ইস্ক সাহেবান পর্ব -১৮

#ইস্ক_সাহেবান
#হীর_এহতেশাম

||পর্ব-১৮||

★দোতালা সিড়ি বেয়ে ফারিস বারান্দার রেলিং ধরে হাটছে। তারই পেছনে ইশরা। লোকটা হাটতে হাটতে গায়ে থাকা কোট খুলে হাতে ঝুলিয়ে নিয়েছে। এক হাতে গলার টাই শিথিল করে দিল। ব্লেজার এর মাঝখানে থাকা বোতাম খুলে দিল। শার্টের হাতে থাকা বোতাম খুলে হাতা ভাজ করে কুনুই অবধি নিয়ে আসে। পরনে থাকা কালো রঙের শার্টটি বেশ মানিয়েছে। শার্টের উপরে বাইসেপ্স গুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। খট করে দরজা খোলার শব্দে ত্রস্ত নয়নে তাকালো ইশরা। একটি রুমের সামনে ফারিস দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খুলে ইশরার দিকে ফিরে দাঁড়িয়েছে।

—-আসুন…

ইশরা এগিয়ে গিয়ে ফারিসের সামনে দাঁড়ালো। ভেতরের দিকে তাকিয়ে বলল,

—এখানে কী?

—-ভেতরে না গেলে কী করে বুঝবেন? ইশরা ছোট্ট শ্বাস ফেলে রুমের ভেতরে প্রবেশ করল। ইশরা রুমে প্রবেয়াহ করতেই ফারিস লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে বিছানায় থাকা চাদর একটানে সরিয়ে দিল। চাদর সরাতেই বেরিয়ে এল শাড়ি, গয়না। ইশরা ভ্রু কুঁচকে একবার তাকিয়ে ফারিসের দিকে তাকালো। ফারিস বিছানার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

—-জিনিসগুলো কেমন?

—-সুন্দর। কিন্তু আমার জানামতে আপনি আনম্যারিড! তাহলে এসব?

—-হ্যাঁ আমি আনম্যারিড। এসব আমার উডবির জন্য। যাকে আমি পছন্দ করি। হাতে থাকা কোট সোফায় রেখে দুহাত পকেটে রেখে বলল ফারিস।

—–ওহ্! আমাকে না দেখিয়ে তাকে দেখালে ভালো হতো। সবার পছন্দ এক হয় না। আর উনি যদি ফরেইনার হয় তাহলে এসব পছন্দ করবে না।

—-আমি জানি কী তার পছন্দ! আর মেয়েদের পছন্দ এক হয়।

—বলতে পারছি না। সবাই এক না।

—-আম…..ফারিস কিছু বলার আগেই ইশরার ফোন বেজে ওঠে। স্ক্রিনে ‘আম্মু’ নামটা দেখে ইশরা হালকা হাসলো।

—স্যার এক্সকিউজ মি। একটু দূরে গিয়ে ফোন রিসিভ করলো। ফারিস বিছানার দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। কিছু বলতে চেয়েছিল, তা আর হলো না। অনেক কিছু জমে আছে, ইশরাকে বলতে পারলে ভালোই হত। কিন্তু, তা হয়ে উঠলো না। ফারিসের ভাবনায় ফাটল ধরল ইশরার ডাক শুনে।

—স্যার?

—হুম বলুন।

—-পরশু আমার বোনের বিয়ে। আমায় বাড়ি যেতে হবে স্যার। আমি দেশে ফিরতে চাই।

—-ওয়াও কংগ্রেচুলেশন। যাবেন সমস্যা নেই।

—-থ্যাংক ইউ স্যার।

—-আমায় দাওয়ার দিলেন না ইশরা? ফারিসের মুখে দাওয়াতের কথা শুনে ইশরা অবাক হয়ে গেল। বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেল।

—–স্যার সত্যি যাবেন?

—-বলে তো দেখুন?

—-তাহলে চলুন।

—ওকে। আমি সকালে আপনাকে ফ্লাইটের টাইম জানিয়ে দেব।

—-কিন্তু স্যার?

