কি ছিলে আমার পর্ব – ১৮

#কি_ছিলে_আমার
-রূবাইবা মেহউইশ
পর্ব-১৮

রাত বারোটার প্রায় কাছাকাছি চলছে। নোরা বসে আছে এখনও মৈত্রীর ঘরে এমনকি আজ আর সে নিচে যাবে না বলে দিয়েছে ফুপিকে। রাতের খাবার ইরশাদ, ফখরুল সাহেব আর নোরা এখানেই খেয়েছে শুধু মাত্র ইরিন মাথাব্যথার বা-হা-না করে চলে গেছে না খেয়ে। রোকসানা অবশ্য অনেক ভেবে বাক্স ভর্তি খাবার দাবার পাঠিয়ে দিয়েছে ইরশাদদের ঘরে। ইরশাদ আর তার মা বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে মৈত্রী বসে আছে নিজের ঘরে। তার যেন নিজের মাঝে কোন চেতনাশক্তিই নেই। সেই যে বসেছে বেলকোনির মেঝেতে সেই বসাতেই শেলি এসে জোর করে চাদর জড়িয়ে দিয়েছে নোরা এসে শেলিকে দিয়ে মোটা কাঁথা দিতে বলেছে। শেলি কাঁথা দিতেই নোরা সেটা বেলকোনির মেঝেতে বিছিয়ে জোর করে সেখানে বসালো মৈত্রীকে। কয়েক মিনিট কেটে গেল নীরবতায়। শীতগন্ধী হাওয়ায় কোথা থেকে ভেসে এলো রজনীগন্ধার ঘ্রাণ। সে ঘ্রাণে আঁধার ঢাকা বেলকোনির নীরবতাকে ভেঙে নোরাই মুখ খুলল, “এভাবে স্ত-ব্ধ হয়ে আছো কেন মৈত্রী? তোমার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা উচিত আজকের জন্য।”

“কেমন ভাবে প্রকাশ করতে হয় প্রতিক্রিয়া!” অবুঝের মত জানতে চাইলো মৈত্রী৷

“মৈত্রী! স্যরি ভাবী। এখন থেকে ভাবীই বলবো তেমাকে। আমার ভাইকে তুমি সত্যিই ভালোবাসো তো?”

নোরার এই একটা প্রশ্নেই যেন মৈত্রীর চেতনা ফিরে এলো। ধীরে ধীরে তার ভেতরটা সরব হয়ে উঠলো সে ক্ষণে। এ কি হয়ে গেল এমনটা কেন হলো! ইরশাদই’বা কেন তার কথাগুলো শুনতেই তাকে নিয়ে এমন বাড়াবাড়ি করলো? বাবা কি তার ওপর রেগে আছে? মামী কি রাত করেই ঢাকা ফিরে গেল! আর ইরিন আন্টি, এক সঙ্গেই তিনি বা উনার পরিবার কি ভাবছে? মৈত্রীকে দেখে নোরা তার অভিজ্ঞ দৃষ্টি বলল, এটাই রিয়াকশন। ওকে এখন সুযোগ দিতে হবে নিজেকে আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরার। নোরা বলল, “আমি চলে যাচ্ছি ফুপির কাছেই আজ তোমার সাথে ঘুমাব বলে প্ল্যান তো করেছিলাম কিন্তু এখন মনে হচ্ছে নিচে যাওয়া উচিত।”

“না না থাকো তুমি, শেলি বিছানা ঠিক করে দে নোরা আপুকে।”

“নো, ইউ নিড স্পেস নাও। আমি কাল আসব তোমার কাছে৷ শেলি দরজা লাগিয়ে যাও এসে।” নোরা সত্যিই চলে গেল সে সময়। মৈত্রীর মনে হলো তার এখন বাবাকে দরকার। সন্ধ্যের পর যা হয়েছে সবটাতে মৈত্রী ঘোরে ছিল যেন। সে তো খেয়ালই করেনি বাবার অবস্থা, ইরশাদ কেন তার এক কথাতেই এত বড় স্টেপ নিলো! আর তাদের পরিবারই কেন এত সহজে মেনে নিলো সবটা? মৈত্রী এলোমেলো পায়ে গিয়ে দাঁড়ালো বাবার ঘরের দরজায়।

