একথোকা কৃষ্ণজোড়া ও তুমি পর্ব -০১+২

নিজের বেষ্টফ্রেন্ডের কাছ থেকে পাওয়া বিয়ের প্রস্তাবে না করে দেওয়াতে ভার্সিটির মাঠে ভরা স্টুডেন্টদের সামনে প্রাহিকে সজোড়ে থাপ্পড় মেরে বসলো ওরই বেস্টফ্রেন্ড হেমন্ত।তাও আবার কাকে বিয়ে করার প্রস্তাব? হেমন্ত’র বড়ভাইকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছে হেমন্ত।আর তা প্রত্যাখান করাতেই চড় মারলো প্রাহিকে হেমন্ত।বিষ্ময়ে অবাক হয়ে গিয়েছে প্রাহি।হেমন্ত যে ওকে এইভাবে সবার সামনে চড় মেরে বসবে ভাবতেও পারিনি প্রাহি।
প্রাহি ছলছল চোখে হেমন্ত’র দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

-‘ তুই আমাকে এইভাবে মারলি হেমন্ত?’

হেমন্ত রাগে দাঁত কিরমির করছে।পারলে এক্ষুনি সে প্রাহিকে গলা টিপে মেরে ফেলে।হেমন্ত রাগী কন্ঠে বলে,, ‘ তোকে আমি কি বলেছিলাম?আজ হোক কাল হোক।তোকে আমার ভাইকেই বিয়ে করতে হবে।তাও তুই কেন আমাকে ফিরিয়ে দিলি আজ।

প্রাহি কাঁদতে কাঁদতে বলে,

-‘ আমি কি জানতাম তুই সেসব কথা সিরিয়সভাবেই বলতি? আমি ভাবতাম তুই আমার সাথে দুষ্টুমি করে এইসব কথা বলিস। আর এইজন্যে তুই আমাকে চড় মারলি?’

-‘বেশ করেছি মেরেছি।আরো মারবো।’

হেমন্ত’র এমন কথায় প্রাহি ‘ আই হেইট ইউ, হেমন্ত!’ বলে দৌড়ে চলে গেলো।হেমন্ত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রাহির যাওয়ার পানে।হঠাৎ কাধে কারো স্পর্শ পেয়ে পিছনে তাকায় হেমন্ত। ইশি দাড়িয়ে আছে ওর পিছনে।ইশি অসহায় কন্ঠে বলে,

-‘কেন শুধু শুধু ওকে মারলি?ওর তো কোন দোষ ছিলো নাহ?শুধু এই সিনক্রিয়েট’টা করলি।এমনিতেই সবাই শুধু তোদের নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলে।পুরো ভার্সিটি তোদের নিয়ে রঙচঙ মাখিয়ে নানান কাহিনি সাজায়।তার উপর তুই আবার আজ এই ঘটনা ঘটালি।’

হেমন্ত কিছু বললো নাহ।পুরো মাঠে একবার চোখ বুলালো।সবাই কানাঘুষা করছে।কেউ কেউ মুখ টিপে হাসছেও।হেমন্ত চিৎকার করে হাঁক ছাড়তেই সবাই ভয়ে সেখান থেকে চলে গেলো।ইশি নিজেও ভয় পেয়ে গিয়েছিলো।হেমন্ত’র এমন চিৎকারে।হেমন্ত এইবার তাকালো ইশির দিকে।মেয়েটা অল্পতেই ভয় পেয়ে যায়।এইযে দেখো এখন কিভাবে কাঁপছে।হেমন্ত গম্ভীর মুখে ইশির হাত শক্ত করে ধরলো।এখন ওর গরম মাথাটা ইশিই ঠান্ডা করতে পারবে।ইশি হেমন্ত’র এইভাবে ওকে টেনে নিয়ে যেতে দেখে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-‘ কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমাকে।’
-‘ জাহান্নামে নিয়ে যাচ্ছি।’
-‘ আমি যাবো নাহ।!’
-‘ এখন এই মুহূর্তে আমার সাথে না গেলে তোকেও সেইমভাবে থাপ্পড় মারবো।ঠিক যেইভাবে প্রাহিকে মেরেছিলাম।’

