কাঠগোলাপের সাদার মায়ায়
পর্ব-৬
আমি বাড়ি ফিরলাম বিকেলের পর। ঘরে ঢুকতেই মা বললেন নিলয় নাকি আমাকে দুইবার খুঁজে গেছে। আমার হঠাৎ ই কেন যেন ভয় লাগতে শুরু করলো। এই ভয় টা সারাদিন ছিলো না কিন্তু যখন শুনলাম নিলয় আমাকে খুঁজছে তখনই মনে হলো সামনে আমার জন্য খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে। যত সময় যেতে লাগলো ভয় তত বাড়তে লাগলো। এখন আমার মনে হলো যে আমি একটু বেশী বাড়াবাড়ি করে ফেলছি। এতোটা বাড়াবাড়িও বোধ হয় করা উচিত হয় নি।
নিলয় তৃতীয়বার আমায় ডেকে পাঠালো ছাদে। ডাকতে আন্টিকেই পাঠালো। আন্টি ডাকতে এলে মা কেমন যেন একটু ত্যড়া চোখে তাকিয়ে দেখছিল। মায়ের অবশ্য আগে থেকেই কিছুটা সন্দেহ হয়েছিল। যাইহোক আমি অবশ্য ওসবে নজর দেয়ার অবস্থায় ছিলাম না। ভয়ে হাত, পা ঠান্ডা হয়ে জ্বর আসার মতো অবস্থা তখন। টলমল পায়ে একেকটা সিড়ি ভেঙে ছাদের দিকে যাচ্ছি।
নিলয় রেলিঙের উপর সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমার পায়ের শব্দে একবার পিছু ফিরে তাকালো। তারপর বলল,
“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। ”
আমার ভয় আরও বেড়ে গেল। যদিও কথা বলছে স্বাভাবিক গলায় তবুও আমার এতো ভয় লাগছে!
কিছু সময় থেমে থেকে আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমার সমস্যা কী প্রত্যাশা? আমি কী তোমার ক্ষতি করেছি?”
আমি জবাব দিতে পারলাম না। কী ই বা বলব ওকে। মাথানিচু করে বসে রইলাম। নিলয় আবারও বলল,
“দয়া করে চুপ করে থেকো না। আনসার মি। ”
আমার চোখে পানি এসে গেল। নিলয়ের গলার স্বর আগের মতো নেই। কথাগুলো রুক্ষ গলায় বলছে।
“তুমি আমার কী ক্ষতি করেছ জানো?”
“ওই মেয়েটা কী সত্যিই আপনার গার্লফ্রেন্ড?”
নিলয়ের চোয়াল শক্ত হলো। বলল, এই কথার জবাব তো আমি তোমাকে দেব ই না। তুমি শুধু এটা বলো যে কেন করেছ এটা?”
আমি বুকভরে নিঃশ্বাস নিলাম। ভুল যেহেতু আমার তাই সব টা মাথা পেতে নেবার জন্য প্রস্তুত হলাম।
“তুমি কী আমার কথার জবার দেবে না?”
“আই এ্যাম সরি।”
নিলয় শ্লেষের সুরে বলল, তোমার সরি দিয়ে কিচ্ছু হবে না আমার। তুমি আমার বান্ধবীকে কী বলেছ! তোমার আর আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে? সিরিয়াসলি! এতো টা চিপ তুমি সেটা আমি ভাবতেও পারিনি।
এইসব কথা শুনে যাওয়া ছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই। নিজের পক্ষে যে কিছু একটা বলব সেটারও কোনো অপশন রাখিনি।
নিলয় বলেই যেতে লাগলো।
“প্রথম দিন থেকে তোমার কর্মকান্ডগুলো আমি দেখছি। ভেবেছি প্রশ্রয় না দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তুমি কী করলে! আঠার মতো পিছে লেগে রইলে।
আচ্ছা আমি যে তোমাকে ইগ্নোর করছি এইটুকু বোঝার মতো গিলু তোমার মাথায় নেই?
