।চলো আমরা রেডি হই”
পাখি ইনায়াহ্’কে কোলে জড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায় উপরে।
🌸🌸
সকাল আট বাজতে এখনো পনের মিনিট বাকি আছে।এর মাঝেই পাখি ইনায়াহ্’কে নিয়ে পৌঁছে যায় তার স্কুলের গেইটে।রাফি তাদের গেইটে নামিয়ে দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যায় বাড়িতে।কারণ শানকে হসপিটালে ড্রপ করতে হবে।রাফিকে বিদায় জানিয়ে পাখি স্কুলের ভিতরে ঢোকে।একে একে সবার সাথে কুশল বিনিময় করে।সব টিচার রা অনেক বেশি ফ্রেন্ডলি। কিন্ডারগার্টেনের টিচার বলে কথা।সবার ব্যবহারই অনেক মিষ্টি। পাখি ইনায়াহ্’কে তার ক্লাসে বসিয়ে প্যারেন্টস ওয়েটিং জোনে অপেক্ষা করে।সেখানে অনেক ছেলে মেয়েদের মায়েরা বসে বসে খোসগল্প করছে।মাঝে মাঝে দু একজন বাবাদেরও দেখা যাচ্ছে।দেখেই বুঝা যাচ্ছে তারা অনেক আগে থেকেই পরস্পরের সাথে পরিচিত।সবার মাঝে পাখির নিজেকে একলা লাগে। কারণ আজ প্রথম দিন ;কাউকেই চিনছে না সে।
হঠাৎ কারো কথায় পিছু ফিরে তাকায় পাখি।
“এক্সকিউজ মি!”
“জ্বি,আমাকে!”,হেসে জবাব দেয় পাখি
মিষ্টি চেহারার সুমধুর কন্ঠের অধিকারী একজন মেয়ে বলে,”হুমম হুমম আপনি”
পাখি উঠে যায় সেদিকে।মেয়েটা তাকে হাত টেনে নিয়ে যায় বেশ নিরিবিলি একটা জায়গায়।
” ইনায়াহ্’র কি হোন আপনি?”
“জ্বি আমি ওর গভারনেস”
“ওহহ আচ্ছা আচ্ছা।ও খুব মিষ্টি মেয়ে আর অনেক সুইট একটা বাচ্চা”
পাখি ঠোঁটের হাসি এলিয়ে রাখে।
“সবার মাঝে আপনাকে দেখলাম একা একা বসে আছেন।আমি রাখি ;ইনায়াহ্’র টিচার”
পাখি মুচকি হেসে বলে,”আমি পাখি”
“ওয়াও আমাদের নামে কতো মিল বলেন!আপনি কি করেন;আই মিন এমপ্লোয়ি নাকি হাউজ ওয়াইফ?”
পাখি মূহূর্তে ভাবনায় পরে যায়।তার কি বলা উচিত?
“আমি অনার্স কমপ্লিট করেছি এই বছরই।আর ….”
“ওহহহ বুঝেছি, অনার্স করলেন ভেবেছেন মাস্টার্সের আগে কয়েকমাস জব করবেন, তাই তো?আরে আমিও তো এবার অনার্স করলাম।তারমানে আমরা ফ্রেন্ড!”
পাখি হাসি হাসি ভাব ধরে রেখে ক্ষীণস্বরে বলে,”হুমম, তাই তো”
মেয়েটা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে,”একদম।তাহলে তোমায় তুমি করেই বলি।বিশ্বাস করবা না,বাড়িতে একা একা কি বোরটাই না হচ্ছিলাম পরে স্কুলে জয়েন করলাম।ছোট বাচ্চা আমার ভীষণ ভালো লাগে।ভাবলাম সময়টা কাটবে সাথে আম্মুরও একটু হেল্প হবে।ওহহহ তোমায় তো জানানোই হলো না,আমি স্কুলের প্রিন্সিপালের মেয়ে।আমাদেরই স্কুল এটা।আব্বু গত হবার পর আম্মুই দেখাশোনা করছে”
“ওহহহ আচ্ছা”,শুকনো জবাব দেয় পাখি।
পাখির সবটা বুঝতে সময় লাগলো না।সাথে এটাও বোঝার বাকি রইল না রাখি কি পরিমানে বেশি কথা বলে।তবুও কোথাও যেন ভালো লাগা কাজ করলো এটা ভেবে যে, যাক কেউ তো একজন বন্ধু টাইপ হলো।
“এই তোমার ফোন নম্বর দাও,ফেসবুক আইডি দাও,ইমো,হোয়াটস’এপ,টুইটার,ইন্সটা সব দাও”,বলতে বলতে রাখি ফোন বের করে।
পাখি আমতা আমতা করে বলে,”আমার কিছুই নেই”
“হোয়াটট?লাইক সিরিয়াসলি?এটা একবিংশ শতাব্দী ম্যাম!আর তুমি বলছ কিনা! হ্যাহহ”,হাফ ছেড়ে রাখি আবার সন্দিহান চোখে পাখির দিকে চেয়ে বলে,”ওয়েট ওয়েট, বাই এ্যানি চাঞ্ছ কোন ভাবে তুমি আমার উপর বিরক্ত হলে না তো গত চার ঘন্টায়!তাই নম্বর দিচ্ছো না। বা একাউন্ট?”
“সেরকম টা একদমই নয়।আর আপনার কথা গুলো আমার খুব ভালো লেগেছে”,প্রসস্ত ঠোঁটে জবাব দেয় পাখি।
“আপনি!”
“সরি,তুমি”
রাখি হেসে বলে,”তাহলে দিবা না?”
“আমি সত্যিই ফোন ব্যবহার করি না। ওসব একাউন্ট তো দূরের কথা ”
“তোমার বাড়ি কোথায়?মনে হচ্ছে না তুমি ঢাকার বা তার আশেপাশের,”চোখ ছোট ছোট করে বলে রাখি।
পাখি শুকনো মুখে জবাব দেয়,”সিলেট”
“সিলেট!এখানে কিভাবে?”
রাখির প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই স্কুলের বেল পরে যায়।বাচ্চারা ছুটে মায়েদের কাছে যায় তাড়াতাড়ি বাড়ি যাবার লোভে।
পাখি হেসে বলে,”সব কথা একদিনে শেষ করলে বাকিদিন কী বলব?”
“আমার কথা আজীবনেও ফুরাবে না”,হেসে জবাব দেয় রাখি।
এরপর রাখিকে বিদায় জানিয়ে গেইটে পা রাখতেই রাফি গাড়ি নিয়ে চলে আসে।পাখি ইনায়াহ্’কে কোলে নিয়ে গাড়িতে বসায়।পনের বিশ মিনিট পরে গাড়ি পৌঁছে যায় আহমেদ ম্যানশনের সামনে।
দিনে দিনে রাখির সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে ওঠে পাখির।পাখি স্কুলে পা রাখার পরপরই শুরু হয় রাখির ননস্টপ বকবক।এরপর ছুটির ঘন্টার সাথে সাথে ইনায়াহ্’কে নিয়ে আসা পর্যন্ত চলতে থাকে সে বকবকানির রেশ।পাখির অবশ্য মন্দ লাগে না।এ কথায়,ও কথায় সময় গুলো পার হয় বেশ ভালোভাবেই।
🌸🌸
প্রতিদিনের মতো পাখি আজও ইনায়াহ্’কে সাথে নিয়ে যায় স্কুলে।ক্লাসে বসিয়ে দিতেই রাখি এসে হাত টেনে নিয়ে যায়।একটা ফাঁকা রুমে নিয়ে বলে,”সত্যি করে একটা কথা বলবে?”
পাখি হকচকিয়ে বলে,”কি কথা?”
“ডক্টর শান কী হয় তোমার?”
