ওই_আকাশটা_আমার_ছিল অন্তিম পর্ব

#ওই আকাশটা আমার ছিল
#রোকসানা আক্তার
#শেষ পর্ব

এবার পালা ওই গুন্ডাটাকে ধরে বের করার।অয়ন তাই করতে প্রস্তুতি নেয়।জড়সড় প্রস্তুতি।ওই গুন্ডার লোকদের ফোন,লোকেশন সব ট্রেক করে ফেলে।ট্রেকে গুন্ডার লোকদের নাগালে পৌঁছে যায়।তাদের সবগুলাকে ধরে ফেলে। আর তুখোড়ভাবে মারে।মারতে মারতে এক পর্যায়ে এগুলোর মুখ খুলে যায়।এগুলোর থেকে ওই গুন্ডার ঠিকানা নিয়ে অয়নের লোকরা আবার দৌড় লাগায় ওই গুন্ডার দিকে।ঠিকানা অব্দি পোঁছেও যায়।কিন্তু আফসোস সেখানে এক টুকরো কাগজ ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পায়নি।কাগজটিতে মোটা কলমের অক্ষরে লেখা,

“আমাকে ধরবি?আমাকে? এই মিস্টার টেঙ্গলকে?হা হা হা হা হা…আমাকে খুঁজিস না ,খুঁজিস না।খুঁজলেও আমাকে পাবি।ময়ূরপঙ্খির মতন উড়ে গেলাম অচিন বনে…!”

লিখাটি পড়ে রিফাত চরম রকমের বিরক্ত হয়।আর মনে মনে বেটাকে জঘন্য একটা গালি দেয়।তারপর পকেট থেকে ফোন বের করে অয়নকে কল দেয়,

“ভাই?বেটা ত মনে হয় পালিয়ে গেছে!তবে পালিয়ে যাওয়ার আগে এক টুকরো কাগজে উদ্ভট একটা লিখা লিখে গেছে…!”
“কাগজটা নিয়ে তাড়াতাড়ি আমার বাড়িতে এসো রিফাত।”
“হ্যাঁ ভাই এখুনি আসছি।”

৩৩.
অয়ন দীর্ঘ সময় নিয়ে কাগজটি দেখতে থাকে।দেখতে দেখতে বলে,

“মিস্টার ট্যাঙ্গেল আর ময়ূরপঙ্খি! এই দুইটা কথার মানে বুঝেছো রিফাত?”
“না ভাই।”

অয়ন ঠোঁটের কোণে হালকা হাস চেপে এবার রিফাতের দিকে তাকায়,

“ওই গুন্ডা সম্ভবত সবকিছুতে তার ছদ্মনাম ব্যবহার করে।”
“ছদ্মনাম? ”
“হ্যাঁ।মিস্টার টেঙ্গেল,ময়ূরপঙ্খি এসব কি মনে হয় সত্য?সত্য নয়।ও ওর সত্যিকার পরিচয় গোপন রেখে একেক জায়গায় একেক পরিচয় বহন করে বেড়াচ্ছে!এই যে এতদিন আমরা ওকে ধরতে পারছি না এখানে আমাদের ব্যর্থতা কীসের,জানো?”
“কি ভাই?”
“ও বিভিন্ন পরিচয়ে ওকে নির্দিষ্ট জন মনে করে বের করতে পারছি না!লোকদের থেকে ওর এক পরিচয় পাচ্ছি না।তাই বিভ্রান্তিতে আমরা।ও আমাদের খুবই কাছে।হয়তো আমাদের আশপাশেই হাঁটছে।কিন্তু আমাদের এই বিভ্রান্তিকরটাই ওকে আমরা নির্দিষ্ট মনে করে বের করতে পারছি না।তবে এবার ওকে ধরা খুব ইজি হবে!ওর ফটো আর এই ছদ্মবেশ পরিচয়ের মাধ্যমে।তুমি একটা কাজ করো রিফাত।যত এলাকায় ওর যত যত ছদ্মনাম আছে সব বের করো।সবগুলোর একটা লিস্ট বানাও।”
“হ্যাঁ,ভাই। অবশ্যই।”
“গুড!”
“তাহলে আমি উঠলাম ভাই…। ”
“লাঞ্চ টা করে যাও।”
“এখন না।পরে একদিন।মা আজ বারংবার কল করে বলেছেন আজ বাসায় গিয়ে খেতে।এতদিন বাইরে খেতে খেতে পেঁটটা বদহজম করে ফেলেছি।বাসায় খেয়ে বদহজম পরিষ্কার করবো।।বুঝেনই ত ভাই মার হাতের খাবার.. ”

বলেই রিফাত ফিক করে হেসে দেয়।রিফাতের মায়ের কথা শুনে অয়নের তার নিজের মার কথা খুব মনে পড়ে গেল।সেই ছোট্ট বেলায় সে কতই না মার হাতের খাবার খেয়েছে।কতটা অমৃত,অতৃপ্ত সেই খাবার।আজ এতটা বছর হয়ে গেল মায়ের হাতের এক লোকমা ভাত আজ পর্যন্ত কপালে জুটে নি।অথচ সেই খাবারটুকু খেতে ভেতরটা এখনো খুব হাহাকার আর মায়া জমে আছে।সে কি এসব অনুভূতি ফিল করে না?ফিল করে কষ্ট পায় না?অবশ্যই পায়।হয়তো তা কাউকে বুঝতে দেয় না।অয়ন ভার বুকে ভারী একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে।তারপর মুখে জোরপূর্বক একটা হাসি টেনে বলে,

