#কলঙ্ক
#৪র্থ_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
তারপর মা চারদিকে ঘটকদের লাগিয়ে দিলেন। তিন মাসের ভেতর যে করেই হোক তিনি আমার বিয়ে দিবেন। ততদিনে আমার শরীরও ভালো করে সেড়ে উঠবে!
কিন্তু শরীর সাড়লেও কী আদৌও মন সেড়ে উঠতে পারবে?আমি কী ভুলতে পারবো আমার পুরনো স্মৃতিগুলো?
আজকাল আমানের কথা আর মনে পড়ে না।মনে পড়ে শুধু ওই দিনটির কথা।যেদিন আমার এবরোশন হয়েছিল। নিজের সন্তানকে খুন করেছিল ওরা আমার সামনে!
রাত প্রায় দুটো। হঠাৎ আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। ইচ্ছে করে এমন করিনি। অনেক চেষ্টা করেছি এসব ভুলে থাকতে। চেষ্টা করেছি কান্নাটা চেপে রাখতে। কিন্তু সম্ভব হয়নি।
আমার কান্না শুনে মা চমকে গিয়ে জেগে উঠলেন।বাবা সুইচ টিপে বাতি জ্বালিয়ে আমার ঘরে এলেন।মা শুয়েছিলেন আমার সাথেই। তিনি আমার সাথেই থাকেন সব সময়।ভয় পান।না জানি আবার কখন গলায় দড়ি টড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ি!
মা বললেন,’কী হয়েছে তূর্ণা?কী হয়েছে রে মা?’
আমি নাকে মুখে ওড়না চেপে ধরে কান্না লুকোতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না।যতোই কান্না লুকোতে চেষ্টা করছি ততোই প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে।
বাবা এসে বললেন,’দুঃস্বপ্ন দেখেছিস?’
আমি কথা বললাম না।
মা আমার হাতে নাড়া দিয়ে বললেন,’তবে কাঁদছিস কেন?’
আমি কান্নাভেজা গলায় বললাম,’ওকে ভুলতে পারি না মা! সব সময় মনে পড়ে!’
মা রাগত স্বরে বললেন,’যার জন্য এতো কিছু হয়ে গেলো ওকেই ভুলতে পারছিস না!তুই কী মানুষ?’
আমি বললাম,’না মা আমানকে নয়!’
মা বললেন,’তবে কাকে?’
‘যাকে আমরা হত্যা করেছি তাকে। আমার সন্তানকে।’
মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।আদর করে বললেন,’ঘুমিয়ে যাও মা।আর কেঁদো না। কাঁদলে শরীর খারাপ করবে।’
মা আমার সাথে হঠাৎ করে খুব ভালো ব্যবহার করলেন। হয়তোবা তিনি বুঝতে পারছেন আমার কষ্টখানি!
এই রাতের পর থেকেই আমার এক অদ্ভুত রোগ হয়ে গেল। এখন আমি সব সময় আমার পেটের অনাগত সন্তানকে দেখতে পাই।দেখতে পাই ওর অপুষ্ট শরীর জুড়ে ক্ষত বিক্ষত।চোখ গুলো উপড়ে ফেলা। মাথাটা থেঁতলানো। আমার ভয় করে। বুকের পাটা কাঁপতে থাকে ভীষণ ভাবে!
এই ভ্রুণটা আবার আমার সাথে কথা বলে। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,’মা,মা,ওমা, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।ওরা আমায় মেরে ফেলেছে। আমার খুব শখ ছিল পৃথিবীটা দেখার। আমার খুব শখ ছিল তোমাকে মা বলে ডাকার।ওমা,মাগো, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাকে কেন তোমরা মেরে ফেললে?’
আমি কোন উত্তর দিতে পারি না।চুপ করে থাকি।
আমার ভ্রুণটা তখন অভিমান করে। অভিমানী গলায় বলে,’মা,আমি আল্লার কাছে তোমার নামে অভিযোগ করবো।বলবো, আমার মাও আমার খুনের সাথে জড়িত!’
আমি নিজের মাথাখানা দেয়ালের সাথে ঠুকতে থাকি। শক্ত করে ঠুকি। কপাল তখন ফুলে যেতে থাকে।লাল হয়ে উঠে। রক্ত জমে উঠে।মা পাক ঘর থেকে দৌড়ে আসেন।আমায় একপাশে টেনে নিয়ে বলেন,’এ কী করছিস তুই তূর্ণা? পাগল হয়ে গেছিস তুই?’
আমি কাঁদতে থাকি।ডুকরে ডুকরে কাঁদি। কান্নাভেজা গলায় বলি,’মা,ও এসেছিল আজ আমার কাছে!’
মা বলেন,’কে?কে এসেছিল?’
আমি বলি,’আমার ভ্রুণটা।ও এসে জবাব চাইছিলো!আমি কিচ্ছু বলতে পারিনি মা।’
মা হঠাৎ ভয়ে কেঁপে উঠেন। তিনি ভাবেন আমি বুঝি পাগল হয়ে যাচ্ছি। তিনি ভয় পেতে থাকেন আমি কখন জানি আবার লোকে লোকে বলে বেড়াই আমার ভ্রুণ হত্যার কথা। গোপন বিয়ের কথা!
