একথোকা কৃষ্ণজোড়া ও তুমি পর্ব -৩+৪

#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০৩
ব্যস্ত নগরী দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল শহরের একটা ষাট তলা ভবনের চল্লিশ তলা ফ্লোরটি পুরোটা একটা অফিস। অফিসের একটা রুমে মিটিং এ ব্যস্ত কয়েকজন লোক।তাদের মাঝে সবার মধ্যাকর্ষন হলো অর্থ।পুরো নাম অর্থ শিকদার।দ্যা ওউনার ওফ শিকদার এম্পায়ার।যে খুব দক্ষতার সাথে মিটিং করতে ব্যস্ত।প্রায় আধাঘন্টা পর মিটিং শেষ হতেই।মিটিং রুম থেকে একে একে বের হয়ে গেলো সকলে।রয়ে গেলো শুধু অর্থ।অর্থ এক কাপ কফি বানিয়ে নিলো।তারপর কফি হাতে সে বিশাল কাচের দেয়ালটার সামনে দাঁড়িয়ে সিউলের রাতের শহর উপভোগ করতে লাগলো।আকাশে আজ সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে।চাঁদের পাশে মিটিমিটি জ্বলছে তারাগুলো।থেকে থেকে কোথা যেন কারা আকাশে আতশবাজি ফুটাচ্ছে।চমৎকার সুন্দর দেখাচ্ছে। সুদর্শন,সুঠাম দেহি,চমৎকার গড়নের গম্ভীর মুখশ্রী, ব্রাউন রঙের চোখের অধিকারি এই ব্যাক্তিকে যেকোন মেয়ে তাদের জীবনসঙ্গী বানাতে একপায়ে প্রস্তুত।তবে আদৌ কি এই পুরুষটি তার মনের মতো জীবনসঙ্গী পাবে?বয়স তো কম হলো না।ত্রিশ পার হয়ে একত্রিশে পরলো।এই একত্রিশ বছর জীবনে আজও কাউকে নিজের মনের মতো পেলো না।ফ্যামিলি থেকে দেশে গিয়ে বিয়ে করার চাপ দিচ্ছে ক্রমাগত তাকে।কিন্তু অর্থ তাদের কিভাব বুঝাবে?অর্থ যেমন ভালোবাসার মানুষটি চাইছে তা তো সে পাচ্ছে না।তাহলে কিভাবে কাউকে সে নিজের জীবনে জড়াবে।আর অর্থ জানেও তার মতো এমন রষকষহীন গাম্ভীর্য পূর্ণ ব্যাক্তিকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না।সবাই তো শুধু ওর বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখে ওর কাছে আসে।মন থেকে ভালোবেসে কাছে আসে না কেউই।তাই অর্থও চায়না কাউকে নিজের জীবনে জড়াতে।সে একাই বেশ ভালো আছে। কফি শেষ হতেই ভাবনাও শেষ হয়।সব কিছু গুছিয়ে অফিস থেকে যেতে হবে।এই বিল্ডিংয়েরই ৫২ তলা ফ্লোরে ওর ফ্লাট।সেখানেই ও থাকে। কাজের মাঝে হঠাৎ একটা মেয়ের কন্ঠে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে অর্থ।

-‘ ওহ বেবি আই মিস্ড ইউ সো ব্যাডলি। নট আ ড্যে ওয়েন্ট বায় দ্যাট আই ডিডন্ট থিং এব্যাউট ইউ।’

ইলফা ন্যাকা কন্ঠে কথাগুলো বলে অর্থর কাছে আসতে নিলেই অর্থ।ঠান্ডা অথচ গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,

-‘ হুয়াই? কুডন্ট ইউর লাভার্স মেক ইউ হ্যাপি ইন বেড?দ্যাট্স হুয়াই আই রিমেমভার ইউ?দ্যেন লিসেন টু মি, ডু ওয়ান থিংক গো টু আ ব্রোথেল হেয়ার টু সেটিস্ফাই দ্যা ডিজায়ার্স ওফ দ্যা বডি।ইট উইল ডু টু থিংক্স এট দ্যা সেম টাইম উইল সেটিস্ফাই দ্যা ডিজায়ার্স ওফ দ্যা বডি এন্ড উইল ওলসো গেট এক্সট্রা মানি।’