হেমন্ত’র এমন থ্রেড শুনে গলা শুকিয়ে গেলো ইশির।সে হেমন্ত’র হাতের চড় খেতে চায়না।একদম চায়না।তাই বিনাবাক্যে হেমন্ত’র সাথে সাথে চললো ও।

————

প্রাহিকে অনবরত ডাকছেন ওর মা রাবেয়া বেগম।কিন্তু প্রাহি দরজাই খুলছে না।রাবেয়া বিরক্ত হয়ে চলে গেলেন নিজের কাজে। এই মেয়েকে নিয়ে আর পারেননা তিনি।কিছু একটা হলেই দরজা জানালা বন্ধ করে রুমের ভীতর ঘাপটি মেরে বসে থাকে।কিছু বলেও না কি হয়েছে? বা কেউ কিছু করেছে কি না! বিড়বিড় করে মেয়েকে বকতে বকতে রান্না করতে লাগলেন রাবেয়া।একটু পর এরশাদ সাহেব আসবেন।তিনি হলেন প্রাহির বাবা।আর প্রাহি হলেন তার আদরের দুলালি।একমাত্র তিনি এলেই এই মেয়ে রুম থেকে বের হবে।তারপর বাবার বুকে উপর হয়ে পড়ে কেঁদেকেটে একাকার করে সবার নামে নালিশ করবে।তার আগে প্রাহি একটা টু শব্দও করবে না।

———
এদিকে দরজায় কান পেতে রেখেছিলো প্রাহি। রাবেয়ার প্রস্থান করার আওয়াজ পেতেই।নিস্তব্ধে একপ্রকার উড়াধুরা ডান্স করলো রুমের ভীতর।
একপর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে ধপাস করে বিছানায় সুয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে থাকলো কতোক্ষন।আনন্দে আর অতী উত্তেজনায় ওর সারা শরীর কাঁপছে থরথর করে।
প্রাহি উঠে বসলো।টেবিলের ড্রয়ারের লকারটা খুলে সেখান থেকে একটা ডায়রী বের করলো।এবং ডায়রী থেকে একটা ছবি।একধ্যানে ছবিটার দিকে তাকিয়ে দেখে।সেটা বুকে জড়িয়ে নিলো ও।
ছলছল চোখে মুখে হাসি নিয়েই বললো,

-‘ এইবার হেমন্তই পারবে আপনাকে আমার করতে।কতো কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে এর জন্যে।এতোদিন ও শুধু বলতো।কিন্তু আমি সিয়র ছিলাম না ভাবতাম ও দুষ্টুমি করছে।কিন্তু না আজ আমি পুরোপুরি সিয়র।হেমন্ত আমাকে তার ভাবি হিসেবে গ্রহন করতে একদম প্রস্তুত।ইসস,হেমন্ত রাজি তো এইবার তুফান হলেও সেই আমিই হবো ওর ভাইয়ের বধু।ইসস, আপনাকে যদি বুঝাতে পারতাম ঠিক কতোটা ভালোবাসি আপনাকে।কিন্তু কিভাবে বলবো বলুন।আপনাকে আমি দেখেছি শুধু একবার।আর কাউকে একবার দেখাতেই এতোটা ভালোবেসে ফেলা যায়।সেটা আমার ক্ষেত্রে না হলে বুঝতেই পারতাম না।উলটো এই আপনি তো জানেনই না যে আমি প্রাহি আপনাকে প্রচন্ড ভালোবাসি।আপনি তো আজও পর্যন্ত দেখেনও নি।কবে আসবেন আপনি?কতো বছর হলো আপনাকে দেখিনা।প্লিজ জলদি দেশে ফিরে আসুননা।’