“আচ্ছা যাও,রিফাত।”
রিফাত চলে যায়।

৩৩.
তিন তিনটে মাস পার হয়।এখনো অয়ন ওই গুন্ডাকে ধরতে পারে নি।আর ধরার প্রতি এই কয়েকটা দিন ওতটা চেষ্টা ও করা হয়নি।কারণ,তার শোচণীয় অবস্থা পৃথীকে নিয়ে।পৃথীর প্রেগন্যান্ট ডেট খুবই কাছে।বলা যায় একসপ্তাহ আর সময় আছে।ইদানীং পৃথীর তলপেটে তার চিনচিন ব্যথা করছে।সে ব্যথাটা মোটা হয়ে আরো প্রকান্ড ব্যথায় পরিণত হচ্ছে । দাঁতের সাথে দাঁত কামড়ে পৃথী সেই ব্যথা কমাতে চেষ্টা করছে তারপরও পারছে না।অয়ন পৃথীর এসবকিছুই লক্ষ করে।।আর অপেক্ষা ফিক্সড ডেটের জন্যে।কিন্তু ডাক্তারের পাঁচ তারিখে দেওয়া ডেটানুযায়ী পৃথীর গর্ভপাত হয় নি।তার দুইদিন আগেই পৃথীর কোল ভরে চলে আসে এক নব পুত্র।তার তুলতুলে হাত।টকটকে ঠোঁট,গাল..!আর ড্যাবাড্যাবা চোখ।বাচ্চাকে পেয়ে পৃথীর যে কী খুশি তা কাউকে বলে বুঝাতে পারবে না!অয়নও খুশি।তবে পৃথীর খুশিতে সে একটু বেশিই খুশি!পৃথী যখন বাবুর গাল, নাক, কান ঠোঁট টিপতে টিপতে বলে,

“ওহ সুইট বাবু তোমার সব এত চ্যাপ্টা কেন?এভাবে ত তোমাকে ভালো দেখাচ্ছে না।ওয়েট তোমার এসব ঠিক করে দিচ্ছি।তোমাকে একদম তোমার বাবার মতন সুইট করতেছি..।

তখন অয়ন দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে খুব হাসে।আর সবচে হাসে পৃথীর এখনো বাচ্চা বাচ্চা ভঙ্গিমা দেখে।গতকাল কি হলো..অয়ন বাইরে থেকে ফিরতেই পৃথী টুপ করে বাবুকে অয়নের কোলে তুলে দিলো।

” সারাদিন বহুৎ টো টো করছেন।এবার বাবুকে রাখুন।হাঁটুন।বাবুর কান্না থামান।আমি একটু ফোনটা টিপি।ক’দিন হলো ফেসবুকে ঢুকি নি!ফ্রেন্ডরা সবাই ত মনে হয় এতদিন ট্টিট খুঁজে খুঁজে মেসেন্জার ফাটিয়ে ফেলছে!বেচারীদের ট্রিট দিতে হবে আবার!”

অয়ন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে।মেয়েটি এখনো বাচ্চা হয়ে রইলো? আর এই বাচ্চা মেয়ের আবার আরেকটা বাচ্চা।হায় আল্লাহ এখন ত তাকে দুই দুটো বাচ্চা একসাথে সামলাতে হবে!

৩৪.
অপূর্বের আজ বয়সের চৌদ্দদিন পার হয়ে গেল।অপূর্বকে আগের থেকে এখন কিছুটা শক্তপোক্ত।কোলে নিতে আরাম বোধ হচ্ছে।পৃথী আরাম করেই কোলে নিচ্ছে। অপূর্ব নামটি তার দাদি রেখেছেন।পাঁচদিন আগে এসে তিনি লুকিয়ে নাতিকে দেখে গেছেন।বিষয়টি অয়ন জানে না।আর পৃথী ও বলেনি।অয়নের মা নিজেই বারণ করছেন তিনি যে অপূর্বকে দেখে গেছেন তা অয়নকে না বলতে।আর অপূর্বের নামের ব্যাপারটায় আসলে পৃথী বলে সে নিজেই এই নাম রাখবে বাবুর।অবশ্যি অয়ন ওতটা চাপ নেয়নি।বাপের নামের সাথে বেটার নামের অপূর্ব নামটা ও অপূর্ব মানিয়েছে তাই।

সবকিছু নিয়েই পৃথীর মোটামুটি ভালোই দিন কাটছে।তবে এবার এতদিনের মনের ভেতরের চাপা অস্বস্তিটা ফয়সালা করতে পারলে আরো হালকা থাকতে পারবে।সে খুব ভেবেছে অয়নকে অয়নের পরিবারের কথা বলবে।সে অপূর্বকে নিয়ে তার দাদার বাড়ি যেতে চায়।বাবুকে প্রথমে দাদার বাড়ি যাত্রা করাতে চায়।দাদা-দাদী বাবুকে দেখবে।বাবুকে দেখলে সবাই খুব খুশি হবে।কিন্তু এই বিষয়টা অয়নকে কীভাবে যে বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না পৃথী।মনস্থির করে ফেলে আজ রাতের মধ্যেই অয়নের কানে কথাটা পাড়বে।

অয়ন রাতের যখন ডিনার শেষ করে রুমে আসে।পৃথী তখন বাবুকে মাত্র বিছানায় শোয়ালো।এতক্ষণে মুখে দুধ দিয়েছিল।দুধ খেয়ে বাবু ঘুমিয়ে গেছে।

“অপূর্ব কি ঘুমিয়ে গেছে?”
“হু।”
“হু” বলেই পৃথী মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে নেয় বলার।
“আপনার সাথে আমার কথা আছে।”
“বলো।”