শান্ত কন্ঠের অর্থর এরকম অপমানজনক কথায় মুখটা চুপসে একটুখানি হয়ে যায় ইলফার।অর্থ রাগি চোখে এক পলক ইলফার দিকে তাকিয়ে গটগট পায়ে চলে গেলো অফিস থেকে।যাওয়ার আগে ওর গার্ড্সদের বলে গেলো।ইলফাকে যেন ওর অফিস থেকে বের করে দিতে।
—————–

রুমে এসে রাগে ওর গায়ের কোটটা সোফায় ছুড়ে মারলো অর্থ।এই মেয়েটাকে একদম সহ্য হয়না অর্থ’র।এতো অপমান করে এইটাকে অর্থ তাও বারবার চলে আসে মুখ উঠিয়ে।এদিকে অর্থ’র দিকে ভ্রু-কুচকে তাকিয়ে আছে ওর বেস্টফ্রেন্ড আরাফ।আরাফ ফোনে গেম্স খেলায় ব্যস্ত ছিলো।অর্থকে এমন রাগে জোয়ালামুখী হয়ে আসতে দেখে ভ্রু-কুচকে এতোক্ষন বুঝার চেষ্টা করছিলো হয়েছেটা কি?এইবার না পেরে প্রশ্ন করেই ফেললো আরাফ,

-‘ কিরে কি হয়েছে?এমন রাগে ফোসফোস করছিস কেন?’

অর্থ রাগি চোখে আরাফের দিকে তাকালো।শক্ত কন্ঠে বললো,

-‘ দ্যাট স্টুপিড গার্ল।আই জাস্ট হেট হার।এতো অপমান করি তাও বার বার চলে আসে।কবে জানি আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ওকে গলা টিপে মেরে ফেলি।শুধু মাত্র তোর কাজিন দেখে কিছু বলিনা।ও যদি আমার বোন হতো এতোক্ষনে থাপড়ে সোজা করে ফেলতাম।’

আরাফ করুন চোখে তাকালো।বন্ধুর এতোটা রেগে যাওয়ার কারন এইবার বুঝতে পারলো ও।ও নিজেও বেশ বিরক্ত ইলফার উপর।মেয়েটাকে যে ধমকে ধামকে অথবা থাপড় মেরে কিছু বলবে তারও কোন উপায় নেই।কিছু থেকে কিছু হলেই এই মেয়ে ন্যাকা কান্না কেঁদেকেটে ওর বাবার কাছে বিচার দেয়।বাবা মরা মেয়েকে আরাফের বাবা অনেক স্নেহ করেন তাই শুধু ইলফার কথা শুনেই আরাফকে ওর বাবাকে রাগারাগি করে।দীর্ঘশ্বাস ফেললো আরাফ। বললো,

-‘ রাগিস না অর্থ।ও একটু এমনি।শাষন তো কর‍তেই চাই।কিন্তু বাবার জন্যে পারি না।আমার সমস্যাটা একটু বুঝ।তুই একটু শান্ত হো।’

-‘ গো টু হেল উইথ ইউর প্রোবলেম।’

রাগে কিরমির করতে করতে ওয়াশরুমে চলে গেলো অর্থ।আরাফ ভাবে এই মানুষটার যে কেন এতো রাগ?কে যে অর্থকে সামলাতে পারবে।এমন কি কেউ নেই?যে ভালোবাসা দিয়ে অর্থকে আগলে রাখবে? ফোনের রিংটোনে ধ্যানভঙ্গ হয় আরাফের।দেখে অর্থ’র ফোন বাজছে।আরাফ চেঁচিয়ে বলে উঠে,

-‘ অর্থ তোর ফোন এসেছে।’

অর্থ’র জবাব শোনা যায়,

-‘ আসছি।’

মিনিট দুয়েক পরেই বের হয়ে আসে অর্থ।ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ওর মা রায়হানা বেগম কল করেছেন বাংলাদেশ থেকে।অর্থ চোখ বুজে নিজেকে ঠান্ডা করে ওর মাকে কল ব্যাক করে,

-‘ হ্যালো মা আসসালামু আলাইকুম! ‘

রায়হানা বেগম কাঁদো কন্ঠে বলে,

-‘ আলাইকুমুস সালাম! কেমন আছিস বাবা?’

-‘ ভালো তুমি কেমন আছো?’

-‘ তোকে ছাড়া কিভাবে ভালো থাকি বাবা?জলদি চলে আয় না আমার কাছে।আর কতো পরের দেশে পরে থাকবি?মা’র কথা কি মনে পরে না একটুও?’

