#কাছে_দূরে ♥️
#moumita_meher
#পর্ব___৩১
সানিয়ার মেহেন্দি অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। বৃষ্টির দরুন ছাদে যাওয়া সম্ভব হলো না বিধায় বাসার ড্রয়িং রুমেই সব আয়োজন করা হলো। ড্রয়িং রুমের সোফা,টি-টেবিল সব সরিয়ে ফেলতেই অনেক জায়গা বেরিয়েছে। সেখানে সবাই বেশ অনেক খানি জায়গা দখল করে আরামসে বসতে পেরেছে। দু’জন মহিলা সানিয়ার দু’পাশে বসে মেহেদি দিচ্ছে। বাকি তিনজন অন্যদের মেহেদি দিচ্ছে। সবার মাঝেই বিয়ের চাপা উত্তেজনা। ড্রয়িংরুমের দুই মাথায় বিশাল আকারের দুটো সাউন্ড বক্স রাখা হয়েছে। সেখানেই হিন্দি গান বাজছে। বাচ্চারা আনন্দে ছোটাছুটি করছে আর নাচছে। সবই দুচোখ ভরে দেখছে সানিয়া। সেই সাথে মিষ্টি করে হাসছে।
বাইরে থেকে ভিজে একাকার হয়ে বাসায় ফিরল সাবাব। ড্রয়িং রুমে সবাইকে দেখলেও হীরকে দেখা গেলো না। তাই নীচে আর এক মুহুর্তও দেরী না করে ছুট্টে গেলো হীরের রুমে। হীর রুমেই আছে। ভেতর থেকে গুনগুন করে গান গাওয়ার আওয়াজ ভেসে আসছে। সাবাব আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলোনা। একপ্রকার ক্রুদ্ধ হয়েই হনহনিয়ে হীরের রুমে ঢুকে গেলো। হীর ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মাথার ভেজা চুল গুলো তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতেই গান গাচ্ছিল। আচমকা বিকট আওয়াজে দরজা খোলার শব্দ হলো অতঃপর জনাব হঠাৎ করেই সামনে তার মূর্তিমান হলেন। হীরের বুকের ভেতর ধুকপুক করে শব্দ হলো। ভালো করে তাকিয়ে দেখল সাবাবের গা চুইয়ে পানি পড়ছে। কতক্ষণ যাবত বৃষ্টিতে ভিজেছে সময় না জানলেও তার শরীর চরম পর্যায়ে সাদা হয়ে যাওয়াতে বোঝা যাচ্ছে একটু অতিরিক্ত সময়ই ভিজেছে সে। কিন্তু হঠাৎ করে সে বৃষ্টিতে কেন ভিজতে গেলো? তাও এতোটা যে বৃষ্টির পানি লাগতে লাগতে সব রক্ত শুষে নিয়ে শরীর সাদা হয়ে উঠলো। নিশ্চয় ঐ ডাইনী তরীটার সঙ্গে রঙ্গ করে ভিজেছে। আহা! প্রেম দেখলে আর বাঁচি না। তা ভিজে পুরে ঢং দেখাতে আবার আমার রুমে কেন এসেছে? আর এতো শব্দ করে দরজার উপরই কেন হুমড়ি খেয়ে পড়ল? কি ভেবেছিলো? তরী এঘরে এসেছে? তাকে বৃষ্টির মাঝে একা দাঁড় করিয়ে রেখে! আচ্ছা সত্যি সত্যি কি হয়েছিলো এমন? ধুর, হলে হলো না হলে নাই! তাতে আমার কি? হুহ্। কিন্তু প্রশ্ন হলো? চোখ দুটো এমন ভয়ানক লাগছে কেন? মনে হচ্ছে তো এখনি আমায় কাঁচা গিলে খাবে!
