#এক_জীবনে_অনেক_জীবন(১৫)
***********************************
বাড়ি ফিরে আসা পর্যন্ত তাবাসসুম জারা’র সাথে একটা কথাও বললেন না । গাড়ির মধ্যে মা-মেয়ে চুপচাপ বসে রইল সারা রাস্তা । জারা’র খুব ইচ্ছে করছিল মা’কে জিজ্ঞেস করতে যে আদিত্যকে কেমন লাগলো কিন্তু মা’র গম্ভীর চেহারা দেখে সে আর কথা বলতে সাহস করলো না । তবে আদির আজকের আচরণে জারা খুব অবাক হয়েছে । আদি এভাবে এসে এতো তাড়াহুড়া করে চলে যাবে এটা জারা ভাবতেই পারেনি । সে কতো কিছু প্ল্যান করেছিল মনে মনে অথচ কিছুই হলো না । আদির সাথে মা’র পরিচয়টাই তো হলো না ঠিক মতো । আর এতদিন পরে আদির সাথে তার যা-ও একটু দেখা হলো অথচ সে আদির হাতটা পর্যন্ত ধরতে পারলো না ! যাগগে ওসব চিন্তা আপাতত বাদ থাক, এখন সবচেয়ে বড় চিন্তা হলো মা যেন আদিকে নিয়ে পজিটিভ কিছু ভাবতে শুরু করেন ।
বাসায় এসে তাবাসসুম দেখলেন কায়সার এখনো আসেনি । কায়সার সন্ধ্যার পরপরই বাসায় চলে আসেন সব সময় । আজ এখনো আসেননি দেখে তাবাসসুমের একটু টেনশন হলো । কায়সারের যদি কখনো দেরিও হয়, তিনি ফোন করে তাবাসসুমকে জানিয়ে দেন । মোবাইলটা নিয়ে কায়সারকে ফোন দিলেন তাবাসসুম । ফোন ধরে কায়সার বললেন –
মনে পড়লো আমার কথা ? কেনাকাটা শেষ হয়েছে তোমাদের ?
হুম । তুমি কোথায়, বাসায় আসোনি কেন এখনো ?
বাসায় আসলে তো একা বসে থাকতে হতো । তুমি কাল রাতে বললে না যে আজ বিকেলে তোমরা বাইরে যাবে । কেনাকাটা আরো কী কী সব কাজ আছে । তাই আর বাসায় গেলাম না । রোজার এখানে এসেছি ।
একা একা মেয়ের বাসায় চলে গেলে আমাকে না নিয়ে ?
তুমি ছিলে না বলেই তো আসলাম । বাসায় ফিরেছো তোমরা ?
হুম ফিরলাম ।
ঠিক আছে আমিও বেরোচ্ছি ।
এসো ।
কায়সারের সাথে কথা শেষ করে তাবাসসুম জারা’র রুমে এলেন । মেয়ের হাতে মোবাইল দেখে বললেন –
তুমি কী মোবাইল ছাড়া থাকতে পারো না এক মুহূর্ত ?
আমি কখন সারাক্ষণ মোবাইলে থাকলাম !
মোবাইল রাখো । এই জিনিসটাই জীবন নষ্ট করছে মানুষের । কাজের চাইতে অকাজে বেশি সময় খেয়ে ফেলে এই জিনিস ।
জারা মোবাইলটা টেবিলে রেখে মা’র দিকে তাকিয়ে রইল । সে জানে মা এখন আদিকে নিয়ে কথা বলার জন্যই রুমে এসেছেন কিন্তু কী বলবেন সেটা ভেবে জারা’র বুকটা ধুকপুক শুরু করে দিয়েছে ।
তাবাসসুম বললেন –
দেখলাম তোমার বন্ধুকে । প্রেমিক কথাটা বলতে তাঁর মুখে কেমন বাধো বাধো ঠেকলো ।
জারা বললো –
আদিকে তোমার কেমন লাগলো মা ?
জারা তোমার কী মনে হয় না যে এই ছেলেটা কোনোভাবেই তোমার যোগ্য না ।
উহ, আবারো সেই কথা ! জারা হতাশ গলায় বললো –
এমন কথা কেন বলছো বলো তো মা ? আদিকে তোমার কোনদিক দিয়ে খারাপ লাগলো ?