ময়ূখ কত কতবার কল করলো আম্মাকে তার হিসেব নেই। ভাইকে করেছে, বাবাকেও করেছে কেউ ফোন তোলেনি। কি হয়েছে সবার তার ফোন কি কেউ খেয়াল করেনি নাকি বাড়িতে কোন সমস্যা হলো! কয়েকটা ঘন্টা পেরিয়ে গেছে কেউ ফোন ধরেনি আর না কল ব্যাক করেছে৷ ভ-য়ে এবার হৃদয় কাঁপছে তার। হঠাৎই মনে হলো নোরাকে কল করছে না কেন? তাকেও কল করে দেখা যাক। ময়ূখ এবার নোরার নাম্বারে কল দিলো আর বিড়বিড় করে বলতে লাগল, “আল্লাহ! সব যেন ঠিক থাকে।”

নোরা মাত্রই এসে ঘরে ঢুকেছে। ইরশাদ বাড়ি নেই আজ, কোথায় গেছে তাও জানা নেই৷ ইরিন সোফায় কুশনে মাথা রেখে আধশোয়া হয়ে আছে কপালে হাত ফেলে। নোরার মনে হলো এখন ফুপিকে একা ছেড়ে দেওয়াই ভালো। সে ময়ূখের ঘরে বর্তমান যেটা তার ঘর সেটাতে ঢুকে বিছানায় বসতেই তার ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের পর্দায় ময়ূখের নাম ভাসছে। এত রাতে ময়ূখ কল দিচ্ছে! নোরার বাবা এখনও ঢাকাতেই আছে তবে তিনি এক বন্ধুর বাড়িতে। অবচেতন মন বলল কোন বি-প-দ হয়নি তো! সে চিন্তায় অ-স্থির হয়ে ফোন ধরতেই ময়ূখ বলল, “কি হয়েছে সবার ফোন ধরে না কেন? আম্মা কই আম্মাকে ফোন দাও জলদি।”

কণ্ঠস্বরে আত-ঙ্ক স্পষ্ট ; কতক্ষণ ধরে কেউ তার ফোন ধরছে না! ময়ূখকে রিল্যাক্স হতে বলল নোরা।

“বাড়িতে একটা ঘটনা ঘটে গেছে তাই কারো নজর ফোনে পড়েনি৷ তুমি শান্ত হও একটা গুড নিউজ আছে।”

“গুড নিউজ!” তখনও আতঙ্ক কমেনি ময়ূখের। নোরা বুঝতে পেরে তাকে বলল, “তোমার আশেপাশে পানি আছে থাকলে আগে এক গ্লাস পানি খাও। তোমার নার্ভ শান্ত করো আগে।”

“আমি ঠিক আছি তুমি নিউজ বলো।”

নোরা বসা থেকে এবার লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। মনে মনে বলল, “আমার যা ধারণা মৈত্রীকে তুমি যে চোখে দেখো তা যদি সত্যি হয় তাহলে ময়ূখ তুমি ঠিক থাকবে না।”

ময়ূখ তাড়া দিতে লাগল এবার তাই নোরা বলেই দিলো, “শাদ ব্রো’র এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে।”

“কি বলছো!”

“ঠিকই বলছি। আজ সন্ধ্যার পর ব্রো আর মৈত্রীর এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে।”

“ভাইয়ের সাথে কার!” ফোনের ওপাশে মানুষটা যেন চেঁচিয়েই উঠলো। নোরা টের পেল তার নিজের কান্না পাচ্ছে। ময়ূখ কষ্ট পাচ্ছে বলে নয় বরং তার ধারণা সত্যি হয়েছে বলে। ময়ূখের প্রতিক্রিয়াই প্রমাণ করছে মৈত্রীকে নিয়ে তার মনে অন্যকিছুই ছিল যা নোরা তার চোখে আগেই দেখেছে।

