★কারো পায়ের শব্দ শুনে থমকে দাঁড়ালো ইফতি। শুকনো ঢোক গিলে আশে পাশে তাকাতে থাকে। পেছনে ফেরার সাধ্য বা সাহস কোনোটাই তাই নেই। কারণ যেখানে সে দাঁড়িয়ে আছে সেটা বাঘের গুহার চেয়ে কম না। আর বাঘের গুহায় তো বাঘেরই আগমন হবে। ইফতি নিজের এক হাত দিয়ে অপর হাতের তালু মালিশ করতে থাকে। পায়ের শব্দ ক্রমশই এগিয়ে আসছে। বার বার চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিচ্ছে ইফতি। কান থেকে সে ফোন সরিয়ে নিয়েছে অনেক আগেই। ফোনের অপরপাশে থাকা ব্যাক্তিকে শেষ কথার উত্তর এখনো দেয় নি ইফতি। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো এখনো কল চলছে। সাথে সাথে কেটে দিলো। কথা বলতে বলতে এমন একটা জায়গায় এসে পড়বে ইফতি ভাবতেও পারে নি। এই বুঝি তাকে কেউ জোরে ধমক দিলো।
ইবাদ কান থেকে ফোন সরিয়ে সামনে থাকা যুবতীর দিকে তাকালো। ঘন কেশরাশি পিঠের উপর ছড়িয়ে আছে। কিন্তু এই মেয়ে এখানে কি করছে? তার এই রুমে তো কেউ আসে না। নিজের অবসর সময় ইবাদ এই রুমেই কাটায়। তাই ইবাদের দাদু এই রুমে কাউকেই আসতে দেয় না। আর বাড়ির কেউ এই রুমে আসেও না। ইবাদ ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মুখের সামনে এনে হালকা কাশি দিলো। কাশির আওয়াজ শুনে ইফতি দু’হাতে নিজের কামিজের পাশ খামচে ধরলো। এই বাড়িতে আসার পর থেকে তাকে বার বার নিষেধ করা হয়েছে দোতালার রুমটায় যেন না যায়। কিন্তু সে কি করলো? মস্ত বড় ভুলটাই তার করতে হলো। কত সুন্দর কথা বলছিলো ফোনে। এখন কি হবে? ইবাদ দু’হাত প্যান্টের পকেটে রেখে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
–হু আর ইউ?
ইবাদের কন্ঠস্বর কানে পৌঁছাতেই ইফতি চোখ খুলে নিলো। চট করে পেছনে ফিরে ঘুরে দাঁড়ায়। ইবাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ইবাদের বাদামী রঙের চোখের মণির দিকে তাকাতেই ইফতি কেঁপে উঠলো। নেত্রমণি মুহুর্তেই নত করে মৃদুস্বরে বলল,
—–আমি আসলে ভুল করে এদিকটা চলে এসেছি খেয়াল করি নি।
ইফতির কথা শুনে ইবাদ আরো অবাক হলো। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সরে দাঁড়ালো ইবাদ। সোফায় বসতে বসতে বলল,
–রুম থেকে বের হতে কি ইনভাইটেশন কার্ড দিবো?
ইবাদের কথা শুনে ইফতি ঘোর অপমান বোধ করলো। লম্বা শ্বাস নিয়ে ইফতি হনহনিয়ে বেরিয়ে আসে রুম থেকে। নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে নিজেকে হাজার কয়েক গালি ইফতি শুনিয়ে দিলো। কোন দুঃখে যে এই বাড়িতে এসেছিলো আল্লাহ জানে। বাড়িটি ইফতির মায়ের মামার বাড়ি। ইফতি মায়ের জোরাজোরি তে এই বাড়িতে এসেছে। এই প্রথমবার কারো বাড়িতে এসে ইফতি চরমভাবে অপমানিত হলো। অবশ্য তার নিজেরও দোষ ছিলো। কোন দুঃখে যে কথা বলতে বলতে দোতালায় চলে গেছিলো কে জানে? রুমে এসে ফোনের দিকে তাকাতেই দেখলো আধাঘন্টা পার হয়ে গেছে। ইফতি কল লিস্টে গিয়ে সবার প্রথমে থাকা নাম্বারটিতে কল দিলো। রিং হতেই হাসি মুখে ফোন কানের পাশে ধরলো।
দিদার মাহসান সবে মাত্র রুম থেকে এসে বসার ঘরে চেয়ারে বসলেন। মারিয়াম এসে সামনে দাঁড়াতেই চশমা হাত দিয়ে ঠিক করে মারিয়াম এর দিকে তাকালেন।
—দাদাজান চা দেইই? খাবা?
