#কাছে_দূরে 🌸🥀
#moumita_meher
#পর্ব___৫৫
হীরের কথা মতোই ক্ষনকাল পেরিয়ে কল এলো একটা প্রাইভেট নাম্বার থেকে। সবাই চুপচাপ একজায়গায় বসেছিলো এই প্রত্যাশিত কলের অপেক্ষায়। কলটা আসতেই চাপা উত্তেজনা তৈরি হলো সবার মাঝে। কিন্তু হীর নীরব। সে নিশ্চুপ সাবাবের ফোনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রইলো। সাবাব আঁড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখলো হীরের নীরবতা। অতঃপর কলটা তুলবে কি না এই নিয়ে প্রশ্ন করতে উদ্যোত হলেই হীর শান্ত কন্ঠে বলে,
—-‘ কেউ কোনো আওয়াজ করবে না পাশ থেকে। তুমি কলটা তুলো। মনে রেখো মনি যা বলবে সবটাতে শুধু হ্যাঁ বলবে। মনির বিপরীতে কথা বলার ভুল করবে না। তাহলে ওরা কিন্তু তরী আর কিরনকে বাঁচিয়ে রাখবে না!’
হীরের শান্ত কন্ঠে শরীরে শীতল কিছু অনুভব করলো সবাই। সবাই অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে কেবল হীরকেই দেখে এসেছে এতক্ষণ। মেয়েটা চোখের পলকে কেমন পাল্টে গেলো যেন। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এটাই তার আসল রূপ। এটাই আসল হীর। সাবাব চোখ ঝাপটে হীরের কথাগুলো মেনে নিলো। হীরের কথামতোই সবাই নিশ্চুপ রইলো। সাবাব কলটা রিসিভ করতেই কতক্ষণ নীরব থাকল দু’পক্ষই। ক্ষনকাল পেরোতে নীরবতা ভেঙে খ্যাকখ্যাক হাসির শব্দ ভেসে আসলো ওপাশ থেকে। এমন বিকট হাসির শব্দে চমকে উঠলো সবাই। মীর তেজ নিয়ে ফোনের দিকে ঝুকে এলো কিছু কঠিন বাক্য ছুড়বে বলে। একটুর জন্য বিফলে গেলো তার বোকামো। হীর ক্ষপ করে মীরের হাত চেপে ধরে কঠিন দৃষ্টি মেলে তাকালে। ইশারায় বুঝালো ‘এই কাজ ভুলেও করোনা’ বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না। হীরের কঠিন দৃষ্টিতে ডেবে গেলো মীর। মাথা নীচু করে দু’হাতে মুখ ঢেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনলো। হীর সাবাবের দিকে ইশারা করে কথা বলতে বলল। সাবাব সহজ কন্ঠে কথা বলতে লাগল,
—-‘ কিরন আর তরীকে ছেড়ে দাও মনি। আমাদের গোটা কেসটাতে ওরা কেবল সাহায্য করেছে মাত্র। কিন্তু ওদের সাহায্যে আমরা তেমন কিছুই উদ্ধার করতে পারিনি। যে রহস্য সামনে এসেছে সবটাই আমার প্রচেষ্টায়। তুলে নিতে হয় তুমি আমাকে নাও। আমি এই কেস নিয়ে বরাবর মাথা ঘামিয়েছি, বাড়াবাড়ি করেছি! এখানে ওদের কোনো ফল্ট নেই। ওরা তো কেবল ওদের ডিউটি পালন করেছে।….মনি? শুনতে পাচ্ছো?’
—-‘ হাহাহা,সাহায্য! আরে সাহায্য করাই তো ওদের অন্যায় হয়েছে। ঘোর অন্যায়। সেই অন্যায়ের শাস্তি না দিয়ে ওদের এতো জলদি কি করে ছেড়ে দেই বলো তো? সেটা কি ঠিক হবে?’
—-‘ মনি,আমি জানি তোমার সম্পুর্ন ক্ষোভ আমার উপরে! তোমার সব রাগ আমার উপর। তুমি আমাকে নিয়ে যাও। আমাকে নিয়ে গিয়ে ওদের প্লীজ ছেড়ে দাও মনি!’
—-‘ না না না। তুমি ভুল করছো বেটা। আমার সমস্ত রাগ,ক্ষোভ তোমার উপরে নয়। উঁহু। একদম না। আমার সমস্ত রাগ, ক্ষোভ যার উপরে সে তুমি নও। সে আরেকজন। শুনলাম, তুমি তাকে সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছো? তা কোথায় সে হুম? তাকে একটু ডাকো? কথা বলি?’
সাবাব শূন্য চোখে হীরের দিকে তাকালো। মনি হীরকে উদ্দেশ্য করে বলছে। ভাবতেই বুকের ভেতর কেঁপে উঠছে বারবার। সাবাব না বোঝার ভান করে বলল,
—-‘ তুমি কার কথা বলছো বলো তো?’