হঠাৎ দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হতেই সম্ভিৎ ফিরে পেলো প্রাহি।বাহির হতে একটা হাসোজ্জল আওয়াজ ভেসে এলো,

-‘ প্রাহি আম্মু।কি করছো ভীতরে।বাবাই এসেছি তো।জলদি আসো বাবাইয়ের কাছে।বাবাই অপেক্ষায় আছি।’
-‘ আসছি বাবাই।’

কথাটা বলেই উঠে দাড়ালো প্রাহি।ডায়রীর ভাজে তার প্রানপ্রিয় মানুষটার ছবি রেখে দিয়ে আবারও ড্রয়ারে লক করে রাখলো।জলদি উঠে আয়ানার সামনে গিয়ে দাড়ালো।নিজেকে পরিপাটিরূপে ফিরিয়ে এনে সস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।এরশাদ সাহেব তার মেয়েকে এলোমেলো অবস্থায় দেখতে একদম পছন্দ করেননা।
প্রাহি কাঁদো কাঁদো মুখে আয়নায় তাকিয়ে আছে।সবই ঠিক আছে কিন্তু হেমন্ত তাকে চড় মেরেছে সেই দাগটা দেখা যাচ্ছে।স্পষ্ট তিন আঙ্গুলের ছাপ।প্রাহি বিরবির করে বললো,

-‘ হেমন্ত’র বাচ্চা। চড় মারলি ভালো কথা তাই বলে এতো জোড়ে মারলি। এখন এই মুখ নিয়ে আমি বাবাইয়ের কাছে কিভাবে যাবো।উনি এটা দেখলেই রেখে যাবে।উফফফ!’

প্রাহি বিরক্তি সহকারে মুখের ওই অংশটুকুতে ফাউন্ডেশন লাগালো তার উপর লুস পাউডার লাগিয়ে নিলো।আয়নায় দেখে নিলো আরেকবার নিজেকে।নাহ এখন আর অতোটা বুঝা যাচ্ছে না।
আস্তে ধীরে রুম থেকে বের হয়ে সোজা ড্রয়িংরুমে বাবার কাছে গিয়ে বসলো প্রাহি।এরশাদ সাহেব আদরে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।প্রাহিও তার বাবাকে ঝাপটে ধরলো।
এরশাদ সাহেব বলে উঠেন,

-‘ শুনলাম ভার্সিটি থেকে এসেই নাকি নিজেকে রুমবন্ধি করে রেখেছো?কিছু খাওনি?কেন আম্মু?’

প্রাহি করুন চোখে তাকালো বাবার দিকে।এরশাদ সাহেব হেসে দিলেন।বললেন,

-‘ আবারও হেমন্ত’র সাথে ঝগরা করেছো বুঝি?’
-‘ হ্যা তোমার তো এটাই মনে হয় আমিই শুধু ঝগরা করি।ওই হেমন্ত কাউকার বাচ্চাটা তো একেবারে দুধে ধোয়া তুলসীপাতা। ‘

এরশাদ সাহেব আবারও শব্দ করে হেসে দিলেন মেয়ের এমন বাচ্চামো কথায়।রান্না ঘর হতে রাবেয়া বেগমের ঝাঝালো কন্ঠস্বর শুনতে পাওয়া গেলো,

-‘ বাবা মেয়ের কতো আনন্দ।আমি তো দিব্যি একঘন্টা ডেকে ডেকে হয়রান হলাম।মেয়ে টু শব্দও করলো।বাবা ডাকতেই একেবারে নেঁচেকুদে হাজির।বলি আমি যদি তোদের এতোই পথের কাটা হয়ে যাই।তাহলে বল আমি চলে যাই এখন থেকে।’

প্রাহি বিরক্ত হয়ে বললো,

-‘ উফফ আম্মু প্রতিদিন এক কথা শুনতে ভালো লাগে না।তুমি কেন এতো রাগ করো বলোতো?আমি কি কিছু বলেছি তোমাকে?’
-‘ কিছু বলেননি ধন্য হয়ে গিয়েছি তাতে আমি।’

এরশাদ সাহেব গম্ভীর স্বরে এইবার বললেন,

-‘ রাবেয়া খাবার নিয়ে আসো জলদি।আমার মেয়ে না খেয়ে আছে।’
-‘ আনছি একটু অপেক্ষা করুন!’

