কোন কাননে ফুটিবে ফুল পর্ব -০৪

#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_04
#Writer_NOVA

গোটা দুদিন ধরে ছোট ভাই জ্বরে পরে আছে শুনে দেরী করেনি নূরজাহান। স্বামী মিলনকে সাথে নিয়ে সকাল সকাল রওনা দিয়েছে বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে। আসার পর থেকে শুভর শিউরে বসে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছে। বার কয়েক শুভ ধমক দেওয়ার পরেও কাজে দেয়নি। বউয়ের কান্নায় বিরক্ত মিলনও। তবে বিরক্তি প্রকাশ করতে পারছে না। তাহলে নূরজাহানের রোষানলে পরতে হবে।

‘তুই আমার সামনের থিকা কি যাবি? ভালো চাইলে সর নূরজাহান। আমার মাথা ধরায় ফেলতাছোস। মনে হয় আমি ম’ইরা গেছি। আরে ছেমরি এহনো বাঁইচা আছি। ম’রলে কান্দিস।’

‘চুপ কর। খালি আজাইরা কথা তোর। দুই দিন ধইরা জ্বরে পইরা রইছোত। আমি খবর পাই ভোরে। আমারে কেউ কওনের দরকার মনে করে না। বিয়া দিয়া পর কইরা দিছে।’

বউয়ের কথা শুনে মিলন মুখ ম্লান করে ফেললো। স্ত্রী যে তাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছে তার কোন সন্দেহ নেই। একটু নড়েচড়ে বসলো সে। এখন কথা বলা মানেই বউয়ের তোপের মুখে পরা। হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর মতো করে হাত নাড়ালো। ততক্ষণে শুভ আরেকদফা ধোলাই দিয়ে ফেলেছে নূরজাহানকে।

‘ম’রা কান্দন আমার সামনে দেহাইস না। দুদিন পর মাথাডারে খাড়া করতে পারছি। আমার মনে হইতাছে তোর চিল্লাচিল্লিতে আবারো ভেটকি মাছের মতো চিত কাইত হইয়া পইরা থাকমু।’

‘এমনে কথা কস কেন? আমি কি নিজের লিগা কানতাছি?তোর লিগাই তো কানতাছি। আমার ভাইয়ের শরীর খারাপ হইছে তার লিগা আমি দুক্কে কি কানতেও পারমু না?’

‘পারবি না কেন? তোরা কানলে আমি ভালো হইয়া যামু তো। যা গিয়া বাড়িসুদ্ধ সব মাইনসেরে ডাইকা নিয়া আয়। একসাথে গলা ছাইরা কানবি।’

শুভর কথা শুনে ফিক করে হেসে উঠলো মিলন। নূরজাহান চোখ লাল করে তাকাতেই মিলন বিভ্রান্ত হয়ে গেলো। দ্রুত মাথা নিচু করে রাখলো। তবে এখনো মুখ টিপে হাসছে সে। মেজাজ তুঙ্গে উঠছে শুভর। জ্বরের কারণে মুখ চিরতা পাতার রসের মতো তিতা হয়ে আছে। এর মধ্যে কানের সামনে মাছির মতো ভনভন করছে নূরজাহান। ভাঙা গলায় ফুলকে ডাকলো। শুভর এই মিনমিনে স্বরের ডাক ফুলের কানে পৌঁছালো না।

‘এহন কেমন লাগে শালাবাবু?’

‘এতক্ষণ ভালোই আছিলাম। কিন্তু এহন আপনার বউয়ের জ্বালায় মাথা ধরছে। ওরে একটু এইহান থিকা নিয়া যান তো। কহন জানি থা’প্পড় দিয়া থোঁতা ব্রেক কইরা দেই।’

মিলন অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। আমতাআমতা করে বললো,

‘নুরু চলো এইহান থিকা। আম্মার লগে দেহা কইরা আহো।’

নূরজাহান ধমকে উঠলো।
‘তুমি চুপ থাকো।’

‘কেন দুলাভাই চুপ থাকবো কেন? তুই আমার কানের সামনে বইয়া বইয়া কানবি আর আমি হেইডা সহ্য করমু।’