সাবাব হীরের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আচমকাই তাকে ধাক্কা মেরে ড্রেসিং টেবিলের সাথে চেপে ধরলো। হীর হোঁচট খেয়ে ড্রেসিং টেবিলটার সাথে লেপ্টে যেতেই ঝনঝন করে কেঁপে উঠলো ড্রেসিং টেবিলটা। তার হাত থেকে পড়ে গেলো তোয়ালেটা। হীর অসম্ভব ভয়ে কুঁকড়ে গেলো! সাবাবের হঠাৎ এই অদ্ভুত আচরন কেন সে বুঝে উঠতে পারছেনা। তার চোখে আঁধার নেমে এলো ভয়ে। শুঁকনো গলায় ঢোক গিলল। সাবাবের দিকে মুখ তুলে তাকানোরও সাহস হচ্ছে না। তবুও সাহস করল! চোখের পলক কাঁপতে কাঁপতে সাবাবের দিকে তাকানোর পূর্বেই সাবাব তার বাহুডোর শক্ত করে চেপে ধরলো। রাগান্বিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
—-‘ আজ কে বলেছিলো তোকে বাইরে যেতে? কে বলেছিলো বল? আমি কি বলেছিলাম? বাইরে যা আর একটা বিপদ সঙ্গে করে নিয়ে আয়! দিনদিন এতো সাহস কি করে বাড়ছে তোর? কি করে বাড়ছে? আজ যদি কিছু একটা হয়ে যেতো? হুম? কে বাঁচাতো তোদের? কে হেল্প করতো?’ (চিল্লিয়ে)
হীর কেঁপে উঠে দু’হাতে নিজের মুখ চেপে ধরলো। তার চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো মুহুর্তেই। সাবাবের শক্ত হাতজোড়ার মাঝে নিজের হাতজোড়া অসহায়ের মতো আঁটকে আছে। চিনচিনে ব্যাথা করছে হাতজোড়ায়। কিন্তু সাবাবের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়াও যে মুখের কথা নয়। গলা জড়িয়ে আসছে কান্নায়। ঢোক গিলে কান্না গুলো ভেতরেই চেপে নিলো। কম্পিত কন্ঠে কিছু বলার চেষ্টা করতে নিলেই সাবাব আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠলো,
—-‘ তুই বুঝতে পারিস দিন-রাত কতটা টেনশনে থাকি তোকে নিয়ে? কতটা আতংকে থাকি? শত্রুরা ওত পেতে আছে তোর জন্য। হাতের নাগালে পেলেই থাবা দিয়ে ধরবে তোকে। আর তারপর খুবলে খুবলে তোকে নিঃশেষ করে দিবে। ওত পেতে আছে একদল হায়না! বুঝিস না তুই? আমার থেকে ভালো অভিজ্ঞতা তো তোর থাকার কথা? তবুও কেন এমন অজ্ঞাত থাকার ভান করে চলিস বল?কেন তুই নিজের জীবনটা নিয়ে এতো উদাসীন?’
হীর জবাব দিতে পারলো না। সাবাবের প্রত্যেকটা কথাই ভীষণ সত্য। এর জবাবে সে কি বলবে? কি বলা উচিত?
—-‘ এই যে আমরা এতো গুলো মানুষ প্রতিনিয়ত তোকে ভালো রাখার চেষ্টা করছি, তার কি কোনো দাম নেই তোর কাছে? আমার কথা না হয় বাদই দিলাম। তুই তো সেই ছোটবেলার ভুলটা আজও অব্দি ক্ষমা করতে পারিসনি। তাই কোনোদিন আমাকে বেঝারও চেষ্টা করিসনি। কিন্তু মা? মা তো তোর চিন্তায় সারাক্ষণ আতংকিত থাকে। কখন কি হয়ে যায় তোর। সে তো পারলে তোর জন্য নিজের জীবনটাও বাজি রাখতে পারে হীর! আর সানি? সানিকে তো তুই নিজের বোন ভাবিস! সানিও যে তোকে অসম্ভব ভালোবাসে। আগলে রাখতে চেষ্টা করে। আর বাবা! সেও কি কম ভালোবাসে তোকে? তুই কি করে ভুলে যাস? এতোগুলো মানুষের জীবন তোর বাঁচা মরার উপর ডিপেন্ড করে আছে। তুই নিঃশ্বাস নিচ্ছিস বলে ঐ মানুষ গুলোও নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তোর কিছু হয়ে গেলে তাদের কি হবে একটা বারও ভেবেছিস তুই?’
