#ইস্ক_সাহেবান
#হীর_এহতেশাম
||পর্ব-৭||
★৪৮ঘন্টার মধ্যে একটি সুস্থ – স্বাভাবিক মানুষ কি করে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে ইবাদের জানা নেই। ডাক্তারি জীবনের এই প্রথম এমন কেস দেখে ইবাদের ভেতরটা নড়ে উঠলো। ইবাদের চোখের সামনেই একটি সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। চেহারার লাবন্য দূর হয়ে গেছে। ইফতির এমন দশা দেখে ইবাদ ভেতরে ভেতরে গুমরে মরছে। প্রাণোচ্ছল একটি মেয়ে ৪৮ঘন্টার মধ্যেই নিজের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে মানসিক রোগীদের কাতারে গিয়ে দাঁড়ালো। ইফতিকে সুস্থ করে তোলার দায়িত্ব পড়েছে ইবাদের উপর। ইফতির এমন দশায় নাহিদা বেগম ভেঙ্গে পড়েছেন। দিদার মাহসান আর জাফর এহতেশাম নাহিদা বেগম কে সামাল দিতে পারছে না। হাজার বার ভেবেও ইবাদ কুল কিনারা পেলো না। ডিপ্রেশন, মেন্টালি প্রেসারের কারণে এমন হলে অনেকদিনের প্রয়োজন। কিন্তু ইফতিকে দেখে কখনোই মনে হয় নি ইফতি ডিপ্রেশন বা মেন্টালি প্রেসারে আছে। কি থেকে কি হলো ইবাদ বুঝতেই পারছে না। বাড়িতেই ইফতির চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নার্সরা ইফতিকে সামলাতে পারছে না। ইফতির দু-হাত বেধে রেখেছে। ইবাদ নিজেকে সামলে ভেতরে প্রবেশ করলো। সাদা এপ্রোন গায়ে ইবাদ কে দেখেই ইফতি বাচ্চাদের মত একটি হাসি দিল। ইবাদ হালকা হেসে ইফতির সামনে গিয়ে বসলো। ইবাদ প্রশ্ন করার আগেই ইফতি বলল,
——আপনি ডাক্তার তাই না?
ইবাদ মাথা নেড়ে ইশারায় হ্যাঁ বললো। ইফতি ঠোঁট উলটে বলল,
—–আমাকে বেধে রেখেছে দেখুন না। আপনি তো ভালো ডাক্তার আমার হাত প্লিজ খুলে দিন। আমার অনেক ব্যাথা লাগছে। ইফতির মায়াভরা কন্ঠস্বর শুনে ইবাদের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। কোনো রোগীর সামনে ইবাদ এতটা ভেঙ্গে পড়েনি যতটা দুর্বল ইবাদ ইফতির সামনে এসে হয়ে পড়ছে। নিঃশ্বাস টেনে নিলো ইবাদ। মৃদুস্বরে বলল,
—-খুলে দেব। আই প্রমিস আমি আপনার হাতের বাধন খুলে দেব। তার আগে আমার কিছু প্রশ্ন আছে তার উত্তর দিবেন? কি দিবেন তো?
ইফতি বাচ্চাদের মত মাথা নেড়ে ইশারায় হ্যাঁ বোঝালো। ইবাদ হালকা হাসলো। নার্স কে ইশারায় নোট করতে বলে ইবাদ। তারপর ইফতিকে জিজ্ঞেস করে,
—–আপনার নাম কি?
—–আমার নাম সাহেবান। হাসি মুখে বলে ইফতি। ইফতির কথা শুনে ইবাদ চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো তার। পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাওয়ার মত একটি কথা বলেছে ইফতি। ইবাদ ঢোক গিলে আবারও জিজ্ঞেয়া করলো,
—–কি বললেন? আপনার নাম কি?
