‘ কথা দিলাম ‘ 🌸❤️
||পর্ব ~ ৬৬||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
সিয়ারা: আভিইই!!
সিয়ারা চিৎকার করেই পিছন দিকে ঢলে পরে নিজের শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে। কিন্তু ও পরে যায় না, তার আগেই কেউ ও’কে ধরে নেয়। স্পর্শটা কেমন চেনা ঠেকছে তবে সাহস পেলো না মাথা তুলে তাকানোর। যদি হারিয়ে যায় স্পর্শটা? কীভাবে বাঁচবে ও? ব্যক্তিটির হৃদস্পন্দন অনুভব করতেই সিয়ারা ঝট করে মাথা তুলে তাকায়। ভালো করে একবার সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে নিয়ে গাড়িটার দিকে তাকায়। ফের মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
সিয়ারা: আ..আভি!
আধভিক: ঠিক আছি আমি সিয়ু। কিচ্ছু হয়নি তেমন।
সিয়ারা ভালো করে একবার দেখে নিল আধভিককে। মাথায় ও হাতের কুনুইতে ব্যান্ডেজ করা রয়েছে। সিয়ারা সোজা হয়ে দাঁড়ালো, আধভিক এখনও একভাবে তাকিয়ে রয়েছে সিয়ারার দিকে। অপেক্ষা করছে সিয়ারার কিছু বলার। হঠাৎ করেই কিছু না বলে সিয়ারা আধ ভিককে দু হাত দিয়ে বুকে ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দিলো। আধভিক একটু হতবম্ব হয়ে গেলো সিয়ারার কাজে।
আধভিক: সিয়ু..
সিয়ারা: একদম, একদম কাছে আসবে না আমার। আমি..আমি জানি, তু..তুমি ইচ্ছা করে, ইচ্ছা করে এসব করেছো। (ফোঁপাতে ফোঁপাতে)
আধভিক: না জান, আমি এসব…
আধভিক সিয়ারার দিকে এগিয়ে গেলে সিয়ারা পিছিয়ে যায় আর চিৎকার করে বলে ওঠে,
সিয়ারা: বললাম না একদম কাছে আসবে না আমার। ইচ্ছা করে করেছো তুমি এসব, আমার থেকে দূরে যাওয়ার জন্য করেছো। যেহেতু আমি সম্পর্কটা শেষ করতে আটকেছি তাই জন্য করেছো। তাই তো? আমার থেকে দূরে যাওয়ার জন্যেই এতো কিছু তাই না? এর থেকে আমাকে বলতে আমি এতো দূরে চলে যেতাম যে তুমি কখনও আমাকে দেখতেও পে…
আধভিক হ্যাঁচকা টান মারে সিয়ারার হাত ধরে। সিয়ারা আধভিকের বুকে এসে পরলে আধভিক নিজের হাত দিয়ে সিয়ারার মাথাটা চেপে ধরে নিজের বুকের মাঝে। সিয়ারা আধভিকের কোমর দুহাতে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে ওঠে।
আধভিক: আমি এসব কেন করবো জান? তুমি ভুল বুঝছো আমাকে। এসব করিনি আমি। শান্ত হও প্লিজ, শরীর খারাপ করবে তোমার নাহলে এবার।
দেবাংশু: অ্যাকসিডেন্ট ছিলো এটা ভিকি?
আধভিক মাথা ঘুরিয়ে দেবাংশুকে দেখতে পায়। আধভিক ইশারায় কিছু একটা বললে দেবাংশু চুপ করে যায়। আধভিক সিয়ারার দিকে তাকিয়ে নিয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পায় আভাস বাবু গাড়ি ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। মুখটা বড্ড অসহায় হয়ে আছে ওনার সাথে কৌতূহলীও হয়েছিলেন। হয়তো আধভিক ওনার দিকে তাকাবে সেই আশাতেই। আধভিক তাকাতেই জানো আধভিককে ঠিক দেখে উনি শান্তি পেয়ে চোখটা বন্ধ করে নিলেন।
আধভিক: দিয়া?
দিয়ারা: হ্যাঁ ভিকি দা?
আধভিক: (আভাস বাবুকে দেখিয়ে) ওনাকে সাবধানে নিয়ে যা বাড়িতে। অনেক রাত হয়ে গেছে, ফিরে যা। দেব, তুইও সিয়ুকে নিয়ে চলে যা।
দেবাংশু: আর তুই?
আধভিক: আমি যাবো। রুদ্রিকের সাথে একটু ফর্মালিটিসগুলো কমপ্লিট করতে হবে। সেগুলো শেষ করেই ফিরে যাবো।
দেবাংশু হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালে আধভিক আভাস বাবুর দিকে তাকায় যিনি ধীরে ধীরে ওর কাছে এগিয়ে এসেছেন। আধভিকের মাথায় হাত রাখবে ভেবে হাতটা তুলেও উনি নামিয়ে নিলেন।
আধভিক: ঠিক আছি আমি। চিন্তা না করে বাড়ি গিয়ে রেস্ট নাও নাহলে শরীর খারাপ করবে।
আভাস বাবু হেসে মাথা নাড়ালো। উনি ভাবতে পারেননি আধভিক ওনার সাথে কথা বলবে। আভাস বাবু শুধু বললেন,
আভাস বাবু: তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।
আধভিক সম্মতি জানালে আভাস বাবু সিয়ারার মাথায় একবার হাত রেখে, গাড়ির দিকে এগিয়ে যান। সিয়ারা এখনও আধভিককে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দেবাংশুর দিকে আধভিক তাকালে দেবাংশু অসহায়ের মতো দু কাঁধ উঁচু করে নামিয়ে ফেলে। আধভিক একটা নিশ্বাস ছেড়ে সিয়ারাকে সোজা করে দাঁড় করায় আর ওর চোখের জল মুছে দেয়।
সিয়ারা: আমি..আমি কোথাও যাবো না তো..তোমাকে ছেড়ে। (নাক টেনে)
আধভিক কিছু না বলে সিয়ারাকে কোলে তুলে নেয়। সিয়ারা আধভিকের গলা জড়িয়ে ধরে আধভিকের দিকে তাকিয়ে রইলো। আধভিক গাড়ির কাছে গিয়ে সিয়ারাকে নামিয়ে দিলো। গাড়ির দরজা খুলতেই সিয়ারা আধভিকের হাতের উপর হাত রেখে অনুরোধ করে বললো,
সিয়ারা: আমাকে থাকতে দাও না তোমার সাথে?
