#কথা_দিয়েছিলে_ফিরবে
#পর্ব_১২
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
অফিসের কাজের প্রেশার বেড়েই চলেছে দিন দিন । এই সময় নাফিসের মন তার কাদম্বরীর কাছে পড়ে আছে । আজকে দুপুর প্রায় ১২ টার উপর হয়ে গেছে । এখন অবদি নাফিস দেখে নি তার কাদম্বরীকে না দেখেছে ইফসিকে । ফাইলের বাহানায় পিওনকে ডেকে
জুঁইয়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই নতুন কিছু শুনতে পায় নাফিস ,
– রহমান ভাই , নাদিরা ইয়াসমিনকে ডেকে পাঠান তো ।
– স্যার ম্যাডাম তো আজ আসেন নাই ।
– আসেন নাই মানে , তিনি আজ অফিসে আসে নি ?
– নাহ স্যার ,
– কেন আসে নি , আপনি কি জানেন কিছু ?
– ম্যাডাম নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন , তাই কয়েকদিন ছুটি চেয়েছেন এম ডি স্যারের কাছে ।
পিওন রহমান সাহেবের কথা শুনেই বুকের মধ্যে ধক করে ওঠে নাফিসের । নিজে নিজে কল্পনা করে যাচ্ছে ,
– কি হয়েছে হঠাৎ করে । পরশুদিন রাতেও তো ভালোই ছিল । মাঝে ছিল গতকালকের দিনটা
, কি হয়েছে ?
নাফিসকে চিন্তিত দেখে পিওন রহমান সাহেব বলে উঠেন ,
– স্যার , কোন সমস্যা হয়েছে কি ?
পিওনের কথায় ভাবনা থেকে বের হয় নাফিস ,
– নাহ ঠিক আছি আমি , আপনি এখন যান রহমান ভাই । প্রয়োজন হলে আমি আবার ডেকে নিবো , কেমন ?
– জ্বি স্যার ,
হাসি দিয়ে পিওন রহমান সাহেব বেরিয়ে যায় রুম থেকে । আর নাফিসও জুঁইকে ফোন করে দিয়ে বসে । কিন্তু সেই ফোন আর রিসিভ হয় নি । একবার নয় দুবার নয় তিনবার নয় লাগাতার ফোন দিয়ে যাচ্ছে নাফিস । কিন্তু রিসিভ হয় নি । টেনশন আরও বেড়ে যায় নাফিসের । বাড়াবাড়ি কিছু হয় নি তো তার কাদম্বরীর । তার উপর একা থাকে বাসাটায় । বাচ্চাটাও একদমই ছোট । নাফিস আর বসে থাকতে পারে নি । সোজা উঠে মাহবুব সাহেব এর রুমে যায় সে ।
– স্যার আসবো ??
– আরে নাফিস সাহেব যে , আসুন ।
– স্যার আমার এই মুহুর্তে ছুটি লাগবে ।
– মানে ?
– জ্বি স্যার , প্লিজ আমার ছুটি চাই এক্ষুনি ।
– এনিথিং রং মিষ্টার নাফিস ?
– স্যার কাউকে ছেড়ে দিয়েছিলাম বহু বছর আগে । এখন তাকে ধরে রাখতেও পারছি না কিন্তু চেষ্টা তো করতেই পারি , তাই না স্যার ?
নাফিসের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝে নি মাহবুব সাহেব । নাফিস কি বলতে চায় , তাও বুঝতে পারেন নি । এরই মাঝে নাফিস আবারও বলে ,
– স্যার , প্লিজ আমায় ছুটি দিন ।
– আজকের জন্যে নাকি কয়েকদিনের জন্যে ?
– আপাতত আজকের জন্যে । ঝামেলা বেশি হলে আমি মেইল করবো ।
– আচ্ছা যান ।
– ধন্যবাদ স্যার ।
নাফিস আর এক মিনিটও দাঁড়ায় নি সেখানে । সোজা বেরিয়ে নিজের কেবিনে গিয়ে কোন রকম গুছিয়ে সে বেরিয়ে যায় । অফিসের বাকি স্টাফরা একটু অবাকই হয়েছেন বটে । মোহি খুব মন দিয়ে সবটা ভেবে দেখে , তার ধারণা সত্যি নয়তো ?