—–সাহেবান! ইফতির পালটা উত্তর শুনে ইবাদ দু-কদম পিছিয়ে গেল। এক হাতে নিজের কপাল চেপে ধরলো। নার্সকে ইশারায় ইফতিকে দেখতে বলে ইবাদ বেরিয়ে আসে। ইফতির রুমে গিয়ে ইবাদ তাড়াতাড়ি ইফতির ফোন খুঁজে বের করে। বালিশের নিচে ইফতির ফোন পেয়েও গেল। ফোন বন্ধ। ইবাদ পকেট থেকে নিজের ফোন বের করলো। ইফতির ফোন অন করে বাম হাতে ধরে ডান হাতে থাকা ইবাদের ফোন থেকে সাহেবান দিয়ে সেভ করা নাম্বারটিতে কল করলো। রিং হতেই ইফতির ফোন বেজে উঠলো। ইবাদ চমকে ইফতির ফোনের দিকে তাকালো। ফোনের স্ক্রিনে ভাসছে ‘মি. ডাক্তার ‘ নামটি। নিজের নাম্বার চিনতে ভুল হলো না ইবাদের। দম আটকে আসছে ইবাদের। নিজেকে সামলে। ইফতির ফোন থেকে নিজের ফোনে কল করতেই ‘সাহেবান’ নামটি ভেসে উঠলো। ইবাদ সাথে সাথে ইফতির ফোন নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে। ধপ করেই মাটিতে হাটু ভেঙ্গে বসে পড়ে। অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
—–আল্লাহ্!! সাথে সাথেই ইফতির আওয়াজ শুনে ইবাদ ছুটে ইফতির রুমে গেল। নার্স ইফতিকে সামলাতে পারছে না। ইবাদ ইফতির এমন দশা দেখে দূরে দাঁড়িয়ে ইফতির দিকে তাকিয়ে রইল। নার্সকে ইশারায় সরে যেতে বলে। ইবাদ ইফতির হাতের বাধন খুলে দেয়। হাতের বাধন খুলে দিতেই ইফতি কাচের গ্লাস তুলে ইবাদের দিকে ছুড়ে মারে। ইবাদের কপালে লাগতেই ইবাদ কপাল চেপে ধরে। এপ্রোনে রক্ত পড়তেই ইফতি বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো। ছুটে ইবাদের সামনে এসে দাঁড়ালো,
—–ডাক্তার আপনি ব্যাথা পেয়েছেন? খুব লেগেছে কি? ইবাদ কপাল চেপে ধরে ইফতির দিকে তাকিয়ে থাকে। ইফতি বাচ্চাদের মত কাদঁতে থাকে। ইবাদ ইফতিকে জাপটে জড়িয়ে ধরে। বুকের সাথে চেপে ধরে ইফতিকে। নার্স মাথা নিচু করে ফেলে। ইফতিকে জড়িয়ে ধরেই ইবাদ বার বার আওড়াতে থাকে,
——সরি, আম’সরি। সরি, সরি, আম’রিয়েলি ভেরি সরি।
★হাসতে হাসতে সোফায় বসে পড়ে ইরফান। একহাত কপালে ঠেকিয়ে বেসামাল হেঁসে যাচ্ছে। হাসি থামিয়ে আপনমনে বলে উঠলো,
——দিদার মাহসান, তুমি বলেছিলে ইফতি সুস্থ মানুষ। অসুস্থ মানুষের হাতে তুমি ইফতিকে তুলে দেবে না। কিন্তু ইফতি তো মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। আমিতো সুস্থ একজন মানুষ ইফতির চেয়ে সুস্থ। এবার ইফতিকে আমার হাতে তুলে দিতে তোমার কোনো আপত্তি নেই আশা করি। আমার পছন্দের জিনিস আমি আপোষে না পেলে, কি করে আদায় করতে হয় তা আমার জানা আছে। ইফতিকেই লাগবে আমার। সোজা আঙুলে যখন ঘি ওঠেনি তখন আঙুল তো বাঁকাতে তো হবেই। করে দিয়েছি আমি। হ্যাঁ আমি ইফতিকে অসুস্থ করে দিয়েছি। আমার কাছ থেকে আমার ইফতিকে আর কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। ইফতি শুধু আমার। আমার হীরামতী কে আমার কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। যে কেড়ে নেবে আমি তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেব। যে হাত বাড়াবে আমি সেই হাত ভেঙ্গে দেব। তাকে স্পর্শ করার অধিকার শুধু আমার। তাকে ভালোবাসার অধিকার শুধু আমার। ইফতি শুধু ইরফানের। শেষের কথা গুলো বলেই ইরফান কাচের সেন্টার টেবিলে ঘুষি দিলো। কাচ ভেঙ্গে ইরফানের হাতে বিধে যায়। দরদর করে গড়াতে থাকে রক্ত। ইরফানের চোখজোড়া লাল হয়ে আছে। মুহুর্তেই ভয়ংকর রুপ ধারণ করে ইরফান।
