#আড়ালে_অনুভবে
#সাদিয়া_আফরিন_প্রতিভা
#পর্বঃ১৫
প্রতিদিনের মতো আজও সুপ্তি আর নিশাত এর সঙ্গে ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে গল্প করছে প্রভা।কিন্তু তার নজর আসে পাশে যাচ্ছে বারবার।প্রতিদিনের রুটিন অনুযায়ি নিরব এখানে আসবে তার সঙ্গে কথা বলার জন্য কিন্তু প্রভা তাকে পাত্তা না দিয়ে চলে যাবে এখান থেকে,আড়ালে দাঁড়িয়ে নিরব এর উদাস মুখখানা দেখে মনে মনে আনন্দ পাবে সে।
কিন্তু আজ সেই রুটিন ভেঙে গেলো।নিরব এলোনা,কেনো জানিনা প্রভার চিন্তা হতে লাগলো।গতকাল যখন এসেছিলো তখন কেমন যেনো মুখটা শুকনো লাগছিলো তবে তাতে আর পাত্তা দেয়নি প্রভা।
গত এক মাস ধরে এমন ই চলে আসছে।নিরব শত চেষ্টা করেও কথা বলতে পারেনি প্রভার সাথে।
সেদিন রাতে নিরব ঐ কথা বলার পর প্রভা হো হো করে হেসে ওঠে।এই হাসির কারণ না বুঝতে পেরে নিরব হাত খানিকটা আলগা করে দেয়।
নিরব:তুমি হাসছো?
প্রভা এবার হাসি থামিয়ে নিজের কাধ থেকে নিরব এর হাত সরিয়ে দেয়।
প্রভা:এমন হাসির কথা শুনলে কেই বা না হেসে থাকতে পারে মিঃ নিরব?
নিরব:হাসির কথা?তোমার কাছে এটা হাসির কথা মনে হয়?
প্রভা:হ্যা আমার কাছে হাসির কথাই মনে হয়। আপনি আমায় কি ভাবেন হ্যা?আমি কি কোনো খেলনা?আপনার খেলার পুতুল আমি?যখন খুশি অপমান করবেন আবার যখন খুশি হুমকি দিয়ে ভালোবাসা আদায় করে নিতে চাইবেন?হা হা হা, আপনি কি ভেবেছেন?মুভির হিরোর মতো আমার সামনে এসে এসব ডায়লোগ দেবেন আর আমিও সুড়সুড় করে আপনাকে মেনে নেবো।কি তাইতো?
তবে শুনে রাখুন নিরব,হ্যা আপনাকে আমি ভালো বেসেছিলাম।তবে এখন আর বাসিনা,আর নাই বা পরবর্তিতে কখনো বাসতে পারবো।আপনার এসব ডায়লোগ অন্য কাউকে বলুন গিয়ে কিন্তু আমাকে বলতে আসবেন না।
হ্যা মেনে নিলাম আপনি আপনার ফ্রেন্ড এর জন্য এসব অভিনয় করেছেন।তাতে আমি কিচ্ছু বলছিনা বরং আপনি দুজন মানুষকে আবারো এক করে দিয়ে খুব ভালো কাজ করেছেন।কিন্তু আপনি এছাড়াও আমায় কি কি বলেছেন তা কি ভুলে গেছেন?যদি ভুলেও থাকেন তাহলে বলে দেই আমি কিন্তু ভুলিনি।আপনার কি আমাকে এতই নির্লজ্জ মনে হয়?আমার কোনো সম্মান নেই, আমি একজন আত্মমর্যাদাহীন মেয়ে? কিছু না ভেবেই সেদিন আপনি আমার চরিত্রে আঙুল তুললেন।বলেই দিলেন,আমার মতো মেয়ে জাস্ট ফ্রেন্ডশিপ কে ভালোবাসা ভেবে নেয়?এই একটা লাইন যে কতটা আঘাত করতে পারে তার কোনো ধারণা আছে আপনার?না নেই,আপনি বুঝবেন না এসব।আর আমি বোঝাতেও চাইনা।
শুধু এটুকু জেনে রাখুন,আপনার মতো একজন মানুষকে আমি কখনো মেনে নেবোনা,কখনো না।
কথাটা বলেই সেখান থেকে দ্রুতগতিতে হাটা শুরু করে প্রভা।কিছুদুর গিয়েই একটা রিক্সায় উঠে বসে।নিরব বারবার পিছন থেকে বলছিলো, “দিয়া দাড়াও,আমার কথাটা শোনো প্লিজ,আমি ওভাবে তোমায় হার্ট করতে চাইনি দিয়াপাখি।”
কিন্তু প্রভা কিছুতেই কান দেয়না।রিক্সায় উঠে চলে আসে হোস্টেল এ।সেদিনের পর থেকে এমন ভাবেই চলছে।একদিন নিরব জোড় করে প্রভার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে প্রভা ঠাস করে চড় মেরেছিলো ওকে।পরে অবশ্য নিজের ও খারাপ লেগেছে।তবুও সে নিজের সিদ্ধান্তে অটুট।
নিশাত:এই প্রভা আসেপাশে কি দেখছিস?
