#একই_সুতোয়_বাঁধা
পর্ব-৬
সপ্ত শীখা
এদিকে মামার বাড়িতে দিন কাটছে সায়নের। আর ওদিকে গ্রামে পুষ্প। আজ এক বছর হয়ে গেল… খারাপ নেই ওরা কেউই।
পুষ্প ক্লাস এইটে পড়ে। তারুণ্যের ছোঁয়া ওকে দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়। পুষ্পর মা আছিয়া মেয়ের রূপ কে পশুর হাত থেকে বাঁচাতে বোরকা পরাচ্ছেন। পুষ্প একেবারে নেকাবে আবৃত হয়ে বাড়ি থেকে বের হয় এখন।এই সময়টায় খুবই হাসি পায় পুষ্পর। ও মনে মনে একটা ব্যাপার ঠিক করেছে। সায়ন ফিরলে পুষ্প ওর সামনে যাবে এই নিকাব পরে। পরিচয় ও দেবে না। দেখা যাক সায়ন চেনে কি না !
— পুষ্প ! ও আম্মাজান। এদিকে আসো।
— কি আব্বা ?
— এই দেখ। পড় তো এইটা কি ?
— আব্বা… তোমার বড় অফিসে চাকরি হইসে ! মিষ্টি আন নাই আজকে ?😍😍😍
— কিন্তু মা, অই অফিসে এইখান থেকে কাজ করা যাইব না। তাই সদরে বাসা নিব ভাবতেছি…
— গ্রাম ছাইড়া যাব আমরা !
— না রে পাগলি মেয়ে। ছাড়ব ক্যান ? এখন আমরার দুইটা বাসা হইব। এখানে ছুটি পড়লে আসব। মন ছোট করবা না।
— ও।
— শুন মা। তোমার জে এস সি পরীক্ষার তো আর এক মাস বাকি মোটে। পরীক্ষাটা শেষ হইলেই আমরা নতুন বাসায় উঠমু। সবেরে বইলা রাইখো।
পুষ্প খুবই মন খারাপ করে এসে পড়তে বসল। কান্না করতে করতেই পড়ছে। এতকালের পরিচিত, এত প্রিয় এত আপন গ্রামটা ছেড়ে যেতে হবে ! যতই বাবা বলুক দুইটা বাসা হবে… পুষ্প জানে ও কখনই আর গ্রামে থিতু হতে পারবে না। হয়ত ঘুরতে আসবে মাঝে মধ্যে।
💚💚💚💚💚
— রহিম ভাই আপনে কি বলেন এইসব ? পুষ্প আমরার বাড়ির বউ। ওরেই আপনে গ্রাম থিকা সরায় নিতেছেন ?
— আহহ সাদেক সাব। আমাদের মধ্যে কি কথা হইছিল ? সায়ন লায়েক হইয়া আসলে তারপরে আমরা বিবাহের কথাটা ওদেরে জানাব। আর বাড়ির বউ এর সাথে শহরে যাওয়ার কি সম্পর্ক ? ও আপনের ছেলের বউ আছে আর থাকব আজীবন ইনশাল্লাহ।
— ভয় হয় রহিম ভাই। ছেলে মেয়ে দুইজনেই আলিদা হইয়া গেল। কে জানে বিবাহের কথাটা মাইন্না নিব কিনা। আম্মার কথায় তো বিবাহ দিলাম। আম্মা ও মারা গেসেন গেল বছর। উনি থাকলে বুঝায়ে বলতেন। যাই হউক… রহিম ভাই আপনের উপ্রে বিশ্বাস আছে আমার।
— আইচ্ছা ভাই। আজকা আসি। এই হপ্তায়ই ইনশাল্লাহ রওনা হমু। দোয়া রাইখেন ভাই।
— জি… আর একটা কথা। আমার বউমার খেয়াল রাইখেন। সায়ন যাউনের পর থিক্কা মেয়ের আমার লাফানি কইমা গেসে… কিন্তু মুখটা তো দেখতাম। এখন ত তাও নাই। খেয়াল রাইখেন ওর…
— চিন্তা কইরেন না ভাই। আর ভাবিসাব রে বইলেন।
— উনি জানেন সব… দুইদিন কাইন্দা ভাসাইতেছে মেয়ের জন্য।
রহিম সাহেব সাদেকুর রহমানের বাড়ি থেকে বেরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কত যে মায়া জড়িয়ে আছে এ গ্রামের সাথে ! সব ছেড়ে যেতে হবে। কত কত ভালবাসার বাঁধন ছাড়িয়ে চলে যাবেন।
💚💚💚💚💚
পুষ্প ভীষণ কাঁদছে। এমনি কান্না যে চারপাশে লোক জমে গেছে। লাইলি বেগম কে জড়িয়ে ধরে কি যে কান্না। সেই সাথে লাইলি বেগম ও কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন। আর এদের কান্নাকাটিতে শেষকালে আছিয়া আর পুষ্পর দাদিও কেঁদে ফেললেন।
পুষ্পর বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছে। জন্ম থেকে এই গ্রামে তার বসবাস। সায়নের সাথে সকল খুনসুটির স্থান এই গ্রামটা। আর লাইলি বেগম ? তিনি পুষ্পর কাছে মায়ের মতই। মায়ের চেয়েও বেশি পুষ্প তার কাছে থেকেছে। সায়নের সাথে যতবার ঝগড়া করেছে তিনি পুষ্পর পক্ষ নিয়ে উল্টো সায়ন কেই বকে দিয়েছেন। এমন মানুষটাকে রেখে কিভাবে যায় পুষ্প !