রাবেয়া বেগম যেমন হোক।স্বামিকে অতি সম্মান করেন।একেবারে স্বামিভক্ত বউ।এইযে একটু আগেই কেমন রনচণ্ডী হয়ে ছিলেন।আর এরশাদ সাহেবের এক কথায় একেবারে শান্ত।এরশাদও তার স্ত্রীকে বড্ড ভালোবাসেন।এরেঞ্জ ম্যারেজ হয়েও তার বাবা মার মাঝে এতো বিশ্বাস আর ভালোবাসা দেখে অবাক হয় প্রাহি।মনে মনে সে রবের দরবারে প্রার্থনা করে।ওর প্রিয় মানুষটিও যেন ওকে অনেক ভালোবাসে।ঠিক যেমন বাবা তার মাকে ভালোবাসে।
#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০২
-‘ ভাবি! ভাবি! ও ভাবি শুনো নাহ ভাবি!’

হেমন্ত এক নাগারে প্রাহিকে ভাবি ভাবি বলে ডেকেই যাচ্ছে।শেষ মেষ বিরক্ত হয়ে প্রাহি বললো,

-‘ কাউয়া কোথাকার আর একবার ভাবি ডাকবি তো তোর জিহ্বা ছিড়ে ফেলবো।’

-‘ ভাবি! ভাবি!’

-‘ হেমন্ত আমাকে বিরক্ত করিস না।আমি ল্যাবে কাজ করছি দেখছিস তুই।’

হেমন্ত প্রাহিকে জ্বালাতন করে খুব মজা পাচ্ছে।দীর্ঘ একঘন্টা যাবত সে এমন করছে।কারন ভার্সিটিতে আসার পর থেকে প্রাহি একবারও হেমন্ত’র সাথে কথা বলেনি।সেইজন্যেই হেমন্ত প্রাহিকে বিরক্ত করছে যাতে বিরক্ত হয়েও প্রাহি ওর সাথে কথা বলে।আর সেটাই হলো।এদিকে হেমন্ত’র বলা বার বার ‘ ভাবি!’ ডাকটা একেবারে কলিজায় গিয়ে লাগছে প্রাহির।কি যে সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছে বলে বুঝাতে পারবে না প্রাহি।তবে সেই খুশিটা মনেরটা মনেই চেপে রেখেছে।হেমন্তকে কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না ওর মনের কথা।তাই মুখটা যথাসম্ভব গম্ভীর করে রেখেছে।প্রাহির ভাবনায় ছেদ ঘটে হেমন্ত’র ওর হাত ধরাতে।ছেলেটা ওকে টেনে হিছরে নিয়ে যাচ্ছে।প্রাহি রাগে কিরমির করে বলে উঠে,

-‘ তুই এমন করছিস কেন?প্লিজ থাম! কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমাকে।থাম হেমন্ত।উফফ!’