নিশাত এর ডাকে ঘোর থেকে বেড়িয়ে এলো প্রভা। প্রভা:ক কই কিছু না তো।
নিশাত:বাই দা ওয়ে,নিরব ভাইয়াকে দেখলাম না আজ।আসেনি নাকি আজ?
সুপ্তি: আসার মতো অবস্থ্যায় থাকলে তো আসবে।
প্রভা:মানে?কি হয়েছে ওনার?
সুপ্তি:তুই এতো জেনে কি করবি?তুই কি আর ওনাকে নিয়ে ভাবিস?
প্রভা:সুপু ফাজলামো না করে বল কি হয়েছে ওনার?
সুপ্তি:দু দিন ধরে জ্বর।ঠিকমতো খাওয়া দাওয়াও করে না।কাল তো জ্বর নিয়েই এসেছিলো।পরে অঙ্কিত জোড় করে বাড়িতে নিয়ে যায়।আজও খুব জেদ করছিলো আসার জন্য কিন্তু সেই শক্তি থাকলে তো আসবে।বিছানা থেকে দাড়াতে পর্যন্ত পারে না।অঙ্কিত কাল রাতেওর সঙ্গেই ছিলো ওর বাড়িতে।হাহ,ভাইয়া অসুস্থ হলেও কি তার দেখাশোনা করার মতো কেউ আছে?আঙ্কেল তো তার বিজনেস নিয়েই ব্যাস্ত।ছেলেকে নিয়ে তার ভাবার সময় কোথায়?
নিশাত:আর আন্টি?
সুপ্তি:ঐ শয়তান মহিলার নাম তুই আমার সামনে নিবিনা।যে মা নিজের ছয় বছরের ছেলেকে রেখে অন্য একজনকে বিয়ে করতে পারে সে মা নামের কলঙ্ক।
প্রভা:উনি এখন কেমন আছেন সুপ্তি?(মাথা নিচু করে শান্ত গলায় বললো)
সুপ্তি:বললাম না তোর জানার দরকার ন..
প্রভা:আমাকে একবার ওনার বাড়িতে নিয়ে যাবি সুপ্তি?
সুপ্তি:তুই যাবি? (ভ্রু কুচকে বলে)
প্রভা:না গেলে তোকে বলতাম কেনো?
সুপ্তি:(মনে মনে খুব খুশি হয়) ঠিক আছে,আজকে আর একটা ক্লাস ই বাকি আছে।তারপর দুজন একসাথেই যাবো।
।।
রোদ্দুর:প্লিজ জান এখন তো কান্না থামাও।দেখো কান ধরছি আমি আর কখনো এমন হবেনা।
রোদেলা:এএএএএএএএ,তুমি আমাকে ধমক দিয়েছো।এএএএএএ..
রোদ্দুর:তো আমি কি করবো জান?দেখো আমাদের বেবির তো খিদে পেয়েছে তাই না?আর এখন যদি তুমি খাবার টা না খাও তাহলে কি করে চলবে?তাই তো আমি ধমক দিলাম,এটুকুতে কাদছো কেনো তুমি!
রোদেলা:আ আমি তো কাদছি না।বেবি কাদছে। ওর তো এখন একটুও খেতে ইচ্ছে করছেনা। তার উপর তুমি ওকে বকা দিলে।তাই তো খুব কাঁদছে।
রোদ্দুর এবার রোদেলার পেটে হাত দিয়ে তার উপর কান পেতে বলে,
রোদ্দুর: তাই বুঝি!আমার মামনি আমার উপর রাগ করেছে?সরি মামনি,আর কেদোনা প্লিজ। খাবার টা খেয়ে নাও।
রোদেলা:এই এই কি বললে তুমি?মামনি না বাবাই বলো।আমার ছেলেই হবে।
রোদ্দুর:হাহ,বললেই হলো নাকি?আমার একটা ছোট্ট রোদেলা চাই।
রোদেলা:মোটেই না।তুমি মিলিয়ে নিও আমার ছেলেই হবে হুম।কিন্তু সে মোটেই তার বাবার মতো হবে না।
রোদ্দুর:কেনো বলো তো?