পৃথী ধীরেসুস্থে বলবে এমন সময় অয়নের ফোনকল বাঁজে।
“বলো রিফাত?”
“ভাই, মিস্টার টেঙ্গেলকে পেয়ে গেছি।হিমপুর চলে আসুন তাড়াতাড়ি!টেঙ্গেলকে ভেঙ্গেল বানাবো।আমরা সবাই হিমপুরেই আছি!”
“গন্ডাটাকে অবশেষে পেলে?”
“জ্বী, ভাই জ্বী!”
“অনেক খুশি হলাম রিফাত।আমি এখুনি আসতেছি।”

বলেই অয়ন পকেটের ভেতর ফোনটা রেখে ব্যতিব্যস্ত মনে উঠতে যায়।ওমনি পৃথী অয়নের বাম হাতটা ধরে ফেলে।বলে,

“কোথায় যাচ্ছেন?”
“পৃথী ওই যে যে গুন্ডাটা তোমাকে কিডন্যাপ করলো না একবার?তাকে আমার লোকরা ধরে ফেলেছে!”
“তো এখন তাকে মারতে যাবেন?”
“মারি না বাঁচিয়ে রাখি তা আপাতত বলতে পারছি না।ওখানে গেলে আই উইল ডিসিশন…! ”
“প্লিজ মেরে ফেলার মতন ওরকম কিছু করবেন না।থানা-পুলিশের ব্যাপার আছে।তাছাড়া এতরাতে আপনাকে আমার একা ছাড়তেও ইচ্চে হচ্ছে না।হিমপুর অনেক দূরে!”
“আহা,পৃথী এত টেনশন করো না।আমার কিছু হবে না।আল্লাহর উপর ভরস রাখো।আমি বারোটার আগে আগেই চলে আসার চেষ্টা করবো।বাবুর দিকে খেয়াল রাখো।”

পৃথী মলীনতা মুখে নিচের দিকেই তাকিয়ে থাকে।তা দেখে,
“এই দেখো আবারো টেনশন..বললাম না কিছু হবে না।”

পৃথী এবার ফসফস করে কেঁদে দেয়।অয়নের বুকের দিকে মাথা ঠেকিয়ে,
“আপনার কিছু হলে আমি সত্যিই মরে যাবো।এইসময়টা প্লিজ ক্যান্সেল করুন।প্রয়োজনে দিনে বের হয়েন।আমার কোনো কিছু ভালো লাগছে না।ভেতরে প্রচন্ড জ্বালাফালা করছে।মনকে কেনজানি কিছুতেই মানাতে পারছি না।”

অয়ন এবার পৃথীর পিঠের এলোমেলো চুলগুলো সযত্নে এক পাশে সরিয়ে পৃথীকে আরেকটু বুকের দিকে টেনে নেয়।আশ্বস্ততা গলায় বল,

“তুমি খামোখা টেনশন নিচ্ছ বউ।তোমার স্বামী প্রতিকূল অবস্থাকে হ্যান্ডেল করার ক্ষমতা আছে। বিশ্বাস রাখো তোমার স্বামীর উপর।এভাবে কেদো না।আমার কষ্ট হচ্ছে খুব।”

পৃথী এবার কান্নার গতিটা হালকা কমিয়ে আনে।অয়ন আলতো করে পৃথীর মাথাটা তুলে।তারপর মাথাটির সেই কপালে একটা চুম্বন এঁকে দিয়ে বলে,

“এবার একটু হাসো?”

পৃথী হাসতে পারে নি।
“প্লিজ হাসো।আমি তোমাকে একটু হাসি মুখে দেখতে চাই।”
“।
পৃথী হাসে।খুবই মলীন সে হাসি।অয়ন সেই মলীনতা হাসি টুকু খুব ফিল করে।তবে তা পৃথীকে বুঝতে দেয়নি।বাঙ্গালী বউরা এরকমই।স্বামীর হালকা পাতলা কোনো অঘটন শুনলেই হলো। পুরো পৃথিবীটা যেন মাথায় তোলা অবস্থা।কিছু বুঝাতে গেলেও লাভ নেই।বিশ্বাস হয় না।তারচে আগে সে ওখান থেকে ফিরুক।সুস্থ-সাবলীল দেখতে বউ আপনা আপনিই চুপ হয়ে যাবে।
#ওই আকাশটা আমার ছিল
#রোকসানা আক্তার
শেষ পর্ব(২য় খন্ড)

আকাশ চলে যাবার পর পৃথী অপূর্বের পাশ দিয়ে শুতেই চোখে হালকা একটু তন্দ্রা লেগে আসে।তবে তন্দ্রাটুকু বেশিক্ষণ স্থায়ী থাকে নি।অপূর্ব কেঁদে উঠতেই পৃথীর অবাধ্য চোখের পাতা মেলে যায়।পৃথী শোয়া থেকে উঠে বসে অপূর্বকে কোলে নেয়।তারপর জামার উপরের দুটো বোতাম খুলে ডান দুধের বোটা টা অপূর্বের মুখে ফুড়তেই আপনা আপনিই অপূর্বের কান্না থেমে যায়।অপূর্ব অত্যন্ত আয়েশ মনে মায়ের দুধ খেতে থাকে।তা দেখে পৃথী মুঁচকি একটা হাসি দিয়ে আদুরে গলায় বলে উঠে,

“আমার লক্ষী, বাবা।”