আধভিক: আমি পুলিশের সাথে কথা বলতে থানায় যাবো সিয়ু। এতো রাতে তুমি আমার সাথে থানায় যাবে? এটা ঠিক দেখাবে না জান। তুমি বাড়ি ফিরে যাও প্লিজ? আমি ঠিক আছি, কিচ্ছু হয়নি আমার। জাস্ট ছোট্টো একটা অ্যাকসিডেন্ট ছিলো।
সিয়ারা: ছোট্টো? এটা ছোট্টো অ্যাকসিডেন্ট আভি? তোমার বড়ো কোনো ক্ষতি হয়ে যেতে পারতো এতে। তোমার প্রাণও যেতে পারতো। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কীভাবে বাঁচবো ভেবে দেখেছো কখনও? এই নাকি তুমি আমাকে ভালোবাসো। শুধু দূরে সরানোর চেষ্টা করছো।
সিয়ারাকে আবার কাঁদতে দেখে আধভিকের বুকের ভিতরটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে কিন্তু ও প্রকাশ করতে পারছে না। আধভিক একটা বড়ো শ্বাস নিয়ে সিয়ারার দু গালে হাত রেখে বললো,
আধভিক: আমার চোখের দিকে তাকাও জান। তোমার মনে হয় আমার তোমাকে ছাড়া কষ্ট হয় না? আমি তোমাকে এখনও এটা বিশ্বাস করাতে পারিনি যে আমি তোমাকে ভালোবাসি। বোঝাতে পারিনি তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাটা?
সিয়ারা: তো তুমি কেন এমন করছো? আমার কেন মনে হচ্ছে তুমি আমার থেকে দূরে সরে যেতে চাইছো? এমনটা করো না এতে কোনো লাভ হবে না। আমরা দুজনেই কষ্ট পাবো, আমি যেই ভুলটা করেছিলাম সেটা করো না তুমি।
আধভিক: আমি কখন থেকে বারণ করেছি তোমাকে কাঁদতে না? কেন কাঁদছো? ঠিক আছি তো আমি নাকি? আমার ভালো লাগছে না তোমাকে এভাবে দেখতে। চুপ একদম!
সিয়ারা চুপ করে গেলেও হিঁচকি তুলতে থাকে। আধভিক কোনো কিছু না ভেবেই সিয়ারার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট গভীর ভেবে ছুঁয়ে দেয়। তারপর সরে এসে সিয়ারার হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে দেবাংশুর কাঁধে হাত রাখে যে আধভিকের গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে।
দেবাংশু: অ্যাকসিডেন্ট নাকি অ্যাটেম্পট টু মার্ডারের কেস এটা ভিকি?
নিজের প্রশ্ন শেষে আধভিকের দিকে তাকালো দেবাংশু। আধভিক সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। দেবাংশু এবার জিজ্ঞেস করলো,
দেবাংশু: কীভাবে বাঁচলি?
আধভিক: এমনভাবে জিজ্ঞেস করছিস জানো মরে যাওয়া উচিত ছিলো। বেঁচে গিয়ে ভুল করে ফেলেছি।
দেবাংশু হেসে দেয় আধভিকের কথা শুনে। আধভিকও হাল্কা হাসে তবে শব্দ হয় না। দেবাংশু বলে,
দেবাংশু: আমিও তাঁদেরই দলে মেরে ফেলতে চায় তোকে যাঁরা! কিচ্ছু চাইনি আমি আজীবন ভিকির পিছনে কাঠি করা ছাড়া। (গানের সুরে)
আধভিক: হয়ে গেছে? মজা নেওয়া শেষ? এইবার বাড়ি যা। (চোখ সরু করে)
দেবাংশু: (হাসি থামিয়ে) কি করে কি হলো?
আধভিক: আমি গাড়িটা নিয়ে দাঁড়াতেই পিছন থেকে একটা গাড়ি এসে ধাক্কা মারে। আমি স্টিয়ারিংয়ে বারি খাই। বেড়াতে যাবো এমন সময় দেখি ওইদিক দিয়েই একটা বড়ো কোনো গাড়ি আসছিলো যাঁর হেডলাইটের জন্য আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। চোখটা একহাতে ঢেকে নিয়ে অপরহাতে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসার পরেই দেখতে পাই ট্রাকটা আমার গাড়িটাকে ধাক্কা মারে। আমার গাড়ির পিছনে যেই গাড়িটা ছিলো সেটা সঙ্গে সঙ্গে ব্যাক করে বেরিয়ে যায় আর ট্রাকটাও।
দেবাংশু আধভিকের হাতটা ধরে নিয়ে একবার দেখে জিজ্ঞেস করলো,
দেবাংশু: পরে যাওয়ার জন্যেই হাতে লেগেছে তাই না? আর কোথায় লেগেছে?