ভালো লাগা বা খারাপ লাগার সময় দিয়েছে সে ? আমি তো ঠিক বুঝলামই না সে আসলো ই কেন, কেন ই বা এতো তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল !
মা ও তো বললো ই যে ওর মা ব্যাথা পেয়েছে ।
হুম বলেছে কিন্তু ছেলেটার কোথাও সমস্যা আছে । ছেলেটা কিছু লুকোচ্ছে তোমার কাছ থেকে । জারা আমি চাই না তুমি এই ছেলের সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখো ।
কেন মা ? আদির দোষটা কোথায় বলো ।
দোষ গুণ আমি জানি না । আমার ছেলেটাকে ভালো লাগেনি জারা । ও মুখে বলছিল এক কথা কিন্তু ওর চোখ বলছিল অন্য কিছু ।
মা তুমি তো ঠিক করেই রেখেছো, আদিকে তুমি কোনোভাবেই পছন্দ করবে না ।
না ছেলেটার সাথে আমার পার্সোনাল কোনো সমস্যা নেই কিন্তু বিষয়টা যখন তোমার তখন আমাকে প্রতিটা বিষয় খুঁটিয়ে দেখতে হবে । তাকে অকারণে কেন আমি খারাপ বলবো ? ছেলেটাকে আমার ভালো লাগেনি তাই আমি এ বিষয়ে আর কথা বাড়াতে চাই না জারা । খুব ভালো হয় তুমি যদি আমার কথাটা ভালোভাবে বুঝতে পারো আর বুঝতে পেরে সরে আসো এখান থেকে ।
মা তুমি কেন ঐ একই কথা বলে যাচ্ছো বারবার ? কেন আমাকে বুঝতে চেষ্টা করছো না ?
তুমি আমার সাথে তর্ক করছো কেন জারা ?
আমি তর্ক করছি না মা । আমি শুধু জানতে চাইছি তুমি কেন এমন করছো ? আদিত্যর দোষটা বলো ।
তুমি এই ছেলেটাকে কতটুকু চেনো জারা ? তার সবকিছু তুমি জানো ? কোথায় পড়ালেখা করেছে, কোথায় বাড়ি, ফ্যামিলি কেমন এসব কিছু জানো তুমি ?
কেন জানবো না ? আদির সবকিছুই আমি জানি মা । ও তো তোমাকেও বললো, নিকুঞ্জে থাকে ওরা । ইস্ট ওয়েস্ট থেকে পাশ করেছে আর এখন নিজের ব্যবসা শুরু করেছে ।
তুমি এগুলো তার কাছ থেকে শুনেছো, তাই তো ? সরাসরি দেখেছো সবকিছু ? এইটুকু ছেলে নিজের কী ব্যবসা দাঁড় করিয়েছে ?
মা ও কী আমার সবকিছু দেখেছে ? ও তো আমাকে কখনোই জিজ্ঞেস করেনি আমার ফ্যামিলি কেমন, কে কোথায় কী করে । আমার বাসা দেখতে চায়নি তো কখনো । আমার কথাতেই সে বিশ্বাস করেছে সবকিছু । ট্রাস্ট হচ্ছে একটা রিলেশনশিপে সবচেয়ে বড় ব্যাপার, এটা জানো তো মা ?
এখন তুমি আমাকে শেখাবে কোনটা কী ব্যাপার ?
আমি তোমাকে কিছু শেখাতে চাই না মা । আমি শুধু চাই তুমি আমাকে বুঝতে চেষ্টা করো । আমার খুব কষ্ট লাগছে মা কারণ তুমি আমার কোনো কথা বুঝতে চেষ্টাই করছো না ।
তোমার কথা আমি বুঝবো না তো জারা । তোমাকে বুঝতে হবে আমার কথা । আচ্ছা বুঝলাম ছেলেটা তোমাকে যা যা বলেছে সবই ঠিকঠাক বলেছে কিন্তু আমার তো ছেলেটাকেই ভালো লাগেনি ।
সমস্যাটা কোথায় মা । ওর সব যদি ঠিক থাকে তাহলে কেন তুমি এমন নেগেটিভ কথা বলছো ওর সম্পর্কে ?
