#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-১৯
মৈত্রী কাল রাতে প্রথমবার তার বাবার সামনে দাঁড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল। মুজিব সাহেব মেয়ের জড়তা কে-টে-ছে বুঝতে পেরেই মনে মনে ভীষণ খুশি হলেন। কতগুলো বছর পর দেখলেন মেয়ের চোখে পানি! মনে পড়ে না মৈত্রী কবে শেষবার হেসেছিল, কবে কেঁদেছিল আর এ নিয়েই তো লোকে বলে, আপনার মেয়ে স্বাভাবিক নয়। কে বলবে আর এমন এই যে, তার মেয়ে কত হাসছে। তার মেয়ে অস্বাভাবিক নয় সে মুখচো-রা কেউ কেন বুঝতে পারে না! মৈত্রী বাবার সাথে কথা বলে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে নিজের ঘরে ফেরে। বিছানায় গা এলিয়ে চোখ বুঝতেই চোখে ভাসে বিড়ালচোখা মানুষটির প্রথমবার দেখা মুখটা। তখনও বিশ্বাস হচ্ছিলো না সন্ধ্যায় কি ঘটে গেল! নোরা বলছিলো প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত মৈত্রী বুঝে পায় না প্রতিক্রিয়া করাটাই কি সব? মৈত্রী এও জানে তাকে সবাই মানসিকভাবে অ-সু-স্থ ভাবে। রাতভর ঘুম এলো না চোখে তার। ঠিক ভোরেই কানে এসেছে সেই পুরনো টিয়া দম্পতির কলরব৷ তা শুনে আর বিছানায় থাকতে পারেনি মৈত্রী। সে এলোমেলো হয়েই বেলকোনিতে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকটা সময় তারপরই চোখের কোণে স্পষ্ট হয় নিচ তলার বেলকোনিতে মানুষটা। না চাইতেও ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় মৈত্রী। কয়েক সেকেন্ড তারপরই ওপাশের মানুষটি কেমন ফ্যাকাশে হাসলো আবার প্রশ্নও করলো, কি হয়েছে?
আকস্মিক এমন প্রশ্নে জবাব দিতেও ভুলে গেছে মৈত্রী। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল তা দেখে ইরশাদই বোকা বনে গেল। চারপাশে কুয়াশার মেঘের মতন ভেসে বেড়ানো, আর বাতাসে কাঁ-টা-র মত শীত গায়ে বাঁধছিল। নতুন সকাল, নতুন সম্পর্কের উদ্বোধন তাদের এমনই হতচকিত করে হলো।উহুম, উদ্বোধন শব্দটা বোধহয় ঠিকঠাক হলো না। নতুন সূচনা বললেই বেশ লাগবে। মৈত্রী বিনা জবাবেই বেলকোনি ছেড়ে চলে গেল। ইরশাদ তখনও বোকার মত তাকিয়ে ছিলো সেদিকে। নোরা আবারও ঘুমাবে বলে রুমে ঢুকেও তার ঘুমও হলো না। সে টি শার্ট আর লেগিংসের ওপরই শাল জড়িয়ে এলো ইরশাদের ঘরে। দরজা খোলা, বিছানা খালি দেখেই সে বুঝতে পারলো ব্রো বেলকোনিতে আছে৷
“রাতটা সবে পার হয়েছে ব্রো এখনই নজর ফেলে বসে আছো?”
পেছনে ফিরে ইরশাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো নোরার দিকে। মুখ গম্ভীর করে বলল, “এদিকে আয় বোন তোকেই তো খুঁজছিলাম। সত্যি করে বলতো এমন মগজ ধোলাই কেন করলি?”