পাখি বুঝতে পারে আজ রাখিকে সবটা বলতে হবে।এরপর অনেক ভেবে নিজের জীবনের সাথে হওয়া সমস্ত ঘটনা রাখিকে খুলে বলে।
হা করে চেয়ে থাকে রাখি।ছলছলে চোখে বলে,”তুমি এতোটা সয়েছো জীবনে?অথচ আমরা সামান্য কিছুতেই হাফিয়ে গিয়ে মৃত্যু কামনা করি; ইভেন সুইসাইড এটেম করি।”
পাখি অপলক চেয়ে শুনে যায় রাখির কথা।
রাখি ঝনঝনে গলায় বলে,”আজ থেকে ধরে নাও তোমার একটা পার্মানেন্ট ঠিকানা তুমি পেয়ে গেছো।নেক্সট টাইম যখনি ঐ ডাক্তার সাহেব বকে দেবে তুমি আমার কাছে চলে আসবে। ইনায়াহ্’কে নিয়েই এসো; চুরি করে।”,বলেই ফিক করে হেসে দেয় রাখি।দুজনেই হেসে কুটিকুটি হয়।
🌸🌸
বিকেল বেলা ইনায়াহ্’কে সাথে নিয়ে বাড়ির পাশে রাস্তার দিকে হাঁটতে বের হয় পাখি।শহর থেকে কিছুটা দূরে আহমেদ ম্যানশন।বেশ নিরিবিলি আর পরিচ্ছন্ন একটা এলাকা।রাস্তার পাশে কয়েকটা খাবারের ছোট ছোট দোকান।সেগুলো দেখিয়ে ইনায়াহ্ বলে,”মুন সাইন চলো ঝালমুড়ি খাবো”
পাখি ইনায়াহ্’র দিকে চেয়ে বলে,”খাবা?ওকে চলো”
বলেই দোকানের দিকে হাঁটা ধরে।কিছুদূর যেতে থমকে যায় পাখি।
“কি হলো চলো না, থামলে কেন?”
“বেবি,টাকা তো নাই আমার কাছে”,মুখটা মলিন করে বলে পাখি।
“তুমি আসো তো”,বলে পাখির হাত টানতে টানতে নিয়ে যায় ইনায়াহ্।সাথে সাথেই একজন লোক পাখির একদম গা ঘেঁষে ফোনে কথা বলতে বলতে চলে যায়।পাখি রাগি চোখে তাকিয়ে পিছন ফিরে দেখে লোকটা অনেকটা দূর চলে গেছে মূহূর্তেই।পাখির বুঝতে অসুবিধা হয় না লোকটা কোন ব্যস্ততার মাঝে আছে।তাই নিজেকে স্বাভাবিক করে ইনায়াহ্’র সাথে দোকানে চলে যায়।
🌸
“হ্যা, হ্যা প্লিজ এ্যারেইঞ্জ দ্য মিটিং । আ’ম কামিং”,ফোনে বলতে বলতে শান বাড়িতে ঢোকে।চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে কেউ বাসায় নেই।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারে সন্ধ্যা হচ্ছে ধীরেধীরে।
ক্ষীণস্বরে ইনায়াহ্’কে ডাকে,”মাম্মাম কোথায় তুমি?,মাম?”
কিন্তু কোন সাড়া পায় না।পুরো বাড়ি, ছাদ সবখানে খোঁজে শান বাধ্য হয়ে দারোয়ানকে ডেকে বলে,”ইনায়াহ্ কোথায় সালাম ভাই?”
“ইনায়াহ্ বেবি তো পাখি ম্যাডামের লগে বাহিরে গেছে অনেকক্ষণ আগে।সেই বিকেল বেলা।এক ঘন্টা অইব”,জবাব দেয় দারোয়ান সালাম।
শানের কপালে চিন্তার ভাঁজ পরে যায়,কারণ পাখি এই এলাকায় নতুন।তেমন কিছু চেনে না।তারউপর ইনায়াহ্’র ব্যপারে সে কারোর উপর অন্ধবিশ্বাস করতে চায় না।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ছয়টা বিশ বাজে।সাতটায় মিটিং আছে হোটেল জিহায়।শান আগপিছ ভেবে গোসল সেড়ে রেডি হয়ে নেয় মিটিং এর উদ্দেশ্যে।সদর দরজায় পা রাখতেই পাখি ইনায়াহ্ সমেত বাড়িতে হুরমুর করে ঢুকে পরে।ধাক্কা লেগে যায় শানের বুকের সাথে।হকচকিয়ে ওঠে শান।এদিকে মুখের সামনে কাউকে বুঝতে পেরে একটু সাহস সঞ্চার হয় পাখির মনে।ইনায়াহ্’র হাত চেপে রেখেই সামনে তাকাতে বুঝতে পারে শানকে।কিছুক্ষন নিষ্পলক চাহনীতে চেয়ে থাকে। শান রেগে গিয়ে বলে,”কোথায় ছিলে এতো সময়?”
পাখি পূর্বের ন্যায় চাহনীরত অবস্থাতেই গোটা শরীরের ভার ছেড়ে দেয় শানের বুকের উপর।সবটাই যেন চোখের পলকে ঘটে যায়।ঘটনার আকষ্মিকতায় শান ভরকে যায়। পরিস্থিতি বুঝে উঠার আগেই পাখি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
এভাবে নারী স্পর্শ এই প্রথম না। অনেক সময় কলিগ,মেয়ে ফ্রেন্ডসদের সাথেও হাগ করেছে শান।কিন্তু ইতোপূর্বে আজকের মতো কোন অনুভূতির সন্ধান শান পায় নি।শিড়দাড়া দিয়ে শীতল বাতাস বয়ে গেলো।পুরো শরীর যেন জমে বরফে হয়ে গেলো মূহূর্তেই।রাগের অন্তরালে মনের মাঝে লুকানো অনুভূতিগুলো আজ একসাথে দলবেঁধে বের হতে চাইছে।এই মূহূর্তে লাগামহীন সে অনুভূতির রাশ কেন জানে না শানের ধরতে ইচ্ছে করছে না।অচেতন পাখির গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পরছে শানের শার্টের ঠিক উপরের দুটো বোতামের নিচের ফাঁকা জায়গাটায়।সে নিঃশ্বাস কাউকে জ্বলেপুড়ে অঙ্গার বানাবার ক্ষমতা রাখে।
“মুন সাইন, এই মুন সাইন কি হলো তোমার?”,পাখির জামার কোণ ঝাকিয়ে বার বার বলছে ইনায়াহ্।
শানের ধ্যান ফিরে আসে পরোক্ষণে।ভাবনার বেরাজাল থেকে বেরিয়ে এসে হন্তদন্ত হয়ে শান বলে
“হে হোয়াট হ্যাপেন্ড?হে?”
পরপর কয়েকবার ডেকেও কোন সাড়া পায় না শান।উপায়ন্তর না পেয়ে চট করে কোলে তুলে নেয়।নেতিয়ে পরা পাখির আরেকটা হাত তখনো ইনায়াহ্’র হাতকে শক্ত বন্ধনে জড়িয়ে রেখেছে।সেদিকে চেয়ে অবাক হয়ে যায় শান।আনমনে ভাবতে থাকে,”পুরোপুরি অবচেতন অথচ হাতটা কিভাবেই না শক্ত করে রেখেছে”
হাত ছড়িয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় শুইয়ে দেয় পাখিকে।
কিছুক্ষণ দেখার পর বুঝতে পারে হার্ট অনেক দ্রুত বিট করছে।হয়ত কোন ব্যপারে আতঙ্কিত থেকেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।চট করে ইনায়াহ্’কে কাছে টেনে বলে,”মাম্মাম কি হয়েছিলো?”
