#ইস্ক_সাহেবান
#হীর_এহতেশাম
||পর্ব-১৭||
★৪মাস পর—–
ছাদে দাঁড়িয়ে আছে ইফতি। শীত চলে গেছে অনেকদিন আগেই। এখন বসন্ত মাস। ইবাদদের বাড়ির বাগানের ফুলগাছে নানানরকমের ফুল ফুটেছে। ফাল্গুন এবং চৈত্র মাস মিলেই বসন্ত মাস। শীত চলে যাওয়ার পরই বসন্তের আগমন ঘটে। এর স্থায়িত্ব থাকে গ্রীষ্ম আসার আগ পর্যন্ত।
ইবাদদের বাগানে থাকা রক্তকাঞ্চন ফুলের গাছটি নিজেই জানান দিচ্ছে এটা বসন্ত কাল। শীতের শেষেই যে ফুল ফোটা শুরু হয় তা, গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত গাছে থাকে। রক্তকাঞ্চন ফুলও বসন্তের ফুল। ফুলের সুভাস চারদিকে ছড়িয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে সেই সুভাস নিচ্ছে ইফতি। মৃদু বাতাসে উড়ছে ইফতির চুল। চুলগুলো কাধ ছাড়িয়ে নিচে নেমেছে। আসরের নামাজ শেষে ছাদে এসে দাঁড়িয়েছিল। কারো পদধ্বনি শুনে ইফতি পেছনে ফিরে তাকালো। ইবাদ কে দেখে হালকা হাসলো। ইবাদ দু’হাত পেছনে লুকিয়ে রেখেছে। এগিয়ে এসে ইফতির সামনে দাঁড়িয়ে ছোট্ট একটি হাসি দিল। আর বলল—
—-কেমন লাগছে?
—-ভালো।
—এটা আপনার জন্য। একবক্স চকলেট আর কিছু গোলাপ ইফতির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল ইবাদ। ইফতি হালকা হেঁসে হাত বাড়িয়ে ফুলগুলো আর চকলেট নিয়ে নিল।
—-এসবের দরকার ছিল না।
—–এতবড় একটা জার্নি পার করেছেন তার জন্য এইটুকু দেওয়াই যায়। আপনার আগামী দিন গুলো সুন্দর হোক। কোনো বিপদ আপনার ধারে কাছে না আসুক। দোয়া রইল!
—–এখানে দাঁড়িয়েই কী সব দোয়া করে দেবেন?
ইফতির এমন কথায় ইবাদ হেঁসে উঠলো, সাথে ইফতিও।
—-থ্যাংক ইউ!
—-কেন? ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে ইবাদ।
—-আমাকে সুস্থ করে তোলার জন্য। এতদিনে নাহলে পাগলা গারদে আমার জায়গা হতো।
—-আমার কর্তব্য ছিল। আর রইলো বাকি পাগলাগারদের কথা, তাহলে বলবো আমি নিজের ডাক্তারি পড়াটা বৃথা যেতে দিতাম? এটা হওয়ার না।
ইফতি হালকা হাসলো।
—–নিচে যাওয়া যাক। সবাই হয়তো অপেক্ষা করছে আপনার জন্য! একটু পর আন্টিরাও চলে আসবে।
—-আপনি যান আমি আসছি।
—-আচ্ছা তাড়াতাড়ি আসুন। বলেই ইবাদ চলে গেল। ইফতি ফোন বের করে কন্টাক্ট লিস্ট থেকে মি.ডাক্তার নাম্বারটি খুঁজে বের করলো। নাম্বারটি ডায়াল করে ফোন কানে ধরলো। নাম্বার বন্ধ আসছে। লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইফতি নিচে নেমে এলো।
★ইবাদ আর ইশাল বসে আছে ড্রয়িংরুমে। ইফতি এসে দাঁড়াতেই ইবাদ হাসি মুখে বলল,
—-বসুন।
ইফতি সামনের সোফায় বসে পড়লো। ইশালের দিকে তাকাতেই ইশাল ছোট্ট একটি হাসি হেঁসে বলল,
—-কেমন লাগছে?
—ঠিক আছি। আপনার কপালে এটা কী?
—-কোনটা?
—বামপাশে।
ইশাল কাটা জায়গায় হাত রেখে ইবাদের দিকে তাকালো। ইবাদ চটজলদি বলে উঠল।
—-একটা এক্সিডেন্টে একটু আঘাত লেগেছিলো ওর।
—–ওহ্।
—-এক্সিডেন্ট টা সামনেই বসে আছে। বিড়বিড় করে বলে ইশাল। তাকে আপনমনে বিড়বিড় করতে দেখে ইফতি জিজ্ঞেস করলো,
—–কিছু বললেন ভাইয়া?
