একই সুতোয় বাধা পর্ব ৪

#একই_সুতোয়_বাঁধা

পর্ব-৪

সপ্ত শীখা

এম্নি করে খুনসুটির মধ্য দিয়ে কেটে যায় দিন… মাস… বছর। আস্তে আস্তে পুষ্প পা দেয় তেরোয় আর সায়ন ষোলোয়।

পড়ার টেবিলে বসে রয়েছে পুষ্প। বসাই সার… পড়া হচ্ছে না একদম। মন অন্য কোথাও ওর। কেবল বাবা চিল্লাচিল্লি করেন তাই বই নিয়ে বসা।

ক্লাস সেভেনে উঠেছে পুষ্প অনেক কমেছে ওর চঞ্চলতা। তবু রেশ কেটে যায়নি পুরোপুরি। চেহারায় প্রথম তারুণ্যের মাধুর্য স্পষ্টই লক্ষ্য করা যায় ওর। উজ্জল শ্যামলা গায়ের রং পুষ্পর। মিষ্টি শিশুসুলভ চেহারা আর পিঠ ছড়ানো কোকড়া চুল। বাহ্যিক মাধুর্য কে ছাপিয়ে গেছে ওর মেধা। প্রতিবছর ক্লাসে ফার্স্ট হয় ও।

সে যাই হোক… এই মুহুর্তে মোটেও পড়ার মন নেই পুষ্পর। ভয়ঙ্কর মন খারাপ তার। সায়নের কথা ভাবতেই চোখ ছাপিয়ে জল আসছে। সায়ন কে ছাড়া এই গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবন কি করে কাটাবে পুষ্প ! আগের মত বাহিরে হুড়োহুড়ি না করলেও অন্তরের টান টা বজায় আছে ওদের। বাড়িতে পুষ্পর পছন্দের কিছু এলে এসে ও কে না দেয়া অব্দি সায়ন মুখে তোলে না সেটি। এখনো পর্যন্ত এরা দুজনই দুজনের সব কথার সঙ্গী। সায়ন মুখচোরা স্বভাবের বলে কোন প্রাণের বন্ধু জোটাতে পারেনি কখনো। পুষ্পই সর্বদা ওর একমাত্র ভরসাস্থল।

ঘটনা এই যে, সায়নের এস এস সি পরীক্ষা হয়ে গেছে। এখন ঢাকায় কলেজের পড়াশুনার জন্য ওর বাবা ওকে পাঠিয়ে দেবেন। আর হয়ত এই গ্রামে আসবে না ও। আসলেও বেশিদিনের জন্য না। তখন কি পুষ্পকে আর মনে থাকবে ওর !! …………যতবার এই কথাটা মনে আসছে ততবারই কেঁদে ফেলছে পুষ্প। অকারণ অভিমানে বুক ভরে ওঠে ওর বারবার…

💚💚💚💚💚

সায়ন তার বাবার এই সুমতি তে খুবই খুশি। যদিও সম্পূর্ণ একা শহরবাসের সুযোগ পাচ্ছেনা ও… তবু কিছুটা স্বাধীনতার আশ্বাসেই ওর হৃদয় উদ্বেল হয়ে আছে। বার বার জিনিস গোছাচ্ছে ও… বাঁধা ব্যাগব্যাগেজ আবার খুলে দেখছে। ভাল ভাল কাপড় গুলোই নিচ্ছে তবু এগুলোকে শহরের তুলনায় বড়ই সেকেলে আর গাইঁয়া বলে মনে হয়। মা কে ধরে নতুন কাপড় ও বানিয়েছে সায়ন। যাবার আর বেশি দিন বাকি নেই। আগামী সপ্তাহেই রওনা হবে ও। মা সারাদিন বসে বসে নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, নানারকম আচার বানান আর রোদে শুকোন। ছেলের যাবার বেলায় সব বেঁধে দিয়ে দেবেন… কতকটা মামার জন্যে আর বেশিরভাগ টাই ছেলের জন্যে।

সায়ন যাচ্ছে ঢাকা শহরে। গিয়ে ওর মামার বাড়ি উঠবে। মামাত দুটো ভাই আছে ওর… রিমন আর সুমন। ওর থেকে ছোটই। মামা বেজায় বড়লোক। একজন অতিরিক্ত লোকে তাদের কোনই সমস্যা হবে না… তাছাড়া সায়নের যত খরচ সব সাদেকুর রহমানই পাঠাবেন বলে স্থির করেছেন।

💚💚💚💚💚

— এই পুষ্প। পুষ্প ? পুষ্পিইইইইইই ?