এভাবে কয়েক মিনিট চলে।তারপর আস্তে আস্তে অপূর্বের চোখের পাতা বুঁজে আসে।আর ভারী ভারী নিশ্বাস ফেলতে থাকে। অপূর্ব আবার ঘুমিয়ে গেছে পৃথী তা বুঝতে পেরে অপূর্বকে খুবই আলতোভাবে আবারো বিছানায় শুইয়ে দেয়।শুইয়ে দিয়ে পৃথী বালিশের কিণার হাতরে তার ফোনটা নেয়।তারপর স্ক্রিন সামনে এনে টাইমটা দেখে।সময়-১১ টা বেঁজে ১৫।বারোটায় অয়ন বাসায় ফিরবে।সময় হাতে আছে ৪৫ মিনিট।এই সময়টুকুতে সে আর ঘুমুবে না।কয়েক রাকাত নফল আদায় করবে।।মনে খুব চিন্তা!অয়ন একা এতরাতে বাসা থেকে বের হয়েছে!কী থেকে কি ঘটে!অথবা ওই গুন্ডাটাও বা কি করে বসে ওই উপরের উনি ছাড়া আর কেউ ভালো জানেন না!!উৎকন্ঠা মনে বলেই পৃথী তরহর খাট থেকে নেমে বাথরুমে ঢুকে নামাজের ওযু করতে।ওযু শেষ করে জায়নামাজে এসে দাঁড়ায়।নামাজ পড়া শেষ হলে পৃথী আবার খাটে এসে বসে।মাথার হিজাবটা খুলে তা একপাশে রেখে দিয়ে আবার ফোনটা হাতে নেয়।তাকিয়ে এখন বারোটা দশ।সময়টা দেখে পৃথী আর এক মিনিটও দেরী করলো না।ওমনি অয়নের নাম্বারে কল লাগায়।রিং হতেই সাথে সাথে ওপাশ থেকে রিসিভ হয়।এপাশ থেকে পৃথী বলে উঠে,

“হ্যালো?হ্যালো?আপনি কোথায়?বাসায় ফিরতেছেন ত?”
“পৃথী কখন ফিরবো তা এখন বলতে পারছি না।তোমার সাথে আমি পরে কথা বলতেছি।টেনশন করো না।”

বলেই অয়ন কলটা কেঁটে দেয়।পৃথীর প্রচন্ড মন খারাপ হয়ে যায়।আর সাথে মনের উৎকন্ঠাটা আরো বেড়ে যায়।-“মানুষটি যাওয়ার আগেই ত বললো বারোটার দিকে ফিরে আসবে।আর এখন বলতেছে কখন ফিরবে তা সিউর বলতে পারছে না!কোনো ঝামেলা আবার হলো না ত?কী করা যায় কী করা যায়?আচ্ছা রিফাত ভাইকে কল করলে কেমন হয়?হ্যাঁ রিফাত ভাইকেই করা যায়।”

পৃথী রিফাতকে কল দেয়।প্রথমবার রিফাত রিসিভ করে নি।দ্বিতীয় বারের মতন রিসিভ করে।
“জ্বী,ভাবী?”
“কি অবস্থা? সব ঠিকঠাক আছে ত?”
“হ্যাঁ,ভাবী সব ঠিকঠাক আছে।আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।”
“আমার খুব চিন্তা হচ্ছে!আপনার ভাই আমার কলটা কেঁটে দিয়েছে!”
“ওই বুঝেন ই ত!মাফিয়া টাইপ গুন্ডা।ভাই তাকে টাইট দিতাছে।।তাই আর কি ভাবী..!”
” কাউকে টাইট দিতে হবে না।বলুন বাসায় চলে আসতে।”

বলেই পৃথী কল রেখে দেয়।

৩৫.
রিফাত তার ফোনটা পকেটে গুঁজে অয়নের দিকে এগিয়ে আসে।

“ভাই? ভাই?ভাবী কল করেছে?ভাবী বারবার আপনার….!”

বাকি কথাটুকু রিফাতের আর বলা হলো না।তার আগেই অয়ন হাত উঁচিয়ে রিফাতকে চুপ করিয়ে দেয়।সে এখন রিফাতের কথা শুনছে না।তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্লাক কোর্ট,ব্লাক জিন্স,ব্লাক স্যু,ব্লাক চশমা পড়া গুন্ডাটার,অর্থাৎ মিস্টার টেঙ্গেলের সাথে আগে কথা শুনা শেষ করে তারপর রিফাতের কথা শুনবে।এর আগে নয়।রিফাত তা বুঝে নিয়ে মাথা নেড়ে আবার সরে পেছনে এসে দাঁড়ায়।অয়ন এবার তীক্ষ্ণ চোখে মিস্টার টেঙ্গেলের দিকে তাকায়।কড়া গলায় বলে,

“তুই আমার খুব ভালোভাবে পেছনে লেগেছিস।প্রথমত পৃথী,আই মিন স্ত্রীকে কিডন্যাপ করেছিস।তারপর আবার আমার বিজনেসের উপর চোখ তুলেছিস!এসব ত করতেছিস ই আবার নিজের রিয়েল পরিচয়টাও লুকিয়ে রেখেছিস।সবার সামনে নিজেকে ছদ্মবেশে পরিচয় দিয়ে আসছিস!এসব কেন করতেছিস?কেন?জবাব দে!”

লোকটি ফিক করে হেসে দেয়।কালো সবকিছুর মাঝে সাদা দাঁতগুলো সেই হাসিতে চকচক করে উঠে।তবে হাসিটা খুবই জঘন্য ছিল।লোকটি হাসি শেষ করে বলে,