তাবাসসুম লম্বা একটা শ্বাস নিলেন । তাঁর ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে যাচ্ছে । তিনি মনে মনে নিজেকে বুঝালেন, এখন ধৈর্য্যহারা হলে চলবে না । এই সময়টা খুব সেনসেটিভ । জারা একটা ঘোরের মধ্যে আছে ৷ তাকে এই ঘোর থেকে টেনে তুলতেই হবে ।
মা আমি কী কাল বাইরে যেতে পারি ?
কোথায় যাবে, কী কাজ ?
মা কেন এখনো এমন করছো ? আমার খুব দমবন্ধ লাগছে তোমার এই আচরণে ।
জারা তুমি কী চাচ্ছো আমি তোমার সাথে জোর করি ? সেই রাইট কিন্তু আমার আছে । জারা তুমি আমাকে রাগিয়ে দিও না । আমি রাগতে চাচ্ছি না ।
আমি তোমাকে মোটেও রাগিয়ে দিচ্ছি না মা । তুমি অকারণে রেগে যাচ্ছো । আজকে আদিত্য তোমার সাথে দেখা করলো তারপরেও তুমি ওকে নিয়ে খারাপ কথা বলেই যাচ্ছো । আমি জানতাম তুমি এমনটাই বলবে । ঠিক সেটাই হচ্ছে । আর তুমি আমার সাথে জোর করতে পারো না মা । সেই বয়স আমার পার হয়ে গেছে ।
কোন বয়স পার হয়ে গেছে তোমার ?
আমি স্কুলে পড়ি না মা । আর কয়দিন পরে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে যাবো পাশ করে ।
তাতে কী হয়েছে, তাতে তুমি আমার মাথা কিনে নিয়েছো ?
মা-মেয়ের কথার মাঝখানে কায়সার এসে রুমে ঢুকলেন । বললেন –
তোমরা এখানে ? কী ব্যাপার সিরিয়াল কোনো বিষয়ে কথা হচ্ছে না-কি ? দু’জনেরই মুখ এতো গম্ভীর কেন ?
কিছু না আব্বু, মা তো সবসময়ই একটু রেগে থাকেন ।
তাবাসসুমের দিকে তাকিয়ে কায়সার জিজ্ঞেস করলেন –
কী ব্যাপার, কোনো প্রবলেম ?
কায়সার মাত্র বাইরে থেকে ফিরেছেন, এই মুহূর্তে এই বিষয়টা নিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে না তাবাসসুমের । সময় নিয়েই কথা বলতে হবে কায়সারের সাথে । মনে হচ্ছে তিনি একা বিষয়টা সামাল দিতে পারবেন না । মেয়েটা একটু বেশি বাড়াবাড়ি শুরু করে দিয়েছে ।
তাবাসসুম কায়সারকে বললেন –
চলো রুমে চলো , চা খাবে তো ?
চা তো খেয়ে আসলাম রোজার ওখান থেকে । আবার খাবো ?
থাক তাহলে, এখন আর কিছু খাওয়ার দরকার নেই । তুমি চেঞ্জ করে নাও । শিল্পীকে বলছি একটু পরে রাতের খাবার দিয়ে দিতে ।
হুম ঠিক আছে ।
তাবাসসুম বের হয়ে চলে যাওয়ার সময় কঠিন চোখ একবার তাকালেন মেয়ের দিকে । জারা চোখ নামিয়ে নিলো ।
মা আর আব্বু চলে গেলে জারা দরজাটা বন্ধ করে এসে আদিকে ফোন করলো । আদি ফোন ধরতেই অনুযোগের সুরে বললো –
এটা কী হলো আদি ? এমনটা আমি মোটেও এক্সপেক্ট করিনি ।
সরি জারা । আমি কী এক্সপেক্ট করেছিলাম বলো ? মা এমনভাবে ব্যাথা পেল যে তখন মা’কে ছেড়ে আসার মতো কোনো উপায়ই ছিলো না । কী করবো বলো ? বাবা বাসায় ছিল না আর আমার তো কোনো ভাইও নেই যে তার কাছে মা’কে দিয়ে চলে আসবো । তুমি রাগ করেছো জারা ?
