#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_03
#Writer_NOVA
‘কি হয়েছে তোমার? আজ এতো জলদী ফিরলে যে?তোমার নাক-মুখ লাল কেনো শুভ ভাই? তুমি কি আজও মা’রামা’রি করে এসেছো?
শুভ অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। বিপদাপন্ন হরিণ শাবক যেমন একটু সাহায্যের আশায় চোখ তুলে তাকায়। শুভর দৃষ্টি ফুলের কাছে তেমন ঠেকলো। এগিয়ে এসে পায়ের পাতা উঁচু করে শুভর সামনে দাড়ালো। শুভর থেকে উচ্চতায় বেশ খাটো সে। ফুলের এহেন কান্ডে শুভর ভ্রু যুগল কুঁচকে গেলো। ফুল কপালে হাত রাখতেই আৎকে উঠলো।
‘শুভ ভাই, তোমার শরীর তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।’
শুভ তাচ্ছিল্যের সুর টেনে বললো,
‘তাতে তোর কি? আমারে নিয়া আদিখ্যেতা দেখাবি না। কারোর যহন আমারে নিয়া চিন্তা নাই তোরও করতে হইবো না। সামনের থিকা সর। আমি ভিতরে যামু।’
‘এভাবে কথা বলছো কেনো?’
‘আমি চোখ মেইলা চাইতে (তাকাতে) পারতাছি না কইতরির মা। কথা কইয়া মেজাজ গরম করিস না।’
‘আমি ধরে নিয়ে যাই আসো।’
ফুল এগিয়ে এসে শুভর হাত ধরতে নিলে শুভ ঝাটকা মেরে দূরে সরে গেলো। ফুল এবার অবাক হলো। শুভ তো কখনো এমন করে না। হঠাৎ হলো কি? তারপর ভাবলো জ্বরের ঘোরে মাথা ঠিক নেই। শুভ টালমাটাল পায়ে এগিয়ে যেতে নিয়ে ধপ করে পরে গেলো। ফুল কিছুটা কড়া গলায় বললো,
‘কি হাঁটতে পারছো? দুই কদম দিতেই পরে গেলে। খামোখা জিদ দেখাচ্ছো।’
নিজের কাঁধে শুভর হাত তুলে ধীর পায়ে এগুতে লাগলো ফুল৷ শুভ কয়েকবার নিজেকে ছাড়াতে গিয়ে পারলো না। জ্বরে শরীর দূর্বল হয়ে গেছে। নয়তো পুঁচকে ফুল ঝাড়া দিয়ে ফেলতে তার দুই মিনিট লাগতো না। শুভ হার মেনে ফুলের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটা ধরলো। মাগরিবের আজান হচ্ছে। এক হাতে কোনরকম মাথায় ওড়না টেনে হাঁক ছেড়ে সবাইকে ডাকতে আরম্ভ করলো।
‘চাচী, ঝুমুর আপা, দাদী! কোথায় তোমরা জলদী এদিকে আসো।’
এই নিয়ে বড় তিন বালতি পানি শুভর মাথায় ঢালা হয়ে গেছে। কিন্তু জ্বর কমার লক্ষ্মণ নেই। এতক্ষণ ফুল মাথায় পানি ঢাললেও এখন ঝুমুর ঢালছে৷ শুভর শিউরের পাশে বসে তবজী জপছেন সুফিয়া বিবি। সোহলী বেগম মাঝে মাঝে ছেলের মুখ মুছিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নিজের চোখ মুছছেন। ফুল দূর থেকে শুভর কাঁপা কাঁপা শরীরের দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে। দুটো লেপ দেওয়ার পরেও শুভ প্রচন্ড পরিমাণে কাঁপছে। আনোয়ার সর্দারকে খবর পাঠানো হয়েছে। মগরিবের আগে সে বেড়িয়েছিলো। খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন। শুভর কামরায় এসেই রুষ্ট গলায় বললো,
‘কতবার কইছি দিনকাল ভালা না। এহন একটু বাইছা বাইছা চল। কিন্তু আমার কথা কি হুনে? কিইন্না দিছি একটা বটবটি হেইডা নিয়া সারা গেরাম চক্কর মারে। ভাদ্দর মাসের দিন কি ভালো? এহন যদি একটা কিছু হইয়া যায়?’