“আমরা ঝালমুড়ি খেতে যাব আমাদের কাছে কোন টাকা ছিলো না বলে দাঁড়িয়ে যাই।তখন একটা পচা লোক মুন সাইকে ধাক্কা মেরে চলে যায়।তারপর যখন আমরা আবার দোকানে গেছি তখন লোকটা আমাদের পিছুপিছু দোকানে চলে যায়।বার বার দূর থেকে ঘুরে ঘুরে মুন সাইনকে দেখছিলো।লোকটাকে দেখে মুন সাইন যেন কেমন করছিলো।ঝালমুড়ি ওয়ালা মামা আমায় দেখে বলল’টাকা লাগবে না’
আমি বলেছি সান সাইন দেবে।তখন ঐ লোকটা এসে বলল’আমি দেব’।তারপর যে কি হলো!মুন সাইন লোকটাকে দেখে আমায় কোলে তুলে নিলো আর তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগল।আমরা হাঁটি লোকটাও হাঁটে।আমরা দৌঁড়ালে লোকটাও দৌঁড়ায়।এরপর আমরা দৌড়ে যখন বাড়ির সামনে আসি তখন মুন সাইন আমায় নামিয়ে দিয়ে আমার হাত ধরে বাড়ির ভিতরে দৌঁড়াতে থাকে।আর দারোয়ান আঙ্কেল লোকটাকে আটকে দেয়। মুন সাইন তবুও দৌড়াচ্ছিলো।”
ইনায়াহ্’র কথায় শান ভাবনায় পরে যায়।
“এলাকায় মোটামুটি সবাই মাম্মাম কে চেনে তাহলে এমন কে? যে ওদের এভাবে তাড়া করবে?আর পাখিই বা কেন এতো ভয় পেলো?”,ভাবতে ভাবতে পাখির অবচেতন মলিন মুখটার দিকে তাকায় শান।কেমন যেন বুকের ভেতরে অজানা আকুতি জেগে ওঠে।মায়াভরা মিষ্টি মুখটা নিজের চিন্তা চেতনাকে আরো বেশি অবাধ্য করে তোলে।
“এক গ্লাস পানি আনো তো মা”,ইনায়াহ্’কে পানি আনতে পাঠিয়ে আবারও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সে পাখিকে।
কিছুক্ষন পর ইনায়াহ্ পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়।শান গ্লাস থেকে পানি নিয়ে পাখির চোখে মুখে ছিটাতেই ভ্রুকুচকে আসে পাখির।ধীরেধীরে চোখ পিটপিট করে খোলার চেষ্টা করে।খানিক সময় পর পুরোপুরি চোখ খুলে উঠে বসে পাখি।আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারে সে এখন বাড়িতে আছে।ভয়ে যেন গলা কাঠ হয়ে গেছে তার।
“কি ব্যপার, কি হয়েছিলো তোমার?”,একটু এগিয়ে এসে শান্ত স্বরে জানতে চায় শান।চোখের সামনে চেনা অবয়ব দেখে নিজেকে আর নিয়ন্ত্রন রাখতে পারে না পাখি। ভয়ে সিধিয়ে গিয়ে শানের হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে ।তখন তড়তড় করে কাঁপছিলো পাখির চোখের পাতা।কোণভরা জল যেন পলক ফেললেই টপকে পরে যাবে দু’গন্ড বেয়ে।শান পাখির কাজে অবাক হয়ে যায়।চট করে নিজের হাতের দিকে তাকায়।
“আ আ আয়ান,আয়ান ভাই এখানে”,বলতে বলতে চোখের জল ছেড়ে দেয় পাখি।
শানের কথার অপেক্ষা না করে পাখি ভয়ার্ত চোখে বলে,”আমি জানি ও এবার আমায় বাঁচিয়ে রাখবে না।জানি তো।”
“আমার জীবনটা এমন ছিলো না ডাক্তার সাহেব।কেন এমন হলো?কেন সবাই শুধু আমাকেই কষ্ট দেয়”,পরপর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে শানের হাতজোড়ার সাথে কপাল ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে কেঁদে ফেলে পাখি।যে কান্নার স্বর বড্ডো করূন থেকে করূনতর হচ্ছে সময়ের স্রোতে। বুকের বাঁ পাশের কোথাও যেন সে কান্নার শব্দটা বন্ধ দরজায় জোড়ে জোড়ে করাঘাতের মতো আঘাত করছে।কোন মেয়ের কান্নাই আজ পর্যন্ত এতোটা নাড়া দিতে পারে নি শানের মরিচা পরা সে দরজায়।
শান বুঝতে পারে না এই মূহূর্তে কি করে পাখিকে শান্তনা দেবে।ডান হাতটা উঠিয়ে পাখির মাথায় রাখতে যাবে এমন সময় ইনায়াহ্ এসে পাখির মাথায় হাত রেখে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,”ও মুন সাইন, এমন করে কেঁদো না প্লিজ।ওই পচা লোককে তো সান সাইন এক ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দেবে।তাই না বলো?”,শানকে ইশারা করে বলে ইনায়াহ্।
শান শুকনো মুখে চেয়ে থাকে ইনায়াহ্’র দিকে।পাখি হঠাৎ মাথা তুলে দুহাত সিটকে সরে যায়।
“কি করছিলাম আমি একটু আগে?”,ভাবতেই কেমন বিব্রত লাগে পাখির।নজর এদিক সেদিক ঘুরিয়ে হাঁটু জড়িয়ে নেয়।ইনায়াহ্ এগিয়ে এসে পাখির চোখের পানি মুছিয়ে বলে,”ঐ পচা লোক কিচ্ছু করবে না মুন সাইন।আমি আছি তো”
পাখি ইনায়াহ্’কে জড়িয়ে কেঁদে ফেলে।শান উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”দেখছি ”
পাখির দিকে তাকিয়ে আবার বলে,”বাড়িতে সাবধানে থেকো।একটুপর তো রাহেলা চাচি চলে আসবে।আমি না আসা পর্যন্ত চাচিকে যেতে দেবে না”
পাখির কোন উত্তর না পেয়ে শান জড়িয়ে আসা গলায় বলে,”আমার জরুরী মিটিং আছে, আসছি”
বলে শান দ্রুত বাড়ির বাহিরে চলে আসে।এসে ঘনঘন শ্বাস নিতে থাকে।বুকের ভিতরের আটকে রাখা ল্যাবডাব যেন বাহিরে থেকে শোনা যাচ্ছে।হাঁফরের মতো বুকের ছাতি উঠানামা করছে শানের।দুহাতের দিকে তাকিয়ে পাখির স্পর্শটা অনুভব করার চেষ্টা করে বার বার।
দ্রুত মাইন্ড ডাইভার্ট করে গাড়ির কাছে ছুটে যায়। গাড়ি চালিয়ে গেইটে পৌঁছে থেমে সালামকে ঐ লোকের ব্যপারে জিজ্ঞেসা করে।সালাম বিনয়ীভাবে জানায়,”স্যার,পাখি ম্যাডাম বাড়িতে ঢোকার পরপর ছেলেডা আমারে ধাক্কা মাইরে চলে যায়”
কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে শান গেইট খুলে দিতে বলে সালামকে।
#আসক্তি২
পর্বঃ১০
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম
পাখির কান্নাটার সাথে ভয়ার্ত মুখটা শান কিছুতেই ভুলতে পারছে না।কোনমতেই মিটিং এ মনোনিবেশ করতে পারছে না সে।বার বার ব্যর্থ হয়ে যায় নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে।বাধ্য হয়ে মিটিং টা স্থগিত করে বাড়ি ফেরে শান।ফিরে বুঝতে পারে রাহেলা বেগম এসেছেন।রান্না ঘরে রান্না করছেন তিনি।শান চোখ বুলিয়ে পাখি আর ইনায়াহ্’র অস্তিত্ব খোঁজে ড্রয়িং রুমের আনাচে কানাচে।কোথাও না পেয়ে ব্লেজার টা হাতে নিয়ে টাই টা ঢিলে করতে করতে উপরে উঠে যায়।ইনায়াহ্’র ঘরটা পার হয়ে শানের ঘরে যেতে হয়।তখন আধখোলা দরজা দিয়ে শানের নজর কাড়ে পাখির লম্বা খোলা কালো চুল।
জানলার গ্রিলে কপাল ঠেকিয়ে খোলা চুলে দাঁড়িয়ে আছে পাখি। দৃষ্টি তার বাহিরের সড়কপথে।শান মাথাটা আরেকটু হেলিয়ে ইনায়াহ্’কে বিছানার উপর খোলা বই সমেত খুঁজে পায়;কিছু একটা লিখছে সে।বুঝতে পারে পাখি ইনায়াহ্’কে পড়তে দিয়ে জানালায় গিয়ে দাঁড়ায়েছে।
কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে মেয়েটাকে।পাখির এ দৃশ্য শানের কাছে কেমন যেন করূন লাগল।বড্ডো মায়া হচ্ছে এই মূহূর্তে।
ঘোর কাটিয়ে নিজের ঘরে চলে যায় শান।
🌸
ডিনার টেবিলে আজ ইনায়াহ্ একা এসেছে।খেতে চাচ্ছে না কিছুই।রাহেলা বার বার জোড় করে খাওয়াতে গিয়েও ব্যর্থ হচ্ছে।শান সিঁড়ি বেয়ে ধীরেধীরে নামতে গিয়ে ইনায়াহ্’র অবস্থা বুঝতে পারে।চেয়ার টেনে বসে পরে।প্লেটে খাবার নিতে নিতে বলে,”কি মা খাচ্ছো না কেন?কি হয়েছে?”