—-‘ কার কথা আবার? আমার আদরের বোনঝির কথা বলছি সাবাব। সব জেনেও নাটক করছো? হাহাহা। আমি এক কথা দু’বার বলবো না সাবাব। যদি তরী আর কিরনকে ফেরত পেতে চাও,অবশ্যই জীবিত! তাহলে হীরকে আমাদের হাতে তুলে দাও।’
—-‘ কিন্তু-
হীর সাবাবের হাত চেপে ধরলো। চোখ দিয়ে ইশারা করে বুঝালো, ‘খবরদার,না করবেনা।’ সাবাব অসহায় চোখে তাকালো হীরের মুখপানে। বাধ্য হয়ে মনের বিরুদ্ধে বলল,
—-‘ ওকে। আমাদের কোথায় আসতে হবে?’
—-‘ ঠিকানা টেক্সট করে দিচ্ছি। আগামীকাল ভোর ঠিক ৬টা নাগাদ হীরকে নিয়ে সেখানে থাকবে। মনে রেখো ঠিক ভোর ৬টা!’
কথা গুলো ভেসে আসতে আসতে কলের লাইন কেটে গেল। সাবাবের মুখ চোখ শুঁকিয়ে এসেছে। সে হীরকে হারানোর ভয় পাচ্ছে। কি হতে যাচ্ছে রাত আড়াই টায়!
মীর হুড়মুড় করে উঠে এলো সাবাবের কাছে। সাবাবের হাত দুটো ধরে করুনসুরে বলল,
—-‘ এবার কি হবে ভাই?’
সাবাব মীরের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
—-‘ ভয় পাসনা। সব ঠিক হবে। তরী আর কিরনকে আমরা ঠিকই উদ্ধার করে নিয়ে আসবো।’
—-‘ আর হীর?’
মীরের প্রশ্নে সবাই শূন্য দৃষ্টিতে তাকালো। সাবাব অসহায় চোখে হীরের দিকে তাকাতে হীর মুচকি হেসে বলল,
—-‘ আমাকে নিয়ে ভেবো না ভাইয়া। মৃত্যু আমায় এত জলদি আপন করবে না। যখন সেদিনই মরিনি তখন হয়তো এখনও মরবো না। কে জানে মনির শেষ দম আমার হাতেই ফুরোবে কি না।’
হীরের কথায় কেমন কেঁপে উঠলো সবাই। হীর এমন অদ্ভুত ভাবে কথা বলছে সেটা সবার হজম করতেই কষ্ট হচ্ছে। মেনে নিতে পারছেনা কেউ।
হীর উঠে দাঁড়ালো। পাশের রুমে যেতে যেতে বলল,
—-‘ তোমরা রেডি হয়ে নাও সবাই। আমাদের মিশনটা সাকসেসফুল করতেই হবে।’
হীরের যাওয়ার পানে তাকিয়ে মীর থমথমে গলায় বলল,
—-‘ ভাই! হীর হঠাৎ এতটা বদলে গেলো কি করে?’
সাবাব ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—-‘ হীর বদলায়নি। বরং বরাবর ও এমনই ছিলো। আর ওর সেই কোমল আচরনটাই ছিলো ওর সবচেয়ে ধারালো অস্ত্র। মনিকে ওর হাতেই মরতে হবে। কেবল মনি না, বাকি দুই গোপন শত্রুদেরকেও ওর হাতেই মরতে হবে। আমি আগাম আভাস পাচ্ছিরে।’
—-‘ আমিও পাচ্ছি।’
ফিসফিসিয়ে বলল মীর। সাবাব মীরের কাঁধে হাত রেখে খানিক বাদে সেও উঠে গেলো পাশের রুমে। হীরের সাথে কথা বলতে হবে তাকে।
________________
মনির দেওয়া লোকেশনে রওয়া দিলো তারা। যাওয়ার প্রথম রাস্তাটাই শুরু হয় পাহাড়ের পাশ থেকে। গাড়ি নিয়ে মোটামুটি ভাবে ঢোকা যায় সেরকম একটা রাস্তা। জানা নেই পরবর্তী রাস্তা কেমন হবে? আর মনির কাছে পৌঁছানোর পরে কি কি হবে! হীর বেশ স্বাভাবিক ভাবে বসে আছে সাবাবের পাশে। সাবাব ড্রাইভ করছে। পেছনের সীটে মীর,ইভান আর আভিক বসে আছে। মাহদীকে নেওয়া হয়নি। মনি সারাজীবন ধরে ঠিক সে-সব মানুষদের উপরই এট্যাক করেছে যাদের সামনে একটা সুন্দর ভবিষ্যত আছে। মাহদীর সদ্য বিয়ে করা বউ বাড়িতে রয়েছে। মনি জানেনা এমন কিছুই নেই। বলা যায় না, বেছে বেছে মাহদীর উপরই তার আক্রমণ শুরু হলো! কোনো একজনকে রেখে আসতে হতোই। তাই সাবাব মাহদীকেই রেখে এলো।
পেছন থেকে মীর চিন্তিত স্বরে বলল,
—-‘ ভাই? পাহাড়ি রাস্তা কিন্তু খুব ডেঞ্জারাস হয়! দেখা যাবে মনির হাতের মরার আগেই পাহাড়ি রাস্তাতেই এক্সিডেন্ট হয়ে গেলো। আর এখানে একবার এক্সিডেন্ট হলে আর বাঁচব বলে তো মনে হয়না!’
