#এখানে_আকাশটা_ভালবাসার
#লেখিকাঃ নয়নতারা নাতাশা
#পর্বঃ ৩২
.
সারাদিন কারোর সাথে কথা বলল না মায়া।
অস্বস্তি হচ্ছে খুব।
তানহা অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছে তার কোনো ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছে কিনা।
কিন্তু মায়া কোনো কথাই বলছে না।
এতদিন পর নিজের মাকে দেখে মায়ার অনুভূতি গুলো সব উলটাপালটা হয়ে গেছে।
হয়তো তার খারাপ লাগতো না যদি না পিছনের কথা না তুলে শুধু মাতৃত্বের দাবি নিয়ে তার সামনে দাঁড়াত!
বাবা বা মায়ের ক্ষমা চাওয়া চেহারা সন্তানরা সহ্য করতে পারে না।
আর সেটা যদি সন্তানের কাছেই হয়।
মায়া শুয়ে ছিল।
রোশনি তখনো ভার্সিটি থেকে ফেরেনি। সাহরাফ সাহেব ও কলেজে, সায়ান, রায়ান অফিসে।
জাহরা আর তানহা অনেক কষ্ট করেও মায়াকে কিচ্ছু খাওয়াতে পারলো না।
মায়া খাটে শুয়ে আছে।
সানজানা আস্তে আস্তে পাশে গিয়ে বলল,
“মা আমায় বলো তো কি হয়েছে তোমার?”
মায়া চুপচাপ বাইরের দিকে চেয়ে রইল।
অসহ্য লাগছে। তার যেমন কারোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তেমনি সবাই বিরক্ত করছে।
“আম্মু, বল না মা তোর কি হয়েছে?”
সানজানা মাথায় হাত বুলাতে লাগল।
হঠাৎ কান্না উপচে আসল মায়ার।
সানজানার কোলের মধ্যে গিয়ে ফোঁপাতে লাগল।
সানজানার খুব খারাপ লাগছিল।
এইটুকু মেয়ে না জানি কত কষ্ট লুকিয়ে রেখেছে নিজের ভিতর।
জাহরা এসে দেখেন মায়া সানজানা কোলের মধ্যে শুয়ে কাঁদছে।
কিছু বলতে গেলে সানজানা ইশারা করে চুপ করিয়ে দেয়।
কিছুক্ষণ পর মায়াকে উঠিয়ে হাতমুখ ধোয়াতে নিয়ে যায় সানজানা।
আর ওয়াশরুমে গিয়েই প্রচুর বমি করে দেয় মায়া।
কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারে না।
বমি করার পর একেবারেই ক্লান্ত হয়ে যায় মায়া।
মায়াকে বিছানায় শোয়ানোর সাথে সাথেই ঘুমিয়ে যায়।
বাসার সবাই রীতিমতো চিন্তায় পড়ে যায়।
সানজানা আর তানহা কাউকে জানাতে গেলে নিষেধ করে জাহরা।
“মায়া ঘুমিয়েছে যখন, ওকে এখন জাগাতে হবে না। সবাই আসবেই তো একটু পর।”
সানজানার যুক্তিটা পছন্দ না হলেও কিছু বলে না।
.
রাহাতের অফিসে চলে যাওয়া একদৃষ্টিতে দেখছে ইতু।
আজকাল তার জন্য কোনো সময়ই হয় না রাহাতের।
বড্ড অবহেলার পাত্র হয়ে গেছে সে।
সংসারের তাল সামলাতে ইতু এখন পুরোদস্তুর গৃহিণী। আগের মতো নজরকাড়া চেহারায় কিছু ঘাটতি পড়েছে। চঞ্চলতা অনেকটাই মন্থর হয়ে এসেছে।
কিন্তু ভালবাসায় ভাটা পড়েনি একটুও।
অনেকবার রাহাতকে বোঝাতে চেয়েছে কিন্তু রাহাত বোঝে না।
বুঝেও না বোঝার মতো করে।
হবে নাই বা কেন?
ভাবতে ভাবতে কখন চোখের কোনে পানি জমেছে খেয়াল করেনি ইতু।
ভাল লাগছে না কিছুই।
হঠাৎ মেয়ে ঘুম থেকে কেঁদে ওঠায় দৌড়ে মেয়ের কাছে গেল ইতু।
রাহাতের ইচ্ছে হলে আদর করে, খেয়াল করে মেয়েকে,
না হলে করেনা। তার কথা তো পুরোপুরি বাদ।
একবার ভেবেছিল সানজানাকে বলবে কিন্তু নিজেদের বিবাহিত জীবনের মাঝে আবার ননদ কে টেনে আনতে সংকোচ হয়েছিল ইতুর।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইতু।
রাহাত জানেনা কতদিনের আফসোস, কতটা কষ্ট লুকিয়ে আছে এই দীর্ঘশ্বাসের মাঝে।
ইতুর মাঝে মাঝেই মনে হয় বাপের বাড়িতে চলে যাওয়ার কথা কিন্তু…!
.