—-না না কিছু না। থতমত খেয়ে বলল ইশাল।
★অনেক্ষণ রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ইফতির উচ্ছ্বসিত কন্ঠ ভেসে এল।
—–কোথায় থাকিস তুই? ফোন কেন রিসিভ করিস না।
—–আরে বাবা, আমি ওয়াশরুমে ছিলাম। কী হয়েছে?
—–কী হয়েছে মানে কী? তুই দেশে আসবি না ইশরা?
—–কে বলেছে আসবো না? আমি আসবো তো।
—–কবে? আমার খাটিয়া উঠলে তবে?
—-ইফতিইই!! একটা চড় দেব। সবসময় বাজে কথা। রাগী স্বরে বলে ইশরা।
—তো আর কী বলবো? তুই তো দেশে আসার নামই নিচ্ছিস না ভাই। আমার কথা তোর যে মনে পড়ে না এটাই তার প্রমাণ।
—-আচ্ছা এখন কী ঝগড়া করবি, নাকি কথাও বলবি?
—-কেমন আছিস?
—-ভালো আছি। তুই কেমন আছিস? হাসি মুখে বলে ইশরা
—–ভালো আছি।
—–কোথায় তুই?
—–বাড়িতে আর কোথায়?
—-ওহ্। আচ্ছা ঠিক আছে আমি তোকে একটু পর ফোন করছি ঠিক আছে?
—-ওকে!
ইফতি নাহিদা বেগমের সাথে চলে এসেছে নিজ বাড়ি। কতদিন পর নিজবাড়িতে এসেছে। সবকিছু যেন নতুন লাগছে। বিছানায় বসতেই ইফতির ফোন বেজে উঠলো।
স্ক্রিনে ‘মি.ডাক্তার’ নামটি ভাসছে! ইফতি হাসি মুখে তাড়াতাড়ি ফোন রিসিভ করলো।
—-হ্যালো!
—–এতদিন কোথায় ছিলেন আপনি? ফোন কেন বন্ধ ছিলো? ওপাশের গম্ভীর কন্ঠ শুনে ইফতি চোখ বন্ধ করে নিল।
——আমি অসুস্থ ছিলাম। মৃদুস্বরে বলল ইফতি
—আচ্ছা, এতোদিন?
—-হয়ে যায় মাঝে মাঝে।
—-বিশাল অসুস্থতা।
ইফতি হালকা হাসলো।
—আপনি কেমন আছেন?
—-অনেক দিন পর।
—কী?
—-কেউ জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছি আমি?
—-এতোদিন আমায় মিস করেছেন?
—-কী বলবো? মানে কী বললে খুশি হবেন আপনি?
—-আপনি তো জানেন কিসে আমার খুশি, সেটাই বলুন।
—-মিস করিনি। কারণ, আপনি সর্বদা আমার কাছেই ছিলেন।
—মানে? ত্রস্তব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো ইফতি।
—-মানে কিছু না।
—-একটু বললে কী হয়?
—কিছু হবে না। তাইতো বলছি না।
—হুহ্!!! গাল ফুলিয়ে অভিমানী স্বরে উত্তর দিল ইফতি।
—-আচ্ছা রাখছি। পরে কথা হবে। বলেই ফোন রেখে দিল ইবাদ। নিচের ঠোঁট কামড়ে হেঁসে ফোনের স্ক্রিনে চুমু বসালো।
হাতের ফোন বিছানায় ছুড়ে ফেলে দিলো ইফতি। লোকটা এমন কেন? একটু বললে কী হয়? কেন এমন ত্যাড়া?
★অফিস শেষ করে নেমে এল ইশরা। গাড়ির দরজা খুলতেই অচেনা একটি হাত গাড়ির দরজা আটকে দিল। ভ্রু কুঁচকে পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখল অফিসের বস। মুখে হাসির রেখা টেনে বলল,
—-স্যার আপনি?
—-মিস ইশরা! আসুন আমি ড্রপ করে দিই।
—-নো স্যার, আমার গাড়ি আছে আমি পারবো।
—-বাট, একটা ছোট্ট কাজ আছে আপনাকে হেল্প করতে হবে। আপনার হেল্প ছাড়া আমি অচল মিস ইশরা। গাড়ি আমি ড্রাইভার কে বলে দিচ্ছি সে পৌঁছে দেবে। আপনি আসুন।
—-কিন্তু স্যার আমার অফিস টাইম তো শেষ।
—মিস ইশরা। একটু এগিয়ে গেল ফারিস। এত কিন্তু কিন্তু আমার পছন্দ না। ইটস মাই অর্ডার মিস ইশরা!
