#ইস্ক_সাহেবান
#হীর_এহতেশাম
||পর্ব-১৯||
রাত ৮টা! আজ ইফতির মেহেদী অনুষ্ঠান। বিশাল স্টেজ সাজানো হয়েছে। পুরো বাড়ির মজলিস জমজমাট। সবাই নানান কাজে ব্যস্ত। বাড়ি ভর্তি মেহমান। একটু পরই ইফতিকে স্টেজ এ এনে বসিয়ে দেওয়া হয়। হলুদ আর হালকা গোলাপি রঙের সংমিশ্রণের একটি লেগেঙ্গা পরেছে, ফুলের গহনা, আর সাজ সব মিলিয়ে ইফতিকে দেখার মত লাগছে। মেহেদী টা স্টেজেই দিবে। ইফতি কে স্টেজে বসিয়ে দিয়ে নাহিদা বেগম নেমে আসে। সামনেই অনেক অনেক পরিচিত মানুষ, লাইট, ক্যামেরা, গান বাজছে। ইফতি একনজর সবটা দেখে চোখ নামিয়ে নিল। চোখে পানি টলমল করছে। চোখের পানি আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মেয়েটি। মেহেদী আর্টিস্টরা ইফতির দু পাশে গিয়ে বসে পড়ে। ইফতির হাতে সযত্নে, অতি সুন্দর ডিজাইনের মেহেদি পরিয়ে দিল। মেহেদি পরানো শেষে আর্টিস্টরা নেমে যায়। নাহিদা বেগম এসে মেহেদী রাঙ্গা হাতের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বলল,
—-মাশাল্লাহ ভারী সুন্দর হয়েছে। মায়ের কথা শুনে ইফতি হাতের দিকে তাকালো। কখন যে মেহেদি পরানো শেষ হয়েছে টেরই পেল না। মেহেদি পরিহিত হাত চোখের সামনে তুলে ধরতেই ইফতির সর্বপ্রথম সেই মানুষটির কথা মনে পড়লো যার কন্ঠ শুনলেই ইফতির মন মেজাজ ফুরফুরে হয়ে যেত। ইফতি মাথা নিচু করে কেঁদে দিল। কান্নার আওয়াজ গাড় হওয়ার আগেই পাশ থেকে ফিসফিস শব্দ ভেসে এল,
—–সাজ নষ্ট হয়ে যাবে। চটজলদি পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো সাদা শেরওয়ানি পরিহিত বিশাল দেহের উজ্জ্বল ফর্সা মুখশ্রীর মানুষটি ইফতির দিকে মোহময় দৃষ্টি আর মুখে মুগ্ধ হাসির রেখা টেনে তাকিয়ে আছে।
—-আ আপনি?
—-এটা নাকি নিয়ম? মেহেদি অনুষ্ঠানে বউয়ের হাতে নিজের নাম লিখতে আসতে হয় বরকে, তাই এলাম!
ইফতির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কথাটি বলে ইবাদ।
ইফতি নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে ইবাদের দিকে একবার তাকালো।
—-আমি এ নিয়ম মানি না!
—-বউসাজে মিষ্টি মধুর কথা মানায়, এমন কাঠ কাঠ কথা না। ঝগড়া তো আরো না। সামনে তাকিয়ে দেখুন আপনার আর আমার দিকে সবাই তাকিয়ে আছে। এখনই ঝগড়া করলে সবাই ভাববে ইবাদ মাহসানের কপাল খারাপ।
ইবাদের কথা শুনে ইফতির রাগ তিরতির করে বেড়ে গেল। হৃদয় ভেঙ্গে কান্না আসছে, নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে রেখেছে ইফতি। ইফতিকে কিছু বলতে না দিয়ে ইবাদ মেহেদী নিয়ে ইফতির হাত ধরে ঘুরে বসে তার দিকে। ইফতি ত্রস্ত নয়নে তাকালো। ইবাদের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। ইবাদ ইফতির হাতে সযত্নে নিজের নামটা লিখে দিল। নাম লিখা শেষে ইবাদ নিজের বাম হাত ইফতির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
—–এই যে দেখুন? আমার হাতেও আপনার নাম আছে। ইবাদের হাতের তালুতে গাড় রঙের মেহেদী। অথচ ইফতি দেখলো না। মুখ ফিরিয়ে নিল। ইবাদ হেঁসে হাত সরিয়ে আনে। ইফতি যদি একটিবার হাতের দিকে তাকাতো তবে দেখতে পেত, মেহেদী রাঙা হাতটিতে গাড় হয়ে বসে আছে ‘সাহেবান’ নামটি।
★এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিল ইশরা আর ফারিস। দুজনই পাশাপাশি বসেছে তবে দূরত্ব রেখে। ফারিস ইশরার দিলে তাকিয়ে বলল,
—–একটা কথা বলার ছিল?