ইনায়াহ্ নাকে কান্নার মতো করে বলে,”আমার ক্ষিদে নেই।খাইতে ইচ্ছে করছে না”
শানের বুঝতে অসুবিধা হয় না পাখি ছাড়া ইনায়াহ্ অন্য কারোর হাতে খাবার খাবে না।আবার নিজের হাতেও খাবে না। ওর দিকে মাথা তুলে শান্ত চাহনীতে বলে,”মুন সাইন কোথায়?”
“মুন সাইনের শরীর নাকি খারাপ করেছে। নিচে আসবে না। একা একা খেতে বলেছে?”,পাংশুটে মুখে ঠোঁট উল্টিয়ে জবাব দেয় ইনায়াহ্।
শান কিছু না বলে নিজেই খাইয়ে দেয় ইনায়াহ্’কে। রুচিমন্দা ভাব নিয়ে কয়েক গাল খেয়ে উঠে দৌড়ে চলে যায় নিজের ঘরে।
শান বুঝতে পারে সন্ধ্যার ব্যপার নিয়ে পাখি অনেক বেশি বিষন্ন রয়েছে।শানও কোনমতে কিছুটা খেয়ে উঠে যায়।ঘরে যেতে পাখি আর ইনায়াহ্’র কথার শব্দে থেমে যায় শান।
“খেয়েছো?”
“হুম।সান সাইন খাইয়ে দিয়েছে।কিন্তু আমি তোমার সাথে খাবো”
“কাল সকাল থেকে আবার আমি খাওয়াব, কেমন!”,বলেই ইনায়াহ্’র কপালে চুমু এঁকে দেয় পাখি।শান সেদিকে একবার চেয়ে মুচকি হেসে নিজের ঘরে চলে যায়।
🌸
শান হসপিটালের কিছু কাজ করছে বসে বসে।ল্যাপটপটা বন্ধ করে পানি খেতে যাবে; দেখে ওয়াটার পটে পানির ছিটেফোঁটাও নেই।ঘড়ির দিকে চোখ রেখে বুঝতে পারে ১.৩০ এর কোঠায় ঘড়ি থেমে আছে।
“কখন এতো রাত হলো বুঝতেই পারলাম না”,একা একা বিড়বিড় করতে করতে শান নিচে নেমে আসে।বোতলে পানি ভরিয়ে নিয়ে যাবার সময় ইনায়াহ্’র ঘরে ড্রিম লাইটের আলো বুঝতে পারে শান।ভ্রকুচকে ভাবে,”এতো রাতে জেগে আছে কে?ইনায়াহ্?নাকি পাখি?”.
ভাবতে ভাবতে দরজায় উকি দিতেই কুঞ্চিত ভ্রুজোড়া সোজা হয়ে যায় শানের।সন্ধ্যেবেলার মতো আবার জানালায় কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাখি।আগের বারের মতো এবারও দৃষ্টি তার নিচের সড়কের দিকে।
ধীরপায়ে এগিয়ে গলায় দুইবার খাঁকারি দেয় শান।পাখি চমকে পিছু ফিরে থমকে যায়।শান এলোমেলো দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,”ইনায়াহ্ ঘুমিয়েছে?”
পাখি অবাক হয়ে যায়।
“এতোরাতে ইনায়াহ্ জেগে থাকে না “,খনখনে স্বরে জবাব দেয় পাখি।শান আরেকটু এগিয়ে এসে নিচে তাকিয়ে বলে,”নিচে কি দেখছিলে?”
পাখির কাছে শানের ব্যবহারগুলো ঠিক হজম হচ্ছে না।কেমন যেন গোলমেলে লাগছে।যে মানুষ আজ অবধি কোন দিন ভালো করে কথা বলল না; অপমান ছাড়া,সে কিনা আজ এতো শান্তস্বরে কথা বলছে!
“তা নিচে কি দেখছিলে শুনি?”,?শানের কথার কোন জবাব না দিয়ে পাখি ফিরতি প্রশ্ন করে,”এতো রাতে এসব জানতে এ ঘরে এসেছেন বুঝি”
“এই যে পানি। পানি নিতে গেছিলাম।”,বোতলের দিকে ইশারা করে বলে শান।
পূনরায় শান বলে,”ঘরে যেতে দেখলাম এ ঘরে লাইট জ্বলছে তাই….”
“ঘুম আসছে না”,শানকে থামিয়ে বলে পাখি।
শান বোতলটা টেবিলে রাখতে রাখতে বলে,”তোমার আয়ান ভাইকে নিয়ে এতো ভয় পেতে হবে না।তার সাহস হবে না এ বাড়ির ত্রিসীমানায় পা রাখার।নিশ্চিন্তে থাকো।”
শানের কথায় পাখি যেন আকাশ থেকে পরে যায়।
“এই লোক, এতো ভালো করে কথা বলছে কেন!”,ভাবতে ভাবতে শানের দিকে তাকায়।শান পাখির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
ঘরের লাইট জ্বালিয়ে বলে,”আগামিকাল থেকে ইনায়াহ্’র স্কুলে জয়েন করো।আমি প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলেছি।মন ভালো থাকবে তোমার”
বলতে বলতে আলোটা পূনরায় নিভিয়ে চলে যায় শান।পাখি ধপ করে বিছানায় বসে পরে।এতো সবকিছুকে স্বপ্ন মনে হচ্ছে তার।এদিকে শান নিজের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ভাবে, “আর কোন খারাপ ব্যবহার নয় তোমার সাথে”
🌸
পরদিন সকালে ইনায়াহ্’কে নিয়ে স্কুলে ঢুকতেই সবাই পাখিকে শিক্ষিকারূপে সম্ভাষন জানিয়ে ভিতরে নিয়ে যায়।নিজেকে অনেকটাই বিশেষ কেউ মনে হয় তার।
রাখি দৌড়ে এসে ফুলের মালায় পাখিকে বরন করে নেয়।
“আমি ভাবতেও পারছি না, তুমি আমাদের স্কুলে জয়েন করবা”,খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে রাখি।
এরপর পাখি গতদিনের সমস্ত কথা রাখিকে খুলে বলে।
রাখি কিছুক্ষণ ভাবুকের মতো চেয়ে বলে,”আমি কেন জানি অন্য কিছুর গন্ধ পাচ্ছি মিস পাখি”
“অন্যকিছু বলতে?”
মুখটা বাঁকিয়ে রাখি বলে,”এটা হলে কেমন যেন হবে,তাই না?তুমি আনম্যারিড অথচ ডক্টর শান অলরেডি বাচ্চার বাবা”
পাখি চিন্তিত মুখে বলে,”কি বলছ কিছুই তো বুঝতেছি না”
“আরে গাধা, ডক্টর শান মনে হয় তোমায় ভালোবেসে ফেলেছে”,পাখির কানে কানে কথাটা বলতেই পাখি চোখ বড় বড় করে বলে,”কি বলো এইসব?উনি আগা-গোড়া নারী বিদ্বেষী ”
রাখি সন্দিহান চোখে বলে,”তাহলে নারীবাদী হলে বুঝে এক্সেপ্ট করতে?”
থতমত খেয়ে পাখি বলে,”না না, সেরকম টা নয়।আর সবথেকে বড় কথা উনার আচরন অনেক বেশিই রুড।উনি মেয়েদেরকে সম্মান করতে জানেন না”
রাখি মুচকি মুচকি হেসে বলে,”ম্যাডাম, মেয়েরা কিন্তু তারই প্রেমে পরে যাকে সে সবথেকে ঘৃনা করে”
রাখির শেষ কথাটা পাখির মস্তিষ্কে গেঁথে যায় বেশ ভালোভাবে।
“সত্যিই কি তাই?না না এসব কি ভাবছি আমি আবোলতাবোল! “,বলেই রাখিকে সরিয়ে ক্লাসে ঢুকে পরে পাখি।
🌸
দুপুর বেলা স্কুল শেষে ইনায়াহ্’কে নিয়ে বাড়ি ফেরে পাখি।পুরো রাস্তা আয়ানের ভয়ে থাকে সে।কিন্তু সেদিনের পর থেকে আয়ানকে আর চোখে পড়ে নি পাখির।
রাহেলা আজ দুপুর বেলায় চলে এসেছে।আজ বিকেলে সে কোথাও যাবে।আগামি তিনদিন আসতে পারবে না।পাখি এই ভরদুপুরে রাহেলাকে দেখে অবাক হয়ে বলে,”চাচি এতো তাড়াতাড়ি আজ!”