কে শুনে কার কথা হেমন্ত প্রাহিকে টানতে টানতে ওর বাইকের কাছে এনে দাড় করালো।প্রাহি হেমন্ত’র কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্যে ছোটাছুটি করছে।হেমন্ত’র তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।ও শান্ত ভঙিতে ইশিকে ফোন দিয়ে বললো ক্যাম্পাসে পার্কিং প্লটে যেন চলে আসে ও।প্রায় ১০ মিনিট পর ইশি এসে পৌছাতেই হেমন্ত বাইকে উঠে বসলো।তারপর ইশি উঠে বসলো।প্রাহি এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।হেমন্ত এইবার দাঁত খিচিয়ে বললো,

-‘ দেখ প্রাহি! ভালোই ভালোই বলছি বাইকে উঠে বস।নাহলে কিন্তু তোকে ঘারে তুলে নিয়ে এক আছাড় মারবো।’

প্রাহি তাকালো।হেমন্তকে ভেংচি কেটে বাইকে উঠে বসলো।নাহলে দেখা যাবে হেমন্ত সত্যি সত্যি ওকে তুলে আছাড় মেরে দিয়েছে।আর প্রাহি এতো তাড়াতাড়ি কোমড় ভেঙ্গে বসে থাকতে চায়না।বিয়ের পর কোমড় ভাঙ্গলে সমস্যা নেই।তখন তো তারই সুবিধা হবে সারাদিন সে তার প্রেমিক পুরুষের কোলে চড়ে টইটই করে ঘুরে বেড়াবে।আহা! ভাবতেই সুখ সুখ ফিলিংস আসছে প্রাহির।

-‘ কিরে ভ্যাটকাইতেছোস কেন?’

প্রাহি থতমত খেয়ে গেলো ইশির কথায়।জোড়পূর্বক হেসে বললো,

-‘ কই না তো!’

-‘ তাহলে আমাকে টাইট করে ধরতে বলছি শুনতে পাচ্ছিস না কেন? রাস্তায় উলটে পরে মরার ইচ্ছা জেগেছে নাকি।’

প্রাহি নাক মুখ কুচকে বলে,

-‘ বেশি কথা বলিস তুই।সামনের দিকে তাকা তো।ফাউল প্যাচাল করিস না!’

প্রাহি ইশিকে শক্ত করে ধরে বসলো।এদিকে ইশি ব্যাক্কল হয়ে বসে।সে কখন ফাউল কথা বললো?আজব!
——————-
ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে আছে প্রাহি,ইশি।চুপচাপ করে বসে আছে।মনে হচ্ছে ওদের মতো ভদ্র আর কেউ নেই।প্রাহি মনে মনে হেমন্তকে ইচ্ছেমতো গালাগাল করছে।ছেলেটা এতো খারাপ।শেষমেষ টেনেহিছড়ে শিকদার বাড়িতে নিয়ে আসলো।আর এসেই ওদের এখানে বসিয়ে দিয়ে ও লাপাত্তা।ও কি বুঝে না প্রাহির এখানে আসলে অসস্তি হয়। এই বাড়ির বড় ছেলেকে ভালোবাসার আগে এই অসস্তিটা ছিলো না।কিন্তু ভালোবাসা বুঝার পর থেকে এই বাড়িতে আসার নাম নিলেও প্রাহির কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগে।প্রাহির ইচ্ছা সে একেবারে বউ হয়ে এই বাড়িতে আসবে।তার আগে এখানে আসার কোন মানেই হয়না। প্রাহিকে অন্যমনস্ক দেখে ইশি ওকে হালকা ধাক্কা দিলো।বললো,

-‘ কিরে? কি ভাবছিস এতো?’

প্রাহি কিছু বলবে তার আগেই ওদের সামনে এসে দাঁড়ায় রায়হানা বেগম। প্রাহি আর ইশি উনাকে দেখেই সালাম জানান।বিনিময়ে উনিও সালামের জবাব দিয়ে বলেন,

-‘ কি হলো আম্মুরা?খাচ্ছো না কেন?সেই কখন নাস্তা পাঠালাম এখনো কিছুই তো দেখছি খেলে না।’

প্রাহির হৃদয় জুড়িয়ে যায়।কি সুন্দর অমায়িক ব্যবহার।আসলে এই বাড়ির প্রতিটা মানুষেরই ব্যাবহার চমৎকার সুন্দর।প্রাহির অবাক লাগে। ও নাকি এই বাড়ির বউ হবে।কতোটা ভাগ্যবতী সে।এখন শুধু ওই বড়লোক খারুসটা রাজি হলেই হয়।
মনে মনে কথাটা গুলো বলেই মিষ্টি হেসে রায়হানা বেগমকে বললো,

-‘ তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম।তুমি নিজে এসে খাইয়ে দেও।কতোদিন পর এলাম। হেনা আন্টি কোথায় তাকে যে দেখছি না?’