—-জি বলুন।
—-আপনি জামা কাপড় নিলেন না যে?
—-ওহ্! তাড়াহুড়োতে খেয়াল করি নি।
—কালকেই তো বলে রেখেছিলাম তখন কেন গোছান নি?
—প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছিল। রাত করে ঘুমিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সকালে করে নেব। কিন্তু ঘুমের ওষুধ দেরীতে খাওয়ায় ঘুম টা কাটছিল না সকালে। আর তাছাড়া বাড়িতে আছে জামা কাপড়। আমি তো বেশিদিন থাকবো না। তাই এত ঝামেলার কী দরকার?
—-আপনি স্লিপিং পিল খান?
—-হ্যাঁ ঘুম আসে না যে।
——ঘুম কেন আসে না? এত কী চিন্তা করেন?
ফারিসের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ইশরা। মৃদুস্বরে বলল,
—-চিন্তা করি না। এমনিই রাতে ঘুমটা আসতে চায় না। বিভিন্ন চিন্তা মাথায় জেঁকে বসে। তাই বাধ্য হয়ে এই পদ্ধতি।
—-এটা ক্ষতিকর।
—–জানি।
—-জেনেও ক্ষতি করছেন?
—-না ঘুমালে আরো বেশি ক্ষতি হতো।
কথা বলতে বলতে ইশরাদের বাড়ির সামনে গাড়ি এসে থামলো। গাড়ি থামতেই ইশরা তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। তাড়াহুড়োই গাড়ি থেকে নামতেই জেনারেটর এর তারের সাথে পা পেঁচিয়ে ইশরা পড়ে গেল মাটিতে।
ইবাদের সাথে এসেছিল ইশাল। সিগারেট ধরিয়ে বাহিরে বের হতেই পায়ের সামনে একটি মেয়ে পড়তেই ইশাল একটু পিছিয়ে গেল। ইশাল হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আগেই ফারিস দ্রুত এসে ইশরার পাশে বসে পড়ে।
—–আর ইউ ওকে?
—— ঠিক আছি। ফারিস হাত বাড়িয়ে দিল। ইশরা সেই হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়ে সামনে তাকাতেই মাথার উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত অবস্থা হলো। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি আর কেউ না তারই পছন্দের মানুষ। মুহুর্তেই অন্তর কেঁপে উঠলো ইশরার। চোখে পানি টলমল করছে। ইশালের মুখপানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ইশরা। এত টা মাস পর ইশরা কে দেখে ইশালের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। কিছু বলার আগেই ফারিস বলে উঠল,
—-কী হয়েছে? ব্যাথা লেগেছে?
ইশরা ফারিসের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলল। ইশালের দিকে তাকিয়ে বলল,
—–একটু তো লেগেছে। ইশাল একবার ফারিসের হাতের দিকে তাকালো। ফারিসের হাতে ইশরার হাত। লোকটা ইশরার হাতকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। ইশাল কিছু বলার আগেই ফারিস আর ইশরা ভেতরে চলে গেল। ওরা চলে যেতেই ইশাল সিগারেট মুখের কাছে নিয়ে আসে। সিগারেটের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট হাসি হাসলো। তারপর ফেলে দিল। এই প্রথম অর্ধ সিগারেট ফেলে দিল ইশাল ফায়াজ।
★স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে ইশরা ‘ইফতিই’ বলে ডাক দিতেই ইফতি স্টেজ ছেড়ে নেমে এল। দৌঁড়ে এসে জাপটা দিয়ে ইশরা কে জড়িয়ে ধরলো। ইশরা টাল সামলাতে না পেরে পিছিয়ে যাচ্ছিলো ফারিস এসে পেছনে দাঁড়িয়ে গেল। ফারিসের বুকের সাথে ইশরার পিঠ ঠেকে গেল। ইশরা নিজেকে সামলে নিতেই ফারিস সরে দাঁড়ালো।
—-এমন করছিস কেন? সবাই কী বলবে?