“মৈত্রী শাদ ব্রোকে ভালোবাসে ময়ূখ। সে নিজেই ব্রো’কে আজ তার মনের কথা বলে দিয়েছিল। ব্রো তো নিজেই একজন ব্রো-কে-ন মানুষ হয়তো তাই চায়নি মৈত্রী মেয়েটা কষ্ট পাক। আর তাই দু পরিবারকে একসাথে ডেকে বিয়ের প্রস্তাব রেখেছে।”

“আম্মা কই? আমার ফোন ধরছে না কেন?” নোরাকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলো ময়ূখ।

নোরা এবার আর কিছু না বলে ফোন নিয়ে গেল ফুপির ঘরের সামনে। বাইরে থেকে ডাকলো, “ফুপি ময়ূখ কল দিচ্ছে তোমাকে।”

“আমি এখানে নোরা, এদিকে আসো।”

পেছনে সোফা থেকে আওয়াজ শুনে পেছনে ফিরলো সে। ফুপি আধশোয়া হয়ে এখনও সোফায় তারমানে ফুপি কোন কারণে আপসেট। নোরা ফোন এগিয়ে দিলো ফুপিকে, “ময়ূখ লাইনে আছে।”

ইরিন ফোন কানে ধরলো, “হু বল, খাবার খেয়েছিস?”

“রাত সাড়ে বারোটা বাজে আম্মা এ সময় কে খাবার খায়?”

ইরিনের হঠাৎই জগৎ-সংসারের খেয়াল হলো। আজ সে রাতে ময়ূখকে কল দেয়নি খাওয়ার আগে। প্রতি বেলায় খেতে বসে আগে ছেলেটাকে কল দেয় কিন্তু আজ তো খাওয়া হয়নি তার। এ ঘরের সবাই নতুন আত্মীয়ের ঘরে খেয়ে এসেছে। ইরিনের এবার অপ-রাধ-বোধ হতে লাগল। মৈত্রীকে নিয়ে মনঃক্ষুণ্ন হয়ে সে ভুলেই গেছে তার সংসারের বাকিদের কথা। ইরিন সোজা হয়ে বসে নোরাকে বলল এক গ্লাস পানি দাও তো! নোরা পানি দিতেই সেটা খেয়ে সে কথা বলল কিছুক্ষণ৷ ময়ূখ একবারও প্রশ্ন করেনি ইরশাদের এনগেজমেন্ট নিয়ে ইরিনও অন্যমনস্কতায় অল্প কথায় কল কাটলো। সে রাতে ইরশাদ বাড়ি ফিরলো না। ইরিনও কোন খোঁজ নেয়নি ছেলের। এমনটা এর আগে শুধু একবার হয়েছিল আর সেটা ইমরান আর সায়রার বিয়ের রাতে। ভোরে নামাজ পড়ে ইরিন নিজ বিছানায় গেলেন। ফখরুল সাহেব নামাজ পড়ে ছেলেকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। ইরশাদ সারারাত মসজিদেই ছিল আজ। এখানে বন্ধু বান্ধব নেই তার তাই সে নিজেকে সময় দিতে মসজিদেই গিয়েছিল। এখানে আছে প্রায় বছর হয়ে আসছে। ইরশাদ রোজ নামাজে যায় সেজন্যই ইমাম সাহেবের সাথে তার পরিচয়৷ কাল তাকে অত রাতে মসজিদের দরজায় দেখে তিনি ভীষণ অবাকই হয়েছিলেন। ইরশাদকে যখন প্রশ্ন করলেন, এত রাতে এখানে কেন তুমি?

