কক্সবাজার পর্ব ২

#কক্সবাজার
#পর্ব_২

পরদিন স্কুলে গিয়ে আমার যেন এখন শ্বাস বন্ধ হয় তখন শ্বাস বন্ধ হয় অবস্থা। কমিশনার সাহেব এলেন দুপুর বারোটায়। বিভাগীয় কমিশনার মানে যে অনেকগুলো গাড়ি, সেদিন বুঝলাম। ইউএনও’র গাড়ি, উপজেলা চেয়ারম্যানের গাড়ি, থানার গাড়ি, পুলিশের প্রহরার গাড়ি, বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়ি, ডিসি স্যারের গাড়ি, এস পি’র গাড়ি… এত এত গাড়ির মাঝখানে কোন গাড়িতে যে তিনি আছেন কে জানে? আমার পা অসার হয়ে আসছিলো। আমি স্কুলের বারান্দায় পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে তাঁকিয়ে আছি। একে একে সবগুলো গাড়ি এসে থামলো। একসময় সাদা জিপ থেকে তিনি নামলেন। নেমে এসে গাড়ির সামনে কোমড়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। পকেটে হাত দিয়ে এক পাঁ আরেক পায়ের উপর বাঁকা করে। খুব সাধারণ হাসলেন।আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। এই দাঁড়ানোটা আমার বুকের ভেতরে গেঁথে যাওয়া দাঁড়ানো। ইউনিভার্সিটিতে আমি উনাকে প্রথম দেখি এরকম দাঁড়ানো অবস্থায়। অর্থনীতি অনুষদের দোতলার বারান্দার রেলিঙে নীল রঙের টিশার্ট পরনে এমন হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। ব্যস, সেই দেখেই খুন হয়েছিলাম আমি। অনেকদিন মরে পড়ে থেকেছিলাম। তারপর ইউনিভার্সিটিতে পহেলা ফাল্গুনে হলুদ জামা পরে, খুব সেজেগুজে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। হাতে গোলাপ নিয়ে একদম বলেই ছাড়বো ভালোবাসি এমন ভঙ্গিতে উনার কাছে গিয়েছিলাম। তিনি পাত্তাই দিলেন না। বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মত্ত! আমি খুব চিৎকার করে ডাকলাম,
—জাকির ভাইয়া.. তিনি তাও শুনলেন না।
উনার বন্ধুরা আমাকে হাঁ করে দেখছিলো। আমি প্রায় আধঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে একসময় কেঁদে ফেললাম শব্দ করে।
তখন তিনি আড্ডা ছেড়ে উঠে এলেন। ধমকে জিজ্ঞেস করলেন ,
—কোন ডিপার্টমেন্ট?
—কেমিস্ট্রি।
—কোন ইয়ার?
—ফার্স্ট ইয়ার..
—এজন্যই… এত আবেগ। দু-এক বছর ইউনিভার্সিটিতে কাটাও। আরো ছেলেপেলে দেখো, নেশা কেটে যাবে। আরো কয়েকটা ফাল্গুন যাক..
—এই ফাল্গুন থেকে বাকি সব ফাল্গুন আমি শুধু আপনার জন্য হলুদ জামা পরতে চাই।
তিনি আকাশ ফাটানো শব্দ করে কিছুক্ষণ হাসলেন। আমি মুগ্ধ হয়ে তাঁকিয়েছিলাম। বাঁ-হাতে টিশার্ট আলগোছে তুলে কোমড়ে হাত রেখে দাঁড়ানো। সাথে ডানহাতে চুলে আঙুল চালানো। চোখ দুটোও যেনো মুখের সাথে হাসছে। পরনে নীল টিশার্টের কলারটাও যেনো হাসছে। এমন মুখের হাসি দেখতে লক্ষ ফাল্গুন তৃষ্ণায় ডুবে থাকতে পারি আমি।
একসময় তাঁর হাসি থামলো। এবারে তিনি জিন্সের দু’পকেটের ভেতরে হাতের আঙুল ঢুকিয়ে দাঁড়ালেন। আমি শুধু দেখছিই তাঁকে। আমার ওইটুকু বয়সে আমার দেখা সব হিরোদের হার মানিয়েছিলেন তিনি।
অামার কল্পনার সব রাজপুত্রদের রূপ, অামার মনের ভেতর বাস করা প্রিন্স চার্মিং সবার রূপকে তিনি যেনো তাঁর একটা চাহনিতেই জিরো বানিয়ে ফেলেছিলেন।
—লিসেন লিটল গার্ল, তোমার বয়স মাত্র আঠারো উনিশ। এখন যা’ই তোমার ভালো লাগছে সেটা চোখের ভেতরেই থাকবে। মন পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই দেখবে পছন্দ বদলে গেছে। আর একটুখানি বড় হও।
এইসব হলুদ জামা পরে, চুলে ফুল গুঁজে, গোলাপ হাতে এসে এমন কান্নাকাটি করা রোগটা থাকবে না তখন।
—আমি শুধু আপনার জন্যই সেজেছি।
—বললাম তো, এটা একটা অল্পদিনের অসুখ৷ ক’দিন পরই সেড়ে যাবে। তোমার এই বয়সে অনেকেরই হয়। আমারও হয়েছিল; অনেকবার। এখন সেড়ে গেছে।
আমি দৃঢ় গলায় বলেছিলাম,
—ঠিক কত বছর পর এসে এমন আপনার সামনে দাঁড়ালে বুঝবেন এই অসুখটা আমার ভালো হবার নয়। সারাজীবনের অসুখ..
—তুমি আমাকে চ্যালেঞ্জ করছো?
আমি জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে ফেললাম।
—আমার এটা ফাইনাল ইয়ার জানো তো?
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম।
—আমি আপনার সব খবর জানি! আপনার মেস চিনি। যে যে বাসায় টিউশন পড়ান সে সে বাসাগুলোও চিনি।
—এটাও নিশ্চয়ই জানো , আমি পথের ছেলে। আমার বাবা মোঃ মাসুক মিয়া একজন নামকরা ভিক্ষুক ছিলেন। হোটেল পূর্ণার সামনের এলাকাটা উনার ভিক্ষার জন্য বরাদ্দ ছিলো। এস এস সি পর্যন্ত রোজ রাতে আমি তাঁকে রাত দশটায় গিয়ে বাড়ি নিয়ে আসতাম।
—এতে আমার কিচ্ছু আসে যায় না। আপনি নিজে ভিক্ষা করলেও আমি এমন করেই চাই। আপনার জন্য আমি হাজার বছর পরেও এমন করে সাজতে পারি…
—হাজার বছর লাগবে না। ঠিক তিনবছর পর এই কথাগুলো আমার সামনে এসে বলো। তোমার তখনো বসন্তের প্রথম দিনে আমার জন্য সাজতে ইচ্ছে করলে ভাববো, আমি ভুল। ব্যস..
আমি চমকে তাকালাম। তিনি আমাকে কি ভাবেন? আমি আবেগের বশে বাচ্চামো করছি এসব? আমার পছন্দের নাম অসুখ! আমি এক্ষুনি প্রাণ দিয়ে সব দেখাতে পারি। এক্ষুনি বিষ গিলতে পারি তাঁর জন্য।
—তিনবছর পারবে না তো?
—তিনবছর পর আপনাকে পাবো কোথায়?
—আমি কি করে বলবো? তোমার দরকার, তুমিই জানো কিভাবে পাবে।
আমি কাজল বাঁচিয়ে খুব সাবধানে চোখ মুছে হেসে তাঁকালাম।
—আমি তিন বছর পর আপনাকে ঠিক খুঁজে বের করবো। তারপর গোলাপ বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, শুভ ফাল্গুন…
—তাহলে তোমার হাতের এই গোলাপটাও আমি তিনবছর পরেই নেবো।
—কিন্তু এটা তো অতদিনে নষ্ট হয়ে যাবে?
—গোলাপ তো পৃথিবীতে আর একটাই ফুটছে না। প্রতিদিনই ফুটছে…. তিনবছর পরেও নিশ্চয়ই ফুটবে।