“আস্তে আস্তে সব জানবি।এত ধৈর্য্যহারা হচ্ছিস কেন?”
“আমি এখানে তোর ফর্রামল লেকচার শুনতে আসি নি।যা বলছি তার সোজাসাপটা জবাব দে!নাহলে তোর সময় খুব তাড়াতাড়ি ই ফুরিয়ে আসছে।হাতে সময় তেমন নেই।”
“তুই যদি ভেবে থাকিস আমি তোকে ভয় পেয়ে সাথে সাথে তোর সব কথার জবাব প্রদান করবো।তাহলে এটা তুই ভুল ভাবছিস!এই রনোক খান কাউকে ভয় পায় না।এই রনোকের জন্ম হয়েছে শুধুই মানুষ তাকে ভয় পাবে বলে।তোর মতন ঠুনকো এক টাকার অয়নও!যাকে ছোট্টবেলায় তার পরিবার লাথি মেরে বাসা থেকে বের করে দেয়!হা হা হা হা হা হা হা”
“তারমানে তোর নাম রনোক খান?!”
“ইয়েস!আরো জানবি আমার পরিচয়?তুই ম্যাজিস্ট্রেট ইলিয়াসকে চিনিস?যদি ম্যাজিস্ট্রেট ইলিয়াসকে না চিনে থাকিস তাহলে রাফিকে চিনিস?যাকে তোর সত্যবাদী বাবার সত্য সংবাদ প্রচারের কারণে দড়িতে ঝুঁলিয়ে ফাঁসি দেওয়া হয়!ওই শোক!ওই তীব্র শোক এখনো আমার হৃদয়ের ভেতরে ভেতরে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।আমি চোখের সামনে ভাইকে হারানোর দৃশ্য,বাবার ব্রেন বিকৃত হওয়ার দৃশ্য সব পই পই করে দেখেছি।এসব দেখার পরও শত্রুকে খুব সহজে ছেড়ে দিব ভেবেছিস?খুব সহজে?নো নেভার!আমার বাবার চোখের সামনে থেকে যেমন আমার ভাইকে তোর বাপ কেড়ে নিয়েছে।তেমনি আজ আমি তোর বাবার চোখের সামনে থেকে তোকে কেড়ে নিব!শুধু সেদিন তোর দাদাকে আমার বাবা মেরে ভুল করেছে।। সেদিন তোকে ই মেরে ফেলা উচিত ছিল!যাইহোক,তোর দাদা গেলো এখন তুই ও যাবি…!”
“তারমানে তুই ওই কুলাঙ্গার ম্যাজিস্ট্রেটের ছেলে!আর ওই কুলাঙ্গারই আমার দাদাকে খুন করেছে?!”

অয়ন রাগের সীমা একদম সপ্তকাশে পৌঁছে যায়!কান দিয়ে গরম ধোঁয়া।বেরুতে থাকে।ঘাড়ের রগ দুটা ফুলে মোটা হয়ে যায়।কপালের রগও। চোখজোড়া রক্তবর্ণ করে চঞ্চল দুই খানা হাত রনোকের দুইগাল বরাবর বসাতেই পেছন থেকে কয়েকটা গুন্ডা এসে অয়নের কপাল বরাবর অনেকগুলো বন্দুক তাঁক করে দাঁড়ায়।সেইম ভাবে পেছন থেকে রিফাত এবং লোকদেরও সেভাবে ঘিরে ধরে দাঁড়ায়।অয়ন বেশ ভালো করে বুঝতে পারে এই গুন্ডা গুলা রনোকের লোক!

৩৬.
রাত দু’টা বাঁজতে চললো।অয়ন এখনো বাসায় আসছে না।পৃথীর ভেতরের হার্টবিটটা এখন কীভাবে যে উঠানাম করতেছে তা সে নিজেও জানে না।যতবার অয়ন এবং রিফাতের নাম্বারে শুধু ফোনের পর ফোন দেয় ততবারই বন্ধ বাতায়।বারোটার দিকেই ঠিকই কল ঢুকেছিল।দুজনে ঠিকই রিসিভ করেছিল!কিন্তু এখন কেন নয়!এখন কেন নয়!একদম উদাস আর অস্থির পৃথী।বলা যায় পাগল প্রায়!পাগলের মতন বার বার এদিক ওদিক ছুটছে।ফেনটাকেও রেস্টে থাকতে দিচ্ছে না।ফাহাদকে একশোবার কল দিচ্ছে।যে করেই হোক সে এখন হিমপুর যেতে!একা যেতে না পারলে তার বাবা,চাচা,মামা যারা আছে সবাইকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে!কিন্তু ফাহাদ পৃথীকে বুঝাতে পারছে না হিমপুর সে কোথায় যাবে?কোন ঠিকানায়?ঠিকানা দিতে!না পৃথী কোনো ঠিকানা জানে,আর না হিমপুর জায়গা টা চেনে!তবে তার অয়নকে যে করেই হোক এনে দিতে হবে!তা কীভাবে আনবে তা সে জানে না!অবাধ্য ফাহাদ না পেরেও আর পারলো না।ধৈর্য্য হারা হয়ে অচেনা ঠিকানায় বেরিয়ে পড়লো অয়নের খোঁজে!পৃথী শুধু যে ফাহাদকে হিমপুর যেতে বলেছে তা নয়।তার শ্বশুর বাড়ির লোকদেরও ছাড়ে নি!শাশুড়ীকে মাকে কল করে বলেছে শ্বশুর এবং ভাসুরকেও যেভাবে হোক হিমপুরে যেতে।তাদের ছেলে মারা যাচ্ছে।একটা গুন্ডা তাদের ছেলেকে কল করে হিমপুর নিয়ে গেছে। দেরী করলে একেবারে মেরেই ফেলবে!আর জ্যান্ত পাবে না অয়নকে।সে অয়নকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে।অপূর্বও তার বাবাকে হারিয়ে ফেলবে!বাবা বলা আর কোনোদিন হবে না অপূর্বের!বেচারাও বউয়ের কথায় আর মন শক্ত করে রাখতে পারলো না।ঘনঘটা আঁধারে তারাও বেরিয়ে পড়লো!তাছাড়া অয়নের ব্যাপারটা রহিমাকেও জানালো পৃথী!এতরাতে রহিমা পিয়ারা বেগমকে নিয়ে পৃথীর কাছে আসতেও নাকি রওনা করে দিলো!
#ওই আকাশটা আমার ছিল
#রোকসানা আক্তার
শেষ পর্ব(৩য় খন্ড)