-‘ এইতো আমি আম্মুরা!’

রান্নাঘর হতে হাত মুছতে মুছতে বের হয়ে কথাটা বলে উঠেন হেনা বেগম।ইশি আর প্রাহি উনাকেও সালাম দিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করে নিলেন।

ইশি বললো,

-‘ আন্টি আসো এখানে এসে বসো তো একটু।’

হেনা বেগম বসতেই রায়হানা বেগম বললেন,

-‘ দেখেছিস হেনা।সেই কখন নাস্তা পাঠালাম।তারা কিছুই খেলো না।ওদের নাকি আমাদের হাতে খাওয়ার শখ জেগেছে।’

বিনিময়ে হেনা বেগম হালকা হাসলেন।বলেন,

-‘ এতো বেশ ভালো কথা।আপা তুমি প্রাহিকে খাইয়ে দেও আমি ইশি খাইয়ে দিচ্ছি।’

প্রাহি আর ইশি বেজায় খুশি হলো।রায়হানা আর হেনা মিলে ওদের দুজনকে খাইয়ে দিলো।ইশি হেনা বেগমের দিকে তাকিয়ে আছে।ওর চোখজোড়া ছলছল করছে।আজ কতোদিন পর এতোটা মমতা নিয়ে কেউ ওকে খাইয়ে দিলো।ওর মা থাকলেও বুঝি ওকে এইভাবে খাইয়ে দিতো? মার কথা খুব করে মনে পড়লো ইশির।না চাইতেও টুপ করে একফোটা জল গড়িয়ে পড়লো ওর চোখ থেকে।সাথে সাথে হেনা বেগম ব্যাকুল কন্ঠে বলেন,

-‘ সে কি ইশি কাঁদছো কেন?নুডুল্সগুলোতে কি বেশি ঝাল দিয়ে ফেলেছি আমি?’

সাথে সাথে ইশি না বোধক মাথা নাড়ায়।তারপর হুট করে হেনা বেগমকে জড়িয়ে ধরে ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠে।হেনা বেগম পরম স্নেহে ইশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,

-‘ কি হয়েছে আম্মু?’

ইশি ক্রোদন স্বরেই বলে,

-‘ জানো আন্টি।মা মারা যাওয়ার পর কেউ আমাকে এতো স্নেহ করে কোনদিন খাইয়ে দেয়নি।তাই মার কথা খুব মনে পড়ে গেলো।’