—না রে আমি এখন চা খাবো না। ইবাদ এসেছে?
—হ্যাঁ দাদাজান ভাইসাব তো সেই কখন আইসা পরছে।
—-ওহ্ খেতে দিয়েছিস কিছু? নাকি না খেয়েই বসে আছে ও।
–কি যে বলো না দাদাজান? ভাইসাব তোমারে ছাড়া কি খায়? অনেক জোর করসি খায় নায়।
—যা ডেকে নিয়ে আয়। একসাথেই খাবো।
—আইচ্ছা।
মারিয়াম চলে যেতে পা বাড়ালেই দিদার মাহসান পিছু ডাকলেন,
–হ্যাঁ রে মারু?
—জি দাদাজান?
—ইফতি কে ডেকে নিস। মেয়েটা কবে যে রুমে ঢুকেছে আর বেরই হলো না।
—আচ্ছা।
মারিয়াম চলে গেল। দিদার মাহসান সোজা হয়ে বসলেন।
ইবাদ, ইফতি কে নিয়ে খেতে বসেছে দিদার মাহসান। বিশাল এই বাড়িতে ইবাদ আর দিদার মাহসানই আছে। আর আছে দুজন মেয়ে যাদের দিদার মাহসান ছোট থেকে মানুষ করেছে। বাড়ির সমস্ত কাজ কর্ম যারা নিজ হাতে করে। একটা এক্সিডেন্টে দিদার মাহসানের পুরো পরিবার মারা যান। ভাগ্যক্রমে ইবাদই বেঁচে গেল। ইবাদের বয়স তখন ৩বছর। পুরো পরিবার কে হারিয়ে নাতি কে বুকে নিয়ে তিনি ২৭টা বছর পার করে দিয়েছেন। ইবাদ পেশায় ডাক্তার। নিজের দাদা আর মারিয়াম ছাড়া কারো সাথেই প্রয়োজন ছাড়া এই ব্যাক্তি কথা বলে না। মারিয়াম ইবাদের সবকিছুর খেয়াল রাখে। ভাইসাব বলতেই মারিয়ামের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। খাওয়ার টেবিলে ইফতির দিকে ইবাদ একবারও তাকালো না। দিদার মাহসান খাওয়া শেষে বলে উঠলেন,
—–এইযে ডাক্তার বাবু, ও হলো আমার নাতনী। আমার বোনের মেয়ের মেয়ে। অনেক জোর করে আমি ওকে এখানে এনেছি। ও কারো বাসায় নাকি যেতে চায় না। নাতনী আমার বড্ড লাজুক। এখানে যতদিন আছে ততদিন আশপাশে ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্ব তোমার। বুঝলে!?
দিদার মাহসানের কথা শুনে ইবাদ চোখ তুলে তাকালো।
দিদার মাহসান বলল,
—ওর নাম ইফরা এহতেশাম হীর।
—-বুঝলাম। বাড়ির নিয়ম কানুন তোমার নাতনী কে বুঝিয়ে দিও। হুট হাট মানুষের ঘরে চলে যাওয়ার অভ্যাস আছে তার। কথাটা বলেই ইবাদ রুমাল দিয়ে হাত মুছতে মুছতে উঠে চলে গেল। ইবাদ চলে যেতেই ইফতি হাতে থাকা চামচ প্লেটে জোর করে রাখলো।
—-নানাজান, এমন অসভ্য একটা ছেলে এই পরিবারে কি করে হলো? আপনাকে দেখে মোটেও তেমন লাগে না।
—-দিদিভাই, ও একটু এমন। তুই পিটিয়ে সোজা করে নিস।
কথাটা বলেই দিদার মাহসান উঠে চলে গেলেন। ইফতি হতভম্ব হয়ে গেল। কি বলে গেল নানাজান সেটা কিছুতেই বুঝতে পারলো না ইফতি।
★গভীর রাত। বারান্দায় বসে বসে ফোনে কথা বলছে ইবাদ। বাম হাতে ফোন কানে ধরে ডান হাতে মাথার চুল আস্তে আস্তে টেনে যাচ্ছে। ফোনের ওপাশে থাকা রমণীর বলা কথা শুনে ফিক করে হেঁসে দিলো ইবাদ। নিচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে বলল,
—সাহেবান আপনি ভাবলেন কি করে আপনাকে আমি কোনোদিন ভুলে যাবো? আমাদের জীবনে এমন কিছু মানুষ থাকে যাদের আমরা চাইলেও ভুলতে পারি না। আপনি আমার সেই কিছু মানুষের একজন। আমার সাহেবান কে আমি ভুলবো না। ইবাদের ঠান্ডা, শীতল, মোহময় কন্ঠস্বর অপরপাশে থাকা রমণীর ঠোঁটের হাসি প্রশস্ত করলো। গাড় হেঁসে বলল,
—জনাব আমার ঘুম পাচ্ছে।
—ওকে, আপনি ঘুমান।
–চলে যাবেন?