না না, আমি রাগ করবো কেন ? মা’কে নিয়ে যাওয়াতে একটু ঝামেলা হয়ে গেল ।
আন্টি খুব রাগ করেছেন তাই না ?
না ঠিক রাগ না তবে মা কেমন জানি উল্টাপাল্টা কথা বলছেন । আমার খুব বিরক্ত লাগছে কথাগুলো শুনতে ।
কী কথা ?
এই যে তোমার না-কি বাইরে এক রকম আর ভেতরে আরেক রকম ।
মানে কী কথাটার ?
আমিও বুঝতে পারছি না । মা কেন এইসব কথা বলছে ! তোমার বাড়িঘর কোথায়, কেমন ফ্যামিলি এইসব নিয়েও বারবার প্রশ্ন করছিলেন ।
মানে কী জারা ? আন্টি কী কোনো কারণে আমার ওপরে রাগ হয়ে আছেন, সন্দেহ করছেন আমাকে ?
আমি বুঝতে পারছি না কিছুই ।
আমার মনে হয় কী জানো, তারা তোমার জন্য অন্য কোনো প্ল্যান করে রেখেছেন । তাদের পছন্দমতো বিয়ে টাইপ কিছু ।
না না তেমন হলে তো আমাকে বলতেনই ।
তোমার কোন আংকেলকে যে বাসায় ডেকেছিলো তখন কী তোমাকে জানিয়েছিল জারা ?
আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না আদি । আমি কী করবো বলো তো ? খুব কনফিউজড হয়ে যাচ্ছি বারবার ।
ওনারা এটাই চাচ্ছেন । তোমাকে কনফিউজড করে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে তাদের পছন্দের কারো সাথে তোমার বিয়ে দিতে ।
যাহ, আমার মা আব্বু এমন না ।
তাহলে তারা কেন এমন করছে বলো আমাকে ? আমার দোষটা কোথায় আমাকে দেখিয়ে দাও, তাহলে তো বুঝতে পারি ।
আমার কাছে তোমার কোনো দোষ নেই আদি কিন্তু আমি এই যন্ত্রণা আর সহ্য করতে পারছি না । মা কেন যে মেন্টালি আমাকে এতো টর্চার করে যাচ্ছেন, মা-ই বলতে পারবেন ।
তুমি কী আমার কাছ থেকে চলে যাবে জারা, আমি হারিয়ে ফেলবো তোমাকে ?
কেন এমন বলছো আদি? আমি আসলে বুঝতে পারছি না আমার এখন কী করা উচিত । মা আমাকে ঘরে আটকে রেখেছেন, বাইরে যাওয়ার পারমিশন দিচ্ছেন না । আপুটাও মা’র দলে । ওর সাথেও আমি কিছু শেয়ার করতে পারছি না ।
ঠিক আছে জারা তুমি তোমার মা-বাবার কথাই মেনে নাও । তারা তো আমাকে পছন্দ করছেন না । নিশ্চয়ই আমার মধ্যে খারাপ কিছু দেখেছেন । আমি চাই তুমি ভালো থাকো যে কোনো কিছুর বিনিময়ে । আমাকে নিয়ে ভেবো না জারা । এরকম একজন আদি যদি মরেও যায়, কারো কোনো সমস্যা হবে না ।
জারা’র বুকটা ছ্যাত করে উঠলো । সে আর্তনাদ করে বলে উঠলো –
আদি ! তুমি মরার কথা বলছো কেন ? আমি তোমাকে ভালোবাসি । আমি তো তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলিনি একবারও । আমি সত্যিই তোমাকে অনেক ভালোবাসি আর সেই কারণেই মা’র সাথে অবিরাম যুদ্ধ করে যাচ্ছি তোমাকে নিয়ে ।
কথার মাঝখানে দরজায় নক করতেই জারা বললো –
এখন ফোন রাখছি, আব্বু খেতে ডাকছেন । আমি পরে কথা বলবো । প্লিজ আদি টেক কেয়ার, লাভ ইউ ।
.