কাদঁতে কাদঁতে হিচকি উঠে গেছে ইফতির। ইফতিকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে ইশরা বলল,
—-তুই কাদঁতে থাক আমি গেলাম। বলে পেছনে ফিরতেই ইফতি হাত ধরে নিল,
—–যাস না।
—-আর কাদঁবি?
দুপাশে না বোধক মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। ইশরা হেঁসে দিল। ফারিসকে দেখিয়ে বলল,
—-তোর বিয়ে খেতে দেখ ইতালি থেকে মেহমান এনেছি আমি। ইফতি এতক্ষণে ফারিসকে দেখল। ফারিসকে উদ্দেশ্য করে বলল,
—-কে উনি?
—-আম…
—-আমি ইশরার বন্ধু। ইশরা কে থামিয়ে দিয়ে বলে ফারিস। ইশরা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল।
—-ওহ্,
—-হ্যাঁ কিন্তু এটা জানতাম না আপনারা টুইনস!
—-এটা সারপ্রাইজ ছিল। বলেই হেঁসে দিল ইশরা। ফারিস শুধু ইশরা কে লক্ষ করছে। কথায় কথায় যতবার হাসছে এত হাসি আগে হাসতে দেখেনি সে। হাসলে মেয়েটিকে অসম্ভব সুন্দর দেখায়। যা ইশরার বাম গালে পড়া টোল জানান দিচ্ছে। এত হাসি নিজের মাঝে লুকিয়ে রেখেছিল এখানে না এলে জানতেই পারতো না ফারিস। ফারিস কে চুপ থাকতে দেখে ইফতি বলে উঠল,
—–কী ভাবছেন?
—কিছু না। আপনার জন্য একটা গিফট আছে। আমার তরফ থেকে।
—-আমার গিফটের প্রয়োজন নেই। আমার বোনের চেয়ে বড় গিফট কিছুই না। আপনি ভেতরে আসুন।
★অনুষ্ঠান শেষ। ক্লান্ত হয়ে সবাই যে যেদিকে পেরেছে শুয়ে পড়েছে। ইশরা নাহিদা বেগম কে ফারিসের খেয়াল রাখতে বলে। কারণ, এমন জমজমাট পরিবেশে হয়তো ফারিস আগে থাকে নি। পুরো বাড়ির পরিবেশ ফারিসের ভালোই লেগেছে। বিশেষ করে নাহিদা বেগমের আপ্যায়ন।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখছে ফারিস। পুরো বাড়ির আশেপাশে বিয়ে বাড়ির সাজে সজ্জিত। বাড়িটাও নিজেকে সাজিয়ে তুলেছে। হঠাৎ বাগানের দিকে চোখ পড়তেই ফারিসের দৃষ্টি আটকে গেল। বেড়ে গেল হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া। বাগানের দোলনায় ইফতির কোলে মাথা দিয়ে কাদঁছে ইশরা। ইশরার কান্নার আওয়াজ ফারিসের কান অবধি এসে পৌঁছালো। কিসের দুঃখে কাদঁছে ইশরা? ইফতির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তাই? নাকি অন্য কিছু? এভাবে কেন কাদঁছে? ইশরার কান্না যেন ফারিসের বুকে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে। দুজনের মধ্যে কী কথা চলছে তা ফারিসের জানা নেই। শুনতেও পাচ্ছে না। তবে ইফতির বিয়ে নিয়ে যে কথা বলছে না তা ফারিসের বুঝতে বাকি রইল না। কিসের এত কষ্ট এই মেয়ের? কী কারণে এমন হচ্ছে?
ভোর বেলা ফারিসের ঘুম ভাঙ্গে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে। ঘুম ভাঙতেই বাহির থেকে ভেসে আসা চিৎকার, কান্নাকাটির শব্দ শুনে ফারিস রুম ছেড়ে বেরিয়ে এল। নিচে নেমে ড্রয়িং রুমে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতেই দেখলো ইশরা কে জাপটা মেরে জড়িয়ে ধরে কাদঁছে নাহিদা বেগম। কেন কাদঁছে? জাফর এহতেশাম মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। কী হয়েছে বুঝতে পারছে না ফারিস..
চলবে..?