মা বললেন,’শান্ত হও মা। আগামীকাল তোমায় ময়মনসিংহ নিয়ে যাবো।ডাক্তার দেখাবো। তখন আর কেউ তোমার সামনে এসে তোমায় ভয় ডর দেখাবে না!’
আমি কাঁদতে থাকি।মার সাথে কথা বলতে আমার ইচ্ছে করে না।
‘
ডাক্তারের কাছে আর আমায় নিয়ে যাওয়া হলো না।বাবা বললেন,’ডাক্তারের কাছে গিয়ে লাভ নেই। ঘটকদের তাড়া দেও। বিয়ে হয়ে গেলেই সব ভুলে যাবে মেয়ে!’
মা বললেন,’তাই হোক। ভালো একটা ছেলে পেলেই বিয়ে ফাইনাল করে ফেলতে হবে।’
ঘটকদের পকেটেও কিছু কাঁচা পয়সা দেয়া হয়েছে।
ঘটকেরা এবার দ্রুত কাজ করছে। অনেকগুলো আলাপ জোগাড় করে ফেলেছে এরমধ্যে। কিন্তু বাবার পছন্দ শিক্ষকতার সাথে জড়িত এমন একটা ছেলে। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হলে সবচেয়ে ভালো।
‘
বাবার পছন্দ মতো ছেলে পাওয়া গেল। ছেলের নাম মেহরাব। খুব সুন্দর চেহারা।অতি আধুনিক। তবে অনেক নম্র ভদ্র।ছেলে আমাদের বাড়িতে আসার আগে ভাইয়া গিয়ে ছেলেকে দেখে আসবে। ছেলের বাড়ি ঘরও দেখবে। পছন্দ হলে ওদের আসতে বলবে।ওরা এসে আমায় পছন্দ করলে বিয়ে। আমাদের এখানেই বিয়ে পড়িয়ে ফেলা হবে।
ভাইয়াকে খবর দেয়া হয়েছে। ভাইয়া আসবে এক দুদিনের ভেতর। আমার ভয় করছে।ভয় করছে এই জন্য যে ভাইয়াকে কিছুই শোনানো হয়নি। তাকে বাড়িতে খবর দিয়ে আনানো হচ্ছে একটা মিথ্যা কথা বলে।বলা হয়েছে যে বাবার অসুখ।এই জন্য তাকে বাড়িতে আসতে হবে। কিন্তু সে এসে যখন শুনবে আমার বিয়ে তখন তো সে মাকে বলবে,ওর বিয়ে মানে? পড়াশোনা রেখে বিয়ে কেন? ঘটনা কী?
মা অবশ্য এই প্রশ্নের উত্তর ঠিক করে রেখেছেন। বাবার অসুস্থতার জন্য।বাবা ভয় পাচ্ছেন।যদি মরে টরে যান। এই জন্য মেয়েকে বিয়ে দিয়ে মেয়ের বর দেখে যেতে চান। অবশ্য বাবাকে এর জন্য কদিন অভিনয় করতে হবে। বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে।
‘
ভাইয়া এসে গেছে বাড়িতে।মা যা প্ল্যান করেছিলো সেভাবেই সব হচ্ছিল। ভাইয়া সব মেনেও নিয়েছিল। শুধু সে বাড়তি যা বলেছিলো তা হলো, আমার পড়াশোনা বন্ধ করা যাবে না। বিয়ের পরেও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে।
মা বললেন,তাই হবে।
কিন্তু ও আসার দিন রাতেই যে আবার আমার ভ্রুণ আমার সামনে এসে উপস্থিত হবে তা কে জানতো!
তখন রাত বারোটা।সবাই ঘুমিয়েছে কেবল।আমি ঘুমোতে যাবো ঠিক তখন দেখতে পেলাম আমার বিছানায় আমার ভ্রুণের থেঁতলানো শরীর খানা।
আমি ওকে ধমক দিয়ে বললাম,’যা।এখান থেকে যা বলছি!’
ও গেলো না। উল্টো কান্না জুড়ে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো,’তুমি না আমার মা।মা হয়ে কীভাবে আমায় তাড়িয়ে দিচ্ছো এখান থেকে?’
আমি বললাম,’কে তোর মা?এই যা বলছি এখান থেকে!’
ভ্রুণ গেলো না।সে বললো,’যাবো না।দেখি কী করে আমায় তাড়াও!’
আমি ওকে তাড়াতে গিয়ে খাট থেকে নীচে পড়ে গেলাম।পড়ে গিয়ে কোমড়ে অসম্ভব রকম ব্যথা পেয়েছি। সেই ব্যথা নিয়ে আমি গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগলাম।
ভাইয়া সম্ভবত ঘুমায়নি তখনও।সে দৌড়ে এলো আমার ঘরে। পেছন পেছন মা এবং বাবাও।
ভাইয়া এসে বললো,’কী হয়েছে তূর্ণা?এ কী তুই নীচে কেন?’
আমি বোকার মতো কাঁদতে কাঁদতে বলে ফেললাম,’ও এসেছিল আবার।ও এসেছিল। এসে বলেছে,মা, কেন আমায় তাড়িয়ে দিচ্ছো তুমি?’
ভাইয়া সঙ্গে সঙ্গে ব্যপারটার অনেকটাই অনুমান করে ফেললো।সে সন্দেহ মাখা গলায় বললো,’মা,তোমরা কী লুকাচ্ছো আমার কাছে বলতো?’
‘
#চলবে