সাবাবের প্রত্যেকটা কথাই ধারালো অস্ত্রের মতো আঘাত করে চলেছে হীরের মনকে। বুক ফেঁটে কান্না আসছে তার। তার সামান্য একটা ভুল মানুষ গুলোকে এতোটা হয়রান করতে পারে কখনও মাথায়ও আসেনি। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল জল। সাবাব তার চোখের জল দেখতে যেন আরও ভয়ংকর রেগে গেলো। আচমকাই হীরকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলো। রাগে তার গায়ে কাটা দিচ্ছে। বারবার ফুঁসে উঠছে।
হীর ধাক্কা খেয়ে নিজেকে সামলাতে না পেরে বিছানার উপর গিয়ে পড়ল। কান্না ভেজা চোখ জোড়া তুলে সাবাবের দিকে তাকাতেই সাবাব মুখ ফিরিয়ে নিলো তার থেকে। অন্য দিকে ফিরে রাগে ফুঁসে উঠে বলল,
—-‘ আগামী চব্বিশ ঘণ্টা তুই এই রুমের বাইরে এক পাও রাখবি না। যদি আমার কথা অমান্য করিস তবে আমি এই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে ছাড়বো।’
কথাটা বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেলো সাবাব। হীর সাবাবের যাওয়ার পানে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। চোখ থেকে অঝোরে পানি পড়তে লাগলে দু’হাতে মুখ আড়াল করে নিলো হীর। আর সঙ্গে সঙ্গেই বিকট শব্দ করে তার রুমের দরজাটা বাইরে থেকে আঁটকে গেলো। হীর কেঁপে উঠে দরজার দিকে তাকালো। দরজাটা বন্ধ দেখে বুঝতে বাকি রইলো না সাবাব বাইরে থেকে দরজাটা লক করে দিয়ে চলে গেছে। হীর কেঁদে উঠল আবারও। কাঁদতে কাঁদতে বালিশে মুখ গুঁজে ডুব দিলো অতীতে__________
সাবাব ছোট বেলা থেকেই ভীষণ রাগী। অল্পকিছুতেই তার ভীষণ রাগ চড়ে বসতো। আর সেই রাগ ভাঙাতে নাজমা বেগমের দিনরাত এক হয়ে যেতো। হীরের বাবার মৃত্যুর পর থেকে সাবাবের জেদ,রাগ সবটাই ক্রমাগত বেড়ে গিয়েছিলো। সারাক্ষণ কিসব যেন বিরবির করে যেতো। আর হীরকে প্রটেক্ট করার চেষ্টা করতো।
হীর তার বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর প্রথম দিকে অনেক অস্বাভাবিক আচরন করলেও ধীরে ধীরে অবশ্য তা ঠিক হয়ে গেছিলো। আর ঠিক আগের মতোই ভীষণ দুষ্টু আর চঞ্চল হয়ে উঠেছিলো সে। সারাক্ষণ সাবাবের পেছন লাগত। সাবাব ধবধবে ফর্সা হওয়াতে সে সাবাবকে হোয়াইট বিল্লি বলতে বেশি পছন্দ করতো। তবে সাবাব হীরের এই নাম দেওয়াটা মোটেও পছন্দ করতো না। সে হুট হাঁট রেগে যেতো হীরের উপর। কিন্তু তাতে হীরের নাম ডাকাটা বন্ধ হতো না। সে ইচ্ছে করে বার বার ভুল করার ভাব করে সাবাবকে হোয়াইট বিল্লি বলে ডাকতো। তার বেশ মজা লাগতো। কিন্তু সাবাব মজা পেতো না। বরং চোখ লাল করে মারাত্মক পর্যায়ে রেগে যেত। আর হীরকে শাস্তি-স্বরূপ দুই ঘন্টা রুমে বন্ধিও করে রাখতো। একবার সেরকমই এক কান্ড করে ভীষণ ভুগেছিলো দুজনে। হীর খেলতে গিয়ে ভুল করে সাবাবকে হোয়াইট বিল্লি বলে ক্ষেপাতে লাগলো। সাবাবকে