.
আজম সাহেবের সাথে ফাহিম গত কয়দিনের কাজের সামারি নিয়ে বসেছে । আজম সাহেব কাগজপত্র, হিসাবনিকাশ সব দেখলেন । টার্গেট অ্যাচিভ করতে পারায় আজম সাহেব ফাহিমের প্রশংসা করলেন । এই ছেলেটার কর্মতৎপরতায় তিনি বরাবরই মুগ্ধ ।
কাগজপত্র সব দেখা শেষ হলে ফাহিম বললো –
স্যার একটা বিষয় আপনাকে জানানোর ছিল ।
কোনটা বলো তো ।
স্যার নতুন যিনি জয়েন করেছেন, রফিকুল ইসলাম ।
হুম কী অবস্থা তার ?
উনাকে নিয়ে কাজ করা একটু টাফ হয়ে যাচ্ছে স্যার । উনি আসলে নিজের মতো চলতে চান । অফিসের যে একটা ডেকোরাম আছে সেটা উনি মানতে নারাজ ।
তাই না-কি ? কী করছে বলো তো ?
ওনার আসলে শেখার আগ্রহটা কম । এটাও হতে পারে উনি এই ধরণের কাজে কমফোর্ট ফিল করছেন না ।
সে কী তোমাকে ফলো করছে না ।
না স্যার । উনি তো দুপুরের পরে আর থাকেন না । বেরিয়ে যান কাজের কথা বলে ।
অফিস টাইমে তার অন্য কী কাজ ?
আমি জানি না স্যার । ওনার সাথে আসলে আমি খুব বেশি কথা বলি না । প্রতিটা কথারই বাঁকা উত্তর দেন । আপনি স্যার ওনার বিষয়টা একটু দেখেন । আমার মনে হয় না আমি ওনার সাথে কাজ করতে পারবো ।
ঠিক আছে তুমি যাও, আমি দেখছি ।
ফাহিম চলে গেলে আজম সাহেব রফিককে ডেকে পাঠালেন রুমে । পিয়ন এসে জানালো লাঞ্চের পরপরই রফিক চলে গেছে । প্রতিদিনই এভাবে চলে যায় ।
আজম সাহেব মোবাইলটা নিয়ে আওলাদ হোসেনকে ফোন করলেন ।
আওলাদ হোসেন তখন দোকানের জিনিসপত্র কিনতে বাজারে এসেছেন । এই অসময়ে আজম স্যারের ফোন পেয়ে একটু অবাক হলেন তিনি । তাঁর মন বললো রফিক কিছু একটা হয়তো করেছে অফিসে । ফোন ধরে আওলাদ হোসেন সালাম দিলেন ।
আজম সাহেব উত্তর দিয়ে বললেন –
কেমন আছেন আওলাদ সাহেব ?
ভালো আছি স্যার । আপনি ভালো আছেন ?
জ্বি ভালো আছি । আপনি কী বাইরে না-কি, এতো শব্দ কেন ?
স্যার একটু কেনাকাটা ছিল তাই বাজারে এসেছি ।
এই অবেলায় বাজারে ? আচ্ছা শোনেন আওলাদ সাহেব , রফিক কী আপনাকে কিছু বলেছে না-কি?
কোন বিষয়ে স্যার ?
চাকরি নিয়ে ?
কেন স্যার, ও কী ঠিক মতো কাজ করছে না ?
না, ও তো লাঞ্চ করেই অফিস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে রোজ । যে ছেলেটার কাছে ওকে কাজ শিখতে দিয়েছিলাম, ওর সাথেও বোধহয় মিস বিহেভ করেছে । আপনি একটু খোঁজ নেন তো ভাই । আমি কিন্তু আপনার কথা চিন্তা করেই আপনার ছেলের জন্য চাকরিটার ব্যবস্থা করেছিলাম । আমাকেও তো কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় । এরকম আচরণ করলে তো তাকে আর কাজে রাখা যাবে না ।
আওলাদ হোসেন মরমে মরে গেলেন । ছেলের জন্য তাঁকে যে আর কতো লজ্জায় পড়তে হবে কে জানে ? রফিকের এমন কান্ডের জন্য বারবার করে আজম স্যারের কাছে ক্ষমা চাইলেন তিনি ।
.