আধভিক: পায়ে সামান্য লেগেছে। আমিই রুদ্রিককে ফোন করেছিলাম। ও ডক্টর নিয়ে এসেছিলো সাথে করে সামান্য চোট পেয়েছি জানানোয়।
দেবাংশু: হ্যাঁ বললো আমাকে ও। কথা হয়েছে আমার সাথে। তুই যা, দেখ কি কি জিজ্ঞেস করে। আমি আসছি তাহলে। সাবধানে থাকিস কিন্তু।
দেবাংশু চলে যেতে নিলে আধভিক দেবাংশুর বাহুটা ধরে রাখে। দেবাংশু তা দেখে আধভিকের দিকে তাকালে আধভিক সামনের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে দেবাংশুর দিকে ফিরে দেবাংশুকে জড়িয়ে ধরে। দেবাংশুও হেসে আধভিককে জড়িয়ে ধরে।
আধভিক: সিয়ুকে দেখে রাখিস দেব। ওর জানো কোনো ক্ষতি না হয়। আমি তোর ভরসায় ও’কে রেখে যাচ্ছি, আমার জীবন তোর হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি। আমার জীবনের গায়ে জানো আর একটাও আঁচ না আসে।
আধভিক দেবাংশুকে ছেড়ে দ্রুত সামনের দিকে হেঁটে চলে গেলো। দেবাংশু একভাবে দাঁড়িয়ে আছে এখনও।
দেবাংশু: কি বলে গেলো ভিকি? কিছুই তো বুঝলাম না।
দেবাংশু পিছন ফিরে দেখলো আধভিক রুদ্রিকের সাথে কথা বলছে। আধভিক অন্যদিকে তাকাতেই রুদ্রিক দেবাংশুর দিকে তাকালো আর দেবাংশু কিছু ইশারা করলো রুদ্রিককে। রুদ্রিক ইশারায় উত্তর দিলে দেবাংশু বাঁকা হাসে। সেই মুহুর্তে আধভিক রুদ্রিকের দিকে তাকিয়ে দেবাংশুর দিকে তাকালেই দেবাংশু হাত দেখিয়ে গাড়ির কাছে চলে আসে। গাড়িতে বসে দেখে সিয়ারা চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। সিয়ারার নজর আধভিকের উপরেই। দেবাংশু কিছু না বলে সিয়ারার হাতের উপর হাত রাখে। সিয়ারা মুখ ফিরিয়ে দেবাংশুর দিকে তাকাতেই দেবাংশু গাড়ি স্টার্ট দেয়। সিয়ারা আবারও আধভিকের দিকে তাকালে দেখে আধভিকও ওর দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনের নজর একে অপরের প্রতি আবদ্ধ হয়ে থাকে। একসময় আধভিক সিয়ারাকে হাত নেড়ে বিদায় জানাতেই সিয়ারার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরে আর সিয়ারা তা মুছে নিয়ে সোজা হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে গাড়িতে। দেবাংশু আড় চোখে লক্ষ্য করে সবটা।
সকালে,
সিয়ারার ঘুমটা ভাঙতেই সিয়ারা উঠে বসে। গতকাল যে একসাথে এতো কিছু হয়ে যাবে সেটা কেউই কল্পনা করতে পারেনি। চুপ করে বসে থাকলে গতকাল কি কি ঘটেছে তা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। হঠাৎ করেই আধভিকের হাত নেড়ে বিদায় জানানোর মুহুর্তটা মনে পরতেই সিয়ারার মনটা কেমন অস্থির হয়ে ওঠে। আশে পাশে নিজের ফোনটা খুঁজতে থাকে সিয়ারা। মস্তিষ্কে আধভিকের বলা কথা, আধভিকের প্রতিটা পদক্ষেপ মনকে অস্থির করে তুলছে। টেবিলে তাকিয়ে যখন ফোনটা দেখতে পেলো তখন সাথে সাথে ফোনটা নিয়ে আধভিককে কল করলো সিয়ারা।
“দ্যা নাম্বার ইউ আর কলিং ইজ কারেন্টলি সুইচড অফ।”
সিয়ারা: ফোন সুইচড অফ কেন বললো? সকাল নটা বাজে এখন তো ও উঠে যায়। আব, কালকে তো অনেক রাতে ঘুমিয়েছে তাই জন্য হয়তো এখনো ওঠেনি।
সিয়ারা নিজেকে সান্তনা দিলো ঠিকই কিন্তু মনের অস্থিরতা গেলো না। ফ্রেশ হয়ে নিয়ে নীচে নেমে ড্রয়িং রুমে গেলো সিয়ারা। সেখানে দেবাংশু আর সুধাংশু বাবু বসে আছে। কিন্তু ওদের সাথে আরও একজন বসে আছে যাঁকে দেখে সিয়ারা অবাক হলো। মনে মনে ভাবলো,
সিয়ারা: দিয়া এখানে কি করছে? দেব কি এতো তাড়াতাড়ি দিয়ার বিষয়ে জানিয়ে দেবে ঠিক করেছে আংকেলকে।
সিয়ারা ঝটপট নীচে নেমে এসে দেখলো সবার মুখটা বেশ থমথমে হয়ে রয়েছে। তাও হাসিমুখে দিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,
সিয়ারা: কি ব্যাপার দিয়া? কখন এসেছিস তুই?
দিয়ারা: এই, এই তো কিছুক্ষণ হলো।
সিয়ারা: তোমাদের সবাইকে এমন কেন দেখাচ্ছে? কিছু কি হয়েছে?
দেবাংশু: তুই বস, বলছি সব।
দিয়ারা ও সুধাংশু বাবু দুজনেই দেবাংশুর দিকে অবাক ভাবে তাকালো। দেবাংশু ইশারায় দিয়ারাকে শান্ত থাকতে বললো। সিয়ারা বসতেই দেবাংশু বললো,
দেবাংশু: সিয়া, ভিকি কলকাতায় নেই।
সিয়ারা: কলকাতায় নেই মানে? এখন তো ফ্যাশনের এক্সিবিশন নেই কোথাও আর না শো। কারণ আর কিছুদিন পরেই তো ফ্যাশন কম্পিটিশন আছে।
দেবাংশু: হ্যাঁ। আমাদের সবারই এটাই কথা। আজকে সকালেই আভাস আংকেল দিয়ারাকে ডাকে। কারণ ভিকির জামা কাপড়ের সাথে সাথে ওর ঘরে নিজের পাসপোর্ট ভিসাও ছিলো না। ওরা দুজন মিলে যে যে জায়গায় ভিকিদের ব্রাঞ্চ আছে সেখানে খোঁজ নেয়। ভিকি কোথাও যায়নি। কিছুক্ষণ আগে আমি সোহমকে ফোন করেছিলাম এখনও ভিকির ফোন সুইচড অফ থাকায়।
সিয়ারা: ক..কি বললো?
দেবাংশু: ভিকি সোহমকে জানিয়েছে ও আর কখনও ফিরবে না। সোহমের সাথেই ভিকি লাস্ট কথা বলেছিলো, তারপর থেকেই ফোন সুইচড অফ আসছে ওর।
সিয়ারা নির্বিকার ভাবে বসে থাকলেও ওর চোখের জল থেমে নেই। অনবরত ওর চোখ থেকে জল গাল গড়িয়ে পরছে। সিয়ারা আর কোনো কথা না বলে উঠে নিজের ঘরে চলে যায়।
দিয়ারা: এখনই সবটা না জানালে চলছিলো না?