রাহেলা সবজি কাটতে কাটতে বলে,”একখানে যাবো।সামনের তিনদিন আসা হবে না মা।আমি রান্নাটা করে দিয়ে যাই।রাতে শুধু গরম করে খাবে।আর আগামি দুইদিন একটু কষ্ট করে রেঁধে নিও। পারবে না?”
পাখি ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি রেখে বলে,”আচ্ছা”
ইনায়াহ্ স্কুল থেকে ফিরেই টিভির সামনে বসেছে;কার্টুন দেখবে বলে।পাখি ইনায়াহ্’কে টানতে টানতে বলে,”এই বুড়ি ওঠো।চলো ফ্রেশ হয়ে নিবে।তারপর টিভি দেখব”
ইনায়াহ্ না করে দিয়ে বলে,”তুমি আগে ফ্রেশ হও তারপর আমি হবো”
“দাদুভাই টিভি দেখুক, ততোক্ষনে তুমি ফ্রেশ হও যাও”,রাহেলার কথায় পাখি আর না করে না।সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়।
ইনায়াহ্’কে কাছে আসতে ইশারা করে রাহেলা বেগম বলে,”দাদু ভাই এদিকে আসো কথা আছে”
“বলো দিদা”,রাহেলা বেগমের তালে তাল মিলিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে ইনায়াহ্।
“তুমি কি চাও না, তোমার সান সাইন আর মুন সাইনের ভাব হোক?”
ইনায়াহ্ জোড়ে জোড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,”হুম হুম চাই তো!”
রাহেলা মূখ্যম সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে বলে,”তাহলে আমি যা যা বলব তাই তাই করবে কেমন”
“ওকে দিদা”
“আরেকটা কথা,তোমার সান সাইন আর মুন সাইন কেউ যেন এ কথা না জানে।তাহলে কিন্তু আবারও ঝগড়া লেগে যাবে ওদের।”
“তুমি একদম ভেবো না।আমি কিচ্ছু বলব না ওদেরকে”,রাহেলাকে আশ্বস্ত করে বলে ইনায়াহ্।
🌸
পাখি ইনায়াহ্ ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখায় ব্যস্ত।এমন সময় একজন ভদ্র মহিলা দরজায় পা রেখেই ইনায়াহ্’কে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে ডেকে বলে,”দাদু ভাই”
ইনায়াহ্ সহ পাখি চট করে সেদিকে ঘুরে তাকায়।ভাবগাম্ভীর্যে ভরা একজন নারী অবয়ব।বেশভূষাই জানান দিচ্ছে তিনি অনেকটাই হাই প্রোফাইলের ব্যাক্তি।
অসময়ে চেনা কন্ঠস্বর কানে আসতেই রাহেলা বেগম রান্নাঘর থেকে দৌড়ে বের হয় আসে।ইনায়াহ্ পাখিকে সরিয়ে একপ্রকার দৌড়ে গিয়ে ভদ্রমহিলার কোলে বসে গলা জড়িয়ে অজস্র চুমু এঁকে দেয়।
ভদ্র মহিলাও ইনায়াহ্’কে আদরে ভরিয়ে তোলে।যে কেউ দেখেই বলতে পারবে বেশ গাঢ় সম্পর্ক তাদের।
রাহেলা ভাবতেও পারছেন না এই সময়ে তিনি আসবেন।দ্রুত এগিয়ে হাত টেনে এনে সোফায় বসায়।ভদ্র মহিলা পাখির আগা-গোড়া পরোখ করে বলে,”ও কে রাহেলা?”
“ম্যাডাম ও হচ্ছে আমাদের ইনায়াহ্ বেবির নতুন গভারনেস।খুবই ভালো মেয়ে”
পাখির দিকে পূনরায় পরোখ করে বলে, “মেয়ে, নাম কি তোমার?”
“জ্বি আমার নাম পাখি।”,ঠোঁটে সৌজন্যতার হাসি রেখে জবাব দেয় পাখি।
ভদ্র মহিলা মুচকি হেসে বার বার জহুরের মতো পাখির দিকে তাকাচ্ছে।কেমন বিব্রত লাগছে পাখির।বার বার অসহায়ের মতোন রাহেলার দিকে তাকাচ্ছে সে।
রাহেলা বেগম বুঝতে পেরে বলেন,”তোমাকে তো আসলে বলা হয় নি। এখন তো পরিবারেরই একজন হয়ে গেছো।তাই এখন আর লুকানোর কিছু নেই।উনি আমাদের শান বাবার…..”
“রাহেলা”,ভদ্র মহিলার শান্তস্বরে থেমে যায় রাহেলা বেগম।অপরাধীর মতো মুখটা করে চেয়ে থাকে তার দিকে।
“ম্যাডাম, কি খাবেন?আমি এনে দিচ্ছি”,ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে রাহেলা বেগম।
ভদ্রমহিলা রাহেলাকে গম্ভীরস্বরে বলে,”আমি কিছু খাবো না রাহেলা।তুমি দাদুভাইকে চট করে রেডি করে দাও।ক’টা দিন আমার সাথে থাকবে ও”
ইনায়াহ্ ফট করে বলে,”আমি যাব না দিদা।মুন সাইনের কাছে থাকব”
“মুন সাইন!”,ভ্রু কুচকে বলে সামনে দাঁড়ানো ভদ্র মহিলা।রাহেলা হেসে জবাব দেয়,”ম্যাডাম ইনায়াহ্ বেবি নতুন গভারনেসকে মুন সাইন বলে ডাকে”
ঠোঁটে স্মিত হেসে ভদ্র মহিলা বুঝতে পারে পাখির সাথে ইনায়াহ্’র অনেক ভালো সম্পর্ক তৈরী হয়েছে।
“সত্যি যাবে না তো!”
“নাহ”,মুখটা ভার করে জবাব দেয় ইনায়াহ্।
রাহেলা বেগম পাখিকে বলে,”মা দাদুভাইয়ের কয়েকটা ড্রেস সমেত স্কুল ব্যাগ টা প্যাক করে নিয়ে আসো”
পাখি বুঝতে পারে না কি করবে।কারণ ভদ্রমহিলাকে ইতোপূর্বে কখনো দেখে নি সে।আমতা আমতা করে বলে,”স্যার কিছু বলবেন না?”
রাহেলা মুখটা থমথমে করে বলে,”নাহ শান বাবা কিছু বলবে নাহ।তুমি যাও রেডি করে আনো সবটা”
পাখি আর না করতে পারে না।কারণ হয়ত কোন ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে তাদের মাঝে যা পাখির অজানা।
পাখি উপরে যেতেই রাহেলা বেগম ইনায়াহ্’কে ফিসফিস করে বলে,”কি বলেছি, ভাব জমাতে হবে না?”
ইনায়াহ্ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,”হ্যা তো”
“তাহলে দিদার সাথে যাও আর কয়দিন ওখানে থাকো”
“কিন্তু….”
“কোন কিন্তু না।দিদার বাড়ি থেকে স্কুলে যাবা আর ওখানে তো মুন সাইনকে পাবাই তাই না”
ইনায়াহ্ ঘাড় টা বাকিয়ে আচ্ছা বলে দেয়।
“তোমরা কি নিয়ে এতো ফিসফিস করছো রাহেলা?”,ভদ্র মহিলা বলে ওঠেন।
রাহেলা থমতম খেয়ে বলে,”ম্যাডাম এখনি কিছু বলব না।সময় আসলে সব বলব।তবে এটুকু জেনে নেন এইবার শান বাবার জীবনটা ঠিক হয়ে যাবে”
শানের কথা শুনে জগৎের একরাশ হতাশা যেন ভদ্র মহিলার চোখ মুখে প্রকাশ পায়।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”আর ঠিক!১৬ বছরে যা ঠিক হয় নি তা কি করে ঠিক হবে রাহেলা?”