.
ছুটির দিনের সকাল । খবরের কাগজ পড়া শেষ করে কায়সার সুডোকু মেলাচ্ছিলেন । এই টাইমে জারা এসে তাঁর পাশে বসে । সে-ও সুডোকু মেলানোর চেষ্টা করে । আজও যখন কায়সার পেপার হাতে বারান্দায় বসে আছেন, জারা এসে কায়সারের গা ঘেঁষে বসলো । বললো –
আব্বু তোমার সুডোকু মেলানো শেষ ?
না, মাত্রই ধরলাম ।
দেখি একটু পেপারটা ।
জারা পেপারটা নিতেই কায়সার জিজ্ঞেস করলেন –
জারা তোমার মা যে সব কথা বললো আমাকে সেগুলো কী সব সত্যি ?
জারা ভেবেছিল মা কথাগুলো আব্বুর কাছে বলবেন না । সে বললো –
কোন কথা আব্বু ?
তুমি জানো জারা কোন কথা । এই বিষয়টা নিয়ে আমরা আগেই কথা শেষ করেছিলাম আর আমার ধারণা ছিল এটা তখনই শেষ হয়ে গেছে ।
জারা কোনো কথা বললো না ।
তোমার মা খুব বেশি রাগ হয়ে আছেন তোমার ওপর । সে যে গতকাল ঐ ছেলের সাথে দেখা করতে যাবে এটা তো আমাকে আগে বলেনি । ঠিক আছে দেখা করেছে, ভালো হয়েছে । তাঁর কাছে যেহেতু ছেলেটার কথাবার্তা ভালো মনে হয়নি, আমি চাই বিষয়টা এখানে শেষ হোক । শেষ মানে শেষ জারা ।
জারাকে চুপ থাকতে দেখে কায়সার বললেন –
কী হলো, তুমি কথা বলছো না কেন ? এভাবে চুপ থাকবে না । কথার উত্তর দাও । আমি একটা বিষয়ে খুব অবাক হচ্ছি, তুমি এতোদিন ধরে ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখলে আমাদের কাছ থেকে ! আমি কিন্তু তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম জারা । এখন তো তোমার যে কোনো কথা বিশ্বাস করার আগে তাহলে আমাকে ভালো মতো ভাবনাচিন্তা করতে হবে দেখছি । কখনো তোমার মা রাগ করেছে, কখনো আমি রাগ করেছি কিন্তু তারপরেও তোমার ভালোর জন্য আমরা দুজন মিলেই নিজেদেরকে বুঝিয়েছি, তোমাকে বুঝিয়েছি ।
যাই হোক তোমার বিষয়ে তোমার মা যেটা ভালো মনে করবে সেটাই ফাইনাল । আমিও তোমার মা’র কথাটাই মেনে নেবো । এখন তুমি আমার কাছে প্রমিস করো আজকের পরে তুমি আগের জারা হয়ে যাবে । এটা আমাদের সবার জন্য ভালো । তোমার মা’কে রাগিয়ে দিও না জারা । রেগে গেলে তোমার মা কিন্তু ভয়ংকর রূপ ধারণ করেন । দু-একবার তুমিও কিন্তু দেখেছো সেই রূপটা ।
বাবা আমি কী আজকে একটু বাইরে যেতে পারি ?