দেবাংশু: যত দেরী করা হতো তত বেশি কষ্ট পেতো।
দেবাংশু কাঠ কাঠ গলায় কথাগুলো বলে দিলে দিয়ারার ভীষণ অবাক লাগে। দিয়ারা উপরে যেতে চাইলে দেবাংশু দিয়ারার পথ আটকে বলে,
দেবাংশু: এখন ও’কে একা থাকতে দে। তুই আন্টির কাছে যা। ওনার খেয়াল রাখাটা প্রয়োজন। চল, আমি ড্রপ করে দিচ্ছি।
দিয়ারা আর কিছু না বলে বেরিয়ে গেলে দেবাংশু সিয়ারার ঘরের দিকে তাকালো তারপর সামান্য হাসলো। সুধাংশু বাবু নিজের ছেলেকে এভাবে দেখে একটু ঘাবড়ে গেলেন। দেবাংশু বেরিয়ে যাবে এমন সময় ওর কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন,
সুধাংশু বাবু: নিজের কার্য সিদ্ধির জন্য আপন জনের ক্ষতি করিস না দেবু। তোর জেদ সব জায়গায় কিন্তু চলবে না। রাগ, জেদ কিন্তু ক্ষতি করে শুধু। এতে তোরই ক্ষতি হবে, সম্পর্ক নষ্ট হবে।
দেবাংশু: সেটা তোমার না ভাবলেও চলবে। তুমি তোমার কাজ করো আর আমাকে আমার কাজ করতে দাও। আমি যেটা চাই সেটা আমি পেয়েই ছাড়ি।
সুধাংশু বাবু: জেদ করে সব পাওয়া যায় কিন্তু…
দেবাংশু কথাটা শোনার আগেই বেরিয়ে গেলো। সুধাংশু বাবু একটা নিশ্বাস ফেলে সিয়ারার ঘরের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন,
সুধাংশু বাবু: না জানি আর কত কষ্ট পাবে মেয়েটা।
দিয়ারা গাড়িতে বসে আছে চুপচাপ। চুপচাপ বললে ভুল হবে, দিয়ারা ব্যস্ত। দেবাংশুকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত দিয়ারা।
দিয়ারা: দেবদা?
দেবাংশু: বল।
দিয়ারা আর কিছু বললো না। এতদিন তো দেবদা বললেই দেবাংশু রেগে যেতো তাহলে আজ কি হলো? পাত্তা পর্যন্ত দিলো না দেবাংশু? দিয়ারার বুকটা কেমন জানো কেঁপে উঠলো দেবাংশুর ব্যবহারে।
দিয়ারা: আমি মাকে দেখতে পরে যাবো। অফিসে চলো আগে।
দেবাংশু: ঠিক আছে।
কিছুক্ষণ পর,
আধভিকের অফিসে এসে দিয়ারা আধভিকের কেবিনে গেলো না। কি হবে গিয়ে? আধভিক তো সেখানে নেই। দিয়ারা আভাস বাবুর কেবিনে যাবে ঠিক করলো। দিয়ারার পিছু পিছু দেবাংশুও এসেছে কিন্তু দিয়ারার সাথে নয়। দেবাংশু ঢুকতেই হঠাৎ করে একটা মেয়ের সাথে ধাক্কা খেলো।
দেবাংশু: আই অ্যাম সো সরি, আমি একদম দেখতে পাইনি।
__ইটস ওকে হ্যান্ডসাম! এরকম ছেলেদের সাথে একটু আধটু ধাক্কা খেলে মেয়েরা খারাপ মনে করে না। বরং ধাক্কা খেলেই লাইফটা একটু ফিল্মি মনে হয়। (হেসে)
দেবাংশু: তাই বুঝি? আমি তো ভাবলাম আমিই নিজেকে লাকি ভাবছি ধাক্কা খেয়ে। ইউ আর সো বিউটিফুল, লেডি!
__থ্যাংক ইউ হ্যান্ডসাম। তোমাকে তো আমি ফ্যাশন শোতেই দেখেছি। বাট এতো ভালো ফ্লার্টিং করছো, তোমার গার্লফ্রেন্ড জানতে পারলে কি হবে ভেবে দেখেছো?
দেবাংশু: এরকম বিউটিফুল লেডির সামনে থাকলে গার্লফ্রেন্ডের কথা ভাবিনা আমি। বায় দ্যা ওয়ে, গার্লফ্রেন্ড নাম কে ভাস্তে, যাঁকে বিয়ে করবো তাঁর জন্য এখনও অনেক কিছু করতে হবে মনে হচ্ছে।
মেয়েটা লাজুক হেসে বলে,
__বেশি কিছু করতে হবে বলে মনে হচ্ছে না।
মেয়েটা চলে গেলে দেবাংশু নিজের ঘাড়ে একটু হাত ঘষে ঠোঁট কামড় হাসলো তারপর আধভিকের কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলো।
অন্যদিকে,
দিয়ারা: ভাগ্যিস আমি ভিকিদার কেবিনে এসেছিলাম। নাহলে তো জানতেই পারতাম না কেউ লুকিয়ে ওর জায়গা দখল করতে এসেছে। এখান থেকে বেরিয়ে যাও অভ্র
অভ্র: তোমাকে রেগে গেলে খুব সুন্দর লাগে জানো তো দিয়া বেবি! এমনিতেই তুমি এত সুন্দর, এতো সুন্দর মুখ, এতো সুন্দর ফিগার উফ! পুরো মা…মানুষটাই তুমি সুন্দর।
অভ্র দিয়ারার কাছে এসে ও’কে পা থেকে মাথা পর্যন্ত বাঁকা দৃষ্টিতে দেখে কথাগুলো বললো। হয়তো খারাপ কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু বললো না। দিয়ারা কেবিনে আসবে না ভেবে ছিলো কিন্তু হঠাৎ ওর কি মনে হতে চলে এলো। এসেই দেখে অভ্র বসে আছে। কিন্তু অভ্রর এইরকম কথা বার্তা আর বাঁকা দৃষ্টির কারণেই দিয়ারা অভ্রের সামনে আসে না কখনও। আসলেও আধভিক থাকে কিন্তু আজ তো আধভিক নেই। দিয়ারার রাগ হয়, মন চায় কষিয়ে একটা চর মারতে কিন্তু পারে না। কারণ সে এখানকার একজন মডেল আর অভ্র এখানকার বসের ভাই। দিয়ারা কিছু না বলে বেরিয়ে যায় ওখান থেকে বিরক্ত হয়ে।
অভ্র: আরে দিয়া বেবি, কোথায় যাচ্ছো? তোমাকে তো কখনও পাই’ই না আমি। আজকে যখন পেয়েছি, তখন আর ছাড়তে মন চাইছে না।
অভ্র দিয়ারার হাত ধরে কথাগুলো বলতে ও’কে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসতে থাকে। কিন্তু সেই সময় কেউ দরজা নক করলে দিয়ারা ঝট করে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অভ্রকে ধাক্কা মেরে ওখান থেকে বেরিয়ে যায় কোনদিকে লক্ষ্য না করে।
দিয়ারা বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই দেবাংশু সেই কেবিনে ঢোকে। কেবিনে ঢোকার সময় দেবাংশুর মুখটা গম্ভীর থাকলেও কেবিনে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই অভ্রর ডাকে দেবাংশুর মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
অভ্র: আরেহ! ভাই আমার। কাম, কাম!