“রাফসানা কোথায়?” তানহাকে ফোন দিয়ে দুই একটা কথা বলেই প্রশ্ন করে নওশি।
“নওশি মায়া হঠাৎ কান্নাকাটি করছিল, কাউকে কিছু বলছিল না,
ছোট ভাবি ওয়াশরুমে ফ্রেশ করতে নিতেই প্রচুর বমি করে দেয়।”
“মানে?” চমকে উঠে নওশি।
মায়ার জন্য ততটা জায়গা যতটা আরজুর জন্য আছে।
মায়াকে প্রচন্ড ভালবাসে নওশি।
“আরে চিন্তা করো না। তেমন সমস্যা না হয়তো।”
নওশির আর একমুহূর্ত থাকতে ইচ্ছে করছে না।
মায়ার খোঁজখবর নিয়ে কোনোরকম ফোন রেখেই ঈশানকে কল দিল।
“নওশি বলো?”
“তুমি কি ব্যস্ত?”
“হুম, ক্লাসে আছি”
“ও সরি। শুনো পারলে তাড়াতাড়ি এসো মায়া অসুস্থ, আমি থাকতে পারছি না”
ঈশান আর কিছু বলার আগেই ফোন কেটে দেয় নওশি।
ভাল লাগছে না কিছুই।
এদিকে তানহার কিছুই ভাল লাগছে না।
বারবার মনে হচ্ছে তার কোনো কথা বা ব্যবহারে মায়া কষ্ট পায়নি তো!
কিন্তু এমন কিছুই হয়নি যাতে মায়া কষ্ট পেতে পারে!
সাতপাঁচ ভেবে সানজানার কাছে গিয়ে বসল,
“ভাবি মায়া আমার কোনো কথাতে কষ্ট পায়নি তো?”
“কেন এমন কিছু কি বলেছ যাতে ও কষ্ট পেতে পারে?”
“না এমন কিছুই না”
সানজানা জানে তানহা খুব ভাল ভাবে চলার চেষ্টা করছে।
ব্যক্তিগতভাবে সানজানারও তানহাকে খুব পছন্দ হয়েছে। তানহা তার ছোট, নওশির বয়সী।
সম্পর্কের হিসেবে বড় হলেও যে কোনো ভুলেই যেন শুধরে দেয় এমনই আদেশ করেছিল সানজানার শ্বশুর।
“আরে ভাবি, তুমি চিন্তা করো না তো, মায়া ঠিক হয়ে যাবে”
তানহাকে বুঝাতে থাকে সানজানা।
হঠাৎ মায়া জেগে উঠে, আর “মেজ ফুপি” বলে ডেকেই আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে।
সানজানা বলল,
“নওশিকে আসতে বলতে হবে”
“নওশি আসবে কাল” উত্তর দেয় তানহা।
“কথা হয়েছে?”
“হুম”
বাসায় ফেরার সবাই খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল।
মায়া রাতে উঠতে চাইল না।
কোনোভাবে একটু খাইয়ে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিলো সানজানা।
সকালে উঠে মায়া পুরোপুরি ভাবে সুস্থ।
স্বভাবসুলভ চঞ্চলতা আর হাসি দিয়ে ভরিয়ে রাখল সারা বাড়ি।
সবাই ভুলেই গেল রাতে ও অসুস্থ ছিল।
নওশি আসলে একটু বেলা হতেই।
নওশি মায়াকে দেখে চমকে উঠল।
কয়েকদিনেই মেয়েটাকে কেমন ফ্যাকাশে রক্তশূন্য লাগছে।
মায়ার কাছে গিয়ে বলল,
“রাফসানা, মামনি এদিকে আয় তো”
মায়া বলল,
“বলো ফুপি”
“চল তোর ঘরে চল, ভাবি কেউ একজন আরজুকে একটু নিয়ে যাও তো”
বলে নওশি মায়ার রুমের দিকে পা বাড়াল।
রুমে ঢুকে মায়াকে নিজের কোলের মাঝে টেনে নিয়ে বলল,
“আম্মা বলতো তুই কাল সারাদিন মন কেন খারাপ করে ছিলি?”
মায়া মাথা নিচু করল।
সে জানে সে মেজ ফুপিকে সব বলবে।
কিন্তু তবুও কেমন যেন লাগছে।
“কি রে মা, কি হয়েছে তোর?”
“ফুপি, মা এসেছিল”
চমকে উঠে নওশি।
কয়েকমুহূর্ত সময় নেয় বুঝতে।
মন থেকে সম্ভাবনা জোর করে তাড়িয়ে বলল,
“কে তানহা?”
“না রিদিমা” নির্লিপ্তভাবে জবাব দেয় মায়া।
নওশির মেজাজ পুরোপুরি খারাপ হয়ে যায়।
রাগ চেপে রেখে বলে,
“কি বলেছে?”