সোহেলী বেগম এগিয়ে এসে স্বামীর বাহুতে হাত রেখে নরম গলায় বললো,
‘আল্লাহর দোহাই লাগি চুপ করেন। পোলাডা অসুস্থ। এর মধ্যে কি শুরু করলেন? রোগ-বালাই কি কাউরে কইয়া আহে?’
‘তোমার পোলায় দাওয়াত দিয়া আইলে কি না আইবো? রাইত নাই, দিন নাই সারাক্ষণ বাইরে থাকবো। আমার কথা হুনলে কি এই অবস্থা হয়?’
‘আপনি কি মানুষ নূরজাহানের বাপ? আপনের পোলায় অসুস্থ। এর মধ্যে বকাবাজি শুরু করছেন। একটু রহম করেন। এসব রাইখা ডাক্তার ডাকেন।’
‘কোনকিছু ডাকমু না আমি। আজাইরা বইয়া বইয়া খাইয়া কয়দিন পরপর অসুখ ডাইকা আনবো৷ আমি সব হালায় থুইয়া হের সেবা-যত্ন করমু। এতো ঠেকা পরে নাই।’
সুফিয়া বিবি হাতের তবজি রেখে ছেলেকে বললো,
‘কথা কইস না বাপ। কেমনে কাঁপুনি দিতাছে দেখ। ভাদ্দর মাসের জ্বর ভালা না। আল্লাহ না করুক যদি কিছু হইয়া যায় তহন পোলা পাবি কই?’
‘ওর মতো পোলার দরকার নাই আমার। বাঁইচা থাকলে আমার মান-সম্মান, নাম সব ডুবাইবো। হের থিকা মইরা যাওন ভালো।’
স্বামীর কথায় আৎকে উঠলো সোহলী বেগম।
‘আল্লাহ গো! কি কন এসব? চুপ করেন।’
সবার নজর এখন আনোয়ার সর্দারের দিকে। যার মুখটা কঠিন আস্তরণে ঢাকা পরেছে। কেউ যদি শুভর দিকে তাকাতো তাহলে হয়তো দেখতে পেতো তার পাষাণ্ড চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পরেছে অবহেলা ও অনাদরের দরুন।
‘কিরে ঝুমুর তুই হা কইরা কি দেহস? মাথায় পানি দে।’
সুফিয়া বিবির ধমকে হুশ ফিরলো ঝুমুরের। হাত চালিয়ে শুভর মাথায় মগ দিয়ে পানি ঢালতে লাগলো। ফুল ধীর পায়ে চাচার দিকে এগিয়ে এলো। মুখোমুখি হয়ে অনুনয়ের সুরে বললো,
‘চাচা, শুভ ভাইয়ের শরীরের অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না। এখন রাগ, গোস্বা করার সময় নয়। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে খবর দাও। সেখানকার ডাক্তার ডাকো। আমার ভয় করছে। তুমি দয়া করে এই সময় অন্য সবকিছু ভুলে ছেলের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করো।’
ফুলের কথা ফেললেন না আনোয়ার সর্দার। দ্রুত পায়ে বাইরে গিয়ে কাকে যেনো গলা ছেড়ে ডাকলো। নিচ থেকে প্রায় ছুটে এলো রমিজ মিয়া।
‘জলদী কইরা ডাক্তার ডাইকা লইয়া আয়। দেরী জানি না হয়।’
ডাক্তার এসে কিছু ঔষধপত্র লিখে দিলো।জানালো ভয়ের কিছু নেই। পাশাপাশি তাকে বিশ্রাম নিতে বলে গেলো। ডাক্তারের সাথে কথা বলতে চলে গেলো। ঝুমুর রাতের খাবারের ব্যবস্থা করছে। সুফিয়া বিবি, সোহেলী বেগম চলে গেলেন এশারের নামাজ পরতে। ফুল শুভর পাশে বসে আছে।ঔষধ খাওয়ার পর জ্বর ছেড়েছে। তবে চোখ, মুখ লাল হয়ে রয়েছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুভকে পর্যবেক্ষণ করছে৷ হুট করে শুভ চোখ মেলে তাকিয়ে অসুস্থ গলায় বললো,
‘আমি ম’রে গেলে সবার লিগা ভালো হয় তাই না রে কইতরির মা? আমার ওপর সবাই বিরক্ত।’
ধমকে উঠলো ফুল।
‘আজাইরা কথা বলো না।’
‘বিশ্বাস কর মাঝে মধ্যে নিজেরে শেষ কইরা দিতে মন চায়। কিন্তু পারি না।’
‘চাচার কথায় কষ্ট পেয়ো না শুভ ভাই। সে তোমাকে অনেক ভালোবাসে। শুধু প্রকাশ করে না। বাবার ভালোবাসা এমনি।’
‘আর ভালোবাসা!’