অভ্র দেবাংশুর দিকে এগিয়ে গিয়ে ও’কে জড়িয়ে ধরলে দেবাংশুও জড়িয়ে ধরে অভ্রকে।
[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে🥀]
বলেছিলাম, “সমীকরণ বদলাবে।”‘ কথা দিলাম ‘ 🌸❤️
||পর্ব ~ ৬৭||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
১৫ দিন পর,
সিয়ারা হাতের ফার্স্ট প্রাইজ মেমেন্টোটা একটা ওয়াল স্ল্যাবের উপর রাখে। তারপর সামনের দিকে ফিরে একটা ছবির দিকে তাকায়। যেটা বড়ো করে টাঙানো আছে, আধভিকের ছবি। ছবিটাতে আধভিক একটা টেবিলে বসে ডান হাতটা মুখের একটা পাশে রেখেছে এবং বাম হাতটা ডান হাতের বাইসেপসের উপরে রাখা। চুলগুলো কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আর ঠোঁটের কোণে মৃদু ডান দিক ঘেঁষা হাসি।
সিয়ারা: আভি! তোমার হয়ে আমি প্রাইজ জিতে নিয়ে এসেছি, ফার্স্ট প্রাইজ।
সিয়ারার চোখ দিয়ে জল গাল গড়িয়ে পরে। মাথা নামিয়ে নিয়ে নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টা করে ঠোঁট কামড়ে ধরে। আবারও মাথা উঠিয়ে বলে,
সিয়ারা: তুমি বলেছিলে না আমি এখন সাফল্য পেয়ে গেছি? আজ সেই কথা গিয়ে মিললো। এখন আমি সত্যি সাফল্য অর্জন করেছি। আমি কথা দিয়েছিলাম তোমাকে এইবারের ফার্স্ট প্রাইজটা তুমি পাবেই, আমি এনে দেবো তোমাকে। আজকে আমি বেস্ট ডিজাইনার অ্যাওয়ার্ডের জন্য নমিনেটও হয়েছি। আমি আমার কথা রেখেছি আভি! শুধু তুমি আমার পাশে নেই। তুমি তোমার কথা রাখনি। আমি চেয়েছিলাম যখন আমি তোমার স্বপ্নপূরণ করবো, নিজের সাফল্য অর্জন করবো তখন তুমি আমার পাশে থাকবে।
সিয়ারা আবারও মাথা নামিয়ে নিলো কিন্তু এইবার খুব একটা নিজের কান্না আটকাতে পারলো না। ডুকরে কেঁদে উঠলো। মাথা উঠিয়ে কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
সিয়ারা: আজ আমি এই জায়গায় শুধু..শুধুমাত্র তোমার জন্য। আমি এমন সাফল্য চাইনি যেখানে তুমি আমার পাশে থাকবে না। আমার কাছে সাফল্যের থেকেও তোমার পাশে থাকাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে পারলে এভাবে তোমার সিয়ুকে একা রেখে চলে যেতে? কতবার তোমাকে বললাম দূরে সরে গেলে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না। তুমি শুনলে না, শুনলে না আমার কথা!!
সিয়ারা হঠাৎ করেই চিৎকার করে উঠে হাতের সামনে থাকা সব অ্যাওয়ার্ড, মেমেন্টো ফেলে দিলো। সবকিছু ফেলতে ফেলতে বলতে থাকলো,
সিয়ারা: শুনলে না আমার কথা। পালিয়ে গেলে তুমি!! ভয় পেয়ে পালিয়ে গেলে। আমার মন বলছিলো তুমি এমন কিছুই করবে। কেন আধভিক?? কেন??
সিয়ারা এক জায়গায় দাঁড়ালো। তারপর সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বড়ো ছবিটার নিজে যে ছোটো ছোটো ফটো ফ্রেম গুলো দেয়ালে লাগানো আছে আধভিকের, প্রাইজ, অ্যাওয়ার্ড হাতে নিয়ে সেগুলো ফেলতে ফেলতে বললো,
সিয়ারা: তুমি জানো না আমি তোমাকে ছাড়া কখনও ভালো থাকবো না। বাঁচার মত করে বাঁচতে পারব না? এইরকম ভাবে বেঁচে থাকার থেকে তোমার সাথে থেকে নিজের প্রাণ দেওয়া ভালো ছিলো। তাহলে অন্তত এই নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হতো না আমাকে প্রতি মুহুর্তে। তোমাকে ছাড়া আমি কীভাবে ভালো থাকতে পারি? তুমিই তো আমার ভালো থাকার কারণ। কখনও বোঝনি তুমি আমাকে, কখনও না।
সিয়ারা ক্লান্ত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বসে পরলো। চিৎকার করে কাঁদছে আজকে সে। দেবাংশুর থেকে খবরটা পাওয়ার পর সেই যে চোখে জল নিয়ে নিজের ঘরে ঢুঁকে ছিলো বেরিয়ে ছিলো একদম কঠোর হয়ে, এক ফোঁটা জল কেউ দেখতে পায়নি সিয়ারার চোখে। হয়তো এইদিনটার জন্যই নিজেকে শক্ত করেছিলো সিয়ারা।
সিয়ারা: আই হেইট ইউ আধভিক রায় চৌধুরী! আই হেইট ইউ! তুমি ভালোবাসতে জানো না, কখনও ভালোবাসোনি আমাকে। আই হেইট ইউ! …. আমি চলে গেছিলাম, সেটারই প্রতিশোধ নিয়েছো তুমি আর ভালোবাসায় প্রতিশোধ থাকে না। তোমাকে আমি কখনও ক্ষমা করবো না, কখনও না!