হীর বাজারে পাঠিয়ে রাঁধতে বসেছিলো! কিন্তু সাবাব ফর্দ অনুযায়ী মিছে মিছে খেলায় কোনো বাজারই ঠিকঠাক করে আনতে পারলো না। তা দেখে তো হীর ভীষণ ক্ষেপে গেলো। পাকা গিন্নির মতো কোমরে কাপড় গুঁজে সাবাবকে কথা শুনাতে লাগলো। আর এক পর্যায়ে গিয়ে বলে উঠলো, “শুধু হোয়াইট বিল্লি মতো এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতে পারো। আর শুধু মিউ মিউ করতে পারো! কাজের কাজ তো কিছুই করতে পারো না!” ব্যস এই কথা শুনে সাবাব গেলো ক্ষেপে! রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে হীরের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চিলেকোঠার ঘরে। ভেতরটা বেশ অন্ধকার। বাইরে থেকে দরজা সম্পুর্ণ বন্ধ করে দিলে ভেতর থেকে সবটাই কুটকুটে অন্ধকার হয়ে যায়। সাবাব জানত হীরের অন্ধকার রুমে সমস্যা হয় কিন্তু সেই মুহুর্তে রাগের কাছে কোনো কিছুই আর টিকতে পারলো না। সে ভুলে গেলো হীরের রোগের কথা। বাইরে থেকে দরজা লক করে দিলো। অতঃপর দশমিনিটের মাথায় কারেন্টের মেইন ফিউজ খুলে দিলো। যেন হীর হাতড়ে সুইচ টিপে রুমে আলো জলাতে না পারে। রাগের মাথায় হীরের চিৎকার সে পুরোপুরি উপেক্ষা করে নিজের ঘরে গিয়ে চুপটি করে বসেছিলো! এদিকে হীরকে খুঁজে না পেয়ে পুরো বাড়ি, এলাকা মাথায় করে ফেললেন আজিম সাহেব! পুলিশকে খবর দিয়ে সবাই হন্নে হয়ে খুঁজতে লাগলো হীরকে। বাসার আনাচে কানাচে, হীরের সব ফ্রেন্ডদের বাসায় সব জায়গায় খুঁজলেও হীরকে পাওয়া গেলো না। এদিকে সাবাব ঘাবড়ে গেলো সবার চিন্তা দেখে। নিজের ভেতরের অপরাধ বোধে আর টিকতে না পেরেই ছুটে গেলো চিলেকোঠার ঘরে। চিলেকোঠার দরজা খুলে হীরের ঠান্ডা হয়ে যাওয়া শরীরটা পড়ে থাকতে দেখে সাবাবের করুন দশা হয়ে গেলো তার। হীরকে আঁকড়ে ধরে চিৎকার করতে লাগলো। বাসার সবাই সাবাবের চিৎকারে ছুটে আসে চিলেকোঠার ঘরে। হীরের এই অবস্থা দেখে সঙ্গে সঙ্গে হীরকে নিয়ে ছুটল হসপিটালে। ডক্টর চেক-আপ করে বললেন, আর মিনিট দুয়েক দেরী হলে হীরকে বাঁচানো সম্ভব হতো না! কারন প্রথম থেকেই হীরের শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা দুটোই খুব খারাপ ছিলো। এ’কথা শুনেই সাবাব সেই প্রথম বার খুব কান্না করেছিলো। হীরের অসুস্থতায় নিজেকে দায়ী ভাবতে লাগলো। তার রাগের প্রকোপে হীরের এই অবস্থা। সে ভাবতেই পারছিলো না তার জন্য হীরের কোনো ক্ষতি হয়ে যেতে পারতো। হীর পূনরায় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে অনেক দিন যাবত সাবাব হীরের সামনে আসেনি। ভুল করেও দু’জনের দেখা হয়ে গেলে হীর ছুট্টে পালিয়ে যেতো ভয়ে। সেই থেকেই সাবাবের প্রতি হীরের ভয় ছিলো। তারপর হঠাৎ একদিন সিদ্ধান্ত হয় সাবাবকে আমেরিকায় পাঠানো হবে পড়াশোনার জন্য। হীর একদিক থেকে স্বস্তি পেলেও কোথাও গিয়ে মনে হচ্ছিলো সাবাব না থাকলে তার জীবনটা ভীষণ এলোমেলো হয়ে যাবে। কিন্তু সাবাবের সাথে পূনরায় স্বাভাবিক ভাবে কথা বলা তার সাহসে কুলোয়নি কোনোদিন। কিছুদিনের মাথায় সাবাব চলে গেলো আর পুরো বাসাও শূন্য হয়ে গেলো। তবে সাবাব যাওয়ার আগে হীরকে একটা কথা বলে গিয়েছিলো।