সাবাব হাতে স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে মীরের কথা গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলো। অতঃপর সামনে স্থীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মীরের উদ্দেশ্যে বলল,
—-‘ রাস্তা পাহাড়ের দিকে যাচ্ছে না। রাস্তা যাচ্ছে জঙ্গলের দিকে। দেখছিস না ক্রমশই অন্ধকার হচ্ছে সামনের দিকে।’
সাবাবের কথার রেশ টেনে আভিক বলে উঠলো,
—-‘ স্যার, মীর স্যারের মতো আমারও সবটা মাথার উপর থেকে যাচ্ছে। এতো এতো জায়গা থাকতে মনি আমাদের জঙ্গলের ভেতর কেন লোকেশন দিলো? মনির উদ্দেশ্য কি?’
সাবাব তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
—-‘ মনির উদ্দেশ্য কি জানি না। তবে মনির উদ্দেশ্য কোনো কালেই সৎ ছিলো না। আর আজও যে হবে সেটা ভাবাও বোকামি। দেখা যাক কি হয়। তবে সবাই কিন্তু এলার্ট থেকো। আমার মনে হয়না মনি এতো সহজে কিরন আর তরীকে ছেড়ে দিবে। আমার মনে হচ্ছে-
সাবাব তার কথাটা শেষ করার আগেই গাড়িটা অটোমেটিক বন্ধ হয়ে গেলো! মনে হলো যেন গাড়ির টায়ার পাঞ্চার হয়েছে। গাড়ি হঠাৎ থেমে যাওয়ায় সবাই আকস্মিক সামনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে গেলো। সাবাব গাড়ির সামনে এবং পেছনে একবার তাকিয়ে ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল,
—-‘ ড্যাম! গাড়ির টায়ারটা এখনই পাঞ্চার হতে হলো!’
সাবাবের কথা শুনে মীরের কান থেকে যেন ধোঁয়া বেরিয়ে গেলো। সাবাবের থেকে দীগুন ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,
—-‘ ভাগ্য কেন আমাদের নিয়ে এমন পরিহাস শুরু করলো বলতো?’
সাবাব মীরের মনের অবস্থা আন্দাজ করে তাকে স্বান্তনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
—-‘ রিলাক্স ইয়ার। এই মুহুর্তে এতো রেগে গেলে চলবে না। আমাদের অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।’
এই বলে গাড়ি থেকে নামলো সাবাব। বাকিরাও নেমে এলো। আভিক গাড়ির টায়ারটা দেখে বলল,
—-‘ স্যার, টায়ারটা পাল্টাতে হবে। আমি এখনই এটা পাল্টানোর ব্যবস্থা করছি।’
আভিকের কথায় মীর যেন একটু স্বস্তি পেলো। সাবাব মৃদুহেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। আভিক টায়ারের কাছে যেতে যেতে ইভানকে সাথে নিয়ে গেলো। মীর গাড়ি থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। কপালের মাঝে সেই চিন্তাদেরই সুক্ষ্ম ভাজ পড়েছে। সাবাব মীরের অবস্থা দেখে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ভালোমন্দ মিলিয়ে তাকে বোঝাতে লাগলো। হীর তাদের থেকে বেশ খানিক দূরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে ভরাট জঙ্গল। বিশাল বিশাল জঙ্গলি গাছ। একেকটার উচ্চতা মাপকাঠিতে তোলা সম্ভব না। হীর চোখ ঘুরিয়ে দেখছে সবকিছু। গাছগুলোর বুকে আঁকিবুঁকির অভাব নেই। দেখে মনে হচ্ছে কেউ খুব যত্নে এসব আঁকিবুঁকি করেছে। হীর কয়েক পা এগিয়ে গেলো সেদিকে। গাছের বুকে হাত রাখতেই শিরশির করে উঠল তার শরীর। এ যেন এক অদ্ভুত শিহরন। হীরের কি মনে হতে পেছন মুড়ে একবার তাকালো সাবাবের দিকে। সাবাব পুরো মনোযোগ নিয়ে মীরকে বোঝাচ্ছে। মীর মাথা নীচু করে বুঝতে চেষ্টা করছে সাবাবের কথা গুলো। হীর সাবাবদের পাশেই আভিকদের দিকে তাকালো। তারাও সর্বোচ্চ মনোযোগ দিয়ে গাড়ির টায়ার ঠিক করছে।
আকস্মিক হীর অনুভব করলো কেউ তার মুখে কিছু একটা চেপে ধরলো! আর সঙ্গে সঙ্গে সে শরীরের ভার ছেড়ে ঢলে পড়লো আগন্তুকের বুকে। লোকগুলো সতর্কতার সাথে হীরকে নিয়ে গায়েব হয়ে গেলো জঙ্গলের মাঝে। এদিকে বাকিরা টেরও পেলোনা সেই খবর। ঘটনার প্রায় দশমিনিট বাদে সাবাব হীরের অনুপস্থিতি টের পেলো। হঠাৎ মনে হলো হীর নেই। তার বুক কেঁপে উঠলো। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকাতেই দেখলো হীরের দাঁড়িয়ে থাকা জায়গাটা শূন্য পড়ে আছে। সাবাব মীরকে ছেড়ে লাফিয়ে পড়লো এপাশে। হীরের দাঁড়িয়ে থাকা জায়গাটায় এসে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
—-‘ হীর কোথায় গেলো?’