সিয়ারা ওখানে বসে কাঁদতে থাকে। চোখ মুছে নিয়ে অভিমান ভরা দৃষ্টিতে আধভিকের ছবির দিকে তাকিয়ে বললো,
সিয়ারা: সেদিন যখন তুমি অন্যকাওর কথা বলায় রেগে গেছিলে, আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে ছেড়ে আর যাই করো কখনও আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাববে না। কিন্তু না, আমি ভুল ছিলাম। তুমি আমাকে এটাই বোঝালে যে, সামনে থাকতে তুমি আমাকে অন্যকাওর সাথে মেনে নিতে পারবে না কিন্তু দূরে থেকে তো পারবে। না দেখতে পাবে, না জানতে পারবে না কষ্ট পাবে। বাহ আধভিক! বাহ! বাহ!!
সিয়ারা উঠে দাঁড়িয়ে আধভিকের ঘর থেকে দৌঁড়ে বেড়িয়ে যাওয়ার সময়ে দেবাংশুর বুকে ধাক্কা খেলো। দেবাংশুর দিকে তাকিয়ে ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পরলো কাঁদতে কাঁদতে। দেবাংশু কিছু না বলে সিয়ারাকে ধরে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে, সামনের দিকে আধভিকের ছবির দিকে তাকিয়ে। একটা সময় পর সিয়ারাকে পুরোপুরি স্থির হয়ে যেতে দেখে দেবাংশু হালকা হাসলো আর সিয়ারাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে কোলে তুলে নিলো। বেড়িয়ে গেলো সেই ঘর থেকে আর সন্মুখীন হলো দিয়ারার।
দিয়ারা: কোথায় যাচ্ছো দিকে নিয়ে? কি হয়েছে ওর? (উত্তেজিত হয়ে)
দেবাংশু: অজ্ঞান হয়ে গেছে। কাঁদছিলো, কাঁদতে কাঁদতেই জ্ঞান হারিয়েছে। (সিয়ারার মুখের দিকে তাকিয়ে)
দিয়ারা: আমি ডক্টরকে কল করছি ওয়েট।
দেবাংশু: লাগবে না। বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি, রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
দিয়ারা: কি বলছোটা কি? জ্ঞান হারিয়েছে দি, জ্ঞান ফেরাতে হবে না নাকি?
দেবাংশু: গাড়িতে নিয়ে গিয়ে চোখে মুখে একটু জল ছিটিয়ে দেবো। আমার থেকে বেশি ভালো কেউ ওর বিষয়ে জানে না দিয়া। কারণ আমি কখনও ও’কে ছেড়ে যায়নি আর না কখনও যাবো। সরে যা, যেতে দে আমাকে।
দিয়ারা কিছু না বলে রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ায়। দেবাংশু দিয়ারার দিকে আর না তাকিয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতেই বলে উঠলো,
দিয়ারা: আমি যাবো? তাহলে দির পাশে থাকতে পারবো।
দেবাংশু: আমি আছি তো ওর পাশে? আর কাওকে প্রয়োজন পরবে না। তুই আভাস আংকেলকে দেখে রাখ আর ভিকির অফিসের দিকটা একটু সামলে নিস তাহলেই হবে কারণ সিয়া কদিন অফিস যাবে না আর। রেস্টের প্রয়োজন এখন ওর।
দেবাংশু চলে গেলো সিয়ারাকে নিয়ে। দিয়ারা চোখে জল নিয়ে তাকিয়ে থাকে দেবাংশুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে। আধভিকের যাওয়ার পর থেকেই দেবাংশু এমন ব্যবহার করছে ওর সাথে যখন দেখা হচ্ছে। অর্ধেক সময় তো এখন দিয়ারা দেবাংশুকে সিয়ার সাথে দেখতে পায় নাহলে দেখতেই পায় না কাজে থাকায়। কাজে থাকার সময় দেবাংশুর অন্য মেয়েদের সাথে কথা বলা, হাসাহাসি দিয়ারার পছন্দ না হলেও দিয়ারা কিছু বলে না বিশ্বাসের খাতিরে। ও’কে সময় না দিয়ে সিয়ারাকে সময় দেওয়ার ফলে দিয়ারার কষ্ট হয় কিন্তু সিয়ারার পরিস্থিতি জেনে দিয়ারা নিজের কষ্ট চেপে রাখে। কারণ ও চায় ওর দিদি ভালো থাকে।
দিয়ারা: ভিকি দা? তুমি কেন চলে গেলে? এখানে সব কিছু কেমন জানো ওলোট পালোট হয়ে আছে। তুমি একদম ঠিক করনি চলে গিয়ে, একদম না।
দিয়ারা নিজের চোখের জল মুছে আভাস বাবুর ঘরে চলে যায়। মানুষটা বড্ড ভেঙে পরেছেন। এতদিন আর যাই করুক, ছেলেকে নিজের চোখের সামনে রেখেছিলেন। কিন্তু এখন সেই চেষ্টা বিফল করে দিয়ে আধভিক চলে গেছে। আভাস বাবু নিজের ঘরের রিক্লাইনারে বসে আছেন একটা অ্যালবাম হাতে নিয়ে। সেখানে শ্রীতমা দেবী যেদিন থেকে কনসিভ করেছেন সেদিন থেকে আধভিক হওয়ার পরের কয়েকমাস অবধি সব ছবি আছে। আভাস বাবু সেসবই চোখ বুলাচ্ছিলেন। একটা ছবিতে আধভিকের হওয়ার পর হসপিটালের বেডে শ্রীতমা দেবী আধভিককে কোলে নিয়ে আছে এবং পাশেই আভাস বাবু বসে আছেন। দুজনেই আধভিকের দিকে তাকিয়ে আছেন। পরের ছবিতে একইভাবে শ্রীতমা দেবী থাকলেও আভাস বাবু শ্রীতমা দেবীর কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিচ্ছেন। পৃষ্ঠা উল্টাতেই আভাস বাবুর চোখে পরে বাম দিকে থাকা হাসজ্বল শ্রীতমা দেবীর ছবি।
