এক মুঠো প্রেম পর্ব -৩০

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ৩০

স্পৃহার উদ্যোগে আজ একটা সম্পর্কের ফাটল ভরাট হয়েছে। নিজের বাবা-মাকে এতো বছর পর একসাথে স্বাভাবিক ভাবে দেখে প্রান্তির চোখে পানি টলমল করছে। কখনো একসাথে বাবা-মায়ের আদর পায়নি ও। পাওয়ার আশাও ছিল না। অবুঝ শিশু থাকা অবস্থায়-ই বাবা-মাকে বিচ্ছিন্ন হতে দেখেছে সে। কিন্তু আজ এই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তির আনন্দটা বলে প্রকাশ করার মতো না। ভেবেই স্পৃহাকে জড়িয়ে ধরে ভাঙা গলায় বললো,

-থ্যাঙ্কিউ, পিহু!! থ্যাঙ্কিউ সো মাচ, ইয়ার। আমি কখনো ভাবতেও পারিনি বাবা-মায়ের মাঝে সব ভুল বোঝাবুঝি মিটে যাবে। তুই না থাকলে কখনো এটা সম্ভব হতো না।

স্পৃহা ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। পাশ থেকে আনিলা অপ্রসন্ন সুরে বললো,

-সবই তো ঠিক হলো! কিন্তু প্রণব যে আবার চটে গেল, সেটার কী হবে?

স্পৃহা কিছু একটা ভেবে বললো,

-সেটার জন্যও একটা ব্যবস্থা করতে হবে। দেখি কী করা যায়!
________________

কুয়াশায় আবৃত নিস্তব্ধ নগরী। নিকষ কালো আকাশের একপ্রান্তে মেঘের আড়াল থেকে বারবার উঁকি দিচ্ছে এক ফালি চাঁদ। ক্ষণে ক্ষণে ঝি ঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। ছাদের এক প্রান্তে বসে গিটারের ওপর অগোছালো টান দিচ্ছে প্রণব। সুরও উঠছে এলোমেলো। তবে সুদক্ষ হাতে সুরটা বেশ সুনিপুণ ঠেকছে। আজ মন ভারাক্রান্ত হওয়ার পেছনে যথাযথ কারণটা ঠিক ধরতে পারছে প্রণব। কারণটা হয়তো তার বাবা, নয়তো তার মা! হয়তো উভয়েই, নয়তো কেউই না! নিবিষ্ট মনে ভাবনায় ডুবে থাকা অবস্থাতেই কারো আগমন তীব্রভাবে অনুভূত হলো তার। কারো পদধ্বনি প্রণবের সচকিত কর্ণকুহরে তরঙ্গিত হতেই সে সুর তোলা থামিয়ে দিলো। আগমনীর ব্যাপারে না দেখেও সে সম্পূর্ণ অবগত। কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপটটা ভিন্ন। অন্য সময়ে মানবী-টির আগমনে অজান্তে, অনিচ্ছায় ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির রেখা ফুটে উঠত। কিন্তু আজ অন্দরমহলে জমাট হওয়া কালো মেঘের কারণে ইচ্ছে সত্ত্বেও আনন্দ গুলো ধরা দিচ্ছে না।

-আপনি কি চাইতেন না যে, আপনার বাবা-মা আবার এক হোক?

প্রণব সামনে থেকে চোখ সরিয়ে পাশে তাকালো। স্পৃহার ওপর দৃষ্টি স্থির তার। হালকা আলোয় স্পৃহার হলদেটে মুখটা মায়াবী ঠেকছে। প্রণব চোখ বন্ধ করে নিলো। সবসময় ইচ্ছে-পাখি গুলোকে ডানা মেলে উড়তে দিতে নেই। চোখ সরিয়ে নিয়ে সে নিস্তেজ কন্ঠে বললো,

-এ ব্যাপারে আমার কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিলো না। ছোট বেলায় বাবাকে সবসময়ই পাশে পেয়েছি একজন বেস্ট সাপোর্টার হিসেবে। কখনো ভাবিনি কালের বিবর্তনে সেই ব্যক্তিটার সাথে ই আমার সম্পর্কে মরিচা ধরবে। মা যেদিন বাবার সাথে ঝামেলা করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন, সেদিন আমাকে আর প্রান্তিকে নিয়ে যেতে চাইলে বাবা আমাদের ছাড়েননি। মা খালি হাতেই চলে গিয়েছিল। এরপর মাঝে মাঝে আমি মায়ের সাথে দেখা করতে যেতাম। মায়ের কষ্ট গুলো খুব কাছ থেকে দেখতে পেতাম। বাবার ওপর রাগ হতো প্রচুর। কেন মাকে অকারণে এতো কষ্ট দিতো? ইচ্ছে করত মায়ের কাছে একেবারে চলে যেতে। কিন্তু প্রান্তির জন্য পারতাম না। ও একা একা থাকবে কী করে? বাবা ওকে কোনো মতেই ছাড়বেন না। বাধ্য হয়ে এ বাড়িতে থাকতে হয়েছে। বাবাও আগের মতো আমাদের সময় দিতেন না। কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে থাকতেন সবসময়। কাজে ডুবে থাকাটাই তিনি বেশি পছন্দ করতেন।