ইরশাদ বিনা দ্বিধায় জানিয়ে দিলো মনের ভেতর চলা অস্থিরতা। বলে দিলো কোন কিছু না ভেবেই সে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং বাবা মাকে জানিয়ে বাগদানও করেছে। ইমাম সাহেব সব শুনে তাকে আশ্বস্ত করলেন এটা অতি উত্তম সিদ্ধান্ত তবে কেন সে অ-স্থি-র এত! ইরশাদ থম মে-রে গেছে সে প্রশ্নের জবাবে। সত্যিই তো সে কেন এত দ্বিধাগ্রস্ত! বিয়ে তো তাকে করতেই হতো এক না একদিন। তবে যে মানুষ তাকে ভালোবাসে তাকে বিয়ে করতে স-ম-স্যা কোথায়? পরে মনে হলো সমস্যা আছে একটা আর তা হলো কাল সে শুধু নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। বাবা- মায়ের সিদ্ধান্ত জানতে চায়নি। তারা তো চুপচাপ শুধু তার কথা রাখতে মৈত্রীকে আম্মু তার নিজের আংটি দিয়ে বরণ করে নিলেন অথচ আম্মুর মুখে হাসি ছিল না। তিনি সেদিন তার স্বভাবের সম্পূর্ণ ভিন্ন আচরণ করেছিলেন। রাতভর নিজেকে হাজারো প্রশ্নত্তোরে ব্যস্ত রেখে ভোরে ফজর পড়লো। আব্বুর সাথে মসজিদেই দেখা হলো নামাজ শেষে তাই আর বসে না থেকে বাড়ি ফিরলো। গেইট খুলে দিলো নোরা। ইরশাদকে দেখে গুড মর্ণিং উইশ করলো। ইরশাদও জবাব দিয়ে জানতে চাইলো, “আম্মু কোথায়?”

নোরা বলল, একটু আগেই ঘুমাতে গেছে।

ইরশাদ আর কিছু না বলে রান্নাঘরে ঢুকলো। নোরা আবার ঘুমিয়ে পড়বে তা জানে ইরশাদ তাই সে আব্বুকে জিজ্ঞেস করলো, “তোমাকে চা দিব আব্বু?”

“না আমি আবার একটু শুয়ে থাকব। তুই নিজের জন্যই বানা।”

ইরশাদ রান্নাঘরে ঢুকে, কফি বানিয়ে আগে সেটা খেয়ে নিলো। শীত শীত ভোরে গরম ধোঁয়া ওঠা কফিটা সারারাতের নির্ঘুম দেহটাকে ফুরফুরে করে দিলো নিমেষেই। তারপর ফ্রিজ খুলে যে ক’রকম সবজি ছিলো সেগুলো কেটে ধুয়ে সবজি খিচুড়ি বসিয়ে দিলো। নিজের ঘরে ঢুকে সে কাল বিকেল থেকে গায়ে থাকা জ্যাকেটটা খুলে রাখলো। কাল তার অনুপস্থিতিতে পাখির খাঁচাটা বাইরেই ছিলো বলে বেলকোনির দরজা খুলে প্রথমে তাদের দেখলো। না খাঁচার ওপর কম্বল আছে তারমানে, রাতে এতকিছুর মাঝেও আম্মু পাখিগুলোকে যত্নে রেখেছে। বাইরে এখনো রোদ উঠেনি, কুয়াশায় আবছা চারপাশ। ইরশাদ খাবারের বক্স খুলে পাখিগুলোকে খাবার আর পানি দিয়ে আবারও ঢেকে দিলো কম্বলে। হঠাৎ মনে পড়লো মৈত্রীর কথা তাতেই চোখ তুলে তাকালো উপরের বেলকোনিতে। মেরুন রঙের সুতি জামা গায়ে ওড়না জড়ানো ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে আছে মৈত্রী। চ-ম-কে গেল ইরশাদ, মেয়েটা কি সারারাত ঘুমায়নি? তার কি শীত লাগছে না? ওভাবে কেন দাঁড়িয়ে আছে এত সকালে! গরম কাপড়ও পরেনি মেয়েটি! ইরশাদ এবার নিজেকেই প্রশ্ন করলো, ভুল করলাম কি মেয়েটিকে এভাবে নিজের জীবনে জড়িয়ে!
মৈত্রী এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতেই ডান পাশে নিচে তাকালো। চোখাচোখি হলো মৈত্রী, ইরশাদের। আকস্মিক দৃষ্টি মিলনে অপ্রস্তুত হাসি দিলো ইরশাদ কিন্তু মৈত্রী হাসলো না। সে নিষ্পলক চেয়েই রইলো। তা দেখে ইরশাদই হঠাৎ একটু উঁচু শব্দে প্রশ্ন করে বসলো, “কি হয়েছে?”

চলবে
(মন্তব্যে আলসেমি করলে কিন্তু ইরশাদের বিয়ের মিষ্টি দেব না কাউকে😒)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here