—-‘যেদিন আমি আবারও এই দেশে ফিরব, সেদিন আমি সবার চেয়ে আগে তোমায় দর্শন দিবো। সবার আগে আমায় তুমি দেখবে হীরপরি।’
কথাটা স্বাভাবিক হলেও হীরের কাছে স্বাভাবিক মনে হয়নি। মনে হয়েছিলো সাবাব তাকে হুমকি দিয়ে গেছে। আর সেই ভয় নিয়েই হীর পার করেছে বারো-বছর। তবে এই ভয়ের মাঝেও এক কোনে লুকিয়ে ছিলো মানুষটার প্রতি এক পৃথিবী সমান ভালোবাসা। তবে কখনও প্রকাশ পায়নি সেই ভালোবাসার রঙ,
শুধু প্রকাশ পেয়েছে ভয়! ভয়!আর ভয়!
________________
ঘড়ির কাটায় বিকাল ৪টা। মিনিটের লম্বা কাটাটা দম্ভ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে একের ঘরের দিকে। ঘন্টার কাটা স্থির আছে চারের ঘরে। আর সেকেন্ডের কাটাটি বেশ প্রফুল্লচিত্তে ছুটে যাচ্ছে মিনিটের কাটা,ঘন্টার কাটাকে অতিক্রম করে। বাইরে বৃষ্টির থামাথামি না হলেও স্বল্প পরিমানে তার তেজ কমে গিয়েছে। বাসার ভেতর লোকজনের হাঁটা-চলায় ফ্লোর হয়ে উঠেছে স্যাঁতসেঁতে। রুবি কতক্ষণ পরপরই একটা কাপড় নিয়ে এসে হাঁটার জায়গাটা মুছে দিয়ে পরিস্কার করে দিয়ে যায়। কিন্তু পূনরায় আবার সেই একই ভাবে স্যাঁতসেঁতে হয়ে ওঠে। বাড়ির বাচ্চা মেয়ে থেকে শুরু করে বুড়ো মহিলারাও মেহেদি পড়া মিস করলো না। সবাই নিজেদের সখ মিটিয়ে মেহেদি পড়েছে। কিন্তু সবার মাঝে হীর নেই। ব্যাপারটা বারবার চোখে পড়লেও জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলো না সানিয়া। তার হাতের মেহেদি শুঁকিয়ে এসেছে প্রায়। তবে জায়গা ছেড়ে ওঠার সুযোগ নেই। আত্নীয়রা বড় সাধ করে এসে আসন পেতে বসে তার পাশে। তার সাথে ভালোমন্দ দশ কথা বলে। তাতেই যেন দম ছেড়ে বাঁচতে পারছেনা সানিয়া। এর মধ্যে হীরের কথা কখনই বা জিজ্ঞেস করবে। ঐদিকে রান্না ঘরে দু’হাত আঁটকে পড়ে থাকলেও মনটা ভীষণ হীরের জন্য দুশ্চিন্তা করছে নাজমা বেগমের। সেই যে এসে রুমে গেলো ফ্রেশ হতে আর যে আসার নামগন্ধও নেই। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল অথচ সে খাবারের কথা ভুলে গিয়ে বসে আছে। নীচে মেহেন্দির অনুষ্ঠানেও তো তার গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। তার মানে এখনও পর্যন্ত নীচেই নামেনি। খাবারওটাও যদি ঠিক সময়ে না খায় মেয়েটা তাহলে শরীর কি ঠিক থাকবে? কে যাবে তাকে ডাকতে? কাকে পাঠাবেন? সেই নিয়ে আবার মহা চিন্তা নাজমা বেগমের।
—-‘ মা! মা?’