আভাস বাবু: শ্রী, তুমি আমাকে ছেড়ে না গেলেই পারতে। তোমার উচিত ছিল একটা বার আমার পুরো কথাটা শোনা। তুমিই তো আমাকে বেশি ভালোবেসেছে, দিনের পর দিন বিশ্বাস করেছো চোখ বুজে। আমি তোমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করতে চাইনি, একদম চাইনি। আমি বাধ্য হয়েছিলাম, তোমাকে হারাতে চাইনি আমি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, সেই হারিয়েই ফেললাম তোমাকে তাও আবার সারাজীবনের মতো।
আভাস বাবুর চোখ দিয়ে জল গাল গড়িয়ে পরে। চোখ যায় ডান পাশের ছবিতে যেটা আধভিকের। সেদিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন,
আভাস বাবু: তোর মায়ের চলে যাওয়ার পরেই আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছাটা মরে গেছিলো। বেঁচে থাকার ইচ্ছা নিয়ে এসেছিলাম শুধুমাত্র তোর মুখের দিকে তাকিয়ে। তোকে পুরোপুরি একলা করে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না আমার এতকিছুর পর। তাহলে যে আমি মরেও শান্তি পেতাম না। ভেবেছিলাম তোকে ভালোবেসে আগলে রাখলেই তোর মায়ের প্রতি করা অন্যায়ের একটু হলেও প্রায়শ্চিত্ত করতে পারবো। কারণ তোর মা তো তাই করতো, সবসময় তোকে ভালোবাসার চেষ্টা করতো, ভালো রাখার চেষ্টা করতো। আমিও সেটাই চেয়েছিলাম, ভালো স্বামী না হতে পারলেও ভালো বাবা হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারিনি তাই তো তুই আমাকে একলা রেখে চলে গেলি তোর মায়ের মত। দেখিয়ে দিলি চোখে আঙুল দিয়ে যে আমি সবদিক দিয়ে ব্যর্থ।
আভাস বাবু লাইট জ্বলে উঠতেই অ্যালবামটা বন্ধ করে দিলেন। তাকিয়ে দেখলেন দিয়ারা দাঁড়িয়ে আছে। হতাশার একটা নিশ্বাস বেরিয়ে এলো ওনার মধ্যে থেকে। দিয়ারা এগিয়ে এসে ওষুধ খাইয়ে দিলেন আভাস বাবুকে।
দিয়ারা: একটু নিজের থেকে ঘুমানোর চেষ্টা করো আংকেল। এইভাবে ঘুমের ওষুধ নিতে থাকলে যে তুমি দুর্বল হয়ে পরবে আরও। এমনিতেই ঠিক করে খাওয়া দাওয়া করছো না তুমি।
আভাস বাবু: (তাচ্ছিল্য হেসে) পাপী মানুষ তো আমি, এতো সহজে পৃথিবী ছেড়ে যাবো না। মরে গেলে তো শান্তিই পেয়ে যাবো কিন্তু ভগবান তো আমাকে শান্তি দিতে চান না, শাস্তি দিতে চান। খুব করে চাই প্রতি রাতে, সূর্য যাতে আর দেখতে না হয়।
দিয়ারা: আংকেল প্লিজ, কেন এসব বলছো বলো তো তুমি? দি, তুমি দুজনেই যদি এমন করো আমার কি হবে বলো তো? আমি কয়দিক সামলাবো? (চোখে জল নিয়ে)
আভাস বাবু কিছু না বলে দিয়ারার মাথা হাত রাখলেন শুধু। তারপর গিয়ে শুয়ে পরলেন। দিয়ারাও আর কিছু বললো না, চলে গেলো ঘর থেকে।
আভাস বাবু: দিয়া, সিয়া মা বাড়ি ফিরে গেছে?
দিয়ারা: (দাঁড়িয়ে গিয়ে) হ্যাঁ, দেবদা নিয়ে গেছে।
দিয়ারা দরজায় দাঁড়িয়ে কথাটা শেষ করেই বেরিয়ে গেলো দরজা বন্ধ করে। আভাস বাবু শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আর মনে মনে ভাবলেন,
আভাস বাবু: কষ্ট কি শুধু সিয়া মা আর ভিকি পাচ্ছে? আমার তো মনে হচ্ছে আরও একটা নির্দোষ মানুষ দিনের পর দিন মুখ চেপে কষ্ট পাচ্ছে। জানি না এসবের শেষ কবে।
আভাস বাবু চোখ বন্ধ করতেই ঘুমিয়ে গেলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। নতুন সকাল ওনাদের জন্য ঠিক কি অপেক্ষা করছে ওনারা কেউ জানেন না। আবার হয়তো কেউ কেউ জানেন। আভাস বাবুর চিন্তায় ঠিক কতটা সঠিক প্রমাণ হবে সেটা হয়তো আগামীদিনে।
কয়েক দিন পর সকালে,
দিয়ারা: দি? আমার মনে হয় না অপেক্ষা করার আর কোনো প্রয়োজন আছে বলে। তোর এবার বিয়েটা করে নেওয়া উচিত।
সিয়ারা: দিয়া তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তুই কি বলছিস তোর মাথার ঠিক আছে? এইভাবে নিজের ভালোবাসাকে অন্যকাওর হাতে তুলে দিয়ে সেটার অপমান করিস না দিয়া।
দিয়ারা: আমি অপমান করছি না দি। আমি শুধু দুজন মানুষের ভালো চাইছি।
সিয়ারা: এই বিয়েতে কার ভালো হবে হ্যাঁ? কার ভালো হবে? আমি আভিকে ভালোবাসি আর দেব তোকে ভালোবাসে। আমরা দুজন বিয়ে করলে আমাদের কীভাবে ভালো হতে পারে? আমি কখনই এই বিয়েতে রাজি হবো না।
সিয়ারা নিজের বিছানায় বসে ঘন ঘন নিশ্বাস নিতে লাগলো। দিয়ারা নিজের দিদির পিছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। দিয়ারার মুখ চোখ শুকিয়ে গেছে। একটা বড়ো নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে শক্ত করে দিয়ারা, সিয়ারার কাছে বসে বলে,
দিয়ারা: দেবদা বিয়েতে রাজি দি!