সাবাবের প্রশ্নে বাকিরা চমকে উঠলো। চাতক পাখির মতো চারপাশে দেখলো লাগলো। এত বড় জঙ্গলে হীরকে কোথায় খুঁজবে তারা?কে নিয়ে গেলো হীরকে?
সাবাব গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগলো হীরের নাম নিয়ে। মীর একপ্রকার দৌড়ে এসে সাবাবের পাশে দাঁড়ালো। ভীত কন্ঠে বলল,
—-‘ মনি তুলে নেয়নি তো হীরকে?’
সাবাব অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো মীরের দিকে। রাগে তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। পুরো মুখমন্ডল রক্তিম আভায় ঘিরে ধরেছে। সাবাব চটজলদি ফোন বের করে মনির কল দেওয়া নাম্বারে ডায়াল করলো। যদি সত্যি মনি এ-কাজ করে থাকে তবে মনির কপালে সীমাহীন দুঃখ লেখা আছে। নাম্বারে কল যাচ্ছে না। তার মানে এই কাজ মনিই করেছে। সাবাব রাগে ফুঁসে উঠে চেঁচিয়ে উঠে ছুঁড়ে মারলো ফোনটা। মীর সাবাবকে শক্ত করে ধরে রেখে বলল,
—-” কি করছিস টা কি? শান্ত হ! মনি এমন কিছু করতে পারে সেটা আমাদের আগেই ভাবা উচিৎ ছিলো!’
সাবাব দাঁতে দাঁত চেপে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
—-‘ খুব বড় ভুল করেছে মনি! এর মাশুল মনিকে গুনে গুনে দিতে হবে।’
________________
হীরকে তুলে আনার দুই ঘন্টা পেরিয়ে গেলো। একটা ডুপ্লেক্স বাড়িতে রাখা হয়েছে হীরকে। এখানে মনিকা তার পরিবার নিয়ে থাকে। তার হাজবেন্ড ফরহাদ রেজা এবং মেয়ে রোজ। রোজ হীরের চেয়ে বয়সে দুই বছরের ছোট। দেখতে বেশ। মাথায় ঝাঁকড়ানো চুল। মুখের আদোল বাবা-মায়ের সাথে মিলেনা। সবার থেকে আলাদা দেখতে। চিকন পাতলা ভ্রুর রেখা। প্রতিনিয়ত ভ্রুর কাটছাঁট করতে ভুল হয়না। চোখ দুটো বেশ ছোট। লম্বায় বেশ। সরু পাতলা শারীরিক গঠন। চলাফেরা সর্বোচ্চ অশ্লীলতার উর্ধে। তার পোশাকআশাক শরীরের বেশির ভাগ জায়গা ঢাকতে অক্ষম। এসবটাই মনিকা এবং রেজার অতিরিক্ত ভালোবাসার পরিনাম। এতে অবশ্য তাদের কিছু যায় আসেনা। আধুনিক জীবন এমনই হবে বলে ভাবেন তারা।
হীরকে অচেতন অবস্থায় বাসার ভেতর নিয়ে আসার সময় ব্যাপারটা রোজ লক্ষ্য করেছে নিজের ঘর থেকে। তার মম ড্যাডের রুমের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে একটা অচেনা মেয়েকে। অবশ্য তাদের ঘরে প্রবেশ করানো হয়নি। বরং কিছুদিন আগে দুটো মেয়েকে এনে যেখানে রাখা হয়েছে সেখানেই এই মেয়েটাকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মেয়ে পাচার তাদের পারিবারিক ব্যাবসা। এটা রোজ গত একবছর ধরে জানে। কিন্তু এসব বিষয়ে কখনও সে মাথা ঘামায় না। সময় মতো তার হাতে মোটা অংকের একটা টাকা এলেই সে খুশি। কিছুদিন আগে তার মম বাংলাদেশে থাকাকালীন তার একটা এক্সিডেন্ট হয়। ড্রাংক অবস্থায় ড্রাইভ করতে গিয়ে গাড়ি এক্সিডেন্ট করে। একদম মরার দশা হয়েছিলো। তাই তার মমকে অতিদ্রুত ফিরে আসতে হয় এখানে। তারপর বেশ অনেকদিন তাকে নিয়েই পড়ে থাকে তার মম ড্যাড। বেশ অনেকদিক মেয়ে তুলে আনার কাজটা তারা বন্ধ রাখে। অবশেষে সে সুস্থ হবার পরে আবারও তারা শুরু করে এই কাজ। সবটা ভেবে রোজ আনমনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুম থেকে চলে যায়। তার আজ লেট নাইট পার্টি আছে। এসব ভেবে সময় নষ্ট করার মতো সময় তার নেই।
#কাছে_দূরে 🌸🥀
#muhtarizah_moumita
#পর্ব___৫৬