—–মিস ইশরা আপনি বড্ড বেশি কিন্তু কিন্তু করেন। আমি আপনার কাধে চড়ে যাবো ভাবলেন কী করে? আর আপনি আমার একজন এমপ্লয়। এইটুকু সার্ভিস অফিসের তরফ থেকে আমি সবাইকে দিয়ে থাকি। নিচে ড্রাইভার হয়তো আপনার গাড়ি নিয়ে এসেছে আপনি বাড়ি চলে যান। সকালে জানিয়ে দেব আমি।

—-ওকে স্যার। থ্যাংক ইউ। ইশরা বিদায় নিল।

ফারিস বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। ইশরার গাড়ি গেইট থেকে বের হওয়া পর্যন্ত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এই একটা মানুষের শূন্যতা ফারিসকে বড্ড ভোগায়। কারো অনুপস্থিতিতে এতটা দুর্ভোগ নেমে আসে না, যতটা এই মেয়ের অনুপস্থিতিতে আসে।

★ইফতির হাতের আঙুলে রিং পরিয়ে দিতেই আশেপাশে থাকা সবাই হাত তালি দিয়ে উঠলো। পানি টলমল করতে থাকা চোখে একবার হাতের দিকে তাকালো ইশরা। হাত পা রীতিমতো কাঁপছে তার। কী থেকে কী হয়ে যাচ্ছে তা বুঝতেই পারছে না। বড্ড বেকায়দায় পড়ে গেছে সে। শাড়ি ঠিক করার নাম করে উঠে নিজের রুমে চলে আসে ইফতি। বিছানায় বসে কাঁদতে থাকে। অনেকবার ‘মি. ডাক্তার’ দিয়ে সেভ করা নাম্বারটিতে কল করেছে কিন্তু নাম্বার অফ আসছে। গা থেকে গয়না খুলে বিছানায় ছুড়ে মেরেছে। চুলের খোপা থেকে ফুল খুলতে গিয়ে চুলই খুলে ফেলেছে। অসহ্য লাগছে এই সাজ। কার জন্য সাজার কথা ছিলো? আর সেজেছে কার জন্য? কে দেখবে এসব? পেছন থেকে গম্ভীর একটি আওয়াজ ইফতির সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে তুলল,

—–এমন কান্নাকাটি কেন করছেন? ইবাদের কন্ঠস্বর শুনে পেছনে ফিরে তাকাল ইফতি। মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে উঠলো। ইবাদ এগিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়ালো,

—-সুস্থ হয়েছেন কিছুদিন হলো। এত উত্তেজিত হওয়া ঠিক না। প্রেসার পড়বে ব্রেইনে।

—পড়ুক। প্রেসার পড়ুক। আমি বেঁচেই থাকতে চাই না। আমার অসহ্য লাগছে এসব। কাদঁতে কাদঁতে বলে ইফতি।

—কেন?

—-আমি আপনাকে বিয়ে করার কথা ভাবতেও পারি না। আমি আপনাকে নিয়ে ওভাবে কখনো কল্পনা করি নি। কারণ.

—-কারণ টারণ রাখুন। আপনাকে আমার ভালো লাগে। চিকিৎসা চলাকালীন কত আবদার, কত রঙ-ঢং। আমি সেসব ভুলে যে এত দিন আছি সেটাই যথেষ্ট নয় কি। শুধু তাই না আমাকে কয়েকশ চুমু ও দিয়েছিলেন। কথা বলতে বলতে ইবাদ ইফতির অনেকটা কাছে চলে আসে। ইফতি রেগে গিয়ে বলে,

—-তখন আমি অসুস্থ ছিলাম। পাগল…..

—–হুশশশ! ইফতির মুখ চেপে ধরে ইবাদ। যা বলেছেন বেশি বলেছেন আমার সামনে নিজেকে পাগল বলা থেকে বিরত থাকুন, অন্যথায়.. বলেই ইবাদ ইফতির গালে চুমু দিয়ে সরে এল।

—পরশু দেখা হচ্ছে। বউ সাজে আপনাকে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি আমি। কথাটা বলে ইবাদ পিছিয়ে যেতে যেতে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। ইফতি নিজের মাথার চুল নিজেই টেনে ধরলো।

★ফোন বাজছে! অনেক্ষণ পর ঘুম ঘুম চোখে একহাত বাড়িয়ে ফোন নিয়ে না দেখেই রিসিভ করে কানে ধরলো ইশরা। ঘুম ঘুম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো–

—–কে?
ইশরার ঘুমজড়ানো কন্ঠ শুনে ফারিস কান থেকে ফোন সরিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে নিল। আস্তে আস্তে ফোন কানে ঠেকিয়ে বলল,

—–মিস ইশরা!