অবশ্যই পারো, তোমার মা’র পারনিশন নিয়ে তুমি যেখানে যাওয়ার যাও ।
জারা আর কোনো কথা না বলে চলে আসলো বারান্দা থেকে । তার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে মা’র ওপর । মা কী মনে করেছেন জোর করে তাঁর সিদ্ধান্ত জারা’র ওপর চাপিয়ে দেবেন তিনি ? এভাবে চারদিক থেকে মা তাকে চেপে ধরছেন কেন ? সে আজকে বাইরে যাবে-ই যাবে । মা’র পারমিশন নেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই । মা’কে শুধু জানিয়ে যাবে যে সে বাইরে যাচ্ছে ।
তাবাসসুমের রুমে এসে জারা দেখলো মা বড় খালার সাথে ভিডিও কলে কথা বলেছেন । দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাঁদের কথা শুনে জারা খুব অবাক হয়ে গেলো, মা এই বিষয়টা বড় খালাকেও জানিয়ে দিয়েছেন ! জারা বড় খালার কথাগুলো শুনে তাজ্জব বনে গেলো ৷ বড় খালা বলছেন –
তোকে তো আগেই বলেছিলাম, তুই তো আমার কথা শুনলি না ৷ আরে টুন্ডু হুজুর বহুত কামেল পীর । বড় বড় বদমায়েশ সোজা হয়ে যায় আর আমাদের জারা তো এইটুকু একটা মেয়ে । যাগগে ওটা বাদ দে । এখন যা বলছি সেটা শোন, ছেলে তো রেডিই আছে । আমরা সবাই যেদিন তোর ওখানে আসলাম, রোজার শাশুড়ি বললো না ডাক্তার ছেলেটার কথা । আমার মনে হয় তুই একবার রোজার শাশুড়ির সাথে কথা বল । ওরা যদি চায় তো ঝটপট আকদ্ করিয়ে দে । পরেরটা পরে দেখা যাবে ৷
কী বলো আপা ! কথা নেই বার্তা নেই হুট করে বিয়ে । এরকম হয় না-কি ?
আরে হয় হয় । হয় না বলে এই দুনিয়ায় কিছু নেই বুঝতে পেরেছিস ? এখন বয়সটা খারাপ, কখন কী করে ফেলবে কোনো ভরসা নেই । আমার মনে হয় তুই রোজার শাশুড়ির সাথে এখনই কথা বল । সেটাই সহজ সমাধান ।
আচ্ছা আপা আমি একটু চিন্তা করে দেখি ।
বেশি চিন্তা করিস না । তোর চিন্তার ফাঁকে কিছু না আবার ঘটে যায় ।
মা আর খালার কথা শুনে জারা’র অস্থিরতা আরো বেড়ে গেল । বাইরে যাওয়ার কথা ভুলে রুমে চলে এলো সে । দরজা আটকে আদিকে ফোন করলো জারা । আদি ফোন ধরতেই বললো –
আদি বাসায় খুব বেশি প্রবলেম শুরু হয়েছে ।
কী হচ্ছে ওখানে, তুমি কী বের হতে পারবে না ?
না বের হওয়ার পারমিশন পাচ্ছি না । মা কঠিনভাবে আমাকে পাহারা দিয়ে রেখেছেন । আব্বুকে জানিয়েছেন তোমার সাথে দেখা হওয়ার বিষয়টা । আব্বুও আমাকে অনেক বকা দিয়েছেন ।
আরে কী যন্ত্রণা আন্টি এমন শুরু করলেন কেন?
এখন আবার আমার বড় খালাকে জানালেন । আমার বড় খালা কী বুদ্ধি দিয়েছে শুনবে ?
কী ?
তাঁদের কাছে কোন পাত্র যেন রেডি আছে । তার সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিতে বলছেন ।
বলো কী তুমি !
হুম, আমি এখনই শুনে আসলাম । আদি আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি, অন্য কাউকে আমি বিয়ে করবো না । তার আগে কিন্তু একটা কিছু ঘটে যাবে । আমার ভীষণ ভয় লাগছে আদি । আমি কী করবো এখন ?
জারা তুমি নিজে ঠিক আছো তো ? তুমি আমাকে ছেড়ে যাবা না তো কখনো ?
কক্ষোণো না কিন্তু মা যে আমাকে ঘরে আটকে রেখেছে । যদি সত্যি এমন কোনো ছেলে চলে আসে তখন ?
জারা তুমি আমার কাছে চলে আসো ।
মানে কী ?
মানে তুমি কোনো ভাবে বাসা থেকে বের হও । আমি বুঝতে পারছি তাঁরা তোমাকে আমার কাছ থেকে সরানোর ব্যবস্থা করছেন । জারা তুমি যে কোনোভাবেই হোক বাসা থেকে বের হও ।
তারপর ?
তারপর আবার কী ? আমার বাসা আছে না । তুমি টেনশন কোরো না ।………………………