মায়া সবই বলে
নওশি এবার সত্যিই মাথা গরম হয়ে যায়।
এরপর কি করতে হবে বুঝে নেয় নওশি।
ভাইয়াকে কিছু বলবে না সে।
তানহা আর সায়ানের মাঝখানে রিদিমা আনতে চায়না ও।
“আম্মু খাবি চল”
“আমার ক্ষুধা নেই”
অনেক জোর করেও মায়াকে পরিমাণমতো খাওয়াতে পারল না কেউ।
মায়া আর তানহার মাঝে সম্পর্কটা সুন্দর দেখে ভাল লাগল নওশির।
মায়ার খাওয়া হয়ে গেলে স্কুলের জন্য
তৈরী করে দিল তানহা।
নওশি আরজুকে তানহা আর সানজানার কাছে রেখে মায়াকে স্কুলের জন্য বের হলো।
মায়াকে ক্লাসরুমে দিয়ে সোজা মিসের রুমে গেল।
“ম্যাম আপনি এই কাজ টা কেন করলেন?”
থতমত খেয়ে গেলেন মিস। তিনি এরকম কিছু ধারণা করেছিলেন।
“আসলে…”
“কি আসলে! আপনি জানেন মায়ার উপর কতটা বাজে প্রভাব পড়েছে?”
“আমি সরি কিন্তু মায়ের আকুতি!”
“কোন মা? কিসের মা? যে মা মাত্র দুইবছরের বাচ্চাকে রেখে শুধুমাত্র নিজের স্বার্থের জন্য, নিজের জেদের জন্য অন্যের সাথে চলে যায়?”
প্রচন্ড রেগে আছে নওশি।
“আপনি শান্ত হোন, প্লিজ”
নওশি খেয়াল করল সিনক্রিয়েট হয়ে যাচ্ছে।
তাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
তারপর ধীরে ধীরে বলে,
“ম্যাম রাফসানার জন্য এটা এই মুহূর্তে খুব খারাপ হলো, ও এখন আস্তে আস্তে টিনএজ হচ্ছে, সামান্য দুঃখ পাওয়া বা আবেগ সহজেই ওর চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে।
ওর মেন্টাল গ্রোথ এখন খুব বেশি দরকার।
কোনোভাবেই রাফসানার উপর কোনো প্রভাব না পড়ে সে বিষয়ে আমি অনেক বেশি সজাগ ছিলাম।
আপনি তো বুঝেন সব।
কিন্তু বুঝেও মায়াকে মোটেই রিদিমার সাথে দেখা করতে দেওয়াটা ঠিক হয়নি।”
প্রচন্ড অপরাধবোধ কাজ করতে মায়ার স্কুলের হেডমিস্ট্রেসের মাঝে।
তিনি তো সব বুঝেন। কিন্তু!
আস্তে আস্তে বলেন,
“সত্যিই মিসেস নওশি আমি খুব গিলটি ফিল করছি, কারণ আমি আমার দায়িত্বে অবহেলা করেছি,
মায়াকে তার মায়ের সাথে দেখা করতে দেওয়ার আগে আমার একবার আপনাদের পারমিশন নেওয়া উচিত ছিল।
যদিও মায়ার মায়ের আকুতি উপেক্ষা করার মতো না, তবুও আমি দুঃখিত।
মায়াকে আমার আলাদা টেক কেয়ার করতে হতো।
আর ও আমার স্কুলের একটা অনেক বড় সম্পদ। টপ গার্ল! সরি”
এরপর আর কিছু বলার থাকে না নওশির।
শুধু বলল, “এবার আসলে আমার কাছে একবার কল করে বলবেন, আমি দেখা করতে চাই রিদিমার সাথে”
“ওকে”
.
মায়াকে দেখার পর থেকে এক মুহুর্ত স্থির হতে পারছে না রিদিমা।
কেন এমন করেছিল সে কেন!
তাকে এখন নিজের পাপের শাস্তি বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
মায়ার সাথে আরেকবার দেখা করবে বলে ঠিক করে রিদিমা।
কিন্তু কিভাবে!
ভাবতে থাকে সে।
ভাবতে ভাবতেই রেডি হয়ে পা বাড়ায় মায়ার স্কুলের দিকে।
হেডমিস্ট্রেসের রুমে ঢুকতেই দেখল নওশি বসে আছে!
এতটা ভাবেনি রিদিমা!
নওশি রিদিমার দিকে খুব শান্ত চোখে তাকাল তারপর বলল,
“মায়াকে দেখতে এসেছ তো?”
রিদিমা কিছুই বলল না।
“অফিস, বিজনেসের প্রব্লেম হবে না?”
রিদিমা এবার মুখ তুলে তাকাল। তারপর আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকল।
নওশির কথা গুলো গায়ে লাগছে খুব।
কিন্তু রিদিমার মন এখন তপ্ত বালির মরুভূমির মতো!
ভালবাসা নামক পানির আশায় যে মরুভূমি অপেক্ষা করছে।
নওশির মনে হলো তিক্ত ভাবে কথা বলছে সে, তাই নিজেকে সামলে নিলো সে।
তারপর বললো,
“চলো আমার সাথে”
“কোথায়?”
“তোমার সাথে কিছু কথা আছে, আশা করি আপত্তি থাকবে না?”
“হুম, তবে এখানে বলো?”
“না, যেকোনো সময় রাফসানা দেখে ফেলবে”
“বেশ চলো” শান্তভাবে উত্তর দেয় রিদিমা।
.
.
(চলবে)