“আপনাকে তো সরি বলছি। তাতে কী হবে না? পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে হবে?”
নিলয় তীর্যক হেসে বলল, তুমি সেটাও পারবে জানি। যতটুকু চিনেছি তাতে বুঝেছি যে আত্মসম্মান নামক কোনো কিছু তোমার মধ্যে নেই। তাছাড়া তুমি যে আমার বান্ধবীকে অপমান করেছ, একবারও কী ভেবেছ যে তাকে অপমান করার যোগ্যতা তোমার আছে কী না?
তোমাকে আর কী বলব! তুমি হয়তো এর আগেও অনেক ভাড়াটিয়াদেরও পায়েশ বানিয়ে খাইয়েছ? তাদের সাথেও নিশ্চয়ই….
বাকীটা বলতে পারলো না কারণ ততক্ষণে আমি হাপুস নয়নে কাঁদতে শুরু করেছি।
আমি চোখ মুছে বললাম, দয়া করে এই ব্যপার টা আমার বাবার কাছে বলবেন না। আর আমি আপনার সামনে আসব না।
কথাগুলো বলে আমি নিচে চলে এলাম। ভাগ্য ভালো ছিলো যে মা আর আন্টির সামনে পড়লাম না। নাহলে তারাও আমাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ফেলতো।
***
আমি নিলয়কে ফেসবুকে ব্লক করলাম। ফেসবুক থেকে যে ছবিগুলো সেভ করে রাখছিলাম সেগুলোও ডিলিট করে দিছি। নিলয়ের কথাগুলো তিক্ত হলেও সত্যি যে আত্মসম্মান খুইয়ে নিলয়ের পিছনে ছুটছিলাম। তাই নিলয় নামক অধ্যায় টা বাদ দেয়ার জন্য পণ করলাম। চেষ্টা করলাম স্বাভাবিক হতে৷
নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য ক্লাস না থাকলেও কলেজে গিয়ে বসে থাকতাম। অনেক টা সময় লাইব্রেরীতে বই পড়ে কাটাতে লাগলাম। ইদানীং কথাবার্তাও কম বলতে চেষ্টা করছি। মা, ভাইয়া আমার এই পরিবর্তন টা লক্ষ্য করেছে৷ ভাইয়া একদিন ডেকে জিজ্ঞেস করলো, কোনো সমস্যা আছে কী না। মোট কথা ইনিয়ে বিনিয়ে জিজ্ঞেস করলো যে প্রেম, টেম আছে কী না। আমি আশ্বস্ত করে বললাম যে আমি ঠিক আছি। জানি না তারা কতটুকু বিশ্বাস করেছে। কিন্তু আমি ঠিক থাকতে চাই।
***
এক বিকেলে আন্টি এসে মায়ের কাছে অভিযোগ করলো আমি কেন আর আগের মতো তার সাথে গল্প করতে যাচ্ছি না?
মা আমাকে ডেকে আন্টির হাতে ধরিয়ে দিলো। আন্টি তার কথার ঝুড়ি নিয়ে আমার সামনে বসলেন। আমি চুপচাপ শুনতে লাগলাম। আন্টি কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলেন, কেন যাই না? নিলয় কিছু বলেছে কী না!
আমি এড়িয়ে যাই। হঠাৎ মনে হলো নিলয়ের কাঠগোলাপ গাছ টা ফিরিয়ে দেয়া উচিত। আন্টিকে ফিরিয়ে দিলে সে অবাক গলায় বলল, তোমার কী হইছে প্রত্যাশা? নিলয় অইদিন ছাদে তোমারে কিছু বলছিল? তারপর থেকে তুমি আর যাও না আমার কাছে?
