একই সুতোয় বাধা পর্ব ৫

#একই_সুতোয়_বাঁধা

পর্ব-৫

সপ্ত শীখা

চলে গেছে সায়ন। চোখের জল ফেলতে ফেলতে ওকে বিদায় জানিয়েছেন লাইলি বেগম। মায়ের মন তার… সর্বদাই ভীত হয়ে থাকে। আর আজ তিনি বুঝতে পারছেন… ছেলে চিরকালের জন্য ঘরছাড়া হয়ে গেল। লেখাপড়া শিখে সায়ন কি কখনো ফিরবে এই গ্রামগঞ্জে ?

পুষ্প সায়নের বিদায়ের আগেই নিজের বাড়ি ফিরে এসেছে। এসে থেকেই মন খারাপ করে বসে আছে জানালার ধারে। এই জানালাটা দিয়ে নদী দেখা যায়। নদীর ঠান্ডা হাওয়া একটু একটু করে আসতে শুরু করেছে। সন্ধ্যে নাগাদ মিষ্টি বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। কিন্তু পুষ্পর আজ এসব দিকে খেয়াল নেই। বারবার চোখে পানি আসছে তার। তের বছরের এই ছোট্ট জীবনে এমন অদ্ভুত অনুভুতি আর কখনো হয়নি পুষ্পের। সায়ন কে আজীবন খেলার সাথী হিসেবেই জেনে এসেছে ও। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সায়ন কে ছাড়া ওর জীবন অসম্পূর্ণ। সায়ন এর বকাঝকা আর অকারণ কানমলা, চড়থাপ্পর, আর তার জন্যে শেষে বিব্রত ভঙ্গীতে ক্ষমা চাওয়া… এসব ছাড়া পুষ্প বাঁচবে কিকরে !!

আছিয়া পুষ্পকে সকাল থেকে খুঁজছেন। তার মশলা বেটে দিতে হবে। ঘরে খুঁজে হয়রান হয়ে বাহির থেকে ঘুরে এসে দেখেন মেয়ে উদাস হয়ে জানালার পাশে বসে রয়েছে। আছিয়া খেপে এসেছেন ধরতে… কোথায় ছিল এতক্ষন !

পাশে এসে পুষ্পর চুলের মুঠি ধরতে গিয়ে থেমে যান আছিয়া। মেয়ের চোখের নিচে শুকনো জলের রেখা স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। তাই নিজেকে নিবৃত্ত করে পুষ্পর দিকে তাকালেন। চোখ ও ছলছল করছে ওর। এত কিসের কান্না ? শুনেছিলেন সায়ন ঢাকায় যাবে পড়তে… তাই নাকি !

— পুষ্প ! ও পুষ্প ! কি হইছে মা ?

পুষ্প মা কে দেখে নিস্পৃহ স্বরে বলল…

— কি হইব ? কিছু না। তোমার নাকি বাটনা বাটা লাগব… চল যাই।

— সায়ন চইলা গেছে ঢাকা ?

— হু গেছে মন হয় এতখনে।

— পুষ্প… তর সায়নের জন্যি মন খারাপ… না ? সত্যি কইরা ক…

পুষ্পের দুচোখে জল এসে পড়েছে ততক্ষনে আবারো। জল গোপনের চেষ্টা করল না ও। মায়ের সাম্নেই চোখ মুছে নিয়ে মশলার ঢিপি নিয়ে বসল।

💚💚💚💚💚

সায়ন মামার বাড়ি এসে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। সাদেকুর রহমান তো নিয়ে এসে নাস্তা খেয়েই দৌড়েছেন ট্রেন ধরতে। এদিকে সায়নের অবস্থা খারাপ। ওর নিজে কে এতটাই ছোট মনে হচ্ছে বলার মত নাহ। মনে হচ্ছে এ বাড়ির সকলে ওর উপর হাসছে আড়ালে।

মনে হবারই কথা অবশ্য। রিমন সুমন ওর মামাত ভাই। রিমন ওরই সমবয়সী। আর সুমন ক্লাস সিক্সে পড়ে। ওদের গেটাপ দেখে আর চালচলনেই নিজেকে অমন নিম্ন শ্রেনীর মনে হচ্ছে সায়নের। যদিও মামা মামী কেউই আপত্তি করেননি কোনরকম… উল্টো ওর বেশ আদর যত্নই করেছেন। কাজের মেয়েটা ওর ঘর দেখিয়ে দিয়েছে। দোতলার উপর একটা সিঙ্গেল রুম পেয়েছে সায়ন।

জিনিসপত্র গুছিয়ে জানালার পাশে বসল সায়ন। সবকিছু গোছাতে গোছাতে বেশ রাত হয়ে গেছে। বাড়ির সবাই ঘুমে বিভোর। এত ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও সায়নের চোখে ঘুম নেই। খুব একা একা লাগছে তার। এই নির্বান্ধব পুরীতে কি করবে ও !! দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলল সায়ন। কান্না পেলেই এই কাজটা করে ও। কারন বাবা বলেছেন… “ছেলেদের কাঁদতে নেই। বেশি কষ্ট হলে দুহাতে মুখ ঢেকে জোরে নিঃশ্বাস নিবি… তাতে কষ্ট দূর হবে।”