সামান্য ভাবুকের মতো চেয়ে মোটা চশমার ফ্রেমটা হালকা উচিয়ে ভরাট হওয়া চোখের কোণ দুটো সন্তর্পনে মুছে নেয় তিনি।
ততোক্ষনে পাখি চলে আসে ইনায়াহ্’র ব্যাগপত্র সমেত।এগিয়ে দেয় রাহেলার দিকে।রাহেলা হাত বাড়িয়ে নিতে নিতে বলে,”আমিও তো চলে যাব একটু পর।ম্যাডাম একটু অপেক্ষা করেন হাতের কাজটা সেড়ে আসি”
ভদ্রমহিলা মাথা এলিয়ে জবাব দেয়।পাখি উপরে ঘরে গিয়ে ভাবে,”চাচিও আসবে না।ইনায়াহ্ও চলে গেলো আমি থাকব কী করে এ বাড়িতে?
অন্য কোথাও যাওয়ারও তো জায়গা নেই!”
ভাবনার মাঝে ছেঁদ পরে নিচ থেকে রাহেলার ডাকে।পাখি নিচে নেমে আসে। ততোক্ষনে ভদ্র মহিলা ইনায়াহ্’কে নিয়ে সদর দরজা পার করেছে।
“শান বাবা আসলে শুধু বলবা ইনায়াহ্ ওর দিদার কাছে গেছে।তাতেই ও বুঝবে।আর ওর একটু খেয়াল রেখো।কেমন!আসছি মা।সাবধানে থেকো”,বলেই রাহেলাও তাদের পিছন পিছন বেড়িয়ে যায়।
🌸
সারাটা দিন একা একা ভালো লাগলো না পাখির।কখনো ছাদ কখনো বেলকোনি কখনো ড্রয়িং রুমে পায়চারি করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে এলো।পাখি টিভি ছেড়ে বিষন্নমনে অন্যদিকে চেয়ে আছে।সন্ধ্যার কিছুক্ষন পর শান চলে আসে।টিভি চলছে অথচ পাখির নজর অন্যদিকে দেখেই চারপাশে ইনায়াহ্’কে খোঁজে।সোফায় ব্লেজার টা রাখতেই পাখি চমকে সেদিকে ফিরে চট করে উঠে দাঁড়ায়।
টাই টা ঢিলে করতে করতে শান বলে,”ইনায়াহ্ কই?রাহেলা চাচি আসে নি আজ?
একা একটা বাড়িতে শানের সাথে থাকতে হবে ভাবতেই পাখির কেমন অস্বস্তি লাগা শুরু করে।কাপা কাপা গলায় বলে,”চাচি দুপুরে চলে গেছে।আগামি তিনদিন নাকি আসতে পারবেন না।আর ইনায়াহ্ বেবি ওর দিদার কাছে গেছে”
“হোয়াটট??তুমি যেতে দিলে কেন?আমায় একবার জানাতে তো পারতে!এতোটা কেয়ারলেস তুমি?”,জোড়ে চিল্লিয়ে বলে শান।
পাখি ভয়ে কেপে উঠে বলে,”আমি আপনাকে জানাতে বলেছিলাম কিন্তু উনি…”
শান নিজেকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা করে।চোয়াল শক্ত করে ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করে,”শর্মিলা বেগম”
শানের রাগে কোনকিছুই পাখির বোধগম্য হয় না।”ইনায়াহ্’র সাথে ভদ্র মহিলার সম্পর্ক দেখে মনে হলো কতো আপন তারা।তাহলে ডাক্তার সাহেব রেগে গেলেন কেন?এনাদের মাঝে অবশ্যই কোন লুকায়িত রহস্য আছে যা আমি জানি না।জানতে পারব কিনা তাও জানি না”
পাখি শানের দিকে সরুচোখে তাকিয়ে থাকে।
শান ভ্রু নাচিয়ে বলে,”কী?”
“কিছু না”,মাথা দুদিকে নাড়িয়ে না সূচক জবাব দেয় পাখি।
🌸🌸
রাতে ডিনারের সময় পাখি খাবারগুলো গরম করে এনে শানের সামনে রাখে।কারো মুখে কোন কথা নাই।শান আড়চোখে বার কয়েক পাখির দিকে তাকায়।আবার মূহূর্তেই নজর সরিয়ে নেয়।
খাবার সামনে দিয়ে পাখি চলে যেতেই শানের কথায় থেমে যায়
“তুমি খাবে না?”
থমকে গিয়ে বলে,”আপনি খান”
“খেয়ে নাও”,শুকনো গলায় আরেকবার খেতে ডাকে পাখিকে।পাখি শানের কথাকে অগ্রাহ্য করে সিঁড়িতে পা রাখতে রাখতে ভাবে,”এনার এতো পরিবর্তন কিসের জন্য?কিছুদিন আগেও তো কেমন আচরন করত আর ইদানিং পুরাই চেইঞ্জড!”
🌸🌸
একা একটা বাড়িতে বিবাহ ব্যাতিরেকে দুটো ছেলেমেয়ে থাকা ভীষণ দৃষ্টিকটু ব্যপার।রাত হওয়ার পর থেকে পাখির চোখে ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই এসব ভাবনা ভাবতে।অন্যদিকে শানের ব্যবহারগুলোও দিনদিন অনেক পরিবর্তন এসেছে।বিছানায় শুয়ে কপালে ডান হাতের উল্টোপিঠ ঠেকিয়ে পাখি ভাবে,”ডাক্তার সাহেবের এতো পরিবর্তনের কারণ কি?কেন উনি এতো ভালো হয়ে গেলেন?আমি সম্মান চেয়েছিলাম উনি তো দিচ্ছেন তাহলে এতো ভাবছি কেন?নাকি রাখির কথাই ঠিক!বাই এনি চাঞ্ছ উনি কি সত্যিই আমায়….. ”
নিজের লাগামহীন ভাবনাকে প্রশ্রয় না দিয়ে পাখি বলে,”আমার মতো মেয়েকে কেউ ভালোবাসতে পারে না”
ভাবতে ভাবতে দরজাটা ভালো করে লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরে পাখি।
#আসক্তি২
পর্বঃ১১
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম
“হাচ্চুউউ”,সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে পরপর কতোগুলো হেঁচে ওঠে শান।মাথা তুলে চমকে তাকিয়ে পাখি অবাক হয়ে যায়।কপালে ভাঁজ ফেলে ভাবতে থাকে,”কাল রাতেও তো ঠিক ছিলেন উনি আজ হঠাৎ কি…..”
“তুতুমি কি কররো,হাচ্চুউউ, হাচ্চুউউ “,বলতে বলতে শান পাখির সামনে এসে দাঁড়ায়।পাখি টেবিলে নাস্তা সাজাতে সাজাতে বলে, “আগে হেঁচে নিন ভালো করে, তারপর প্রশ্ন করুন”
শান হাতের ভাঁজ করা টিসুতে নাক মুছে বলে,”সর্দি লেগেছে।”
শানের কথায় পাখি মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে সত্যিই সর্দিতে অবস্থা কাহিল শানের।ফর্সা নাকের ডগাটা টকটকে লাল হয়ে গেছে টিসুতে মুছতে মুছতে।লাল লাল চোখ দুটোর দুইকোণা বেয়ে জল গড়াচ্ছে।চোখের পাপড়ি গুলো যেন জলের ভারে নুয়ে পড়তে চাইছে বার বার।শানের সারা শরীরের দিকে ভালো করে পরোখ করে পাখি সংকোচে বলে,”এতো বড় একখান শরীর, তাতে আবার ডাক্তার মানুষ সে কিনা সামান্য সর্দিতে এতো নাজেহাল!”