নোরা থতমত খেয়ে গেছে এই প্রশ্নে। এত কাঁচা কাজ সে আগে কখনো করেনি। সাইকোলজির পড়াশোনায় তার প্রশংসায় বরাবরই পঞ্চমুখ তার প্রফেসররা। তার এডুকেশন শেষ না হতেই সে অনেকরকম প্রয়াকটিসিংয়ে জড়িয়ে ছিল। এবারও দেশে আসার আগে তার প্রফেসর হেনরির এক পেশেন্টের সামনে বসে সে কিছু ট্রিকস ট্রাই করেছিল অবশ্যই তা প্রফেসরের অনুমতি সাপেক্ষে ছিল কিন্তু সেখানে তার যথেষ্ট উন্নতি দেখেছে হেনরি। এরপরও কয়েকটা ডিপ্রেশনের পেশেন্টকে ডিল করেছিল। তবে এমন মগজ ধোলাই ব্যপারটা সে দেশে এসেই প্রথম করলো ইরশাদের৷ শাদ ব্রো’র ডি-প্রে-শন নেই এখন তবে সে মানসিকভাবে কোন সম্পর্কে জড়ানোর জন্যও প্রস্তুত ছিলো না। নোরা কথা বলেছিল প্রফেসরের সাথে তিনি সব শুনে বলেছিলেন, “তোমাকে দুজন মানুষের ভেতরকার নিস্তব্ধতাকে কথার জালেই বের করে আনতে হবে। দুজনের সমস্যা এক নয় তোমাকে প্রতি স্টেপ খুব ভেবে চিন্তে নিতে হবে।”
নোরা তাই করেছে; শুধুমাত্র কথাতেই বের করেছে মৈত্রীর অনুভূতিদের কিন্তু ইরশাদকে নিয়ে তার পরিশ্রম হয়নি একটুও। শুধু ভগ্ন হৃদয়কে একটু খুঁ-চি-য়ে দিতে হয়েছে এই যা! তারপরের উপলব্ধি ইরশাদের নিজের ছিল। সে নিজের মত মৈত্রীর কষ্ট হয়তো উপলব্ধি করেই আকস্মিক এমন সিদ্ধান্ত নিলো। ইরশাদ নোরার জবাবের অপেক্ষায় চেয়ে থেকেও জবাব না পেয়ে আবার ডাকলো, “কি হলো?”
“ভাবছি।”
“কি ভাবছো?”
“মৈত্রী কতোটা লাকি!”
“সিরিয়াসলি! মৈত্রী লাকি?”
“অফ কোর্স ব্রো। শি ইজ আ লাকি গার্ল এন্ড ইউ অলসো লাকি ম্যান টু।”
“কিভাবে!”
“সে তার ভালোবাসার মানুষকে পেয়ে গেছে আর তুমি তাকে পেয়েছো যে তোমাকে ভালোবাসে।”
ইরশাদ শুনলো কিন্তু কিছু বলল না। এবার সে নিজেও ভাবনায় ডুব দিলো। কোন এক মহেন্দ্রক্ষণে সায়রা এমনই তো বলেছিল, আপন তাকে করো যে তোমাকে ভালোবাসে তুমি যাকে ভালোবাসো তাকে নয়।” কথাটা সায়রা যেমন বলেছিলো ঠিক তাই তো করেছে সে করেছে। উফ, প্রতিটি ক্ষণ কেন তাকেই মনে পড়তে হবে! অ-স-হ্যবোধ লাগছে এখন ইরশাদের নিজেরই৷ খিচুড়ি কতটুকু হলো চেক করার বাহানায় নিজের অভিব্যক্তি লুকাতেই চলে গেল ইরশাদ। নোরাও আন্দাজ করলো ভাইয়ের অবস্থা সেও চুপচাপ চলে গেল। আবারও কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়৷ চোখ বুঁজে লম্বা করে শ্বাস টেনে নিলো সে। যেন নিঃশ্বাসে ময়ূখের গায়ের ঘ্রাণকেও টেনে নিচ্ছে নিজের ভেতর। আজ প্রায় বারো দিন তার এ বাড়িতে অবস্থান। প্রথম রাতটা শুধু তারা ইরশাদের ঘরে ঘুমিয়েছিল তারপর থেকে সে এ ঘরে। এ বিছানা, বালাপোশ সবটাতেই যেন ময়ূখ মিশে আছে। নোরার জীবনে প্রেমিক পুরুষ তো কম আসেনি অথচ এই একটা পুরুষ তাকে আমূল বদলে দিয়েছে। বছর খানেক আগেও সে এসেছিল তখন থেকেই না ময়ূখ নামের ঝড় তাকে উথাল-পাতাল করে দিয়েছে৷ তার ব্রিটিশ মনকে কখন যে বাঙালিয়ানায় এক্সচেঞ্জ হয়ে এসেছে তা টের পায়নি নোরা। অথচ যখন বুঝলো নিজের মনের তোলপাড় তখন থেকেই তো কোন রাখঢাক ছাড়া সে কতবার বলেছে ময়ূখকে সে কথা। কিন্তু ছেলেটা সে কথাকে কানেই তোলেনি উল্টো হাসি ঠাট্টায় উড়িয়ে দিয়েছে। নোরা সেসব ভাবতে ভাবতেই আবারও ঘুমিয়ে পড়লো।