ডাইনিং টেবিল থেকে সাবাবের গলা ভেসে আসল। নাজমা বেগম গ্যাসের পাওয়ার কমিয়ে দরজা ধরে কেনো রকম বাইরে এলেন। ছেলের পানে এগিয়ে আসতে আসতে ব্যস্ত নজর দিলেন হীরের রুমের দিকে। ‘একি, রুমতো মনে হচ্ছে বন্ধ।’
—-‘ হ্যাঁ রে বল বাবা? কি হয়েছে?’
—-‘ বলছিলাম যে, রাতে সংগীতের পর যে খাওয়া-দাওয়া যা হবে সেগুলো এখানে এতো খেটেখুটে না রেঁধে তুমি বরং রেস্ট নাও। আমি বাবুর্চিদের মেনু বলে দিয়ে এসেছি উনারাই ব্যবস্থা করবেন। বুঝলে?’
—-‘ হ্যাঁ বুঝলাম। তাহলে কাল থেকে সব রান্না ওরা করবে?’
সাবাব অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
—-‘ কাল থেকে কেন? বললাম না আজ থেকেই?’
—-‘ ও আজ থেকেই? আচ্ছা আচ্ছা।’
মায়ের কন্ঠস্বর স্বাভাবিক নয় মনে হতেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সাবাব। ভাবুক কন্ঠে বলে উঠলো,
—-‘ মা? কি ভাবছো তুমি এতো মন দিয়ে? সব ঠিকাছে তো?’
ছেলের প্রশ্ন নাজমা বেগম তার দিকে পূর্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
—-‘ হ্যাঁ? আমি। না রে। কিছু না। তুই খেয়েছিস তো দুপুরে? নাকি খাসনি এখনো?’
সাবাব এবার অবাক হলো বটে। সে তো ঘন্টা খানিক আগে এখানে বসেই খেয়ে গেলো। তিনি নিজ হাতে খাবার বেড়ে দিলেন। তাহলে হঠাৎ আবার কেন জিজ্ঞেস করছেন?
—-‘ হ্যাঁ খেয়েছি তো। তুমি কি ভাবছো বলো তো মা! কি হয়েছে?’
নাজমা বেগম আরেকবার দেখলেন হীরের রুমের দিকে। ছেলের পানে তাকিয়ে মন খারাপ করে বললেন,
—-‘ মেয়েটা এখনও পর্যন্ত দুপুরের খাবার খায়নি। কি করছে ঘরে বসে জানিনা। এভাবে না খেয়ে থাকলে তো অসুস্থ হয়ে যাবে। কাউকে যে পাঠাবো ডাকতে সেই সময়ও তো পাচ্ছি না। নিজেও যেতে পারছিনা বাকিরাও পারছেনা। যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত।’
মায়ের কথাগুলো মনে লাগল সাবাবের। পেছন ফিরে একবার দেখলে হীরের ঘরের বন্ধ দরজাটা। হীর যে তার জন্যই রুম থেকে বের হয়নি। তার আদেশ পালন করছে না খেয়েদেয়ে। নিশ্চয়ই খুব ক্ষিদে পেয়েছে তার। সাবাবের বুক চিঁড়ে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল। মায়ের দিকে একবার আঁড়চোখে তাকিয়ে বলল,
—-‘ তা তুমি আগে বলবে না? আমায় বললে তো আমিও ডেকে নিয়ে আসতে পারতাম।’
—-‘ তোকে কোথায় পেতাম বল? তুই তো বাবুর্চিদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলিস!’