বলতে বলতে রায়হানা বেগম কেঁদে দিলেন।অর্থ বিরক্ত হলো বেশ।ওর এইসব কান্নাকাটি একদম ভালো লাগে না।তারপরেও গলার স্বর যথাসম্ভব নরম করে বলে,

-‘ মা স্টোপ ক্রায়িং।এভাবে কাঁদলে হবে?ওকে ফাইন আমি আর দু’দিন পরেই আসছি।নাও হ্যাপি?’

রায়হানা বেগম ছেলের মুখে ‘ দু দিন পর আসবে!’ শুনে খুশিতে গদগদ হয়ে গেলেন।উচ্ছাসিত কন্ঠে বলেন,

-‘ সত্যি বাবা?সত্যি তুই আসবি?আমি এখনি সবাইকে বলে আসি হ্যা?ইসস আমার কতো আনন্দ লাগছে।’

রায়হানা বেগম ফোন রেখেই ছুটে গেলেন সবাইকে জানাতে তার ছেলে আসবে দেশে।এদিকে অর্থ’র ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠে।মা’কে এতো খুশি দেখে ওর নিজেরও ভালো লাগছে।ওর মা এই বয়সে এসেও কেমন বাচ্চামো করেন।ছোট ছোট বিষয়েই বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে যান।এইযে দেখো এখনই খুশির চোটে কলটাও কাটতে ভুলে গিয়েছে।অর্থ নিজেই ফোনটা কাটতে নিলে ফোনের স্ক্রিনে কিছু একটা দেখে থমকে যায়।রায়হানা বেগম ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে কথা বলছিলেন। উনি যেখানে বসেছিলেন ঠিক তার পিছনেই দোতলার সিড়ি।সেখানেই দেখা যাচ্ছে দুটো মেয়ে দাঁড়িয়ে তার মধ্যে একজন মেয়ে হেমন্তকে মারছে আর একজন ওদের থামানোর চেষ্টা করছে।মেয়েটার চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।কোমড় সমান চুলগুলো এলোমেলো হয়ে চেহারাটা প্রায় ঢেকে দিয়েছে।তাও কেন যেন অর্থ’র সেটা দেখতে ভালো লাগছে।বুকের কোথায় যেন একটা কিছু প্রচন্ড হাঁসফাস করতে লাগলো শুধু একটি পলক মেয়েটাকে দেখার জন্যে।

-‘ কিরে?কি দেখছিস ওমন করে?বাহিরে যাবি নাহ?আজ তো একটা পার্টি আছে।’

আরাফের কথায় ছিটকে চোখ সরিয়ে নিলো ফোনের স্ক্রিনের দিকে।এতোক্ষন সে কি করছিলো? একটা অচেনা মেয়েকে দেখার জন্যে ওর এতো ব্যাকুলতা কিসের?কেন এতো অস্থির লাগছিলো?নাহ এইসব উল্টাপাল্টা ভাবা যাবে না।রাগে মাথাটা থপ করে উঠে।সাথে সাথে কলটা কেটে দেয় অর্থ।আরাফকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-‘ আমি রেডি হয়ে আসছি।তুই গাড়ি বের কর।’

বলেই নিজের রুমে চলে গেলো অর্থ।মনে মনে ভাবলো আজ দিনটাই কেমন যেম এলোমেলো গেলো ওর।

—————-

রায়হানা বেগমের মুখে অর্থ দুদিন পর আসবে শুনে।খুশিতে বাকহারা হয়ে গিয়েছে প্রাহি।আনন্দে ওর চোখে অস্রুরা এসে ভীর জমিয়েছে।চোখ জোড়া জলে টইটুম্বুর! তা দেখে ইশি বলে,

-‘ কিরে কাঁদছিস কেন?’

প্রাহি যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নিলো। বললো,

-‘ ওই হেমন্ত মারার সময় চোখে কিছু একটা গিয়েছে বোধহয়।বাদ দে।তবে আর কতোক্ষন থাকবো বাড়িতে যাবি না।হেমন্তকে বলে আসি চল বাড়ি যাবো।’

ইশিও সম্মতি জানালো।অবশেষে হেমন্তকে বলে ওরা যার যার বাড়ি চলে গেলো।আসলে এখন প্রাহি নিজের বাড়িতে গিয়ে দরজা আটকে কান্না করবে।ওর আনন্দটা আজ হিসেব ছাড়া।ঠিক কতোটা খুশি ও আজ তা ওর চোখের অস্রুদানা গুলোই বলে দিচ্ছে।অবশেষে! অবশেষে ওর ভালোবাসার মানুষটি আসতে চলেছে।এইবার আসলে আর তাকে যেতে দিবে না প্রাহি।একেবারে নিজের বাহুডোরে আটকে রাখবে।ভাবতে ভাবতে অস্রুচোখেও হেসে ফেললো প্রাহি।
#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০৪

-‘ হেই হ্যান্ডসাম ওয়ান্না ড্যান্স ইউথ মি?’