অন্ধকার ছিমছাম পরিবেশ। একটু দূরে দু’জন মানুষের নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ আসছে। অনেক্ষণ চারপাশটা নীরব থাকায় তাদের নিঃশ্বাসের শব্দ এখন বেশ স্পষ্ট ভাবেই কানে ভেসে আসছে। হীর চোখ মেলে তাকালো। পাশের দু’জনকে না দেখলেও মনেমনে ভেবে নিলো ওরা দু’জন তরী আর কিরনই হবে। নিঃশ্বাষ ফেলার ধরনে মনে হচ্ছে ওরা জেগে নেই। ঘুমচ্ছে। ঘুমচ্ছে মানে ওরা নিজেদের হুঁশে নেই। অজ্ঞান হয়ে আছে। হীর অন্ধকার হাতড়ে উঠে বসার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। তার হাত দুটো পেছন মুড়ে শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছে। পা দুটোরও একই অবস্থা। এমন অবস্থায় তরী আর কিরনের কাছে যাওয়া মুশকিল। তাই হীর নীচে পড়েই ‘তরী আপু,কিরন বলে ফিসফিসিয়ে ডাকতে লাগলো। অনেক্ষন ধরে ডাকার পরও তাদের কোনো উত্তর এলো না। হীর অধৈর্য্য হয়ে ডাকা বন্ধ করে দিলো। মনেমনে ভাবলো এভাবে তাদের হুঁশ ফেরানো যাবেনা। কারোর আসার অপেক্ষা করতে হবে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকার ভান করে দেখতে হবে ওদের সাথে কি কি হয়।
মিনিট দশেক পেরোতেই এদিকে কারোর পায়ের শব্দ ভেসে আসতে লাগলো এদিকে। হীর শব্দ পেয়ে সচেতন হয়ে গেলো। লোকগুলো ওকে যেভাবে ফেলে রেখে গেছে সেভাবেই পড়ে রইলো। বাইরে থেকে তালা খুলে দু’জন লোক ভেতরে প্রবেশ করলো। একটা লোক ঘরের কোনাকুনি চলে গিয়ে লাইট অন করে দিলো। আর মুহুর্তেই ফকফকা হয়ে উঠলো রুম। হীর ঢোক গিলে চোখ জোড়া পিটপিট করে খুলল। লোক দুটো তরী আর কিরনের মুখে পানি ছিটাচ্ছে। হয়তো জ্ঞান ফেরাচ্ছে। মুখের উপর পানির ছিটে পড়তেই ধড়ফড়িয়ে উঠলো কিরন আর তরী। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকাতেই লোকদুটো বিকৃত হাসলো। তরীর গালে হাত বুলিয়ে বলল,
—-‘ ঘুম ভাঙল সুন্দরী? এবার যে খেতে হবে। দয়াকরে খেয়ে নাও কেমন। কাল রাতে তো তোমাদের দু’জনকে পাচার করে দেওয়া হবে৷ তারপর আর জানা নেই তোমাদের সাথে কি কি হবে? আমাদের মতো এতো আদর করে কেউ খাওয়াতে আসবে কি না!’
লোকটার ছোঁয়ায় ঘৃনায় মুড়িয়ে গেলো তরীর মুখ। লোকটার ছোঁয়া থেকে বাঁচতে মুখ ঘুরিয়ে নিলো অন্যদিকে। রাগে ঘেন্নায় তরীর শরীর কাঁপছে। না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে কি করতে! পাশের লোকটা একই আচরন করলো কিরনের সাথে। কিরনের চোখে জল টলমল করে ভাসছে। দেয়ালের বুকে মিশে গিয়ে লোকটার আপত্তিকর ছোঁয়া থেকে বাঁচার আপ্রান চেষ্টা করছে। হীর সবটা পর্যবেক্ষণ করছে। তার মনটা বিষিয়ে উঠলো লোক দুটোর আচরনে। ইচ্ছে করলো যে দড়ি দিয়ে তাকে বাঁধা হয়েছে সেই দড়ি দিয়েই দুটোকে একসাথে ফাস চড়াতে। কিন্তু এই মুহুর্তে এসব সহ্য করা ছাড়া আর যে কিছু করারও নেই।
কিরনের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তেই লোকটা আফসোস করে বলল,
—-‘ আহারে। দেখ না বেচারি কাঁদছে। খুব কষ্ট হচ্ছে সুন্দরী? তোমরা বলো তো তোমাদের আমরা এখান থেকে বের করে নিতে পারি। তবে একটা শর্ত আছে-
এই বলে লোকটা বিকৃত হেসে পাশের লোকটার দিকে তাকালো। দু’জন মিলে চোখ দিয়ে ইশারা করে বিকৃত ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে বলল,
—-‘ যদি তোমরা আমাদের সাথে কিছু সময় থাকতে রাজি হও। আরে বুঝছো না কেন মজাই হবে! কি থাকবে নাকি?’