সিয়ারা: (চমকে উঠে) কি? কি বলছিস এসব তুই?
দিয়ারা: (মলিন হেসে) হ্যাঁ। আমি চাই তুইও রাজি হয়ে যা। এইবার আমিও বলছি যে ভিকি দা যা করেছে ভুল করেছে। আর সেইজন্য কষ্ট পেয়ে বা অপেক্ষা করে লাভ নেই। ক্ষমা করারও প্রশ্ন আসে না। তুই প্লিজ এই বিয়েটা তে রাজি হয়ে যা? দেখবি, সব ঠিক হয়ে যাবে যদি তুই রাজি হয়ে যাস।
সিয়ারা: (চোখের জল ফেলে) আমি যে দেবকে কখনও সেই নজরে দেখিনি দিয়া। সব জানার পরেও কীভাবে আমি..??
দিয়ারা: আংকেলের জন্য! (সিয়ারা দিয়ারার মুখের দিকে তাকালো) হ্যাঁ! আংকেলের জন্য এই বিয়েতে রাজি হয়ে যা। ভুলে যাস না আজ আংকেল না থাকলে তুই এই জায়গায় পৌঁছাতে পারতিস না। আমরা তোকে ফিরে পেতাম না। আংকেলের অনেক ঋণ আছে দি, সেটা ভেবেই না হয় রাজি হয়ে যা।
সিয়ারা দিয়ারার মুখের দিকে চেয়ে দেখলো মেয়েটার মুখটা শুকিয়ে গেছে তাও মেয়েটা হাসছে। ও’কে সাপোর্ট দিচ্ছে। সেই মুহুর্তে দেবাংশু, আভাস বাবু আর সুধাংশু বাবু সিয়ারার ঘরে এলো। দেবাংশু কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজাসাপ্টা সিয়ারাকে জিজ্ঞেস করলো,
দেবাংশু: তুই কি এই বিয়েতে রাজি সিয়া? তুই রাজি থাকলেই এই বিয়ে হবে নয়তো না।
সিয়ারা কিছুক্ষণ চোখ বুজে চুপ করে থাকার পর চোখ খুললো। চোখের জলটা মুছে নিয়ে নিজেকে শক্ত করে বললো,
সিয়ারা: রাজি!
সিয়ারার উত্তরটা শুনে দিয়ারা মলিন হেসে পিছনে পিছিয়ে গেলো। দেবাংশুর দিকে তাকালো যে ওর দিকে না ওর দিদির দিকে তাকিয়ে আছে দিয়ারাকে অগ্রাহ্য করে। দিয়ারার চোখটা জলে ভরে উঠলে দিয়ারা পিছন ফিরে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে থাকে এবং ধীরে ধীরে সকলের আড়ালে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এক এক করে সবাই বেরিয়ে গেলেও দেবাংশু বেরিয়ে যায় না। সে সিয়ারার পাশে বসলে সিয়ারা দেবাংশুকে জিজ্ঞেস করে,
সিয়ারা: সেদিন তোর আর আধভিকের কি কথা হয়েছিলো দেব?
দেবাংশু: (কিছুক্ষণ চুপ থেকে) ভিকি বলেছিলো, তোর খেয়াল রাখতে। ও ওর নিজের জীবনকে আমার ভরসায় আমার হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছে তাই তোর গায়ে জানো কোনো আঁচ না আসে।
সিয়ারা তাচ্ছিল্য হেসে উঠলো। দেবাংশু চুপ করে শুধু সিয়ারাকে দেখতে থাকে।
সিয়ারা: আমি ভেবেছিলাম ও কখনও আমাকে অন্য কোনো ছেলের সাথে মেনে নিতেই পারবে না। দেখতেই পারবে না আমাকে অন্যকারোর সঙ্গে। (একটু থেমে) ঠিকই ছিলাম আমি, ঠিক ছিলাম একদম। ও আমাকে অন্যকরোর সাথে দেখতে পারবে না তাই তো চলে গেছে। এখানে না থাকলে ও’কে দেখতেও হবে না, কষ্ট পেতেও হবে না।
সিয়ারার কাঁধে দেবাংশু হাত দেয় সিয়ারাকে উত্তেজিত হয়ে উঠতে দেখে। সিয়ারা দেবাংশুর হাত সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
সিয়ারা: প্রতিশোধ নিচ্ছে, প্রতিশোধ! আমি যেমন ও’কে অন্যকারোর হাতে তুলে দিয়ে গেছিলাম তেমনটাই ফিরিয়ে দিলো আমাকে। সব জানি আমি! নিজের কষ্টটা আমাকে অনুভব করাতে চাইছে। আমাকে তো কখনও বোঝেনি তাই প্রতিশোধ নিচ্ছে। বুঝলে জানতো যে আমিও একই যন্ত্রণা, কষ্ট অনুভব করেছি। আলাদা করে অনুভব করানোর জন্য প্রতিশোধ নিত না। (একটু থেমে) ভালো চেয়েছে আমার! ভালো!! খুব ভালো আছি আমি, খুববব!! এতো ভালো থাকার থেকে তো মরে যাওয়া ভালো ছিলো।
দেবাংশু সিয়ারার কাঁধে হাত দিতেই সিয়ারা ডুকরে কেঁদে ওঠে মাথা নীচু করে দুহাতে নিজের মুখ ঢেকে। দেবাংশু তা দেখে মনে মনে বলে,
দেবাংশু: (মনে মনে — তোকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমি খুব ভালো ভাবে পালন করতে চাই সিয়া। আজকে তো শুধু ফাইনাল স্টেপে পৌঁছালাম। আমাদের বিয়ের দিনটার জন্যেই আমি অপেক্ষা করে আছি সিয়া, এইবার আমার অপেক্ষার অবসান হবে।)
[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে🥀]