রোদেলা:কারণ ওর বাবা শুধু ওর মাম্মা কে কষ্ট দেয়।
রোদ্দুর:তাই বুঝি?
রোদেলা:হুম তাই
রোদ্দুর:তাহলে যেই মানুষটা তোমায় এত্ত কষ্ট দেয় সেই মানুষটাকেই এতো ভালোবাসো কেনো?
রোদেলা এবার রোদ্দুর এর বুকে মাথা রেখে মুচকি হাসে।
রোদেলা:কারণ তার দেওয়া কষ্ট ও আমার কাছে সুখের,আনন্দের।কারণ সেই মানুষটাই তো আমার কাছে সবচেয়ে স্পেশাল।
_______🌼
এক বিশাল বাড়িতে প্রবেশ করলো প্রভা আর সুপ্তি।প্রভা শুধু চারিদিকে তাকিয়ে দেখে যাচ্ছে। এতো বড় বাড়িতে সাধারণত জয়েন্ট ফ্যামিলিরাই থাকে কিন্তু এই বাড়িতে কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না।আসার সময় বাড়ির পাশেই একটা বাগান দেখেছিলো,তার পাশেই ছোট্ট সুইমিংপুল ও আছে।বাহিরে থেকে দেখতে রাজপ্রসাদ এর চেয়ে কোনো অংশে কম না।
চারিপাশ দেখতে দেখতেই হঠাত সামনে একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা এসে দাড়ালো।মহিলাটি প্রভা কে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো একবার।
মহিলা:আরে ম্যাডাম আফনে!
প্রভা:আ আপনি আমাকে চেনেন?
মহিলা:হ চিনি তো ছোডো সাহেভ এর ঘড় পরিষ্কার করতে যাইয়া একদিন আফনের ছবি দেখছিলাম
সুপ্তি:ছোট সাহেব মানে?
মহিলা:মানে নিরব বাবার।
অঙ্কিত:আরে প্রভা তুই এখানে? (সিড়ি থেকে নামতে নামতে বললো অঙ্কিত)
প্রভা:নিশ্চুপ
সুপ্তি:নিরব ভাইয়া সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। ও কেমন আছে এখন?
অঙ্কিত:জ্বর তো কিছুতেই নামছে না।ডক্টর এর দেওয়া মেডিসিন তো খাওয়ালাম।তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না।জ্বরের ঘোরে কিসব জেনো বলছে, সেটাও বুঝিতে পারছি না।
প্রভা:ভ ভাইয়া আমাকে একটু ওনার ঘর টা দেখিয়ে দেবে প্লিজ
অঙ্কিত:চল আমি ই নিয়ে যাচ্ছি।
সুপ্তি:তার কোনো দরকার নেই।তুমি ওকে বলে দাও তাতেই হবে। (অঙ্কিত কে চিমটি দিয়ে বলে)
অঙ্কিত:আউচ..ও ঐ যে উপরের সাইড এর রুম টাই নির এর।
প্রভা আর এক সেকেন্ড ও না দাঁড়িয়ে চলে যায় উপরে।
অঙ্কিত:এই তুমি আমায় চিমটি দিলে কেনো?
সুপ্তি:আরে গর্ধব এতটুকু কমনসেন্স নেই?নিরব ভাইয়ার জন্য আসল মেডিসিন এসে গেছে।এখন আর অন্য কোনো মেডিসিন এর দরকার নেই।বুঝলে!
