[১]
—“আমায় নিজের বউ বানানোর স্বপ্ন দেখিয়ে, সংসার বাঁধার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তুমি অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেললে! আমায় এভাবে ঠকাতে তোমার বিবেক বাঁধলো না, আহির?”
আহিরের শার্টের কলার দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে চিৎকার করে কথাগুলো বললো স্পৃহা। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি গড়িয়ে পড়ছে ওর। আহির আহত দৃষ্টিতে তাঁকাতেই স্পৃহা ওকে ধাক্কা দিয়ে দূরে ঠেলে দিলো। ভাঙা গলায় বললো,
-বিয়ে যদি না-ই করবে, তাহলে কী দরকার ছিল এভাবে প্রেম-প্রেম খেলার? এতো স্বপ্ন কেন দেখিয়েছিলে যদি সেগুলো নিজ হাতেই ভেঙে দেবে? আমি তো তোমাকে আগে ভালোবাসিনি! তুমিই নিজের জীবনের সাথে আমায় জড়িয়েছো, এতো এতো স্বপ্ন দেখিয়েছো। তাহলে সবটা শুরু করার আগেই কেন ভেঙে দিলে?
বলেই মুখে হাত চেপে অনেকটা শব্দ করে কেঁদে উঠলো স্পৃহা। আহিরের চোখের কোণেও পানি জমে এসেছে। তাই কয়েকবার ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। কম্পিত স্বরে বললো,
-স্পৃহা, আমি তোকে ঠকাতে চাইনি। কিন্তু সবটা আমার বোঝার ভুল ছিল। আসলে তুই আমার ভালোবাসা ছিলি না, ভালোলাগা ছিলি। সবটাই আমার আবেগ ছিল। এখন যখন আমার বিয়ে হয়েই গেছে, তখন আমি চাই তুই আমায় ভুলে যা। তুই অনেক ভালো কাউকে ডিজার্ভ করিস!
স্পৃহা কান্না থামিয়ে বিস্ফোরিত চোখে আহিরের দিকে তাকালো। দুই হাত দিয়ে আহিরের বুকে ধাক্কা দিয়ে বললো,
-মিথ্যে বলছো তুমি। এটা কোনো লজিক হলো? আমায় তুমি সত্যিই ভালোবাসোনি! এক বছরে তোমার মধ্যে নিজের আমার প্রতি যে অনুভূতি গুলো দেখেছি, তা কোনোদিন ভালোলাগা হতে পারে না। আবেগ হতে পারে না। তুমি মিথ্যে বলছো!
আহির ভীত দৃষ্টিতে তাকালো। এই ভয়টাই পাচ্ছিলো সে। কিছু বলতে যাবে, তার আগেই স্পৃহা ওর হাত দু’হাতে আঁকড়ে ধরে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বললো,
-কী হয়েছে তোমার আমায় বলো, আহির! এই বিয়ে-টিয়ে সব মিথ্যে, তাই না? তুমি কোনো বিয়ে করোনি। শুধু একবার বলো! একবার। বলো যে, তুমি আমায় ভালোবাসো। এটুকুই চাই। একবার বলো।
স্পৃহার আকুতিভরা কন্ঠ শুনে আহির কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। কী করে বলবে সবটা? সে নিজেও যে নিরুপায়! কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে শক্ত করে নিল আহির। অকস্মাৎ ঝাড়া মেরে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো স্পৃহার মুঠো থেকে। কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে তেতে উঠে বললো,
-ভালোবাসি না তোকে আমি! কতোবার বলবো এক কথা? বাংলা বুঝিস না? আমি এখন বিবাহিত। আনিলা আমার বউ আর আমি ওকেই ভালোবাসি, ওর সাথে সুখে থাকতে চাই। সো, তুই আর আমাদের মাঝে আসিস না। নিজের জীবনটা নতুন করে গুছিয়ে নে। আর পারলে আমাকে ঘৃণা করিস, ভালো থাকবি।
আহির আর এক মুহূর্ত দেরি না করে হনহন করে ঘর থেকে চলে গেল। স্পৃহা বজ্রাহত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। আহিরের বলা প্রতিটা শব্দ ওর মনে তীরের মতো বিদ্ধ হয়েছে। পাথরের মূর্তির মতো স্থির দৃষ্টিতে আহিরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে সে।
•
-পিহু, বরপক্ষ চলে এসেছে। চল!