—ইয়েস?

—৩টাই ফ্লাইট। আপনি আসবেন নাকি আমি আসবো।

—–আসুন।

—মিস ইশরা? ইশরা… ইশরার আর কোনো আওয়াজ পেল না ফারিস। ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো। এই কয়েকদিন প্রজেক্টের কাজে রাত দিন কাজ করতে করতে ঘুম বাদ দিয়েছিল। এখন তারই ঘাটতি পূরণে ব্যস্ত ইশরা। কান থেকে ফোন সরিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো ফারিস।

দুপুর ২টা! ইশরার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অনেকবার ইশরা কে ফোন করলো ফারিস। ইশরা ফোন রিসিভ না করাই বাধ্য হয়ে বেল বাজালো সে। তিন বার বেল বাজানোর পর হঠাৎ দরজা খুলে গেল। দরজা খোলার শব্দে পেছনে ফিরে তাকালো ফারিস। এক হাত কপালে ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে ইশরা। পরনে একটি জিন্স, আর টি-শার্ট। ইশরাকে এই প্রথম এই পোশাকে দেখেছে ফারিস। ঘুরে দাঁড়িয়ে ইশরার দিকে তাকিয়ে আছে। ইশরা হয়তো ঘুম থেকে উঠে এসেছে। এলোমেলো চুল গুলো কিছু গালে গলায় জড়িয়ে আছে। চুলের দৈর্ঘ্য যে কোমর অবধি গিয়ে ঠেকেছে আজই তা দেখেছে ফারিস। চোখ সরিয়ে নিল ফারিস। গলা খাঁকারি দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ডেকে উঠলো–

—-মিস ইশরা? ফারিসের ডাক শুনে ইশরা থতমত খেয়ে গেল।

—স স্যার আ আপনি?

—কয়টা বাজে? আমি আপনাকে কী বলেছিলাম?

—-ক কী ব বলেছিলেন স্যার?

—–সকালে ফোন করে বলেছিলাম তো আমি আসবো?

—-সকালে?

—–ওটাও মনে নেই? ওহ্ গড। এখন বাজে ২ঃ১৫। ৩টাই ফ্লাইট। মিস করার চিন্তায় আছেন নাকি?

—–না না স্যার। আপনি দাঁড়ান আমি আসছি। জাস্ট দুই মিনিট। বলে ভেতরে পা বাড়াতেই ইশরা দাঁড়িয়ে গেল। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে জিহ্বা কামড়ে ধরলো। পেছনে ফিরে বলল,

—–স স্যার?

—-হু?

—-ভেতরে এসে বসুন। বলেই ইশরা চলে গেল। ফারিয়া ভেতরে গিয়ে বসলো। ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট। ড্রয়িংরুম থেকে ইশরার বেড রুমের দরজা দেখা যাচ্ছে। চারপাশ বেশ গোছানো। ফারিস হাতে ঘড়ির দিকে একবার তাকালো।
ইশরা বেরিয়ে এল।

—–স্যার চলুন।

পরনে লং গাউন। যার হাতা কবজি পর্যন্ত এসে থেমেছে। ওড়না ঝুলছে গলার সাথে। চুলগুলো পেছনে খোপা করা। সিম্পল একটা সাজ। মুখে নেই কোনো প্রসাধনী। একটু আগে এই মেয়েকেই ফারিসের মন ‘আবেদনময়ী’ বলে আখ্যায়িত করতে চেয়েছিল। কী সাদামাটা!

★ফ্লাইটে ইশরা ঘুমিয়ে পড়ে। ফারিসের পাশেই বসেছে। দুজনের সিট পাশাপাশি। এক দৃষ্টিতে ইশরার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো ফারিস। ফারিসের কানে এয়ারফোন। ফোন ফ্লাইটমুডে রেখে কানে এয়ারফোন গুঁজে গান শুনছিলো সে। কানে বাজতে থাকে ফারিসের প্রিয় গানটি…

Tere saath saath aisaa Kohinoor aya hein
Chand tere Roshni ka halka sa ek saya hein…

Teri nazroone dil ka kiya jo hasar asar yeh huaa
Ab inme hi dub ke ho jau par yehi hein duaa….

হেঁসে দিল ফারিস। সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে হাসছে সে। মাথা কাত করে কয়েকবার ইশরাকেও দেখেছে। ইশরা গভীর ঘুমে মগ্ন.!

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here