– নাফিস স্যার নাদিরা ম্যামের বাসায় যাচ্ছেন না তো ? কেন যেন মনে হলো তার মনটা নাদিরা ম্যামের অসুস্থতার খবর পেয়ে ভালো নেই ।
মোহি এইসব উপলব্ধি করতে তো পারছিল বেশ । কিন্তু কারো কাছে খুলে বলতে পারছিল না সে ।
জুঁইয়ের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নাফিস । ডোরবেল ৪/৫ বার দেয়া শেষ তার । তবুও দরজা খুলছে না জুঁই । দুপুর প্রায় দেড় টার উপর হয়ে গেছে , জুঁইয়ের কোন পাত্তাই নেই । আবারও ডোরবেল দেয় নাফিস , ৮ম ডোরবেল দেয়ার পরেই জুঁই গিয়ে দরজা খুলে দেয় ।
দরজা খোলার পর জুঁইকে দেখে নাফিস । পুরো মুখ লাল হয়ে আছে , চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে । চোখ দুটো লাল হয়ে আছে । ওড়নাটাও ঠিক মত গায়ে নেই তার । জ্বর একদম কাবু করে ফেলেছে তার কাদম্বরীকে । ভেতরে বাচ্চা মেয়েটা কি অবস্থায় আছে কে জানে ।
এদিকে জুঁই নাফিসকে দেখে পুরাই অবাক । এই সময়ে তার বাসায় নাফিস । কি করে সম্ভব এটা । নাফিস সোজা ভেতরে ঢুকে যায় । এরই মাঝে জুঁই নাফিসকে বলে উঠে ,
– তুমি এই অসময়ে ?
জুঁই কথাও বলতে পারছে না ঠিক মত । গলাটাও বসে গেছে । দাড়াতেও তার কষ্ট হচ্ছে । সিংগেল খাট টায় ধুপ করে বসে পড়ে সে । কোকিয়ে উঠছে বার বার । নাফিস তার কাদম্বরীর বেহাল অবস্থা দেখছে ।
– এতগুলা ফোন দিছি রিসিভ কেন করো নাই ?
– ফোন কই আমি কই , জানি না ।
– ইফসি কোথায় ?
– খেলে ,
– এত অসুস্থ একবার ফোন করলেও তো পারতে ।
– উফফফফ , আহহহ ।। খেয়াল ছিল না । ইফসিকে কিছু খাওয়াও তো ।
– কিহহহ , ও এখনও কিছু খায় নি ?
– নাহ , আমি তো উঠতেই পারছিলাম না । রান্না ঘরে কৌটায় বিস্কিট রাখা আছে । এনে খাওয়াও তো , দেখো খায় কিনা ।
– আন্টিকে ফোন দিলেই তো পারতে ।
– আমার কাউকে ফোন করার মত শক্তি নাই নাফিস ।
এটা বলেই জুঁই সেখানেই শুয়ে পড়ে । নাফিস আগে ভেতরের রুমে ইফসির কাছে যায় । নাফিস দেখে ইফসি খাটে বসে পুতুল দিয়ে খেলছে । নাফিস দরজা থেকেই ইফসিকে ডেকে উঠে ,
– ইফসি মামুনি,,,,,,,,,?
কারো আওয়াজ পেয়ে দরজার দিকে তাকায় ইফসি । দরজায় নাফিসকে দেখে খুব খুশি হয় ইফসি । খিল খিল করে হেসে উঠে দাঁড়ায় সে । তারপর খাটের পাশে এসে দাঁড়ায় সে আর দুইহাত উচিয়ে কোল দেখায় নাফিসকে । নাফিসও এক গাল হেসে দিয়ে ভেতরে ঢুকে ইফসিকে কোলে তুলে নেয় । ইফসি এমন ভাবে নাফিসকে আঁকড়ে ধরে মনে হচ্ছিলো তার বাবা নাফিস । বাচ্চা তো , তাই এত কিছু তার মস্তিষ্কে কাজ করে না ।
ইফসি নাফিসের গলা জড়িয়ে ধরে আছে । নাফিস ইফসিকে চুমা দিয়ে খাটের উপর দাড় করায় আর বলে ,
– কিছু খেয়েছো মামুনি ?
– আম্মুন দেয় না , আম্মুন দেয় না
– আম্মুন এর অসুখ মামুনি , বিস্কিট খাবা মামুনি ?
তারপর নাফিস ইফসিকে কোলে তুলে রুম থেকে বের হয়ে সামনের রুমে যায় । সেখানে গিয়ে দেখে জুঁই খাটে শুয়ে আছে , দুনিয়ার খবর নেই তার । নাফিস ইফসিকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে যায় । খুঁজে খুঁজে বিস্কিটের কৌটা বের করে প্লেটে করে বিস্কিট এনে ইফসির সামনে দেয় ।
– মামুনি তুমি বিস্কিট খাও , কেমন ?
নাফিস রুমে গিয়ে আগে রুমের সব গুছিয়ে বিছানা ঝাড়ু দেয় , ইফসির খেলনা গুলো গুছিয়ে রাখে পাশে । পুরো রুমটা পরিষ্কার করে দেয় সে । সামনের রুমে এসে জুঁইকে ডেকে তুলে নাফিস ।
– জুঁই,,,,,,?
-…………….