শান কিছুক্ষন পাখির দিকে ছলছলে চোখে তাকিয়ে থাকে।চোখের পাপড়ি গুলো পরপর কাঁপতেই পাখি জোড়ে ধমক দিয়ে ওঠে।শানের হাঁচি উবে যায় মূহূর্তেই।আটকানো হাঁচিগুলো বাহিরে বের না হতে পেরে নাক চোখ দিয়ে ঝড়ঝড় করে পানি ঝড়তে লাগে।
“করছেন টা কি?খাবার গুলোয় নাকের পানি পরলে কে খাবে? “,রাগি রাগি ভাব নিয়ে বলে পাখি।শান মায়াভরা মুখে বলে,”আমি সর্দি সহ্য করতে পারি না”
“আরেহহ!তো ঔষধ নেন না কিসের জন্যে?”,অবাক হয়ে বলে পাখি।পাখির কথা শেষ হতে না হতে শান শব্দ করে টিসুতে নাক মুছে ফেলে।পাখি ঘৃনাভরা ভঙ্গিতে চোখ মুখ কুঁচকে মাথাটা সামান্য পিছনে নিয়ে যায়।
“এই সামান্য অসুখে যদি ঔষুধের প্রয়োজন পরে তাহলে আর কি বলার!হাচ্চুউউ”
নাক মুছে শান স্বগতোক্তি করে বলে, “বছরে দু একবার এরকম অসুখ বিসুখে মেডিসিনের হেল্প নিতে নেই।শরীর থেকে টক্সিক বের হওয়ার সুযোগ দিতে হয়।হাচ্চুউউ”
“ওকে ওকে সড়ুন।আর বলতে হবে না। আমি বুঝেছি বুঝেছি”,দুই হাত দিয়ে শানকে থামিয়ে দিয়ে বলে পাখি।
“নিন এবার খেয়ে নিন।আমি স্কুলে যাবো”,নাস্তা এগিয়ে দিয়ে এলোমেলো স্বরে বলে পাখি।
“এসব কেন করেছ তুমি?আমি করে নিতাম”,ঠান্ডা স্বরে বলে শান।পাখি মূহূর্তেই ঝনঝনে গলায় জবাব দেয়,”সকাল বাজে ০৮ টা। আমি স্কুলে যাব।”
শান ব্রেডে জেলি লাগাতেই ফোনের ক্ষীণস্বরে স্ক্রীনের দিকে চোখ রাখে।দ্রুত ফোনটা রিসিভ করে।
“আস্সালামু আলাইকুম স্যার।ওকে… আমি তো ই-মেইলে ছুটিটার জন্যে এপ্লাই করেছি স্যার।কাইন্ডলি চেইক ইট ।ওকে স্যার, আমি মেডিসিন নিব ”
কথা শেষ করে শান আরেক দফা হেঁচে নিয়ে ব্রেডটা মুখে দেয়।পাখির বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না শান ছুটি নিয়েছে আজ।
“একটা জিনিস মাথায় ঢুকছে না। একটা এতো সুস্বাস্থ্যবান মানুষ সামান্য সর্দিতে ছুটি পর্যন্ত নিলো।অবশ্য চোখ মুখের যা অবস্থা ছুটিই বেটার”,আনমনে ভেবে পাখি মুচকি হেসে ওঠে।
ওমলেটের কোনা ছিড়তে ছিড়তে শান বলে,”তুমি খাবে না?”
“আমি খেয়ে….. ”
“হাচ্চুউউ ”
পাখি তীক্ষ্ণ চোখে শানের দিকে চেয়ে সোফার উপরে রাখা সাইড ব্যাগটার ফিতা টেনে কাঁধে তুলে নেয়।এরপর সদর দরজা পেরিয়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
🌸🌸
পাখি স্কুলের ভিতরে পা রেখেই থমকে দাঁড়ায় পরিচিত দুটো হাত দৌড়ে এসে তার কোমর জড়িয়ে ধরে।হকচকিয়ে ওঠে পাখি।মনে হচ্ছিলো এই হাতদুটো তাকে জড়িয়ে ধরবার জন্যেই গেইটের আড়ালে লুকিয়ে ছিলো।কতো পরিচিত এই হাতদুটো!
“বেবি,কেমন আছো সোনা?”,ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে জিজ্ঞেসা করে পাখি।ইনায়াহ্ ফিক করে হেসে বলে,”আমি অনেক গুলা ভালো আছি মুন সাইন।তুমি কেমন আছো?”,
পাখি ইনায়াহ্’কে কোলে তুলে নিয়ে ভিতরে হাঁটা ধরে।হাটঁতে হাঁটতে বলে,”তোমায় ছাড়া কি ভালো থাকা যায় বলো!”,
এরপর দুজনেই ক্লাসের ভিতর ঢুকে পরে।
ক্লাস নেয়ার একফাঁকে রাখি কতোকগুলো হালকা নাস্তা নিয়ে আসে পাখির জন্যে।টিফিন পিরিয়ডে সেগুলো পাখিকে সার্ভ করে দিয়ে খেতে বলে রাখি।দুজনেরই খাওয়ার এক পর্যায়ে হঠাৎ পাখির সারা শরীরে ইচিং ভাব চলে আসে।ধীরেধীরে সেটার মাত্রা এতোটাই বেড়ে যায় যে পুরো শরীরে ফুলে ফুলে ওঠে।পাখির বুঝতে অসুবিধা হয় না তার এলার্জি বেড়ে গেলো।দম ছোট হয়ে আসে তার।
পাখির অবস্থা খারাপের পথে দেখে রাখি ঘাবড়ে গিয়ে বলে,”এসব কিরে?তোর কিসে এমন হলো?”
পাখি নিজেকে খানিকটা শান্ত করে বলে,”পিয়াজি তে কী ডাল ছিলো?”,
“অভিয়াসলি মুশুর ডাল।তারমানে….”,চোখ কপালে তুলে বলে রাখি।
পাখি লাল লাল চোখে চেয়ে বলে,”এই মূহূর্তে গোসল করে মেডিসিন না নিলে আমায় বাঁচানো মুশকিল।আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি।তুই ম্যামকে বলিস।কেমন!”,
রাখি সহমত পোষণ করে পাখিকে বাড়ি যাবার জন্যে তাড়া দেয়।পাখি ইনায়াহ্’র সাথে আরেকবার দেখা করে বাড়ির পথে পা বাড়ায়।
বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই পাখির শ্বাস থেমে আসে।সদর দরজাটা পুরোটাই খোলা।সোফার কাছে শানের শরীরটা নিথর হয়ে পরে আছে।দিগ্বিদিক না ভেবে পাখি দৌঁড়ে গিয়ে শানের পাশে মেঝেতে বসে পরে।
“এই যে শুনছেন?এই যে….”,পাখি বুঝতে পারে না সে কি করবে!এবার কাপাকাপা হাতে শানের বাহুতে হালকা স্পর্শ করতেই পাখি হাত সরিয়ে নেয় শরীরের মাত্রাতিরিক্ত উত্তাপে।ভীষণ ঘাবড়ে যায় পাখি।অজানা আশঙ্কায় নিঃশ্বাস সাথে সাথে পাল্সও চেইক করে নেয় শানের।
“সবই তো ঠিক আছে।তাহলে জ্বরের তাপে সেন্সলেস হয়ে গেছেন!”,ভেবে শানকে পূনরায় ডেকে ওঠে।কিন্তু কোন সাড়া পায় না। শানের হাতটা উঠাতে নিতেই হাফিয়ে ওঠে পাখির শরীর।এদিকে নিজের শরীরের সীমা অতিক্রম করা এলার্জিক সমস্যা টা যেন পাখির শরীরকে আরো বেশি দূর্বল করে দেয়।বিড়বিড় করে আওরায়,”এতো ভারী!বাপ রে বাপ!এখন কাকে ডাকি আমি!”
চট করে উঠে দাঁড়ায়।সদর দরজার বাহিরে এসে মাথা উচিয়ে পাখি এদিক সেদিক তাকায়।
“কেউই তো নেই।এবার!”