৩৭.
সবাই এলো।সবাই এলো বলতে রহিমা,পিয়ারা বেগম পৃথীর শাশুড়ী আর বড় ঝাঁ। অবশ্যি শাশুড়ী আর বড় ঝাঁ যে এই দুপুর রাতে চলে আসবে এটা পৃথী কস্মিনকালেও ভাবে নি।সে আরো প্রচন্ড মাত্রায় অবাক হয় যখন তার শাশুড়ী এসেই বলে,

“পৃথী? তোমার শ্বশুর আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে।বাবুকে নিয়ে একা একা আছো তারউপর আবার অনেক বড় টেনশন ছেলেটা কোথায় গেল!তাই একটা সেকেন্ডও বাসায় দাঁড়াতে দিল না।”

পৃথী এ’কথার পিঠে আর কোনো জবাব প্রদান করতে পারে নি ।শুধু মনে মনে এটুকুই বলা ছাড়া,হে খোদা সব ঠিকঠাক হবে।সবার সাথে সদ্ভাব হবে।এখন শুধু তুমি আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দাও।

আল্লাহ ঠিকঠিকই পৃথীর কথা শুনে।তার প্রায় আধাঘন্টা পরই অয়ন বাসায় ফিরে আসে।অয়ন একা আসে নি।সাথে রিফাত,অয়নের বাবা এবং বড় ভাই।তবে ফাহাদকে সাথে দেখতে পায়নি।ফাহাদের অনুপস্থিতি দেখেই পৃথী চট করে বলে উঠলো,

“ফাহাদ ভাই কোথায়?”

তা শুনে অয়ন চোখ বড় করে বলে,

“ফাহাদকেও ছাড়লে না!”
“ফাহাদ ভাইকে কল করেছি।উনি অনেক আগে হিমপুর গেছে।আপনারা ফাহাদ ভাইকে দেখেন নি!”
“না।”
“হিমপুর কোথায় ছিলেন সেটার আবার এড্রেস দিতে পারিনি উনাকে।হয়তো অন্য জায়গায় খুঁজছে।আচ্ছা আপনি প্লিজ তাড়াতাড়ি ফাহাদ ভাইকে কল করুন। বলুন আপনি বাসায় চলে এসেছেন।বেচারা আবার এতরাতে একা একা বাইরে।ভয়ের ব্যাপার আছে।”
“ভয়ের ব্যাপার থাকলে সবাইকে এভাবে কল করার কি প্রয়োজন ছিল?”

পৃথী এবার কিছুটা চুপসে যায়।নাজুক ভরা চোখে অয়নের দিকে ফের তাকায়।অয়ন টান টান চোখে পৃথীর দিকে তাকিয়ে।।পৃথী এবার ধুপ করে চোখজোড় বুঝে ফেলে।আর দপদপ করে দুই দুইবার দম নেয়।তারপর বাচ্চাদের মতন বলে উঠে,
“আপনি ১২ টায় বাসায় আসার কথা বলে কখন এসেছেন বলেন ত?আমার কি চিন্তা হয়নি?আমি কত চিন্তা করেছি এবং ভয় পেয়েছি, জানেন আপনি?”
“আমি একটু ওই মাফিয়ার সাথে কথার গোলমালে আঁটকে গেলাম!তাই দেরী হয়ে গেছে।তোমাকে ত আমি আগেই বললাম আমার নিজেকে সেইভ করার সেই ক্যাপাবিলিটি আমার আছে।আর তুমি কিনা….!”

পাশ থেকে অয়নের মা বলে উঠে,
“আহা অয়ন,বউ মার দোষ কি! বউমা আমাদের বলেছে বিধায় ই ত আমরা জানতে পেরেছি।যদি তোর সত্যি ই কিছু হয়ে যেত!তখন?”

অয়ন এবার মার দিকে তাঁকায়।খুবই মন্ত্রমুগ্ধ মাখা মুখে তাকায়।আজ কতটা বছর পর সেই চিরচেনা মুখখানা দেখলো।কতটা বছর পর সেই চিরচেনা মুখখানার সুমিষ্টময় ধ্বনি শুনতে পেলো।কোথায় ছিল এই মানুষটি এতটাদিন?সে ত নিজেকে এতটা বছর লুকিয়েছিল কিন্তু এই মানুষটি তাকে একবারও খোঁজ করার প্রয়োজন বোধ করে নি?তাদের নাড়িরটানের কি কোনো সম্পর্ক ছিল না?ছিল।সব ছিল।মা হয়তো খুব কাঁদতো।রাতদিন উজাড় করে কাঁদতো।এতে মুখ ফুলে যেত,চোখ লাল হয়ে যেত।চোখের নিচে আবার সেই পানির কালো শিরার দাগ পড়তো।কিন্তু অবাধ্য বাবা তা দেখতো না।শুনতো না।শুনলে-দেখলেও তা এড়িয়ে যেত।অথচ আজ সেই বাবাও এতটা বছর পর এসেছেন।সাথে ভাই-ভাবীকেও সঙ্গে করে!তাহলে কী বাবার এতদিনের মনের সব রাগ-অভিমান-কষ্ট মুছে গেছে?বাবা কি তাহলে দাদার মৃত্যুর কথা ভুলে গেছে?নাকি দাদার মৃত্যুর জন্যে একজন অবুঝ শিশু কেন দায়ী থাকবে নিজের ভুল বুঝতে পেরে চলে এসেছে!ঠিক অয়নের ভাবনার মাঝেই অয়নের বাবা অয়নের কাঁধে আলতো করে হাত রাখে।অত্যন্ত গম্ভীরা কন্ঠে বলে,

“অয়ন?”