লোক দুটোর কথায় গায়ে কাটা ফুটলো যেন হীরের। নিজেকে কিছুতেই সামলে রাখতে পারছেনা।
লোকদুটো কিরন আর তরীর দিকে এগিয়ে যেতেই দুজনে একই সাথে মুখ ভর্তি থুথু ছুঁড়ে দিলো তাদের মুখে। তরী আর কিরনের এমন কাজে ক্ষেপে গেলো লোকদুটো। দু’জনেই একসাথে উঠে গলা চেপে ধরলো তাদের দু’জনের। তরী আর কিরন অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে মুখ বুঝে রইলো স্রেফ। লোকদুটো না পেরে তাদের গলা ছেড়ে শার্টের বোতামে হাত দিলো। গায়ে তাদের ইউনিফর্মের শার্ট। দু’জনেই আগাম বিপদের আভাস পেয়ে চাপা স্বরে আর্তনাদ করে উঠলো। হীরের মাথার রক্ত ছিটকে বেরিয়ে এলো যেন। তরী চোখের জল ছেড়ে দিয়ে কন্ঠে বলল,
—-‘ দয়াকরে আমাদের এতবড় সর্বনাশ করবেন না! প্লিজ-
কিরন কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,
—-‘ যত টর্চার করার করুন কিন্তু আমাদের সম্মান এভাবে নষ্ট করবেন না ভাই। প্লিজ! রিকোয়েস্ট করছি। আপনারা দরকার হয় আমাদের মেরে ফেলুন! কিন্তু এটা করবেন না। ভাই প্লিজ-
—-‘ ঐ মা** চুপ কর। শুধু স্যারের অর্ডার আছে বলে আজ তোরা বেঁচে গেলি। নয়তো আজই তোদের শেষ দিন হতো!’
কথা গুলো বলে ছেড়ে দিলো দু’জনকে। হাতের বাঁধন পেছন থেকে খুলে দিয়ে খাবার ঠেলে খেতে বলে তারা বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। লোকদুটো সামনে থেকে সরে যেতেই একটু দূরে অচেতন অবস্থায় অপ্রত্যাশিত কাউকে পড়ে থাকতে দেখে আতংকে কেঁপে উঠলো তরী আর কিরন। তরী দেয়ালের বুকে সিঁটিয়ে গিয়ে দুর্বল কন্ঠে বলল,
—-‘ হীর!’
কিরন বারকয়েক ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
—-‘ হীর এখানে কি করে এলো? ম…ম্যাম তবে কি সবাব স্যার মালয়েশিয়া এসে গেছেন?’
তরী দুর্বল চোখে চেয়েই রইলো হীরের দিকে। কিরনের উদ্দেশ্যে কি বলবে কোনো জবাব খুঁজে পেলো না!
হীর যখন নিশ্চিত হলো লোকদুটো বাইরে বেরিয়ে গেছে তখন ধীরেধীরে চোখ খুলে তাকালো। নীচে পড়ে থেকেই চারোপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো। এখান থেকে এই দু’জনকে বের করার মাধ্যম কি? আগে তরী আর কিরনকে এই নরক থেকে বের করতে হবে। তারপর ওদের দু’জনের ইন্সট্রাকশন নিয়েই সাবাব তার কাছে পৌঁছোতে পারবে।
হীরকে চোখ খুলে চারাপাশে দেখতে দেখে কিরন মৃদুস্বরে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
—-‘ ম্যাম হীরের তো সেন্স আছে!’
কিরনের কথা শুনে তরীও তড়িঘড়ি তাকালো হীরের দিকে। কিরনের মৃদু চিৎকার হীরের কানে আসতেই হীর চটজলদি চোখ বুঁজে নিল। পুনরায় অচেতন হওয়ার ভান করে পড়ে রইলো। কিরনের আওয়াজ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদুটোর কানেও পৌঁছেছে। কিন্তু স্পষ্ট ভাবে তারা কিছুই শোনেনি। তারা দু’জন হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে এসে তাদের সামনে দাঁড়ালো। কিরনের চেঁচানোর কারন বোঝার জন্য বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠে বলল,
—-‘ কি হচ্ছে কি এখানে? চিৎকার করছিস কেন?’
লোক দুটোর উপস্থিতিতে ভড়কে গেলো তরী আর কিরন। কিরন উত্তেজনার বসে এভাবে চেঁচিয়ে উঠবে সেটা তার কল্পনাতীত ছিলো। মাথায়ও আসেনি এমন কিছু। এখন ভয়ে চুপসে যাওয়া ছাড়া আর পথ নেই।
একটা লোক তরীর মুখ চেপে ধরলো। খ্যাকখ্যাক করে বলল,
—-‘ কি হলো এখন চুপ করে আছিস কেন দুটিতে? বল কেন চেঁচালি?’
তরী লোকটার ছোঁয়া থেকে বাঁচার জন্য দেয়ালের বুকে সিঁটিয়ে যাচ্ছে। দু’হাতে টেনে লোকটার হাত সরাতে চেষ্টা করছে। আর দুর্বল কন্ঠে বলার চেষ্টা করছে,
—-‘ জল! জল দেননি!’
পাশের লোকটা ওদের জন্য দেওয়া খাবারের দিকে তাকিয়ে দেখলো আজকে খাবারের সাথে জল দেওয়া হয়নি। তাই যে লোকটা তরীর মুখ চেপে ধরলো তার পিঠ চাপড়ে বিরক্তিভরা কন্ঠে বলল,
—-‘ আরে ছেড়ে দে। ওদের তো জল দিতেই ভুলে গেছি। জলের জন্য হয়তো চেঁচিয়েছে। আয়।’
দ্বিতীয় লোকটার কথায় প্রথম লোকটা তরীর মুখ ছেড়ে দিয়ে খাবারের দিকে তাকালো। অতঃপর দ্বিতীয় লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল,
—-‘ খাবার দেওয়ার সময় দেখবি না?’