আর সবচে বড় কথা। সায়ন ! ও গ্রামে ফিরে পুষ্পকে না পেয়ে যদি কষ্ট পায় তবে ? ছেলেটা মুখচোরা প্রকৃতির বলেই খুব অভিমানী। রেগে বসে থাকবে যে !
— খালা… সায়ন ভাই আসলে-
— ভাই কইতে না করছি না ? সায়ন বল
— ক্যান যে মানা কর ! ও খালা… সে আসলে আমারে একটা খবর দিও গো
— তরে না তো কারে খবর দিমু রে পাগলি ! তুই যে ওর কি তুই নিজেও জানছ না।
— খালা… আমার খুব কষ্ট হইতেছে যাইতে 😭😭
— কান্দে না লক্ষ্মী মা আমার… আম্রার ও তো কষ্ট হইতেছে দেখ আমি কি কানছি ?
— কান্দ নাই তো এইডি কি চোখ দিয়া ঝরনা পড়তেছে ? ও খালাগো… আমারে তোমরা রাইখা দাও না…
এইরকম বাচ্চাদের মত কান্না করায় তাকে সামলাতে বেগ পাচ্ছেন রহিম সাহেব। খুব কষ্টে মেয়েকে টেনে নিয়ে ট্রাকের উপর বসালেন। মালপত্র বেশিরভাগ ই চলে গেছে। অবশিষ্ট গুলোর সাথে আজ তারাও যাচ্ছেন গ্রামের মায়া কাটিয়ে।
সবাইকে বসিয়ে এসে বাড়ির দরজায় তালা লাগাতে গিয়ে নিজের কাছে নিজেকে অপরাধি মনে হচ্ছে রহিম সাহেবের। ভাল চাকরির জন্য মেয়েটাকে এত কষ্ট দিলেন… কিন্তু এ তো সব ওর জন্যেই ! বাপ দাদার ভিটা ছেড়ে যাচ্ছেন। খুব কষ্ট হলেও তা লুকোতে হচ্ছে তাকে। কি করার.. তিনি ভেঙ্গে পড়লে ঘরভরা মেয়েদের সামলাবে কে ? মনে মনে বাবা ও দাদাজানের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে শেষবারের মত সবকিছু চেক করে দরজায় তালা দিলেন গোলাম রহিম সাহেব।
💚💚💚💚💚
ক্লান্ত হয়ে পড়েছে পুষ্প। প্রথম দিনেই হাঁফ ধরে গেছে তার। এত ইট কাঠের ভিড়ে কোন সবুজ খুঁজে পাচ্ছেনা ও। তার বাবা গলির ভেতর একটা চার রুমের বাসা নিয়েছেন। আগের মতই পুষ্প আর দাদি এক রুমে থাকছে।
যেদিক দিয়েই তাকায় কেবলি উচুঁ উচুঁ বিল্ডিং। কোন গাছপালা নেই। মাঝে মাঝে রাস্তার দুপাশে আধমরা গাছের সারি দেখা যায়। এমনকি উচুঁ বিল্ডিং গুলোর ভিড়ে আকাশ দেখার ও সুযোগ নেই। কি ভীষণ চাপা ! হাত পা ছড়িয়ে বাঁচে কিকরে এখানকার মানুষ !
— কিরে পুষ্প। ঘুমাছ না ?
— আসেনা ঘুম। তুমি ঘুমাইতেছ না ক্যান ?
— আমিকবেই ঘুমাই রে দাদু। বয়স যত হইব তত ঘুম আর ক্ষিদা কমব। এল্লিগা বয়স থাকতে থাকতে খাইয়া নে যা খাওয়ার।
— কি যে কও দাদি। হাসি লাগে আমার। আমি তো সবসময়ই বেশি খাই।
— সায়নেরে মনে পড়ে পুষ্প ?
— মনে পড়ব না ক্যান ? ওর কথা হঠাৎ ?
— এম্নি জিগাই। দেখতে মনে চায়না অরে ?
— দাদি ঘুমাও ত। রাইত জাইগা উল্টাপুল্টা জিনিস বকতেছ। ঘুমাও।
পুষ্প পাশ ফিরে শুয়ে চোখ বুজল। দাদিরচোখে ঘুম নেই।তিনিও হাঁপিয়ে উঠছেন এই ইট কাঠের ভিড়ে। অন্ধকারে নিঃশব্দে হাসলেন তিনি। পুষ্পকে সায়নের কথা এতদিন জিজ্ঞেস করেননি তিনি। আর আজ জীবনে প্রথম ওকে সায়নের নামে লজ্জা পেতে দেখলেন। তার বয়সী চোখ…বুঝতে ভুল করেনি কখনো। তার নাতনি সায়ন কে ভালবাসতে শুরু করেছে। বা হয়ত আগে থেকেই ভালবাসে ! কে জানে… তবে বাসলেই ভাল। স্বামী স্ত্রীর মধুর সম্পর্কটাকে এরা আরো মধুর করে তুলুক… যেন এর নির্যাসেই এদের বাকি জীবন টা কেটে যায়।
[ মুগ্ধ ! ]