প্রণব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললো,

-স্কুলে পেরেন্টস ডে-এর দিন একা একা যেতাম। কখনো বাবা-মাকে সঙ্গী হিসেবে পাইনি। সবাই সবার পেরেন্টস-এর সাথে আনন্দ করত, খেলত, টিচারদের সাথে ডিসকাস করত। আর আমি শুধু দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। ছুটির পর ড্রাইভার নিতে এলে অনেক বকতাম। কান্না করতে করতে বলতাম, “কেন নিয়ে এসেছ আজ স্কুলে? তুমি জানো না আজ প্যারেন্টস ডে? আমার তো বাবা-মা নেই! আমায় কেন স্কুলে নিয়ে এসেছ?” অনেক কান্না পেত। বাবা-মায়ের কাছে অভিযোগ করতে ইচ্ছে করত। কিন্তু কাউকেই কাছে পেতাম না। মায়ের কান্না দেখে তাকে দূরে ঠেলতে পারতাম না। কিন্তু বাবার কান্না তো দেখতে পেতাম না। তাই রাগটা উনার ওপরই পড়ত। বাবা বলতে ইচ্ছে করতো না। সবসময় মিস্টার চৌধুরী বলেই সম্বোধন করতাম। আমি নিজে এসব সহ্য করলেও প্রান্তিকে কখনো একাকিত্ব বোধ করতে দেইনি। ওর জীবনে একমাত্র গার্ডিয়ান আমি ছিলাম। বাবা-মা দুজনদুজনের আদর একাই দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এজন্যই ও আমাকে ছাড়া কিছু বুঝে না।

কথাগুলো বলার সময় প্রণবের কন্ঠ বারবার কেঁপে উঠছে। স্পৃহা সবটা নীরবে মনযোগ সহকারে শুনলো। কষ্টটা ওর বেশ ভালো করেই বোধগম্য হলো। কেননা সে নিজেও একই পরিস্থিতির কবলে পড়ে বড় হয়েছে। তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে প্রশ্ন করলো,

-আপনার বাবাকে আপনি ভালোবাসেন না?

প্রণব মলিন হাসলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,

-খুবই জটিল প্রশ্ন করে ফেললেন, মিসেস নিস্তব্ধতা! ছোট বেলায় অবুঝ ছিলাম। অনেক অদ্ভুত কাজ করতাম যার কারণ গুলো আজও আমার কাছে অজানা। সকালে উঠে বাসার সবগুলো গাড়ির টায়ার পাম্পচার করে দিতাম যেন স্কুলে যাওয়ার আগে বাবা আমার গাড়িতেই লিফট চায়। ফাদার’স ডে তে বাবার জন্য শার্ট বা ওয়াচ কিনে ওনার ব্যবহার করা শার্ট-ঘড়ির সাথে এক্সচেঞ্জ করে রাখতাম। বাবা নিজের অজান্তেই আমার দেওয়া গিফটগুলো ইউজ করতো। বাবার বার্থডে তে একা একা ছাদে বসে কেক কাটতাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে কতশত অভিযোগ করতাম। গল্প করতাম। ছোট ছিলাম তখন। কিন্তু সেই অনুভূতি গুলো আজও প্রখর। বাবা-মা দুজনকেই ভালোবাসি আমি। কাউকে কারো থেকে কম ভালোবাসি না। দুজনের প্রতি আমার অনুভূতি সমান।

বলে পেছনে ঘুরতেই প্রণব স্থির হয়ে গেল। তার সামনে তার বাবা-মা দুজনেই দাড়িয়ে আছে। দুজনের চোখই জলপূর্ণ হয়ে আছে। তার মানে প্রণবের বলা প্রতিটা কথা তারা শুনেছেন। প্রণব চোখ ঘুরিয়ে স্পৃহার দিকে তাকালো। স্পৃহা হালকা হেসে চোখ সরিয়ে নিতেই প্রণব বুঝতে পারলো, প্রণবের মুখ থেকে সবটা শোনার জন্যই স্পৃহা এসব জিজ্ঞেস করেছে। তাই নিজের প্রতি খানিকটা বিরক্তি নিয়েই বাবা-মায়ের পাশ কাটিয়ে চলে যেতে উদ্ধত হলো সে।

-আমরা আমাদের ভুল শুধরে নিতে চাই। উই আর সর‌্যি!!!