★মাটিতে হাটু ভেঙ্গে বসে পড়ে ইবাদ। মাথার উপর খোলা আসমান। জনমানবশূন্য একটি জায়গায় গাড়ি থামিয়ে ইবাদ দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে একটি ঝিলের ধারে এসে থামে। দৌঁড় থামিয়ে ঝিলের ধারেই বসে পড়ে হাটু ভেঙ্গে। দু-হাত হাটুর উপরিভাগ অংশে (রানের উপর) ঠেকিয়ে ইবাদ চিৎকার দিলো। ইবাদের গগন কাঁপানো চিৎকার শুনে আসে পাশে বসে থাকা পাখিরাও নিজেদের বাসা ছেড়ে পালিয়ে গেল। পরিবেশ নিস্তব্ধ। পর পর তিনটা চিৎকার দিয়ে ইবাদ তবেই থামলো। মাটিতে প্রচন্ড জোরে আঘাত করে ইবাদ,
——এ আমি কি করলাম? আমার চোখের সামনে থেকেও আমি কেন তাকে চিনতে পারলাম না? এত বড় ভুল আমার ধারা কি করে হয়ে গেল? কিসের ভালোবাসা এটা যদি আমি তাকে চিনতেই না পারি। আকাশের দিকে তাকিয়ে ইবাদ চিৎকার করে বলল,
—–তুমি আমার কাছ থেকে সব কেড়ে নিয়েছো। আমার মা বাবা। আমার সব কিছু কেড়ে নিয়েছো তুমি। যাকে আকড়ে ধরে আমি হাসতে শিখেছিলাম তাকেও তুমি কেড়ে নিতে চাইছো? তার দিকে তুমি কি করে হাত বাড়ালে? একটিবার ভাবলে না আমি কি করে বেঁচে থাকবো? একটিবার ভাবলে না আমি জানার পর আমার কি অবস্থা হবে? কেমন সৃষ্টিকর্তা তুমি? যে সৃষ্টির মন বোঝে না। আল্লাহ্ আমি ছোট থেকে তোমার কাছে কিছু চাইনি। কোনো মিনতি আমি করি নি। আজ করছি! হ্যাঁ আজ করছি। তুমি আমায় আমাকে আমার সাহেবান ফিরিয়ে দাও। আমি আর কোনোদিন কিছু চাইবো না প্রমিস। আই প্রমিস আমি আর কিচ্ছু চাইবো না। আমি শুধু আমার সাহেবান কে ফেরত চাই। আর সেটা তুমি আমায় দিবে। আমাকে সম্পুর্ন নিঃস্ব করে দিতে পারো না তুমি। কিছুতেই পারো না। আমার সাহেবান আমায় ফিরিয়ে দাও। আমি আজ ৩দিন তার সেই ডাক শুনি নি। আমায় মি. ডাক্তার বলে ডাকে নি আজ তিনদিন। আমি কিভাবে বেঁচে আছি একটিবার ভাবো মাবুদ। তুমি আমার সাহেবান কে সুস্থ করে দাও। তাকে কষ্ট কি দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। আমি কিছুতেই তার ট্রিটমেন্ট করতে পারবো না। তুমি একটুতো বোঝো আল্লাহ্। আমার কষ্ট হচ্ছে। আমি পারবো না….. মাটতেই শুয়ে পড়ে ইবাদ। ইবাদের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। চোখ দিয়ে ঝরছে অঝোর ধারায় পানি। ইবাদের আর্তনাদ যেন আকাশেরও মন খারাপ করে দিলো। কালো মেঘে ছেয়ে গেল আকাশ। বিকট শব্দে বিদ্যুৎ চমকে মুহুর্তের মাঝেই ভারি বৃষ্টিপাত শুরু হলো। ইবাদ মাটিতেই শুয়ে রইল। একদিকে ঝরছে ইবাদের চোখের পানি। অন্যদিকে তাল মিলিয়ে হচ্ছে বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ইবাদের চোখের পানি ধুয়ে দিলেও মনের রক্তক্ষরণ ধুয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। মাটিতে শুয়ে কাদঁতে কাদঁতে অস্ফুটস্বরে ডেকে উঠলো,
——সাহেবান!
চলবে…..?
|| কি অবস্থা সবার? আপনাদের রেসপন্স দেখে আমি মুগ্ধ😍। তাই ডাবল পার্ট দিয়েছি😁। আমিও খুশি আপনারাও খুশি😍….||