তিনি আবার আড্ডায় বসে গেলেন। আমি মন খারাপ করে ফিরে এলাম। কিছুটা চলে এসে আমার মনে হলো আসল কন্ডিশনটা তো বলাই হয়নি।
আবার ফিরে উনার কাছে গেলাম। ডাকলাম। তিনি না তাঁকিয়ে হাতের আঙুল দেখিয়ে বললেন,
—তিনবছর মানে তিনবছর! এক সেকেন্ডও আগে না। নাহলে এই ডিলটাও বাতিল হয়ে যাবে।
আমি চেঁচিয়ে বললাম,
—আপনি যদি এই তিনবছরে কাউকে পছন্দ করে ফেলেন! তো?
তিনি চোখ রাঙিয়ে তাঁকালেন।
—না মানে আপনাকেও একটা কথা দিতে হবে; আপনি কাউকে এর মধ্যে ভালোবাসবেন না। আমি তিন বছর পর এসে যদি…
তিনি আড্ডা ছেড়ে আবার উঠে এলেন। খপ করে আমার হাত থেকে ফুলটা নিলেন।
—আমি তোমাকে লিখে দিচ্ছি, তিনবছর পর তুমি এই ফুলটাকেই চিনতে পারবে না।
—পারবো।
—চুপ মেয়ে।
তিনি আমার খাতায় লিখে দিলেন,
“ডিয়ার নীরা হায়দার, ডটার অফ সেলিম হায়দার, আই ওয়ান্ট টু এশিওর ইউ দ্যাট দ্য ক্রেজি ফিলিং অফ ইওর মাইন্ড উইল নট লাস্ট ফর মোর দ্যান থ্রি মান্থস্। ইউনিভার্সিটি লাইফে এটাও তোমার অনেক ঘটনার একটি হয়ে হয়তো মনে থাকবে।
বাণীতে আমি।
নিচে উনার নাম সই করে ডেট দিলেন।