,,,
নিরব এর রুমের সামনে আসতেই পা আটকে গেলো প্রভার।বিছানায় শুয়ে আছে নিরব,চোখ দুটো বন্ধ।বোধ হয় ঘুমোচ্ছে।ঘুমের মাঝেও বারবার কেপে উঠছে সে।দু দিনের জ্বরেই এমন অবস্থা হয়েছে!কেউ দেখে বুঝতেই পারবে না ইনি ই সেই জাতির ক্রাশ নিরব।
কাপা কাপা পায়ে ভিতরে প্রবেশ করলো প্রভা। বেড এর সামনে গিয়ে নিরব এর কপালের দিকে হাত বারালো,কিছুটা সামনে এগিয়ে আবারো উঠিয়ে নিলো হাতটা।পরক্ষনে আবারো হাত বাড়িয়ে নিরব এর কপাল স্পর্শ করলো।সঙ্গে সঙ্গেই চোখ বড়বড় হয়ে গেলো তার।গা জ্বরে পুরে যাচ্ছে।হাত টা দ্রুত সরিয়ে নিলো প্রভা।দ্রুত রান্নাঘর এ গিয়ে একটা বাটিতে পানি নিয়ে এলো। রুমে এসে বাটি টা বিছানার পাশে রেখে নিজে নিরব এর মাথার পাশে বসে পরলো।কিন্তু জলপট্টি দেবে কি দিয়ে।পরিশেষে কিছু খুজে না পেয়ে নিজের ওড়নার সাইড কিছুটা ভিজিয়ে ধিরেধিরে নিরব এর কপালে ছোঁয়ায়।হুট করে ঠান্ডা কিছু অনুভব করতেই পিটপিট করে চোখ খোলে নিরব।চোখ খোলা মাত্রই এতো জ্বরের মাঝেও ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে নিরব এর। সে জানতো প্রভা অবশ্যই আসবে,উপরে উপরে যতই রাগ দেখাক না কেনো।
নিরব:দ দিয়া.. (কাপা কাপা গলায় বলে নিরব)
প্রভা চোখ বন্ধ করে নেয়।এই ডাক!কি আছে এই ডাকের মধ্যে?যেনো সারাদিন এই ডাক শুনতে ইচ্ছে করে।
চোখ খুলে নিরব এর দিকে তাকাতেই দেখে সে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।প্রভা এবার দ্রুতগতিতে বিছাটা থেকে উঠে ফলে যেতে নেয়।নিরব তখনি পিছন থেকে প্রভার হাত টেনে ধরে।যদিও সেই শক্তিটুকু নেই শরীরে।
নিরব:যেওনা দিয়াপাখি।প্লিজ,,একবার আমার কথাটা শোনো।আমি সেদিন তোমাকে ওভাবে হার্ট করতে চাইনি।ভেবেছিলাম তোমায় একটু জেলাস ফিল করাবো,তাই ওসবকথা বলেছিলাম।কিন্তু তোমার চরিত্র নিয়ে কথা বলার কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না আমার।আমি মানছি আমি ভুল করেছি, তবে সেই ভুলের শাস্তি এতো কঠিনভাবে দিওনা প্লিজ।আর সজ্য করতে পারছিনা আমি।এতো এভয়েড আর নিতে পারছি না আমি।তুমি আমায় শাস্তি দাও।যা বলবে তাই করবো আমি।কিন্তু এভাবে এগনোর করোনা প্লিজ।পারছিনা আমি..
প্রভা এবার ফিরে এসে আগের জায়গায় বসে। নিজের ওড়নাটা আবারো বাটির পানিতে ভেজাতে লাগে।
নিরব:দিয়াপাখি!কিছু তো বলো..
প্রভা এবার গম্ভির কণ্ঠে বলে,
প্রভা:অবশ্যই পাবেন শাস্তি।কিন্তু এভাবে অসুস্থ হয়ে শুয়ে থাকলে শাস্তি গ্রহণ করবেন কি করে শুনি?
নিরব:তার মানে তুমি..
নিরব কে আর কিছু বলার সুযোগ দেয় না প্রভা। নিরব এর দিকে খানিকটা ঝুকে ঠোটের উপর আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়।
প্রভা:হুশশশ..সেদিন তো খুব সাহস করে বলেছিলেন আমি চাই কিংবা না চাই আমাকে নাকি আপনার সঙ্গেই থাকতে হবে।তাহলে এখন কোথায় গেলো সেই সাহস?
নিরব:এটা কি সপ্ন নাকি বাস্তব? (চোখ বন্ধ করে কাপাকাপা গলায় বললো নিরব)
প্রভা এবার আরো খানিকটা ঝুকে গেলো নিরব এর দিকে।হাত দিয়ে নিরব এর চোখ চেপে ধরে আলতো করে অধর ছোয়ালো তার কপালে।
ব্যাস,এতেই যেনো নিরব এর মাথার সমস্ত ভার,শরীরের সকল ক্লান্তি এক নিমেষেই দূর হয়ে গেলো।প্রভা এবার নিরব এর কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
প্রভা:বুঝেছেন?এটা সপ্ন নাকি বাস্তব।এখন আরো শুনুন।সেদিন আপনি বলেছেন আজ আমি বলছি,আপনার দিয়াপাখির থেকে এতো সহজে মুক্তি পাচ্ছেন না মিঃ চঞ্চল।
#চলবে
[