মুখ থেকে হাত সরিয়ে জানালার বাইরে তাকাল সায়ন। বড় একখানা চাঁদ উঠেছে আজ। মেঘমুক্ত আকাশ তারায় তারায় উজ্জ্বল। আচ্ছা… পুষ্প এই মুহূর্তে কি করছে ? নিশ্চয়ই পড়াশুনো শেষ করে ঘুমাতে গেছে। সায়ন থাকলে এই ভরা পূর্ণিমার রাতগুলো পুষ্প ঘুমাতে চাইত না। প্রায় রাতেই সায়ন পুষ্পরই কথামত চুপিচুপি ডেকে বের করে আনত ওকে বাড়ি থেকে। তারপর দুজনে মিলে গড়ের টিলায় বসে চাঁদের আলোয় গল্প করত আর পুষ্পর আনা চালভাজা খেত। কি ভীতু যে মেয়েটা ! রাতের বেলা চাঁদের আলোয় বসে গপ্প করবে ঠিকি… এদিকে ভয়েরও অভাব নেই। বলে কিনা রসালো খাবার আনলে তেনারা আকৃষ্ট হবেন তাই চালভাজার ব্যবস্থা !

অনেক স্বপ্ন পুষ্পর। গ্রামদেশের মেয়েদের এত স্বপ্নচারী হতে নেই। দুদিন পরেই হাতে বেড়ি পড়বে, শ্বশুরবাড়ির ঘানি টানতে হবে আজীবন। সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার !

তবু স্বপ্ন দেখত পুষ্প। খুব পড়াশুনা করতে চায় ও। ভাল চাকরি করবে… নিজের সব ছোট ছোট শখ গুলোকে পূরণ করবে। সায়ন এইসব শুনে কেবল হাসে। ওর নিজেরো বড় শখ পুষ্পর সাথে মনের কথা বলবে। সব বললেও এটুকু বলতে পারেনি সায়ন। যদি হাসে পুষ্প ! সায়ন চায় বড় ইঞ্জিনিয়ার হবে ও। ঘর বাড়ি তৈরি করবে খুব। তারপর যখন টাকা হবে, ছোট একটা বাড়ি তৈরি করবে ওর আর পুষ্পর জন্য। কিচ্ছু জানাবে না পুষ্পকে… একদিন হুট করে চোখ বেঁধে এনে বলবে,

” বল দেখি পুষ্পি এটা কার বাড়ি ?”

পুষ্প অভ্যাসমত মুখ ঝামটা দেবে।

” অত ঢং না কইরা বল। এই বাড়ি কার ?”

” তোমার বাড়ি গো। ”

” আমার ? আমাদের বাড়ি ?😍😍”

সায়নের কল্পনা এইটুকু এসেই থেকে যায়। এরপর পুষ্প কি করতে পারে সেটাই তার ধারণায় আসে না। খুশিতে ওকে জড়িয়ে ধরে কেদেঁ ফেলবে… না হেসে উঠবে ? দৌড়ে ভেতরে যাবে না ?

পুষ্পর কথা ভাবতে ভাবতে সায়নের মুখ এক টুকরো হাসি ফুটে ওঠে। দুষ্টু মেয়েটাকে কত্তদিন দেখবে না কে জানে ! ওর সাথে খোচাখুঁচি করতে মন আনচান করলে কি করবে ও !

— ভাইয়া ? ঘুমাওনাই এখনো ?

সায়ন প্রচণ্ড চমকে তাকিয়ে দেখে সুমন এসে দাঁড়িয়েছে ঘুম ঘুম চোখে। দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে সুমন কে কাছে ডাকল সায়ন।

— তুমি ঘুমাও নাই ভাইয়া ?

— ঘুমিয়েই ত ছিলাম। বাথরুম যেতে উঠেছি। তুমি এখনো বসে আছ কেন ? রাত ২টা বাজে !

— সবকিছু গুছালাম এতক্ষন। কেমন হল দেখ ত ?

— ভাল হয়েছে। ভাইয়া এই বই গুলা তোমার ? তুমি এত গল্পের বই পড় ?

— আমি যত না পড়ি তারচে বেশি একজন উপহার দেয় ।

— কে ? তোমার জি এফ ?

— উহু। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।

— অহ। আচ্ছা তোমার জিএফ নাই ভাইয়া ?

— না রে ভাইয়া। একথা ক্যান জিজ্ঞেস করতেছ ?

— রিমন ভাইয়ার আছে। আম্মুকে বইল না কিন্তু।

— হাহ হা… আচ্ছা।

— ভাইয়া ঘুমায় যাও এখন। আমি শুই গিয়ে।

সুমন চলে যেতে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ল সায়ন। স্বস্তি লাগছে ওর। সুমনই এখন পর্যন্ত ওর সাথে ফরমাল ব্যবহার না করে আপনজনের মত করেছে। এখন ও এসেই মন ভাল করে দিলো সায়নের।

চোখ বুজতে ঘুমে ঢলে পড়ল ও।

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here