নাঁচের তালে আবেদনময়ী ভঙ্গিতে কথাটি বলে উঠে একটি মেয়ে।অর্থ’র চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।রাগি চোখে তাকালো মেয়েটির দিকে।মেয়েটি ভয় পেয়ে তৎক্ষনাৎ স্থানটি ত্যাগ করলো।এদিকে আরাফ শব্দ করে হেঁসে দিলো।ওর এমন হাসি দেখে অর্থ বিরক্ত হয়ে বললো,

-‘ ডোন্ট লাফ লাইক আ ইডিয়ট।এইভাবে হাসার কি আছে?’

আরাফ হাসতে হাসতেই বলে,

-‘ যেভাবে তাকিয়েছিলি মেয়েটার দিকে।মেয়েটা দেখলি না কিভাবে হুরমুরিয়ে ভাগলো। তুই এমন কেন ইয়ার।লাইফে একটু এঞ্জয় কর।মেয়েদের এভাবে কাছে ঘেসতেও না দিলে।ভবিষ্যতে তোর লাইফ পার্টনার পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।’

অর্থ নিষ্প্রভ চোখে তাকালো।হাতের ওয়াইনের গ্লাসটায় একটা চুমুক দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো,

-‘ আমার এমন মেয়েদের লাইফ পার্টনার বানানোর কোন ইচ্ছাও নেই।যারা সেচ্ছায় নিজেদের বিলিয়ে দিতে পারে।যাদের ইজ্জতের তাদের কাছে কোন দাম নেই।তারা আমাকে কতোটুকু ভালোবাসবে বল?আমি তো চাই এমন একজন মেয়েকে আমার লাইফ পার্টনার বানাতে যাকে দেখলে আমার চোখ জুড়িয়ে যাবে।যার স্নিগ্ধতা আমার হৃদয়কে শীতলতায় ভরিয়ে দিবে,যে আমার টাকা, পয়সা,আমার বাহিরের সৌন্দর্যকে না আমাকে আর আমার মনটাকে ভালোবাসবে যে আমার পরিবারকে আগলে রাখবে।তাকেই আমি আমার জীবনসঙ্গী বানাবো।’

আরাফ হা করে চেয়ে আছে অর্থ’র দিকে।এই রাগি,গম্ভীর ছেলেটার মনের ভীতরে যে এতোটা আবেগ লুকিয়ে আছে তা আজ জানতে পারলো ও।নেহাত নেশার ঘোরে অর্থ এইসব বলেছে নাহলে জীবনেও ওর মুখ দিয়ে এইসব বের হতো না।আরাফ চিন্তায় পরে গেলো।কোথায় পাবে ও এমন মেয়ে যে ওর বন্ধুর মনের মতো হবে? যদি ওর কোন চেনাজানা এমন মেয়ে থাকতো বন্ধুর সুখের জন্যে হলেও সেই মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে আসতো।

——————
নিস্তব্ধ কালো রাত।বাহিরে হিমেল বাতাস শীতলতা দিচ্ছে।থেকে থেকে জোনাকি পোকাগুলো জ্বলজ্বল করে উঠছে। শিউলিফুল গাছটা থেকে দমকা হাওয়ার তালে তালে কয়েকশতো ফুল ঝরে পরছে ধরনীতে।ছাদে দাঁড়িয়ে রাতের প্রকৃতি উপভোগ করছে প্রাহি।মনটা বড্ড আনচান করছে।তাই একা একটু সময় কাটাতে ছাদে চলে এসেছে ও।কতোটা রাত হয়েছে অথচ ওর চোখে বিন্দু মাত্র ঘুম নেই। মনটা যে বড্ড অস্থির হয়ে আছে।অপেক্ষা করছে শুধু একজনের আগমনের।শুধু আজকের রাতটা কাল আসবে ওর প্রিয় মানুষটি। অতী উত্তেজনায় প্রাহির সারা শরীর কেঁপেকেঁপে উঠছে। প্রাহি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,