শুভর কথায় স্পষ্ট তাচ্ছিল্যের সুর ছিলো। সাথে এক আকাশ দুঃখ ও কষ্টের আভাস। ফুল এখন শুভকে কি সান্ত্বনার বাণী দিবে তা জানে না। তাই চুপ হয়ে গেলো। শুভ আকুতিভরা কন্ঠে বললো,
‘আমার চুলগুলো একটু নেড়ে দিবি ফুল?’
ফুল স্তব্ধ হয়ে গেলো। শুভ কখনো তাকে নাম ধরে ডাকে না। হঠাৎ নাম ধরে অনুনয় করায় সে ভড়কে গেছে। তবে মানা করলো না। শুভর মাথায় হাত বুলিয়ে চুলগুলো হালকা করে টেনে দিতে লাগলো। আচানক শুভ ফুলের কোলে মাথা তুলে দিয়ে ফিসফিস করে বললো,
‘আমার না ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ফুল। ইচ্ছে করতেছে তোরে জড়ায় ধইরা কানতে। আমি যদি এহন দাঁড়ানোর শক্তি পাইতাম তাইলে তোরে শক্ত কইরা জড়ায় ধইরা ইচ্ছামতো কানতাম।’
মনে কতটা কষ্ট থাকলে কেউ এভাবে বলতে পারে তা ফুলের জানা নেই। তবে ফুল এতটুকু বুঝতে পারছে শুভর মনে অনেক বড় চাপা দুঃখের পাহাড় আছে। যা সে একা বয়ে বেড়াচ্ছে। ফুলের ইচ্ছে করছিলো শুভর কাছ থেকে ছিটকে সরে যেতে। কিন্তু পারলো না। কারণ আচমকা শুভর শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফুল বুঝতে পারলো শুভ সব জ্বরের ঘোরে বলছে। তবে তার কপালে চিন্তার ভাজ পরলো। ঔষধ খাওয়ার পর তো জ্বর কমে গিয়েছিলো হঠাৎ আবার বাড়ছে কেনো?
ঘুলঘুলি দিয়ে সকালের রোদ আছড়ে পরছে। ফুলের মুখে তারা এসে লুকোচুরি খেলছে। মিষ্টি রোদের আলোয় ফুলের ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিলো। ধরফরিয়ে উঠে জিভে কামড় দিয়ে ফেললো। সকালে ফজরের নামাজ বাদ পরে গেছে। সারারাত জেগে এতোটা ক্লান্ত ছিলো যে আজান শুনতে পায়নি। দ্রুত উঠে শুভর কামরায় গেলো। শুভ ঘুমাচ্ছে দেখে দেরী করলো না। নিচে চলে গেলো। এখনো কেউ উঠেনি। ঝুমুর কলপাড়ে চাল ধুচ্ছে। ফুল খোঁয়াড় থেকে হাস, মুরগী ছেড়ে দিয়ে খাবার দিলো। হাতের তালুতে ছাইয়ের মাজন দনিয়ে দাত ডলতে ডলতে কলপাড়ে এলো।
‘বাসার কেউ উঠেনি?’