সাবাব মাথা নীচু করে নিয়ে আবারও দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো। অতঃপর মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
—-‘ হ্যাঁ। আচ্ছা ছাড়ো ওসব কথা। এখন তুমি এক কাজ করো। ওর জন্য কিছু খাবার দাও আমি ওকে দিয়ে আসছি।’
নাজমা বেগম দ্রুত উঠলেন খাবার আনার জন্য। কিছুক্ষণের মাথায় খাবার নিয়ে এসে ছেলের হাতে দিতে দিতে বললেন,
—-‘ কিন্তু ও তো আমার হাতে আগে না খেলে খাবেনা।’
সাবাব মুচকি হেসে বলল,
—-‘ এখান থেকে এক লোকমা তুলো আর হাতে মুড়ে পাশে রেখে দাও। আমি ওকে বলে দিবো এটা তুমি দিয়েছো। কেমন?’
নাজমা বেগম খুশি হয়ে গেলেন ছেলের কথা শুনে। তিনি তাই করলেন সাবাব যা বলল।
সাবাব আবারও হাসলো মায়ের বাচ্চামো দেখে। মা এক লোকমা ভাত পাশে সাজিয়ে দিতে সে চলে গেলো হীরের রুমে। দরজাটা এখনও আগের মতোই চাপানো যেভাবে সে রেখে দিয়ে চলে গেছিলো। সাবাব দরজার সামনে কিছুক্ষন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে করে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। গত কয়েক ঘন্টা আগে সে চলে যাওয়ার পরে হীরের রুম যেমন ছিলো এখনও তেমনই আছে। ভেজা তোয়ালেটা নীচে পড়ে আছে। ড্রেসিং টেবিলের উপরের জিনিস গুলো কয়েকটা নীচে পড়ে আছে আবার কয়েকটা ড্রেসিং টেবিলের উপরে এলোমেলো হয়ে বিছিয়ে আছে। সাবাব সবটা দেখে ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলো হীর বিছানার মাঝামাঝি কাত হয়ে শুইয়ে আছে। মনে হচ্ছে কাঁদছে! কিন্তু না। সে কাঁদছে না। বরং কাঁদতে কাঁদতে এভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সাবাব বাঁ হাত বাড়িয়ে দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো হীরের বিছানার দিকে। খাবারের প্লেটটা বিছানার উপর রেখে নীচে পড়ে থাকা তোয়ালে এবং বাকি জিনিসগুলো সব উপরে উঠিয়ে রাখল। তোয়ালেটা বিছানার উপর রেখে ড্রেসিং টেবিলের সব জিনিসপত্র গুলো সুন্দর করে গুছিয়ে রাখল। বিছানার পাশে এসির রিমোটটা তুলে এসির পাওয়ারটা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে রিমোটটা আবারও ঠিক জায়গায় রেখে দিলো। তারপর ধীরেসুস্থে হীরের পাশে বসে তার মাথায় হাত রাখল। মুখের উপর পড়ে থাকা চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে আলতো করে চুমু খেলো হীরের কপালে। চোখের কোনে এখনও জল লেগে আছে। সাবাব হাত দিয়ে মুছে দিলো সেই জল। মুখের সামনে হাতটা তুলে হীরের চোখের জলের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। মনেমনে ভাবল,