ভাবনার মাঝে কারো ডাকে অনেকটা চমকে উঠলো স্পৃহা। এক মাস আগে আহিরের বলা কথাগুলো এখনো কানে বাজে ওর। বিশ্বাসই হয় না যে, আহির ওর সাথে এমনটা করেছে। ভাবনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে আয়না থেকে চোখ সরালো স্পৃহা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই মেয়েগুলো বললো,
-কী এতো ভাবছিস, হুম? বরমশাই কিন্তু তোর জন্য বিয়ের আসনে অপেক্ষার প্রহর গুনছে! দেরি করলে বেচারার কষ্ট লাগবে না?
মেয়েগুলো স্পৃহার কাজিন। ওরা যে মজা করছে, সেটা স্পৃহা ঠিকই বুঝতে পারছে। কিন্তু ওর এসব ঠাট্টা প্রচন্ড বিরক্তিকর লাগছে। আহিরের প্রতি অভিমান আর জেদের বশেই বিয়েটা করতে এককথায় রাজি হয়ে গেছে ও। সেই সুবাদেই আজ অন্য কারো জীবনের সাথে নিজের জীবন বাঁধতে চলেছে সে। সবার দিকে তাকিয়ে নাক-মুখ কুঁচকে বললো,
-হয়েছে তোদের? মজা করা শেষ? এবার চল।
সবার মুখ মলিন হয়ে গেল। স্পৃহার এই হঠাৎ গম্ভীর আর খিটখিটে রূপটা ওদের কারোরই ভালো লাগে না। যদিও ওরা কেউ এর কারণও জানে না। স্পৃহা তো একদমই এমন ছিল না। হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল একটা মেয়ে ছিল। কিন্তু এক মাস যাবৎ ওর এই পরিবর্তন কেন হলো সেটা সবারই অজানা।
বিয়ের আসরে নিয়ে এসে বসাতেই বধূ বেশে সজ্জিত স্পৃহার দিকে চোখ আঁটকে গেল আহিরের। ঠিক এমনভাবেই স্পৃহাকে দেখতে চেয়েছিল সে, নিজের পাশে ওর বউ হিসেবে। স্পৃহা আজ ওর মন মতোই সেজেছে কিন্তু অন্য কারো জন্য। অদৃষ্টের পরিহাস সত্যিই খুব অদ্ভুত। ওদের দুজন দুজনের প্রতি আকাশ পরিমান ভালোবাসা থাকলেও আজ বিচ্ছেদ-ই ওদের পরিণতি। ভাবতেই বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আহিরের।
স্পৃহাকে বরের পাশে বসানো হয়েছে অনেকক্ষণ আগেই। কিন্তু একবারের জন্যও পাশে বসা মানুষটার দিকে তাকায়নি ও। হঠাৎ কী মনে হতে আশেপাশে একবার তাকাতেই সামনে কিছুটা দূরে আহিরকে দেখতে পেল। স্পৃহার চোখে চোখ পড়ার আগেই আহির দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। স্পৃহা আবার চোখ নামিয়ে নিল।
ধর্মীয় রীতিমতো বিয়ে পড়ানোর পর স্পৃহাকে ‘কবুল’ বলতে বললেই ও আবার অদূরে দাঁড়ানো আহিরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আহির সেটা বুঝতে পেরে পাশে দাঁড়ানো আনিলাকে একহাতে জড়িয়ে ধরলো। সেটা দেখে স্পৃহা চোখ বন্ধ করে একদমে কবুল বলে দিলো। কাঁপা কাঁপা হাতে সিগনেচারও করে দিলো। বুকের ভেতর ভারী হয়ে উঠছে স্পৃহার। কান্নাগুলো গলায় আঁটকে আছে। তবে ও মনস্হির করে ফেলেছে, আহির যদি ওকে ঠকিয়ে সুখী থাকতে পারে, তাহলে ওকেও পারতে হবে। অতীতের পিছুটান গুলো দূরে ঠেলে নতুন সম্পর্কটা ভিত্তি করেই ভবিষ্যৎ সাজাতে হবে তাকে।
এদিকে আনিলা আহিরকে আড়ালে টেনে নিয়ে এসে অবাক কন্ঠে বললো,
-এটা কী ঠিক হলো, আহির? তুমি আমায় বিয়ে না করলেই পারতে। পিহু কিন্তু তোমাকে এখন ঘৃণা করবে!