প্রাহি,রায়হানা বেগম, হেনা বেগম সবার খারাপ লাগলো অনেক ইশির কথা শুনে।আসলে ইশির মা ইশির যখন চার বছর বয়স তখন মারা যান।ইশির একটা বড় ভাইও আছে।ইশির মা মারা যাওয়ার মাস কয়েক পরেই তার বাবা আরেকটা বিয়ে করেন।বেশ ভালোই যাচ্ছিলো।কিন্তু আস্তে আস্তে ইশির সৎমায়ের আসল রূপটা বেড়িয়ে আসে।ইশির ভাই থাকতো হোস্টেলে সেখান থেকেই পড়ালেখা করতো।ইশি শুধু একা ছিলো বাড়িতে।ওর বাবা ব্যাবসার কাজে বেশির ভাগ বিভিন্ন জেলায় জেলায় যেতেন।সেই সুবাদে তিনিও বেশি বাড়িতে আসতেন না।আর সেটারই সুযোগ নিয়ে ইশির সৎমা ওর উপর নানান ভাবে টর্চার করতো।ওকে দিয়ে সব কাজ করাতো।ছোট্ট ইশিকে ভয় দেখাতো ওর বাবার কাছে যেন বিচার না দেয় সেই জন্যে।একদিন ধৈর্য’র বাধ ভেঙ্গে ইশি একদিন ওর বাবার কাছে বিচার দেয়।কিন্তু ওর সৎমা ওর বাবাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বিভিন্ন মিথ্যে কথা বলে ওর বাবাকে পটিয়ে ফেলে।পরে ওর বাবা সেটাই বিশ্বাস করে নিয়ে ইশিকে ইচ্ছামতো মারধর করে।ইশি পরে ফোন দেয় ওর মামাকে ওর মামারা সব শুনে ইশিকে তাদের কাছে নিয়ে যান।ইশির বাবাও এতে আপত্তি করে না।মামারা আর নানু ইশিকে অনেক ভালোবাসে।কিন্তু ওর দুই মামি কেউ ওকে দেখতে পারে না।নানু মারা যাওয়ার পর যেন মামিদের কটু কথা আরো বেড়ে যায়।ওর মামারা বাড়িতে থাকলে কেউ কিছু বলে না।কিন্তু তারা না থাকলেই দুই মামির আসল রূপ বেড়িয়ে আসে।সেই থেকেই ইশির দিনকাল এমনই যাচ্ছে।এরশাদ সাহেব আর রাবেয়া বেগম ইশিকে উনাদের কাছে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন।কিন্তু ইশি রাজি না।শুধু কেন অন্যের ঘারে বোঝা হয়ে থাকবে ইশি।এর থেকে ও যেমন আছে সেইভাবেই দিনকাল চলুক না।

হেনা বেগম ইশির চোখের পানি মুছে দিলো।কপালে চুমু খেয়ে বলেন,

-‘ পাগল মেয়ে এতে কাঁদতে হয়।যখনই মার কথা মনে পরবে চট করে এখানে এসে পরবে।আমি তো বলি রোজই এসো আমি নিজ হাতে তোমাকে খাইয়ে দিবো।’

রায়হানা বেগম বলে উঠেন,

-‘ আমিও আছি এতে ভাগিদার।আমিও খাইয়ে দিবো।’

ইশি মৃদ্যু হাসলো।প্রাহি মুগ্ধ হয়ে দেখছে ওদের।ঠিক কতোটা উদার মনের হলে কেউ কাউকে এতোটা আপন করে নিতে পারে।প্রাহি মনে মনে শপথ করলো এই বাড়ির বউ হয়ে আসলে এই বাড়ির প্রতিটা মানুষকে অনেক ভালোবাসবে। অনেক অনেক।প্রাহি ঠোঁটের কোনে মৃদ্যু হাসি ফুটে উঠলো।

-‘ যা কান্না করার কয়েকদিন করে নে ইশি।বড় ভাইকে বিয়ে করার জন্যে রাজি করিয়ে।প্রাহিকে তার বউ বানাতে পারলেই।তার কয়েকদিন পর তোকেও আমার কাছে নিয়ে আসবো।আমার স্ত্রীর মর্যাদা দিবো।এই বাড়ির ছোট বউ করে আনবো তোকে।আর একটু সবুর কর ইশি।আর একটু।’

কথাগুলো মনে মনে বলেই ইশির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো হেমন্ত।এই মেয়েটার চোখের পানি তার একদম সহ্য হয়না।একদম না।মেয়েটাকে যে সে অনেক ভালোবাসে।কিন্তু অবুঝ মেয়েটা তার ভালোবাসা বুঝেই না।তবে হেমন্ত আর অপেক্ষা করবে না।ইশিকে ওর বউ করে আনবে শীঘ্রই।অপেক্ষা শুধু একজনের বিয়ে করার জন্যে রাজি হওয়ার।ব্যস তাহলেই হবে।

#চলবে_______

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here