— আহহ চিল্লাও ক্যান? কি হইল ?

— চিল্লাও ক্যান মানে কি। তোরে এই জানলা দিয়া ডাকতে ডাকতে আমি ত্যক্ত হইয়া গেলাম। নে এইটা ধর।

— কি এইটা ?

— তোর জন্যি।

— আমার জন্যি সে আমিও বুচ্ছি। কিন্তু জিনিস টা কি ?

— আমার জমানো টাকাগুলিরে দুই ভাগ করছি। এক ভাগ তোরে দিয়া যাইতেছি… ইচ্ছামত খরচ করিস।

— ঘুষ দিতেছ ? যেন যাউনের আগে না আটকাই ?

সায়ন স্তব্ধ হয়ে গেছে পুষ্পর এই অভিযোগ শুনে। পুষ্প চোখভরা জল নিয়ে বলছে…

— আমার বাপের কম নাই গো যে তোমার থিকা ঘুষ খাইতে হইব। একলা রাইখা যাইতেছ সেইটা যথেষ্ট না যে আবার টেকা দিতেছ ?

— পুষ্পি আমারে ভুল বুঝতেসস তুই… আমি ঘুষ দিমু কিজন্যি ?

— জানি আমি তোমারে ভুইল্লা যাই… তার জন্যি ঘুষ লাগব না। শহরে গেলে এম্নেও এই গেরাইম্যা মেয়ের কথা তোমার মনে পড়ব না… শহরে কত রঙ্গের মাইয়া আছে ওরাই-

— (ঠাসসসস…)

সায়নের হাতের চড় খেয়ে পুষ্পর মাথা ঘুরে উঠেছে। জানালার কবাট ধরে নিজেকে সামলে নিলো পুষ্প। সায়নের ফরশা মুখ গনগনে লাল হয়ে উঠেছে রাগে।

— তুই কি বল্লি পুষ্পি ? আমি তোরে ভুইল্লা যামু… শহরের রঙ্গিলা মাইয়া দের দেইখা ? বলতে পারলি এইটা ? ছি !

— ভুলবাই তো… দেখমু আমিও। যাওয়ার আগে আমারে মারলা…

— হু মারলাম। মারার মতই অপরাধ করছিস তুই।

সায়ন হনহনিয়ে বাড়ির পথ ধরল। সন্ধ্যাবেলার নির্জন পথ ঘাট। হাঁটতে হাঁটতে সায়ন অনুভব করল ক্ষোভে ওর চোখে জল এসে গেছে… কান গরম হয়ে উঠেছে। কি সাহস পুচঁকি মেয়ের… বলে কিনা ভুলে যাবে !

কিন্তু সে জানে না… শহরের চাকচিক্য ওর মত গ্রামের বড়লোকের দুলালের মাথা খাবার জন্য যথেষ্ট। আর পুষ্পর মত সাধারণ গ্রাম্য বালিকাকে ভুলিয়ে দেয়ার জন্যও।

💚💚💚💚💚

সায়নের যাবার বেলা এসে গেছে। ট্রেন ধরবে বেলা চারটার। তাই এই দুপুর একটায়ই লাইলি বেগম খাইয়ে দাইয়ে সাজিয়ে দিলেন একমাত্র পুত্রধন কে। কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। প্রথম থেকেই প্রচণ্ড কষ্ট বুকে চেপে যেন কিছুই না এমন ভান করছেন… কিন্তু এখন যেন আর পারছেন না। তবু জোর গলায় বলতে পারেননি যে আমার ছেলে কোথাও যাবে না… অল্প শিক্ষিত হবার এই জ্বালা ! ছেলের ভবিষ্যতের পানে চেয়ে চুপ থাকতে হয় তাকে। কিন্তু আজ আর পারেন না… ছেলেটার অপরূপ মুখশ্রী আর নব্য বেশভুষা দেখে নিজের অজান্তেই তার চোখ ফেটে জল নামে। দৌড়ে পেছনের বারান্দায় যান নিজের বুক হাল্কা করতে। কিন্তু সেখানে আগেই একজন কে চুল এলিয়ে হাঁটুর ভিতর মুখ গুঁজে রয়েছে।

বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠেছিল প্রথমে লাইলির। পরী- টরি ভেবেছিলেন। পরে দেখেন যে এ তো পুষ্প ! সায়নের টানে বাড়িতে থাকতে পারেনি… এদিকে এসেও অভিমানে ওর আশেপাশে যাচ্ছে না। তাই এই পেছনের বারান্দায় বসে মনের দুঃখ ঝাড়ার চেষ্টা করছে সে। লাইলির বড্ড মায়া লাগল। বাচ্চা মেয়েটা… তবু সেও স্বামী বিদায়ের কষ্ট বুঝছে ! বিবাহ বন্ধনের কি অদ্ভুত ক্ষমতা !!