-‘ আজ দীর্ঘ ৭ বছর পর আপনি আসছেন।জানেন এই সংবাদটা পাওয়ার পর থেকে আমার চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নেই।সারাটা দিন ছটফট করেছি।আচ্ছা আপনি কি আমাকে ভালোবাসবেন?আমি যদি আমার মনের কথা ব্যক্ত করি আপনার কাছে তাহলে কি আপনি আমায় গ্রহন করবেন?নাকি আর সবার মতো আমাকেও দূরে ঠেলে দিবেন?এমনটা যেন না হয় আমি মনে প্রানে প্রার্থনা করি।তাহলে যে আমি নিজেকে সামলাতে পারবো না।একেবারে ভেঙে গুড়িয়ে যাবো।’

গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রাহি।আজও মনে পড়ে অর্থকে প্রথমবার দেখা আর সেই এক দেখাতেই কিভাবে ভালোবেসে ফেলেছিলো সে অর্থকে।
৭ বছর আগে।প্রাহি তখন দশম শ্রেনিতে সবে এসে ভর্তি হয়েছে।নতুন স্কুল নতুন জায়গা সব মিলিয়ে বেশ নার্ভাস ছিলো সে।ক্লাসে বসে একা একা বই পরছিলো প্রাহি কারন তখন ওর কোন বন্ধু ছিলো না।হঠাৎ স্টুডেন্টদের হইচই দেখে প্রাহিও নিজের কৌতুহল দমাতে না পেরে স্কুল মাঠে যায়।দেখে একটা ছেলে কয়েকটা ছেলেকে উরাধুরা মারছে।ও নিজেও বেশ মার খেয়েছে।তাও যেন ছেলেটা একাই একশো।ছেলেটা ছিলো হেমন্ত।ইশিকে কয়েকটা ছেলে বাজেভাবে ট্রিট করার কারনে হেমন্ত ওই ছেলেগুলোকে রেগে ইচ্ছামতো মেরেছিলো।মারামারি শেষে হেমন্ত চলে যেতে নিবে তখন প্রাহির নজর যায় হেমন্ত’র হাত থেকে রক্ত ঝরছে।প্রাহির মায়া হয়।ও দৌড়ে গিয়ে হেমন্ত’র হাত চেপে ধরে।তারপর লাইব্রেরিতে নিয়ে গিয়ে সুন্দরভাবে হাতটা ব্যান্ডেজ করে দেয়।হেমন্ত’র নিজেরও প্রাহিকে অনেক ভালোলাগে তাই ও আর ইশি মিলে প্রাহির সাথে বন্ধুত্ব করে নেয়।এদিকে হেমন্ত’র বাড়িতে খবর চলে যায় যে হেমন্ত স্কুল মাঠে মারামারি করেছে।তার কয়েকঘন্টা পরেই স্কুলে আরাফকে নিয়ে হাজির হয় অর্থ।সেদিন অর্থ হেমন্ত’র থেকে ওর মারামারি করার কারনটা জেনে হেমন্ত’কে কিছুই বলে না উলটো ওকে আরো সাহসীকতা দেয় যে ও যা করেছে একদম ঠিক করেছে।স্কুলের টিচার্সরাও আর কিছু বলার সাহস পায়নি।কারন এই স্কুলে অর্থও স্টাডি করেছে।আর ওর সম্পর্কে বেশ ভালোভাবেই জানেন তারা।অন্যায় একদম সহ্য করতে পারেনা অর্থ।সম মিটমাট করে চলে যায় অর্থ আর আরাফ।কিন্তু সাথে করে নিয়ে যায় প্রাহির মন।সেই ছোট্ট প্রাহি সেদিন এক দেখায় ভালোবেসে ফেলে অর্থ।কতোশতো পাগলামি তার।হেমন্ত’র কাছ থেকে ইনিয়ে বিনিয়ে নানানভাবে অর্থ’র কথা জিজ্ঞেস করতো।হেমন্ত বলতো ওর ভাইয়ের সমন্ধে।আর প্রাহি হেমন্ত’র বর্ননা সরূপ ওর কল্পনা রাজ্য সাজাতো।একদিন জানতে পারে অর্থ চলে গেছে বিদেশে।অর্থ নাকি সেখানেই পড়ালেখা করতো।দেশে এসেছিলো ছুটিতে।সেদিন অনেক ভঙ্গে পড়েছিলো প্রাহি।কান্নার ফলে জ্বর এসেছিলো মারাত্মকভাবে।