দ্বিতীয় লোকটা কপাল কুঁচকে বেরিয়ে গেলো। প্রথম লোকটাও তার পেছন পেছন গেলো। তরী থরথর করে কাঁপছে। পাশ থেকে কিরন তরীকে জড়িয়ে ধরে কান্না জড়ানো কন্ঠে বলল,
—-‘ আম সরি ম্যাম! আমার জন্য আপনাকে এসব সহ্য করতে হলো! আম সরি!’
তরী কিরনের মাথায় হাত রেখে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
—-‘ কেঁদো না কিরন! বিপদে যখন পড়েছি তখন ভেঙে পড়লে চলবে না। সব সহ্য করে এখান থেকে বের হওয়ার পরিকল্পনা করতে হবে। আর পরিকল্পনা করার জন্য তো আমাদের স্ট্রং থাকতে হবে তাই না? আর তার জন্য খেতে হবে। আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শুরু করো।’
কিরন সোজা হয়ে বসে চোখ মুছলো। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে খাবার তুলে খেতে শুরু করল। তরী মুখে খাবার তুলে চিবোতে চিবোতে আঁড়চোখে দেখতে লাগলো হীরকে। হীর ইচ্ছে করে অচেতন হওয়ার নাটক করছে। হয়তো এদের হাতে ধরা পড়বে না বলে। নয়তো অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে হীরের। হীরকে এখানে তুলে আনার উদ্দেশ্য কি? মেরে ফেলা? সেটা তো মনির সবসময়ের প্ল্যান ছিলো। কিন্তু এখানে আসার পর থেকে আর এই কথা মনে হয়নি যে মনি হীরকে মেরে ফেলতে চায়। মনে হয়েছে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। আর মনির হাজবেন্ড রেজা! উনাকে দেখলেই ভয়ংকর কিছু ঘটে যাওয়ার আভাস পাওয়া যায়। উনাকে দেখলেই মনে হয় কোনো ভয়ানক হিংস্র প্রানী লোকটা। যার শরীরে কোনো মানুষের বৈশিষ্ট্য নেই। এই তো গত দু’দিন আগে তাকে আর কিরন কে যখন কিডন্যাপ করে নিয়ে আসা হয় তখন এই ঘরটা অল্প বয়সী মেয়েদের দিয়ে ভরপুর ছিলো। কি অস্বাভিক অত্যাচারে ঝনঝন করে কাঁপছিলো ঘরটা! মেয়েগুলোর আত্নচিৎকারে রুহুটা যেন ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছিলো। তার ঘন্টাখানেক পরেই তাদের নিয়ে যাওয়া হয় পাচার করার উদ্দেশ্য। গত আঠারো ঘন্টা যাবত আর কাউকে নিয়ে আসা হয়নি এ-ঘরে। হয়তো তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য হাসিল না হওয়া অব্দি আর কাউকে আনবেওনা। ক’টা দিন এখন তারা নীরব থাকবে। তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য সফল করার জন্য।
—-‘ এই নে জল। খেয়ে উদ্ধার কর।’
আচমকা পুরুষালী কন্ঠে কেঁপে উঠল ঘরময়। কিরন চমকে উঠে তরীর হাত চেপে ধরতেই তরী আলতো করে কিরনের হাতের উপর হাত রাখলো। চোখের ইশারায় ভয় পেতে বারন করে খাওয়ায় মন দিতে বলল। কিরন পূনরায় খেতে আরম্ভ করে। খাওয়া শেষ হওয়া অব্দি লোকটা তাদের সম্মুখ থেকে নড়ল না। খাওয়া শেষ হতেই পূনরায় দু’জনকে বেঁধে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা লক করে দিয়ে চলে গেলো। তারা চলে যেতেই তরী সাবধানী কন্ঠে হীরকে ডাকলো। কিরন সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হীরের দিকে। তরীর ডাক হীরের কান অব্দি ভেসে আসতেই হীর চোখ খুলে তাকালো। হীরকে তাকাতে দেখে তরী আর কিরন খুশির জোয়ারে ভাসতে লাগলো। কিরন তরীর দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
—-‘ ম্যাম, হীর চোখ খুলেছে।’
তরীও একই অনুভূতি মৃদুহেসে বলল,
—-‘ হ্যাঁ গো। হীর? তুমি ঠিকাছো?’
হীর তরী আর কিরনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
—-‘ আমি একদম ঠিকাছি তরী আপু। কিন্তু ওরা তো তোমাদের উপর খুব অত্যাচার করছে! তোমরা এসব মুখ বুঝে কেন সহ্য করছো? তোমরা তো সাধারণ মানুষ নও! যে কেউ তোমাদের উপর এট্যাক করলো আর তোমরা মুখ বুঝে সব সহ্য করে নিলে!’