অয়ন তার বাবার দিকে তাকিয়েছে কি তাকাই নি তা সে নিজেও বুঝতে পারছে না।সে অত্যন্ত ভার শূন্য,নিষ্প্রভ, নিষ্প্রাণের মতন।মনের সকল তীব্র চেতনা কেনজানি মুহূর্তের জন্যে মুছে যায়।

“অয়ন খুব রাগ তোর বাবার উপর তাই না?আমি তোকে খুব ভুল বুঝেছি।মা-বাবার মৃত্যুর জন্যে তোকেই শুধু দায়ী করেছি।কেন তখন ওতটা অবুঝ হয়ে গেলাম বলতো? একবারও কি মাথায় আসে নি একটা ছোট্ট শিশু হত্যাকারীর কথা কীভাবে বলতে পারবে?তা সম্ভবও কীভাবে?তার চোখের সামনে তার দাদাকে একজন হত্যাকারী জখম করতে দেখে সে যে স্বাভাবিক ছিল বা সে বেঁচে এসেছে এটাই ত বেশি!তখন বুঝি নি।কিন্তু এখন বুঝলাম।খুব বুঝলাম।তবে বুঝেও কি হলো তোকে যে হারালাম।তোকে খুব কষ্টে রাখলাম!”

বলতে বলতে অয়নের বাবার কন্ঠস্বর খুব ভেঙ্গে আসতে থাকে।যেন এক পাল না ধরতেই তিনি একদম নিচেই পড়ে যাবেন।। অয়ন দুই হাতে তার বাবাকে আগলে নেয়।অয়নের বাবা অয়নের সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে এবার বলে,

“আমাকে ক্ষমা করে দে অয়ন।আমি তোর একজন খারাপ বাবা।খুবই খারাপ বাবা।যে তোকে খুব খুব কষ্ট দিয়েছে।”
“ছিঃ বাবা,এভাবে বলতে নেই।তোমার কোনো দোষ নেই।দাদা-দাদীর মৃত্যুটা তুমি খুব স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারো নি।ভীষণ কষ্ট পেয়েছ।বুঝি আমি।”
“কিছু বুঝিস নি তুই।বুঝলে আর আমাকে, তোর মাকে,ভাইকে ছেড়ে এভাবে পালিয়ে যেতিস না।”

এভাবে অনেকক্ষণ ধরে বাপ-ছেলর রাগ-অভিমান ভাঙ্গতে থাকে।তারপর বাবার সাথে অয়নের কথা বলা শেষ হলে মায়ের সাথে।অতঃপর ভাই-ভাবীর সাথে।উপস্থিত সবার সাথে সবার ভালো একটা সদ্ভাব হয়।কারো মনে নেই কোনো রাগ নেই,দুঃখ নেই,কষ্ট নেই,মান-অভিমান নেই।সবকিছুই স্বচ্ছ আর নরম!পৃথী এমন একটা দৃশ্য দেখে মনে মনে খুশিতে নেচে যায়।আর আকাশপানে তাকিয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে বলে উঠে,

“খোদা তোমার দয়ার শেষ নেই! আমি এরকম একটা দিনের জন্যেই এতদিন অপেক্ষা করেছিলাম।ঠিক এরকম একটা দিনের জন্যেই।”

মনে মনে বলার পরপরই পৃথীর আবার ফাহাদের কথা মনে পড়ে যায়।

“আচ্ছা এবার ফাহাদ ভাইকে কল করুন। কোথায় আছেন ভয় হয় খুব।”

হায়রে বউয়ের পাগলামী! অয়ন এবার আর বউয়ের ফিকির থেকে না বেঁচে পকেট হাতড়ে ফোনটা বের করে।ফাহাদকে কল লাগায়।সাথে সাথে ওপাশ থেকে কল রিসিভ হয়।

“হ্যালো?তুই কোথায়? আমি তোকে খুঁজতে খুঁজতে শেষ।উফফ…!”
বলতে বলতে বেচারী ফাহাদের ওপাশ থেকে জোর গলায় কয়েকটা দম ফেলার শব্দ শোনা যায়।তার দম ফেলার ধরণ শুনে বুঝা যাচ্ছে সে অয়নকে খুঁজতে খুঁজতে প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে গেছে।

“আমি বাসায় ফিরেছি ফাহাদ।তুই বাসায় চলে আয়!আর কষ্ট করে খুঁজতে হবে না তোকে।”
“শুকরিয়া।চিন্তা মুক্ত হলাম।আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসতেছি।আর পারলে ভাবীকে একটু কুল করিস।ভাবীর মনে হয় এরইমাঝ একশোবার হার্ট এ্যাটাক করা শেষ।”সেই কথার পিঠে অয়ন পৃথীর দিকে তাকিয়ে হালকা একটু হাসি দেয়।হাসিটা গভীর।দেখেই বোঝা গেল হাসিতে কিছু একটা ছিল তার।হয়তো সে হাসিতে অয়ন এমনটা বুঝালো”বউ কে ত কুল করবোই।বাই এ্যানি চান্স তাকে একটু একা পেয়ে নিই।”