—না সাহেবান। আপনার ঘুম না আসা পর্যন্ত আছি আমি। আপনি ঘুমোন। আপনার ঘুম এলে আমি লাইন কেটে দেব।
—থ্যাংক ইউ!!
—–নট এক্সেপ্টেড! হালকা হেঁসে বলল ইবাদ।
—কেন? সামান্য থ্যাংক ইউ আমি গ্রহণ করি না।
—ঠিক আছে জমা থাকলো তবে।
—তাই হোক।
—–হুম! বলেই বালিশে মুখ গুঁজে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
হন্তদন্ত হয়ে বাসা থেকে বের হতে গিয়েই ইফতির সাথে ধাক্কা খেল ইবাদ। হাতে থাকা ফোন পড়ে যেতেই রাগী দৃষ্টিতে ইফতির দিকে তাকালো। ইফতি তাড়াতাড়ি ফোন তুলে ইবাদের দিকে এগিয়ে দিলো,
_—-দুঃখিত আমি……
—আই নো আপনি খেয়াল করেন নি! এই এক বাহানা আর কত? দেখে শুনে চলুন, নাহলে ডাক্তার দেখিয়ে চশমা নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেব আমি।
ইবাদের কথা শুনে ইফতির গা জ্বলে উঠলো। এসেছে পর্যন্ত এই লোক এমন করছে। চোখে বালি পড়লে তা সহ্য করে নেবে এই লোক কিন্তু ইফতিকে সহ্য করছে না। ইফতি কি তার ভাতের পাতে পড়ে রয়েছে? কেন এই লোক কথায় কথায় এমন করবে? ইফতি কে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইবাদ নিজের দিকে তাকালো। তারপর বলল,
—-কিছু বলবেন?
ইফতি একটু পিছিয়ে গেল। দুপাশে মাথা নাড়িয়ে বলল,
—না না কিছু বলবো না।
—তাহলে তাকিয়ে দেখছেন কি?
—না আসলে….
—-কি?
—কিছু না। ইফতি ইবাদকে এড়িয়ে ভেতরে চলে গেল। ইবাফ ইফতির যাওয়ার দিকে একবার তাকালো। তারপর গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে গেল। গাড়িতে বসে ব্লুটুথ কানেক্ট করে কল লিস্টে গিয়ে ‘সাহেবান’ নামে সেভ করা নাম্বারটিতে কল দিলো ইবাদ। দু’বার রিং হতেই ফোন রিসিভ করলো। সাথে সাথে ইবাদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো,
—-গুড মর্নিং সাহেবান।
—গুড মর্নিং জনাব।
—ঘুম কেমন হলো?
—অনেক ভালো! নাস্তা করেছেন?
—না সাহেবান আমার একটু ইমারজেন্সি আছে। আমি হসপিটালে গিয়েই খেয়ে নেব। আপনি খেয়ে নিন। কেমন?
আমি রাখছি….
—-শুনুন!
—হুম?
—খেয়ে একটা টেক্সট করে দেবেন প্লিজ।
—আপনাকে পরিবর্তন এ জীবনে করতে পারলাম না আমি।
ওপাশ থেকে মৃদু হাসির আওয়াজ শুনে ইবাদ নিজেও হাসলো। সরস গলায় বলল,
—-ইউর স্মাইল মেড মাই ডে সাহেবান।
উত্তরে কিছুই বলল না অপরপাশে থাকা রমণী।
মারিয়াম ইফতির দরজায় নক করতেই ইফতি হেঁসে ভেতরে যেতে বলল,
—–আপা অনেক বেলা হয়ে গেছে চলেন খাইবেন।
—বুবু আমার খিদে নেই। আমি একটু পর খাই?
—-ও কি কথা আপা? সকাল থেকে কিছুই তো খাইলা না। বেলা ১১টা বাজে। কবে খাইবা তুমি?
—-খিদে লাগলেই খেয়ে নেব বুবু।
—আইচ্ছা খিদা লাগলে আমারে ডাইকো। চুপচাপ বইসা থাকবা না কেমন?
—আচ্ছা। বলেই মৃদু হাসলো ইফতি।
#ইস্ক_সাহেবান
#হীর_এহতেশাম
#সূচনা_পর্ব
চলবে?
(