মিস্টার চৌধুরী ও মিসেস মেহরীন একসঙ্গে কথাটা বলে উঠতেই প্রণবের পা থেমে গেল। সে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে পেছন ফিরে তাকালো। মিস্টার চৌধুরী ও মিসেস মেহরীন চোখে পানি রেখেই মলিন হেসে নিজেদের কান ধরলেন। মিস্টার চৌধুরী অনুযোগের স্বরে বললেন,

-এই যে কান ধরছি তো! আর জীবনেও তোকে কষ্ট দেব না।

বলেই মিসেস মেহরীনকে ইশারা করতেই তিনিও কান ধরে বললেন,

-আমিও তোদের আর একা ফেলে কোথাও যাবো না। আর রাগ করে থাকিস না, বাবা। এবারের মতো ক্ষমা করে দে।

ওনাদের কথা বলার ধরণ দেখে প্রণব চেষ্টা করেও হাসি আটকাতে পারলো না। সশব্দে হেসে বাবা-মাকে দু’হাতে আগলে নিলো,

-সিরিয়াসলি তোমরা এতো নাটক জানো? তোমাদের ওপর রাগ নেই। কিন্তু অনেক অভিমান হয়েছিল।

কোথা থেকে প্রান্তি দৌড়ে এসে ওদের তিনজনের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে বললো,

-এই ভাইয়া! তুই বাবা-মাকে একদম ভালো-টালো বাসবি না। তোর ভালোবাসার ভাগ আমি কাউকে দেবো না।

মিস্টার চৌধুরী ভ্রু কুঁচকে বললো,

-ওরে হিংসুটে!!!

প্রান্তি ভেংচি কেটে বললো,

-হ্যাঁ, হিংসুটে-ই। তোমরা এভাবে উড়ে এসে জুড়ে বসছো কেন?

মিসেস মেহরীন বললেন,

-আমাদের তো অধিকার আছে! প্রণব আমাদের ছেলে, বুঝলি? তোর থেকে আমাদের হক বেশি।

-এ্যাহহহহ!!! বললেই হলো নাকি? আমি যা বলেছি, সেটাই হবে। আমার ভাইয়া শুধু আমাকে ভালোবাসবে। আর কাউকে না।

প্রণব কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,

-তাহলে তো তুই আমাকে বিয়েও করতে দিবি না দেখছি! তোর মতো হিংসুটে ননদের ভয়ে আমার বউ আমাকে ছেড়ে চলে যাবে!

-তোর বউয়ের ব্যাপার তো আলাদা! সেক্ষেত্রে কন্সিডার করা যায়। তবে অন্য কোনো ক্ষেত্রে না।

আনিলা আর স্পৃহা ওদের কাহিনী দেখে হাসছে। শেষে আনিলা তাড়া দিয়ে বললো,

-অনেক হয়েছে। এবার চলো সবাই ডিনার করবে। চলো! চলো!!

একে একে সবাই চলে যেতেই স্পৃহা সবার শেষে ছাদের বাইরে পা রাখলে। এমনসময় প্রণব ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। স্পৃহা খানিকটা চমকে উঠলো। প্রণব সেটা বুঝতে পেরে হাসলো। বললো,

-এতো কিছু করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারবো না। যার পুরো সত্তাটাই আমার জন্য স্পেশাল, তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভঙ্গিটাও স্পেশাল হওয়া উচিত।

বলেই স্পৃহাকে কিছু না বলতে দিয়ে ঝড়ের গতিতে চলে গেল। স্পৃহা কথার মানে বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো শুধু।
___________________

চৌধুরী ভবনের প্রতিটা মুহূর্ত-ই এখন সুমধুর। সম্পর্ক গুলো নতুন মাত্রায় নতুন অভিব্যক্তি নিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। প্রতিটা বেলা যেন স্বর্গীয় অনুভূত হয়। এমনই এক সকালে সবাই ব্রেকফাস্ট সেরে বসার ঘরে গোল হয়ে বসেছে। প্রণব ব্যতিত সবাই উপস্থিত। টিভিতে নিউজ চ্যানেল ওপেন করতেই নিচের লেখা গুলো পড়ে থমকে গেল স্পৃহা। সাংবাদিক নিজের বক্তব্য শুরু করতেই একে একে বিষয়টা সবার দৃষ্টি গোচর হলো। মিস্টার চৌধুরী দেখলেব পত্রিকার শিরোনামও একই খবর তুলে ধরেছে। এই দিনটাও দেখা বাকি ছিল স্পৃহার?

# চলবে……

✘]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here