পৃথীকে একা পাওয়ার সেই সুযোগটা পেয়েও গেল অয়ন।যখন তার বাপের বাড়ির লোক আর শ্বশুর বাড়ির লোক এক হয়ে অপূর্বকে কোলে তুলে নেয়।ওমনি অপূর্ব প্যাঁচপ্যাঁচ করে কেঁদে দেয়।আর সবাই অপূর্বের কান্না থামাতে, “ওরে সোনা আমার,ওরে দাদুভাই আমার,ওরে নানুভাই আমার,ওরে ভাতিজা আমার”-বলতে বলতে অপূর্বকে বাইরে নিয়ে যেতে থাকে সবাই।আর ফাঁকা রুমে শুধু অয়ন আর পৃথী থেকে যায়।পৃথী ত ভয়ে শেষ!সে যে কান্ড ঘটিয়েছে…সবাইকে কল করে করে রাত-বিরাতে ঘর বাহির করেছে!এটার ষোলকলা ত অয়ন উদ্ধার করবেই করবে।তাকে ত অয়ন এমনি এমনি আর ছেড়ে দেবার মতন পাত্র নন ।পৃথী বিচলিত চোখে এদিক ওদিক তাকায় অয়নের সামনে থেকে ছুটে যেতে।কিন্তু পারে নি।অয়ন তার আগেই পৃথীকে দেয়ালের সাথে চেপে নেয়।ওমনি পৃথী ভয় জড়ানো গলায় বলে উঠে,

” আই’ম সরি গ্যাংস্টার!আপনার যদি কিছু একটা হয়ে যায় সেই ভয়ে আমি সবাইকে…!”

বাদবাকি কথা বলতে পারলো না পৃথী।উসফুস মনে কথাগুলো গলাতেই জড়িয়ে গেল।
“যদি সত্যি সত্যি অয়নের কিছু হয়ে যেত তাহলে কি করতে তুমি?”
“জানি না কি করতাম।তবে এটুকু জানি আমি শেষ হয়ে যেতাম!”
“আচ্ছা? ”
“জ্বী!বিশ্বাস হয় না?”

অয়ন ফিঁকে হেসে এবার পৃথীকে ছাড়িয়ে দেয়য়।তারপর লম্বা একটা শ্বাস টেনে বলে,

“তুমি জানো?আমার যে একটা আকাশ আছে?”
“য়ু হু।কেমন সেই আকাশ?”
“সেই আকাশটা গভীর আর বিশালকার।সেই আকাশটা ভালোবাসা-মায়া-আবেগ-ভরসা-মমতার স্থান ।সেখানে কেউ একজন অতি সযত্নে আমার পুরো অস্তিত্ব জুড়ে জড়িয়ে আছে।তাকে ছাড়া আমি আমাতে প্রাণহীন।সেও আমাকে তাই। তার সেই আকাশে তার প্রিয় মানুষটি তাকে কখনোই ছেড়ে যাবে না।বাকিটা জীবন তাকে নিয়েই কাঁটাবে।এবার বলো ত আমার সেই আকাশটা কোথায়?”

পৃথী ঠায় খানিক্ষন চুপ করে থেকে কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করে।তারপর বলে,

“এই যে যে এই আকাশ?”
“য়ু হু।পৃথিবীর আকাশেতে তো কোনো অনুভূতি নেই।অনুভূতিশূন্য।আমার আকাশটা অনুভূতিপূর্ণ। আমার আকাশটা ঠিক এইখানে।”শেষের বাক্যটা অয়ন তার বুকের মাঝখানের দিকটায় হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে তারপর আবারও বলে,

“সেই আকাশটায় আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই পৃথী নামের মেয়েটিরই বিচরণ।এই মেয়েটিকে ছেড়ে তার এক্সিডেন্টলি কিছু হয়ে যাবে এটা সে ভাবলে কি করে?”

পৃথীর আগের মতনই ঠায় দাঁড়িয়ে ।তবে তার চোখের চাহনিতে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।পুরো চোখের উপর চিকচিক পানির কণা টুপটাপ করে উঠছে!অয়নের কথাগুলো খুবই আবেগাপ্লুত।পৃথীর হৃদয়কে মুহূর্তে ই যেনো বিষিয়ে দিবে।সে কেঁদে উঠবে।কাঁদতে কাঁদতে বলবে,”নাহ কিছুই ভাবি নি।আমি আপনাকে ভালোবাসি।পাগলের মতন ভালোবাসি।কিন্তু কেনজানি আপনার হালকা কিছুও আমার খুব ভারী লাগে।আমি মেনে নিতে পারি না।বিশ্বাস করেন কেন আমার এরকম হয় আমি জানি না।কারণ খুঁজি।কারণও খুঁজে পাই না।”

পৃথীর ভাবনার মাঝেই,
“বেশি ভালোবাসো। তাই আমার হালকা কিছু নিয়েও সিরিয়াস হয়ে যাও।তাই না?”
“জানি না।”
“আমি জানি!”(উষ্ণতা জঠানো গলা)

পৃথীর এবার অয়নের চোখে চোখ রেখে তাকায়।সাথে ঠোঁট জোড়া তার কেঁপে উঠে।তবে জবাব আসে নি ।অয়ন বর্ধিত ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুঁলিয়ে রেখেই পৃথীর একটু কাছে এগিয়ে তার মুখের উপর উপচে পড়া চুলগুলো একহাতে কানের দুইপাশে গুঁজে দেয় অয়ন।কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলে,

“শুনবে না ওই আকাশের গুনগুন?কি বলতে চায় সে?”

পৃথী এবার অয়নের বুকের উপর আলতো মাথা রাখে।কান ক্ষীণ করে ওই আকাশের গুঞ্জন শোনার চেষ্টা করে,
“ওই আকাশটা তোমার ছিল।শুধুই তোমার।তোমার আকাশকে তোমার মাঝে সারাজীবন এভাবে আগলে রেখো।হারাতে দিও না।ভালোবেসো।খুব ভালোবেসো।হ্যাঁ হ্যাঁ ওই আকাশটা আমার ছিল এবং থাকবে।সবসময়।সবসময়।…!”
ভাবতে ভাবতো পৃথীর চোখমুুুখ উচ্ছাসে ভরে যায়।সাথে অয়নেরও।

সমাপ্তি…

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here