তরী অসহায় চোখে নিজেকে একবার দেখলো। করুন কন্ঠে বলল,
—-‘ সরাসরি মৃত্যু সে হয় এক কথা। কিন্তু মেয়েদের সবচেয়ে বড় সম্মানটা যখন বারবার খোয়ানোর একটা ভয় ঢুকে যায় না তখন না পেরে সবটা মুখ বুঝে সহ্য করতে হয়! ওরা আমাদের উপর টর্চার করছে সে অন্য কথা কিন্তু ওরা বারবার আমাদের সম্মানের উপর হাত দিচ্ছে। আমরা চাইলেও বাঁধা দিতে পারি না! যখনই ভাবি ওদের উপর পাল্টা আঘাত করবো তখনই মনে হয় এখানে শতশত শকুন আমাদের শরীরটা ছিঁড়ে খাওয়ার অপেক্ষায় আছে। ভয়েও পাল্টা আঘাত করার কথা ভাবতে পারিনা। জানিনা কিভাবে এখান থেকে বের হবো। মনে হচ্ছে না আর কখনও বের হতে পারবো কি না!’
তরীর কথা শুনে হীর কঠোর গলায় বলল,
—-‘ অবশ্যই পারবে বের হতে। আমার বোনদের আমি এখান থেকে বের করবোই। তোমরা চিন্তা করোনা তরী আপু। এবার ওদের উল্টো সময় গোনা শুরু হয়েছে। ওদের এই সাম্রাজ্য এবার আমি এক এক করে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিবো।’
হীরের এমন কথায় হোঁচট খেলো যেন তরী আর কিরন। এটা হীরের কোন রূপ!
কিরন অবাক কন্ঠে বলল,
—-‘ হীর! তুমি এসব কি বলছো?’
হীর বাঁকা হেসে বলল,
—-‘ ওদের বিনাশ। আমার হাতেই ঘটবে।’
বুকের ভেতর কেঁপে উঠলো তরী আর কিরনের। দু’জনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে হীরের দিকে তাকাতেই দেখলো হীর পূনরায় চোখ বুঁজে নিয়েছে। তরী দম বন্ধ করে কিরনের উদ্দেশ্যে বলল,
—-‘ কিরন, কি হতে যাচ্ছে বলো তো?’
কিরন ঢোক গিলে বলল,
—-‘ জানিনা ম্যাম।’
________________
ঘন্টা খানিক সময় অতিবাহিত হতেই দু’জন লোক এসে হীরকে অন্য একটা রুমে নিয়ে গেলো। হীর তখনও অচেতন হওয়ার নাটক করে সবটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছিলো। তরী আর কিরন চুপচাপ দেখল সবটা। হীরকে বের করে নিয়ে তাদের দরজা আগের মতোই লক করে রেখে দিয়ে গেলো। তরীদের রাখা রুমটা থেকে পরপর দুটো রুম পেরোতেই সাজানো গোছানো ছোট্ট একটা রুম। হীরকে সেই ঘরে নিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসানো হলো। অতঃপর হাতে পায়ের দড়ি খুলে পূনরায় দড়ি দিয়ে চেয়ারের সাথে বাঁধলো। বাঁধা শেষে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে এক গ্লাস জল এনে হীরের মুখের উপর ছুঁড়ে মারলো। হীর আঁতকে উঠে চোখ মেলে তাকালো। হীর চোখ খুলতে লোক দুটো চোখে চোখে ইশারা করে বাইরে বেরিয়ে যেতে নিলেই হীর ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
—-‘ আ..আমি কোথায়? আমি কোথায়? তোমরা কারা? আমাকে এভাবে বেঁধেছো কেন? তোমরা কোথায় যাচ্ছো?’
কথা গুলো বলতে বলতে হীর বাঁকা হাসলো। হীরের একাধারে প্রশ্ন শুনে দাঁড়িয়ে গেলো লোকদুটো। তাদের দাঁড়িয়ে যেতে দেখে হীর হাসি মাখা মুখটা নিমিষেই মলিন করে নিয়ে কাঁদো কাঁদো ভাব করে আবারও বলে উঠলো,
—-‘ সাবাবা! সাবাব কোথায়? তোমরা কারা?’
হীরের নাটকীয় মুখ ধরতে পারলোনা লোকদুটো। পেছন মুড়ে বিকৃত হেসে বলল,
—-‘ মরন দুয়ারে এসে পড়েছো পাখি। মৃত্যুর জন্য তৈরি হও।’
হীরের মুখ শুঁকিয়ে গেলো। ঢোক গিলে ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
—-‘ ক..ককিহ্ কি বলছো এসব? তোমরা কারা?’
লোকটদুটো হাসতে হাসতে বলল,
—-” আমরা তোর জম।’
এই বলে বেরিয়ে গেলো তারা। হীর তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। তারা যেন শুনতে পায় সেরকম করে অসহায় কন্ঠে বলতে লাগল,
—-‘ আমাকে ছেড়ে দাও! আমাকে যেতে দাও! আমি আমার হাজবেন্ডের কাছে যেতে চাই। তোমরা শুনতে পাচ্ছো? ছেড়ে দাও আমায়।’
#চলব___
[