পাখি আবারও এদিক ওদিক চোখ বুলাতে বাগানের একদম শেষ মাথায় কোন পুরুষালি গায়ের ফতুয়া দেখতে পায়।দৌড়ে সেদিকে গিয়ে দেখতে পায় বাগানে কাজরত অবস্থায় আব্দুল্লাহ্’কে।দ্রুত তাকে সবটা বলতেই আব্দুল্লাহ্ শুকনো ঢোক গিলে বলে,”শানবাবার সর্দি জ্বরের মাত্রা অনেক বেশি হয় মা।খুব কাহিল করে ফেলে ওকে।”
“চাচা আগে চলুন “,পাখি দ্বিতীয় বারের মতো তাড়া দেয়।
দুজনেই ধরাধরি করে অনেক কষ্টে শানকে ওর ঘর অবধি নিয়ে যায়।বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পাখি বলে,”চাচা এবার কী করব?কি মেডিসিন লাগে উনার কিছুই তো জানি না।আর ওনাকে অনেক বেশি দূর্বল লাগছে তো।কি হবে এখন”
পাখির উৎকণ্ঠভাব দেখে রাহেলার সেদিনের কথাগুলো আব্দুল্লাহ্’কে প্রথমবার ভাবতে বাধ্য করে।
“চাচা!কি করব?”,আব্দুল্লাহ্’র হেলদোল না দেখে আবার বলে পাখি।
আব্দুল্লাহ্ শান্তভঙ্গিতে পাখির দিকে চেয়ে বলে,”তুমি শানবাবার কাছে একটু থাকো আমি ফার্মাসিতে বলে ঔষধ নিয়ে আসি”
দূঃচিন্তা ভরা চোখ মুখ নিয়ে পাখি সম্মতি জানিয়ে মাথাটা একটু হালায়।
“চাচা দুইটা এলার্জর ট্যাবলেট আনতে পারবেন!”,অসহায়ের মতো মুখটা করে বলে পাখি।
“আনতেছি মা”,বলেই আব্দুল্লাহ চলে যায়।
এদিকে পাখি শানের ঘরের মেঝেতে পায়চারী করছে আর নিজের শরীর মনের সাথে যুদ্ধ করে চলছে।
“জ্বরে তো মাথায় পানি দিতে হয়।রিলিফ মেলে।সেটা কি করব? “,ভাবতে থাকে পাখি।ব্যাস যে’ই ভাবা সে’ই কাজ।পাখি শানের ওয়াশরুম থেকে বালতি ভরে পানি এনে বিছানার পাশে রাখে।মাথার নিচে বালিশের উপরে মোটা তোয়ালেটা বিছিয়ে খুব কষ্টে শানকে বালিশের উপর নিয়ে আসে।এরপর ঝিরঝির করে মাথায় পানি ঢালতে থাকে।বালতির পানি কয়েকবার পাল্টিয়ে এনে পাখি একই প্রক্রিয়ায় শানের মাথায় ঢালতে থাকে।
গা শিউড়ে কেপে ওঠে শান।পাখি তৎক্ষনাৎ পানি দেয়া বন্ধ করে শানের গায়ে মোটা ব্ল্যাঙ্কেট টা ছড়িয়ে দেয়।
খানিক পরে ধীরেধীরে পিটপিট করে চোখ খোলে শান।রক্তবর্ণ ধারন করা চোখ দুটো পাখির উপর গিয়ে নিবদ্ধ হয়।কিন্তু বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারে না।চোখের মনি থরথর করে কেপে ওঠে শানের।ব্ল্যাঙ্কেট টা শক্ত করে জড়িয়ে একদম তার ভিতরে ঢুকে পরে শান।
পাখি সন্তর্পনে ব্ল্যাঙ্কেট টা টেনে বলে, “আব্দুল্লাহ্ চাচা মেডিসিন আনতে গেছে।আপনি কিছু খেয়ে মেডিসিন টা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন ”
শান বসে যাওয়া গলায় বলে,”মেডিসিন কেন আনতে গেছে।আমি কি বলেছি একবারও? লাগবে?”,
পাখি বিরক্তি নিয়ে বলে,”আপনি সত্যিই একজন ডাক্তার তো!”,
“কোন সন্দেহ?”,কাপাকাপা গলায় ফিরতি প্রশ্ন করে শান
পাখি কিছু না বলে দ্রুত ঘর থেকে বেড়িয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরে।ভালো করে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসে।ততোক্ষনে বাহিরে বেড়িয়ে এসে বুঝতে পারে আব্দুল্লাহ্ ঔষধ নিয়ে চলে এসেছে।নিজের এলার্জির ঔষধটা দ্রুত মুখে দিয়ে পাখি শানের রুমে একবার উকি দেয়। দেখে শান তখনো ব্ল্যাঙ্কেটের নিচে। এই সুযোগে রান্নাঘরে গিয়ে শানের জন্যে সামান্য স্যুপ তৈরী করে নেয় পাখি;সাথে কিছু নাস্তার।ট্রে সাজিয়ে শানের ঘরে ঢুকে সেগুলো সাইড টেবিলে রাখে পাখি।এরপর ক্ষীণস্বরে ডাক দেয় শান।
একরাশ বিরক্তি নিয়ে শান চোখ মুখ কুচকে ফুলে।ঘুম জড়ানো অসুস্থ্য কন্ঠে বলে,”কি সমস্যা?”
“উঠুন স্যুপ খেয়ে মেডিসিন খেয়ে নিন”,সংকোচে জড়িয়ে আসা কন্ঠে বলে পাখি।শানের শরীরে সামান্যতম শক্তিটুকুও নেই যে উঠে বসবে।শোয়া অবস্থা থেকেই বলে,”আমি উঠতে পারব না।”
পাখি বিপাকে পরে যায়।কারণ ঘরে সে ছাড়া কেউ নেই।আব্দুল্লাহ ঔষধ দিয়ে কি একটা জরুরী কাজে বাহিরে চলে যায়। পাখি কী করবে ভেবে পায় না;সংকোচে চুপসে যায়। আগপিছ না ভেবে শানকে ধরে উঠানোর চেষ্টা করে।
চমকে চোখের পাতা খুলে শান পাখির দিকে তাকায়।সদ্য গোসল নেয়া এক স্নিগ্ধ নারী।যার গা দিয়ে এখনো সাবানের কড়া সুগন্ধ যায় নি।এই সুগন্ধ বিপরীত মেরুর যেকোন ব্যক্তিত্বকে ঘায়েল করার ক্ষমতা রাখে।
“কি, কি করছো?”,থতমত খেয়ে শান প্রশ্ন করে।আপনাআপনি বিব্রতভাব চলে আসে পাখির চোখে মুখে।চোখ নামিয়ে শান্তস্বরে বলে,”উঠার চেষ্টা করুন।আপনার মেডিসিন নিতে হবে।শরীর অনেক দূর্বল আপনার”
শান পূনরায় চোখ বন্ধ করে আগের মতোই শুয়ে থাকে।পাখির বেশ বিরক্ত লাগছে এবার।
“আপনার সাথে এরকম নাটক করার সময় আমার নাই।উঠুন। আমার কাজ আছে অনেক”
পাখির কথায় শান ধীরেধীরে উঠে আধশোয়া হয়ে বসে বলে,”মেডিসিন গুলো দেখি?”,
“দেখি মানে?আগে কিছু খেতে হবে তারপর মেডিসিন।খালিপেটে মেডিসিন না”,পাখি হন্তদন্ত হয়ে বলে।
শান চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ এনে বলে,”অতিরিক্ত বলো কেন।যা চাইছি দাও”,
পাখি আর কোন কথা না বলে মেডিসিন গুলো এগিয়ে দেয়।শান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বলে,”আমিও একজন ডাক্তার। ভুলে যেও না”
এরপর আবার সাইড টেবিলে সেগুলো রেখে দেয় শান।গা কেঁপে কেঁপে উঠছে বার বার।পাখি গরম স্যুপের বাটিটা শানে হাতে দেয়।দূর্বল হাতে সেটা নেয় শান।কাপা কাপা হাতে চামুচের স্যুপটা মুখে দিতেই গড়িয়ে পরে ব্ল্যাঙ্কেটের উপর।দুজন দুজনের মুখের দিকে তাকায়।
পাখির লাল চোখের দিকে বেশিক্ষন চেয়ে থাকতে পারে না পাখি।দ্রুত চোখ সরিয়ে স্যুপের বাটিটা শানের থেকে নিয়ে চামুচে নাড়াচাড়া করে কিন্তু শানের মুখের সামনে দেয়ার মতো অসাধ্যটা সাধন করতে পারে না।শান বুঝতে পেরে বলে,”হাআআ”
পাখি মাথা তুলে খুব সাবধানে বিব্রত হয়ে শানকে স্যুপটা খাইয়ে দেয়।এরপর সামান্য কিছু নাস্তা খাইয়ে দেয়।
পুরো টা সময় শান স্থীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো পাখির দিকে।যেটা পাখির নজর এড়ায় নি।খাওয়া শেষে শানকে মেডিসিন গুলো ধরিয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় পাখি..
চলবে…..
চলবে…..
চলবে….