লাইলি বেগম পুষ্পর মাথায় হাত রাখলেন। বেশ ঘন চুলের বুনোট মেয়েটার। কিশোরি বধূর মাথায় হাত রাখতেই নিজের কান্না আর চাপতে পারলেন না তিনি। ঝরঝর করে কেদেঁ ফেললেন। দুই অসহায়া নারী চুপচাপ কাদঁছে… কান্না ছাড়া এদের করবার আছেটাই বা কি !!

এদিকে সায়ন মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থায় ঘুরছে। আর একটু পরে ওর ট্রেন… আর এখন কিনা সব কাজ ফেলে ও পুরো গ্রাম পুষ্পকে খুঁজছে ! এদিকে নিজের মাও গায়েব। পুষ্পকে খুঁজে টুজে ঘেমেঘুমে ফিরেছে সায়ন। আর বড়জোর আধঘন্টা পরেই রওনা হবে… পুষ্পকে না বলে যাবে কি করে !

লেবুর শরবত নিয়ে এসেছে কেউ। ক্লান্ত সায়ন না দেখেই এক নিঃশ্বাসে পান করল পুরোটা। গ্লাস ফেরত দিতে গিয়ে দেখে কেউ নেই… পাশে চেয়ে দেখে পুষ্প বসে আছে গাল মুখ লাল করে।

সায়নের যা রাগ উঠল পুষ্পকে দেখে বলার না। সারা গ্রাম বলতে গেলে ও তছনছ করল পুষ্পর খোঁজে আর নবাব নন্দিনী এই বাড়িতেই বসে আছেন ! রাগের মাথায় পুষ্পকে যা হোক একটা সাজা দিয়েই দেয় সায়ন… এতেই ওর রাগ অবসান হয়। পুষ্পর হাতটা শক্ত করে মুচড়ে ধরল ও। লাল হয়ে উঠল পুষ্পর কব্জি, মোচড়ানর ব্যথায় মুখচোখ কুঁচকে উঠেছে পুষ্পর। তবু দ্বিরুক্তি করল না। মিনিট পাঁচেক পর রাগ কমে আসতে সায়নই হাত ছেড়ে দিয়ে উঠে গিয়ে একটা কাপড় ভিজিয়ে এনে পুষ্পর হাতের লাল স্থানটুকুতে বিছিয়ে দিল। পুষ্প চুপ চাপ বসে সেবা নিচ্ছে। এত চুপ কখনো থাকে না ও…

সায়ন গড়মিল টের পেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বুঝল যে খুব কেদেঁছে আজ পুষ্প। মুখ চোখ ফুলে লাল হয়ে আছে। সায়নের চোখে চোখ পড়তে পুষ্প বলল…

— আমারে ছেড়ে চলে যাইও না তোমার কসম লাগে। আমি কেম্নে থাকব !

–কিছু করার নাই পুষ্পি।

— অইখানে ত নতুন সই পাতাইবা… ওগোর হাত মুচড়াইতে কি থাপ্পর লাগাইতে পারবা রাগ উঠলে ? রাগ কিসে কমাইবা ?

— তুই ভয় পাস ক্যান পুষ্পি। আমি অইখানে পড়ি… তুও এইখানে পড়বি। বড় হইয়া আমরা একসাথে থাকমু।

— ছিহ। পোলা মাইয়া বিয়া ছাড়া একসাথে থাকে নাকি ?

— তাইলে বিয়াই করব আমরা…

পুষ্প দুই হাতে মুখ ঢেকে এক ছুটে বারান্দায় বসে পড়ল। অল্প বয়েস হলেও গ্রামের মেয়ে সে। এটুকু জানে যে এইটা একটা বিষম লজ্জার কথা। তবু কি একটা আনন্দের উচ্ছ্বাস ওর মুখটাকে বার বার আরক্ত করে তুলছে।

ঘরের ভিতর সায়নের ও এই অবস্থা। সে ত বাচ্চা নয়। এসব বেশ বোঝে… তবু কোন ঝোঁকেই কে জানে এত বড় কথাটা বলল পুষ্প কে ! এত বড় আশ্বাস দিল !

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here