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই স্কুলের জন্য চলে গিয়েছিলো মেহের। দুপুরে বাড়ি এসে ময়ূখের সাথে দেখা হয়নি। বিকেলে যখন মেহের ছাঁদে থাকা দোলনায় বসে দুলে দুলে পড়ছিলো তখন জরিনা খালা তার জন্য পাস্তা বানিয়ে নিয়ে এলো। কথায় কথায় সে জানিয়ে দিলো, “ইরশাদ মামার তো বিয়া ঠিক হইছে মেহের। আফায় নাকি এইবার ঢাহা(ঢাকা) আইবো। ছোট ভাইজানের লগেও মীমাংসা হইবো এইবার আমার মন কয়।”
“কি বললেন জরিনা খালা।”
মেহেরের হাত ফসকে বই পড়ে গেল। পা দিয়ে দোলনার দুলুনি থামিয়ে সে বিষ্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো জবাবের আশায়।ময়ূখ সবে বাড়ি ফিরেছে বাইরে থেকে। মেহেরকে খুঁজতে খুঁজতেই সে ছাঁদে এসেছিলো। জরিনার বলা কথা শুনতেই আত-ঙ্কিত বোধ করলো। মেহের যে অনেক আগেই তাকে জানিয়েছিল নিজের আবেগি মনের ভাবনা। ইরশাদ ভাইয়ের প্রতি তার বোনের কিশোরী ভাবনা কতোটা যে প্রকট তা ময়ূখের অজানা নয়। সে ইচ্ছে করেই দুপুরে বাড়ি ফেরেনি, বাবাকেও জানায়নি ভাইয়ের বাগদান সম্পর্কে। নিজেকেও তো সময় দেওয়ার ছিলো তার।
“জরিনা খালা আপনি নিচে যান তো।”
ময়ূখকে দেখেই জরিনা ছাঁদ থেকে নেমে গেল। ময়ূখ বোনের পাশে এসে দোলনায় বসে মাথায় হাত রাখলো। তার আবেগ নিয়ে কথা শুরু করার আগে সে কিছুক্ষণ পড়াশোনা নিয়ে কথা বলতে চাইলো। মেহের সুযোগ দিলো না উল্টো ভাইয়ের এক হাত জড়িয়ে কেঁ-দে ফেলল শব্দ করে। ময়ূখ ভাবছে কি বলবে সে? মেহের কি বলবে কিন্তু না মেহের কাঁদলো তো অনেকটা সময় কিন্তু কিছু বলল না। রাতে খাবার টেবিলেও পেলো না তাকে কেউ। অনেক রাত পর্যন্ত ময়ূখ পায়চারী করলো নিজের ঘরে৷ সে প্রাপ্তবয়স্ক অল্পতেই অনুভূতির করা-ঘাতে ভেঙে পড়বে না কিন্তু মেহের! চিন্তিত হলো ময়ূখ এবার। ঘর থেকে বেরিয়ে বোনকে একবার দেখার জন্য এগিয়ে গেল তার ঘরের কাছে। দরজায় নক করার জন্য হাত তুলতেই দেখলো ভেতরে বাতি জ্বলছে।
“মেহের ঘুমিয়ে পড়েছিস?”
কোন জবাব এলো না। ময়ূখ আরও কয়েকবার ডাকলো জবাব পেলো না। বাতি জ্বালিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে সে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াচ্ছিলো তখনই কানে গো-ঙা-নির আওয়াজ এলো। অবচেতন মন তাকে ঋ-ণা-ত্মক সংকেত দিতেই আ-ত-ঙ্কে দরজায় ধা-ক্কা-তে লাগলো ময়ূখ।
চলবে
(বাড়ির বাইরে থাকলে লেখালেখিটা মুশ-কিল খুব। গুণে গুণে ১০০০+ শব্দই লিখতে পেরেছি)