– জুঁই ,,,, এই জুঁই শুনছো ?
– হুউউ,,,,,,
– উঠো ওই রুমে আসো ।
নাফিসের কথা শুনেও শুয়ে থাকে জুঁই । শরীরে শক্তিও নেই মনে হচ্ছে৷। নাফিস জানে জুঁইয়ের যখন জ্বর হয় তখন তার দিন দুনিয়ার খবর থাকে নাহ । জুঁইয়ের কপালে হাত রেখে জ্বরের পরিস্থিতি অনুভব করে নাফিস । জুঁইয়ের শরীরে নাফিসের হাত , এ যেন এক অনাকাঙ্ক্ষিত মুহুর্ত । যেখানে স্বাক্ষী শুধু সে আর সময় । কারণ জুঁই তখন জ্বরের ঘোরে । দেড় বছরের বাচ্চা মেয়েটা তখন পুতুল কোলে বিস্কিট খাচ্ছে । নাফিস জুঁইকে কোলে তুলে নিয়ে রুমে শুইয়ে দেয় । নাফিসের কোলে উঠে নাফিসের শরীরের গন্ধ অনুভব করে জুঁই তার নাকে কিন্তু নাফিসকে জড়িয়ে ধরার শক্তিটাও তার নেই ।
জুঁইকে শুইয়ে দিয়ে বাকি কাজ গুলো করে ফেলে নাফিস । রান্নাঘরে গিয়ে দেখে রাতের ভাত ছাড়া আর কিছুই নেই । এখন এই দুপুর বেলা এত অল্প সময়ে রান্না করা যাবেও না । তাই এক বন্ধুকে ফোন করে কিছু খাবার আনায় নাফিস । খাবার এনে আগে ইফসিকে খাইয়ে দেয় নাফিস । তারপর জুঁইকে তুলে ভাত খাইয়ে দেয় । জ্বরের তাড়নায় মাথায় কিছুই নেই জুঁইয়ের । গায়ে যে তার ওড়না নেই সেই জ্ঞানটুকুও নেই তার । নাফিস নিজের মত করে সবটা সামাল দিচ্ছে আজ । একবার ইফসিকে দেখছে আবার জুঁইকে দেখছে । সব গুছিয়ে জুঁইয়ের মাথায় পানি ঢেলে দেয় নাফিস । অন্যদিকে ইফসি নাফিসকে জ্বালাচ্ছে , নাফিসের সাথে খেলছে । বাচ্চাটা তো আর বুঝছে না তার মা অসুস্থ ।
একদিকে জুঁইকে দেখছে সে অন্যদিকে ইফসিকে সামলাচ্ছে সে । যেন আজ নাফিস একজন আদর্শ স্বামী আর একজন আদর্শ বাবা । এই মুহুর্তে নাফিসের অন্য কোন দিকে খেয়াল নেই ।
এদিকে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত প্রায় ৯ টা । জুঁইয়ের জ্বর যেন আরও বেড়ে গেছে । এদিকে মোবাইলে একটার পর একটা ফোন বেজেই চলেছে । বাসা থেকে ফোন আসছে । নাফিসের সেদিকেও খেয়াল নেই । প্রায় অনেক্ষন পর শান্তার ফোন রিসিভ করে নাফিস ।
– ভাইয়া তুই কই ? কয়টা বাজে আসিস না কেন এখনও ? ভাইয়া তুই ঠিক আছিস তো ?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে নাফিস আস্তে আস্তে সব বলে তার বোনকে ।
– তুই এখন জুঁই আপুর বাসায় ??
– হ্যাঁ ,
– বাচ্চাটা কি করে ?
– খেলে ,
– আপু ?
– পড়ে আছে , খবরও নেই ।
– আপুর তো বরাবরই এমন হয় ।
– হু
– বাচ্চাটার একটা ছবি দে তো আমাকে দেখি ।
– অনেক কিউট রে , একদম যেন আমার কাদম্বরী ।
– আচ্ছা তুই ছবি পাঠা আর আমি মাকে কিছু একটা বলে ম্যানেজ করে নিবো ।
– আচ্ছা ।
বোনের সাথে কথা বলে খাটে এসে জুঁইয়ের পাশে বসে নাফিস । এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে দেখে যাচ্ছে জুঁইকে সে । যেন ঘোর লেগে গেছে তার চোখে ।
– আমার কাদম্বরী , যাকে আমি কথা দিয়েও ফিরে আসি নি । আজ আমার সেই কাদম্বরী আমার সামনে । আমি তোমায় ভালোবাসি , হ্যাঁ কাদম্বরী আমি তোমায় ভালোবাসি । অনেক অনেক ভালোবাসি । ফিরে এসেছি আমি , হয়তো দেরি করে ফেলেছি তবুও ফিরে এসেছি আমি ।
.
.
চলবে…………………………