পুরো তিনদিন জ্বরে বেহুশের মতো ছিলো।আস্তে আস্তে সময় যায় মেনে নিয়েছিলো ভাগ্যকে।অপেক্ষা করা শুরু করে দেয় প্রাহি তার ভালোবাসার মানুষটির জন্যে।ডায়রীতে অর্থকে নিয়ে ওর না বলা হাজারো ভালোবাসার কথা লিখে রাখতো।একদিন ওর মা ওর ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে সেই ডায়রী পায়। বুঝতে পারেন তার মেয়ে অল্প বয়সে আবেগে গা ভাসাচ্ছে।ভাগ্য ভালো ডায়রীতে প্রাহি অর্থ’র নাম উল্লেখ করেনি কোনদিন।রাবেয়া নিজের মেয়েকে বুঝান এইসব দুদিনের আবেগ।এই আবেগে গা ভাসিয়ে নিজের পড়ালেখার ক্ষতি হবে।প্রাহি সেদিন মায়ের কথার গুরুত্ব দেয়।হাজারো চেষ্টা করতে থাকে অর্থকে ভুলে যাওয়ার।পড়ালেখায় মন দেওয়ার। কিন্তু এতো সহজে কি সবটা হয়।দুটো বছর অনেক কষ্ট করে যুদ্ধ করেছে সে যেন অর্থকে ভুলে যায়।কিন্তু পারেনা।ভার্সিটিতে উঠে প্রাহি।প্রাপ্তবয়স্ক হয়।বুঝতে পারে এটা ওর আবেগ না।ও সত্যিই অর্থকে ভালোবাসে মন থেকে অনেক বেশি ভালোবাসে।তাই তো এতো চেষ্টা করেও পারেনা অর্থকে ভুলতে।এদিকে হেমন্ত বাড়ি থেকে জানতে পারে অর্থকে বিয়ে করাবে তাই ওর কাকিমা ওর ভার্সিটিতে ভালো কোন মেয়ের খোজখবর নিতে বলেছে।হেমন্ত কয়েকদিন খুজে কিন্তু কাউকেই মন মতো পায়না।অবশেষে হেমন্ত বুঝে প্রাহির মতো এতো ভালো একটা মেয়ে থাকতেও ও কেন অন্য মেয়েদের খুজছে।প্রাহিই হবে ওর ভাইয়ের জন্যে পার্ফেক্ট।সেখান থেকেই শুরু হেমন্ত উঠেপরে লেগে যায় প্রাহিকে মানাতে।এদিকে হেমন্ত তো আর জানেনা ওর যাকে বিয়ে করার জন্যে প্রাহির পিছনে এতো কাঠঘোর পুরাচ্ছে।সে বহু আগেই নিজের মনপ্রান উজাড় করে ওর ভাইকে ভালোবাসে। প্রাহি ভাবতো হেমন্ত ওর সাথে দুষ্টুমি করে ওকে ভাবি ডাকে।উপরে মিথ্যে রাগ দেখালেও মনে মনে ভীষন খুশি হতো প্রাহি।মনে মনে দোয়া করতো ও যেন সত্যি সত্যি হেমন্ত’র ভাবি হতে পারে।
অবশেষে প্রাহির এতো অপেক্ষার পালা শেষ হতে যাচ্ছে।দীর্ঘ সাতবছর পর ও কাঙ্খিত মানুষটিকে দেখতে পাবে।এইবার আসলেই নিজের মনের কথা আর লুকিয়ে রাখবে না।সবটা বলে দিবে ও অর্থকে।ঠিক কতোটা ভালোবাসে ও অর্থকে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রাহি।বুকের ভীতরটায় তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।ও পারছে না নিজের খুশি আনন্দটা কারো সাথে ভাগাভাগি করতে। চোখ বুজে অর্থ’র মুখটা কল্পনা করলো প্রাহি।এখনো যেন সবটা ওর চোখের সামনে বাস্তবভাবে ভেসে উঠে। তারপর চোখ খুলে রুমের দিকে অগ্রসর হয়।আজ আরও একটা রাত ওর নির্ঘুম কাটাতে হবে।জেগে জেগে শুধু প্রহর গুনবে প্রিয় মানুষটির আসার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here