—-‘ যেই আমি তোমায় কখনও কাঁদতে দিবোনা বলে নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করেছি, সেই আমিই তোমায় কাঁদিয়ে চলেছি প্রতি ক্ষণেক্ষণে। সাবাব সরি হীরপরি। সো সরি। প্লিজ এবারের মতো ক্ষমা করে দাও? আর কখনও সাবাব তোমায় হার্ট করবে না প্রমিজ। এত্ত গুলো সরি।’
হীর ঘুমে বিভোর থাকলেও সাবাবের স্পর্শ তাকে অস্থির করে তুলল। ঘুমের ঘোরেই নড়েচড়ে উঠতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো তার। চোখ খুলতে সামনে সাবাবকে বসে থাকতে দেখে যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো সে। মুহুর্তেই ভয়ে ছিটকে পড়ল এক হাত দূরে। সাবাব নিজেও চমকে গেলো হীরের ভয় পাওয়া দেখে। হীর এমন সময়ে সাবাবকে যেন কিছুতেই আসা করেনি। ভীত চোখ জোড়া এদিক ওদিক ঘুরতে লাগল। সাবাব গম্ভীর মুখে বলে উঠলো,
—-‘ কি হলো? আমাকে দেখে এতো ভয় পাওয়ার কি আছে হ্যাঁ? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক?’
সাবাবের কথায় কান না দিয়ে হীর ভয় জড়িত কন্ঠে বলে উঠলো,
—-‘ আ,,আমি কিন্তু রুম থেকে বের হইনি। প্লিজ আমায় বকোনা!’
সাবাব এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
—-‘ আমি কি বকেছি তোকে?’
হীর অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সাবাবের দিকে। না সূচক মাথা নেড়ে কিছু বলতে নিলে তার মাঝেই সাবাব আবারও বলে উঠলো,
—-‘ তাহলে? এমন দূরত্ব নিয়ে ছিটকে পড়লি কেন? আর দুপুরে খেতে নামিস নি কেন? নিজেকে কি মহারানী ভিক্টোরিয়া ভাবছিস যে সবাই তোর জন্য সময় নষ্ট করে খাবার নিয়ে দৌড়ে আসবে?’
—-‘ ক্ষিদে পায়নি তাই নামিনি!’
—-‘ ক্ষিদে পায়নি মানে? দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো। একটু বাদে সন্ধ্যাও হয়ে যাবে আর তুই বলছিস তোর ক্ষিদে পায়নি। আস্ত গন্ডার খেয়ে বসে আছিস নাকি? যে দুই তিনদিনেও ক্ষিদে লাগার চান্স নেই।’
—-‘ ছি!’
—-‘ হোয়াট ছি! ভুল বললাম কি?’
—-‘ ইয়াক! আমি গন্ডার কেন খেতে যাবো? মানুষ কি এসব খায় নাকি?’
—-‘ তোর মতো মানুষ হলে ব্যাপার না। চলে এসব!’
হীর সাবাবের কথা শুনে পেট আর মুখ একসাথে চেপে ধরলো! বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ে বমি করার ভাব করে বলল,
—-‘ তুমি এতো বাজে কেন?’
সাবাব নিজেকে একবার দেখে নিয়ে বলে উঠলো,
—-‘ আমি কি করলাম!’
—-‘ তুমি! তুমি একদম কথা বলবেনা আমার সাথে!’
সাবাব মনে মনে হেসে উঠলো। হীর নর্মাল হয়েছে।
—-‘ আচ্ছা বলবো না। তার আগে তুই এই খাবার গুলো খেয়ে শেষ কর জলদি।’
—-‘ আমি এখন কিছুতেই খাবোনা। তুমি কি বাজে কথা বলছো! আমার বমি পাচ্ছে৷ আর তাছাড়া আমার ক্ষিদেও পায়নি।’
#চলবে_
বিঃদ্রঃ এতদূর কষ্ট করে পড়ে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করবেননা। যদি ছোট্ট একটা মন্তব্যে আপনার মতামত জানাতে কষ্ট হয়। ধন্যবাদ]