তারপর…
তিন বছর পর… আমি উনার সামনে ঠিক সেদিনের মতই সেজে দাঁড়িয়েছিলাম। তাঁর লিখে দেওয়া কাগজটা সামনে বাড়িয়ে ধরেছিলাম।
তিনি খুব করে আমাকে ধমক দিয়েছিলেন।
—তিনবছর বলেছি বলে তিন বছর পরই আসবে নীরা?
—বারে! এর মাঝে এলে যদি একেবারেই ফিরিয়ে দেন আমায়?
—ফিরিয়ে দিলে সেদিন প্রথম কথা হওয়ার দিনই আমি তোমার নাম ধরে নোট লিখে দিতাম কি করে? তোমার ছিলো চ্যালেঞ্জ করা অপেক্ষা, নীরা। আর আমার তো অনিশ্চিত অপেক্ষা। তুমি না আসলেও আমি গিয়ে তোমায় ডাকতে পারতাম না। কি যে আধমরা হয়ে বেঁচে আছি জানো তুমি?
আমার বোকা বুদ্ধি চমকে গেলো তখন। আসলেই তো সেদিনই তো উনার সাথে আমি প্রথম কথা বলেছিলাম। ইউনিভার্সিটিতে তখন আমার মাত্র মাস দেড়েক কেটেছে। নিজের ডিপার্টমেন্টের সবাইও তখন ভালো করে আমার নাম জানে না। উনি কি করে জেনেছিলেন তাহলে! আমার বাবার নামও লিখেছিলেন… মানে তিনিও আমাকে…
আমি আনন্দে ভেউভেউ করে কেঁদে ফেলেছিলাম। তাঁর মানে এই তিন বছর যে অনুভূতি বয়ে নিয়ে প্রতি মুহূর্তে আমি উনার জন্য পাগল হয়েছি, তিনিও হয়েছিলেন।

তারপরের সময়টা ছিলো আমাদের জন্য স্বপ্নের মত। তিনি খুব পড়ছিলেন পোস্ট গ্রাজুয়েশনের জন্য। কানাডার এক ইউনিভার্সিটিতে চান্সও হয়ে গেলো। ব্যাংক ব্যালেন্স দেখিয়েছিলেন উনাদের ডিপার্টমেন্টের জামান স্যার। সবকিছু ব্যবস্থা হবার পর টিকিটের টাকায় সাত হাজার টাকা কম পড়ছিলো। আমার গলার চেইনটা তখন বিক্রি করে দিয়েছিলাম ঊনিশ হাজার টাকায়। টিকিটের সাতহাজার টাকাটা দিয়ে, বাকি টাকায় কি করা যায়? আমি বললাম কিছু শপিং করে দিই আপনাকে? তিনি বললেন, একার শপিং কেন হবে দুজনের জন্য শপিং করবো। বিয়ে করবো আমরা। বিদেশে গিয়ে তোমাকে যদি ভুলে যাই, সেজন্য তো একটা ব্যবস্থা দরকার। তাই না?
আমরা বিয়ে করেছিলাম। উনি চলে যাবার মাত্র নয়দিন বাকি এই সময়ে। এই স্বল্প সময়ের গোপন বিবাহিত জীবন ছিলো আমাদের। আমি ক্লাস ফাঁকি দিয়ে উনার মেসে যেতাম, রান্না করতাম, ঘর গুছিয়ে দিতাম। উনার বন্ধুরা বেরিয়ে গেলেই একান্তে সময় কাটাতাম।এই ছিলো আমাদের বিশুদ্ধ ভালোবাসার নিষিদ্ধ সংসার।

~চলবে~

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here