‘সারা রাইত সব জাইগা থাকলে উঠবো কেমনে?’
‘তুমি উঠলে কিভাবে?’
‘আমি মাইনসের বাড়ি কাম করি। আমার কি বেলা দশটা পর্যন্ত ঘুমানোর সময় আছে?’
‘তোমার চোখ ফোলা দেখা যাচ্ছে। রাতে ঘুমাতে পারোনি। এগুলো রেখে ঘন্টা খানিক ঘুমিয়ে নাও। নয়তো শরীর খারাপ করবে।’
‘করলেও কিছু করার নাই।’
‘তুমি যাও। সকালের খাবার আমি রান্না করে নিবোনি।’
চাল ধোয়া রেখে ঝুমুর চোখ তুলে তাকিয়ে বললো,
‘তুমি একলা পারবা না। আমার অভ্যাস আছে। সারাদিন কাম করতে পারমু।’
‘বেশি কথা বলো না তো ঝুমুর আপা।’
‘তুমি এতো তাড়াতাড়ি উঠলা কেন?’
‘আলোতে আমার ঘুম আসে না। ঘুলঘুলি দিয়ে রোদ এসে চোখে লেগেছে। তাই উঠে পরেছি। খারাপ লাগছে জানো৷ সকালের নামাজটা পরতে পারিনি।’
মন খারাপ করে বললো ফুল। ঝুমুর হালকা হেসে বললো,
‘কাজা পইরা নিও।’
‘হ্যাঁ, তাই করতে হবে। তুমি এবার যাও তো।’
জোরজবরদস্তি করে ঝুমুরকে পাঠিয়ে দিলো ফুল। সেও মানুষ, তারও ক্লান্ত লাগে। এটা মানুষ বুঝে না। কাজের মানুষদের যেনো কোন খারাপ লাগা থাকতে নেই। ফুল ঝুমুরকে নিজের বোনের চোখে দেখে। তাই ওর প্রতি আলাদা টান তার। চাল ধুয়ে উনুনের ওপর রেখে কোমড়ে ওড়না গুঁজে সামনের উঠোন ঝাঁট দিতে লেগে পরলো। কিছু সময় পর বাইরের থেকে কেউ জোরে হাঁক ডেকে বললো,
‘চেয়ারম্যান সাব বাড়িতে আছেন নি?’
ফুল শলার ঝাড়ু ফেলে দরজা খুলে উঁকি মেরে জিজ্ঞেস করলো,
‘কে?’
‘আমি ডাকবক্সের থিকা আইছিলাম।’
‘ডাকপিয়ন?’
‘হো, চেয়ারম্যান সাবের একটা চিঠি আইছে।’
‘কে পাঠিয়েছে?’
‘হের বড় পোলায়।’
কাছেই বড় মোরগটা কুকুরকুক করে চেচিয়ে উঠলো। যার কারণে ডাকপিয়নের কথাটা ফুলের কর্ণগোচর হলো না। বিরক্তিতে এক হাতে কান চেপে ধরে আরেক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
‘জ্বি, আমার কাছে দিন।’
‘আপনে কেডা?’
‘চেয়ারম্যানের ভাতিজী।’
‘ওহ ভাস্তি!’
‘জ্বী।’
একটা হলুদ খামের চিঠি এগিয়ে দিলো ফুলের দিকে। হাতের একটা ছোট কাগজ ও কলম দিয়ে বললো,
‘এইহানে একটা সই কইরা দিয়েন।’
ফুল সই করে কাগজ, কলম ডাকপিয়নের দিকে বাড়িয়ে দিলো। লোকটি চলে যেতেই হাতের চিঠির দিকে তাকিয়ে প্রেরকের নাম দেখে থমকে গেলো। কাঁপা গলায় উচ্চারণ করলো,
‘অ অ অভি সর্দার!’
#চলবে