আহির মলিন হেসে বললো,
-আমি তো সেটাই চাই! কিন্তু ও আমায় কোনোদিন ঘৃণা করতে পারবে না। একটু বেশিই ভালোবাসে মেয়েটা আমায়।
-ওকে সবটা খুলে বলে দাও। ওকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে দিয়ে কী লাভ হলো? সত্যিটা জানলে হয়তো ও এতোটা কষ্ট পাবেনা যতটা এখন পাচ্ছে।
-সাময়িক এই কষ্টটাই ওর ভবিষ্যৎটা সুন্দর করবে। আর সবটা জানলে ও সারাজীবনই কষ্ট পাবে। সেটা তো আমি হতে দিতে পারি না, তাই না?
-কিন্তু …
-কোনো কিন্তু নয়। বিয়েটা হয়ে গেছে স্পৃহার। এখন কোনো কথার দরকার নেই। ধীরে ধীরে ও আমার জায়গায় আদ্রকে বসিয়ে ফেলবে। সেটা জেদ করেই হোক বা বাধ্য হয়েই হোক। মিলিয়ে নিও।
আনিলা মাথা নাড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কথার পৃষ্ঠে বলার মতো কোনো কিছু আর নেই।
_____________________
ফুলে সজ্জিত গাড়িটা একটা বড় গেইট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই স্পৃহা বুঝতে পারলো, এটাই তার শশুরবাড়ি। গাড়িটা বাড়ির ঠিক সামনে গিয়ে থামলো। স্পৃহার পাশের দরজাটা খুলে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো কেউ। স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটা অমায়িক একটা হাসি দিলো। হঠাৎ পেছন থেকে মেয়েলি কন্ঠ ভেসে এলো,
-এটা কী করছিস তুই, আদ্র? তোকে কী বলেছিলাম আমি?
আদ্র বিরক্তি নিয়ে বললো,
-আরে, ওকে বের তো হতে দাও আগে!
বলেই স্পৃহার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললো,
-আর তুমি! গিভ মি ইয়র হ্যান্ড এন্ড কাম উইথ মি।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজের হাতটা আদ্রের হাতের ওপর রাখলো স্পৃহা। গাড়ি থেকে বের হতেই আদ্র ওকে হুট করে কোলে তুলে নিলো। স্পৃহা শকড হয়ে বললো,
-আরে এসব কী?
আদ্র ওকে কোলে নিয়ে ভেতরে যেতে যেতে বললো,
-এটাই রুলস। মেইনডোর পর্যন্ত এভাবে না নিয়ে গেলে একটা মারও মাটিতে পড়বে না।
স্পৃহা হতভম্ব হয়ে গেল এমন কথা শুনে। দরজার সামনে গিয়ে আদ্র ওকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো। একটা মধ্যবয়সী মহিলা ওকে বরণ করলেন। স্পৃহা বুঝতে পারলো যে, এটাই ওর শাশুড়ী মা। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই মনের ভেতর এক অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করলো স্পৃহা। আজ থেকে এটাই ওর ঠিকানা, এখানেই কাটবে ওর ভবিষ্যৎ। সে পারবে তো অতীতের সবকিছু ভুলে নতুন করে জীবন সাজাতে? নাকি আবারও ঠকতে হবে তাকে? কী অপেক্ষা করছে স্পৃহার আগামী দিনগুলোতে?
-চলবে?
#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#সূচনা_পর্ব
#পর্বঃ০১