—-ওকে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফারিসের সাথে গাড়িতে উঠে বসলো ইশরা। ফারিসের সাথে ইশরার দেখা আজ থেকে ৫মাস আগে। ফারিসের গাড়ির পেট্রোল শেষ হয়ে যাওয়ায় মাঝরাস্তায় ফারিস আটকে পড়ে। মধ্যরাতে কোনো ক্যাব ও বুক করতে পারছিল না। চার্জ না থাকায় ফারিসের ফোন অফ হয়ে গেছিলো। তখনই ইশরা ফারিসকে সাহায্য করে। ফারিস একজন বাংলাদেশী হলেও ইতালিতেই তার সবকিছু। ফারিসের বাবা মা মারা যাওয়ার পর ফারিস আর বাংলাদেশে আসে নি। ইতালিতেই নিজের আলাদা একটা জগৎ বানিয়ে নিয়েছে। সেইরাতে ইশরার আচরণে মুগ্ধ হয়ে যায় ফারিস। ইশরাকে নিজের কোম্পানিতে জব করতে বলার সাথে সাথেই ইশরা রাজি হয়ে গেল। একটা চাকরির প্রচন্ড দরকার ছিল । ফারিস নিজেরই পার্সোনাল সেক্রেটারির পদে ইশরাকে জব দিল। ইশরার প্রতি প্রচুর যত্নশীল এই মানুষ টা। কোনো কিছুতে ইশরার আগ্রহ না দেখতে পেলে ফারিস নিজেও সেদিক থেকে সরে আসে।
কিছুক্ষনের মধ্যেই ফারিসের এপার্টমেন্টের সামনে গাড়ি থামে। গাড়ি থেকে নেমে ইশরা খানিকটা বিচলিত হলো,
—এটা আপনার বাড়ি?
—-নো! ইটস মাই হোয়াইট হাউজ।
—-স্যার এখানে আমার কাজ?
—ভেতরে চলুন দেখতে পাবেন।
—-আচ্ছা।
বাড়িতে প্রবেশ করতেই ইশরা দাঁড়িয়ে গেল। পুরো বাড়ি সাদা। নামেই শুধু হোয়াইট হাউজ না এটা কাজেও হোয়াইট হাউজ। ইশরা মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলো,
—–স্যার আপনি হোয়াইট কালার পছন্দ করেন?
—-নো!
—-তাহলে এটা? আশেপাশে তাকিয়ে বলল ইশরা।
—-আপনার না সাদা রং পছন্দ?
—-হ্যাঁ কিন্তু!
—-কোনো কিন্তু না। আসুন!
ফারিস এর পেছন পেছন গেল ইশরা।
★—-তুমি আমায় একটি বার জিজ্ঞেস করলে না মা?
আমি উনাকে কী করে বিয়ে করবো? না না আমি ওনাকে বিয়ে করতে পারবো না।
—-ইফতি! সব ঠিক হয়ে গেছে। কাল বাদে পরশু তোর বিয়ে এখন এসব বাদ দেওয়া অসম্ভব মা। তুই না করিস না।
—-কিন্তু মা?
—ইফতি! দিনরাত ইবাদ তোর পেছনে খেটেছে। ৯টা মাস ও টের পাইনি কখন দিন কখন রাত। ইবাদ তোর প্রতি শুধু নিজের কর্তব্য না ভালোবাসাও দেখিয়েছে। ইবাদের চেয়ে ভালো তোকে কেউ বাসবে না ইফতি।
—না না না! তুমি কেন বুঝতে পারছো না মা আমি ওনাকে ওভাবে দেখি না। আমি তো…
—-ইফতিই!
—-মা! অশ্রুসিক্ত নয়নে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল ইফতি।
—বিয়েটা তোর ভালোর জন্যই হচ্ছে। ইবাদ অনেক ভালো ছেলে। তোর জন্য, তোর আগামী দিনের জন্য। ওর মত মানুষ হয় না। ওনারা এখন আসছেন তোকে রিং পরাবে। তুই রেডি হয়ে নে আমি ইশরা কে একবার ফোন করি। ও কখন আসছে দেখি।
ইফতি কে কিছু বলতে না দিয়ে নাহিদা বেগম চলে গেল। বিছানায় পড়ে থাকা গোলাপি রঙের কাতান শাড়িটির দিকে তাকিয়ে কেঁদে দিল ইফতি।
চলবে…?
|| আর মাত্র কিছু দিন…..||