আমি হেসে বললাম, না আন্টি। আসলে ওই যে বলছিলাম না কিছু সাবজেক্টে আমার দূর্বলতা আছে। সেগুলোর জন্য এক্সক্লুসিভ নোটস দিয়েছে।
আন্টি সরলমনে বিশ্বাস করলেন। আবারও ছেলের গুনকীর্তন শুরু করলেন। আমি চুপচাপ শুনে গেলাম। আন্টির নিশ্চয়ই বলতে পেরে অনেক ভালো লাগে, তাই যতক্ষণ থাকলেন ততক্ষণ শুধু ছেলের সুনাম ই করলেন।
যাওয়ার সময়ে বলে গেলেন, প্রত্যাশা শোনো, সামনের সপ্তাহে নিলুর বন্ধুরা আসবে। এখানে নাকি ঘুরতে আসবে।
আমি আস্তে করে বললাম, আচ্ছা।
আন্টি কাঠগোলাপ গাছ নিয়ে চলে গেলেন। যদিও নিতে চায় নি। আমি বলেছি যে আন্টি আমি নিজেই নিজের ঠিকঠাক যত্ন নিতে পারি না। কাঠগোলাপ গাছের যত্ন কী করে নেব বলুন।
আন্টি হাসলেন।
**
এর পরের দিন আন্টি কাঠগোলাপ গাছ সমেত ফেরত এলেন। বললেন,
“নিলু বলছে এটা তোমাকে যখন দিয়েছে তখন আর ফেরত নেবে না। তাই নিয়ে এলাম। ”
আমি কিছু বললাম না। মা ওখানে বসা ছিলো তাই কথা আর এগোয় নি। তবে মা জেরা করেছেন ঘটনা জানার জন্য। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা’কে বললাম যে আমি নিলয়কে ক্ষ্যাপিয়েছি বলে নিলয় আমাকে কথা শুনিয়েছে। বিস্তারিত কিছু বলি নি অবশ্য। মা এরপর আর কিছু জিজ্ঞেস করে নি, শুধু বলেছে কথা বলিস না তো ওই ছেলের সাথে। পড়াশুনোয় ভালো বলে একটু বেশীই দেমাগ। দেখলি না সেদিন কীভাবে তোর বাবাকে নালিশ করলো।
আমি শুধু হাসলাম। মনে মনে বললাম, মা তোমার মেয়ে কী করেছে সেটা জানলে আর এই কথাগুলো বলতে পারতে না।
***
দুই তিনদিন পরের ঘটনা। আমি বাসা থেকে কলেজের উদ্দেশ্য বের হবার পর পর শুরু হলো বৃষ্টি। এমন একটা জায়গায় বৃষ্টি শুরু হলো যেখানে রিকশা পাওয়াও মুশকিল। ভেজার ভয়ে দৌড়ে দোকানের ছাউনিতে যাবার সময় জুতোটা গেল ছিড়ে। ছেড়া জুতা পরে হাটতে গিয়ে বেকায়দায় পা কেটে গেল। এদিকে ভিজে অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় কলেজে যাওয়াও সম্ভব না। বাসায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম মনে মনে। কিন্তু বাসায় ফিরতে হলেও রিকশা নিতে হবে তাই অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ দেখি একটা রিকশা এসে থামলো। নিলয় সেই রিকশা থেকে নেমে আমাকে বলল,
“প্রত্যাশা বাসায় যাবে? তাহলে রিকশায় উঠে পড়ো। ”
“ইটস ওকে। আমি ম্যানেজ করতে পারব। ”
“আকাশের অবস্থা ভালো না। বৃষ্টি সহজে থামবে বলে মনে হয় না। ”
“আমার সমস্যা নেই এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে। ”
নিলয় আমার পায়ের দিকে তাকালো। আঙুল থেকে এখনো চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। সেটা দেখে বলল, ঠিক আছে তুমি একাই রিকশায় যাও। আমি তোমার সাথে যাব না।
আমি বললাম, আমি বাসায় যাব না। কলেজে যাব। এই বলে বৃষ্টির মধ্যেই খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটতে শুরু করলাম।
নিলয় সম্ভবত পলকহীন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো!
চলবে….