‘এমন করোস কেন ভাই? তোরে আমি কত ভালোবাসি। তুই বুঝোস না।’

‘তোর ভালোবাসা পান-চুনের লগে মোড়াইয়া খাইয়া ফেলগা যা।’

ভাইয়ের তিরিক্ষি মেজাজে কথা শুনে নূরজাহান এবার চুপ করলো। শুভর রাগ উঠলে সত্যি যদি থাপ্পড়-টাপ্পড় মেরে বসে। একে দিয়ে বিশ্বাস নেই।

মিনিট চার পর ফুল ট্রে হাতে কামারার ভেতর ঢুকলো। সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করে খাটের ওপর ট্রে রাখলো। দুই কাপ চা, এক পিরিচে বেকারি থেকে আনা ঘিয়েভাজা টোস্ট বিস্কুট, আরেক পিরিচ ভর্তি নিমকি। চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো নূরজাহানের দিকে। নূরজাহান মুখটাকে চৌদ্দ রকম করে চায়ের কাপ ধরলো। মায়ের মতো সেও ফুলকে দেখতে পারে না। বাসায় এলে শুধু কথা শোনানোর কারণ খুঁজে। আরেক কাপ চা মিলনের দিকে বাড়িয়ে দিলো। সবার অলক্ষ্যে মিলন খোপ করে ফুলের হাত ধরতে চাইলে ফুল কিছুটা পিছিয়ে যাওয়ায় ধরতে পারলো না। ফুল সাবধানী ভঙ্গিতে সরে গেলো। চোখ তুলে মিলনের দিকে তাকাতেই দেখলো একজোড়া হায়না চোখের লোভাতুর চাহনি।

‘আমার লিগা চা আনোস নাই কইতরির মা?’

শুভর গম্ভীর কণ্ঠস্বর পেয়ে ফুল এগিয়ে এসে চোখের পাতা নাচিয়ে বললো,

‘তুমি তো চা খাও না।’

‘খাই না তো কি হয়েছে? এহন কি খাইতে মন চাইতে পারে না?’

‘আচ্ছা, আমি নিয়ে আসছি।’

ফুল চলে গেলো। শুভ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার মিলনের দিকে তাকিয়ে রইলো। যে কোন সময় ভস্ম করে দিতে পারে তাকে। যা দেখে মিলন শুকনো ঢোক গিললো। এসবে হুশ নেই নূরজাহানের। সে পরমানন্দে চায়ে বিস্কুট চুবিয়ে মুখে পুরছে।

বিকেল দিক থেকে শুভর শরীরটা একটু ভালো লাগছে। দুদিন পর সাবান ঘষে গোসল করায় মাথা ও শরীর দুটোই পাতলা লাগছে। যদিও মুখের তিতকুটে ভাবটা এখনো যায়নি। দুপুরে অল্প একটু খেয়ে উঠে পরেছে। নাগ বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের দিকে নজর দিলো শুভ। নূরজাহান ও সোহেলী বেগম একসাথে বসে শাক বাছছে।মিলন দুপুরের খাবারের পর বাসায় চলে গেছে। পাশের গ্রামের মেম্বার সে। শ্বশুর বাড়ি বসে থাকার সময় নেই। ছেলেকে দেখেই সেহেলী বেগম মুখের হাসি চওড়া করে জিজ্ঞেস করলো,

‘শরীর এহন কেমন লাগে বাপ?’

‘ভালো।’

‘উডলি কেন? আরেট্টু হুইয়া থাকতি। শরীর ভালা থাকতে তো সারাদিনেও তোর চেহারা দেহা যায় না। অসুখের কারণে দুই দিন দেখলাম।’

শুভ উত্তর দিলো না। তার অস্থির চোখ জোড়া কাউকে খুঁজতে ব্যস্ত। মায়ের সাথে গলা মিলালো নূরজাহান।

‘চেহারার কি হাল হইছে দেখছো? তাকান যায় না। দুইদিন শুকায় চেংটা হইয়া গেছে। মুখ, চোখের কি অবস্থা। আমি তো প্রথম দেইখা ডরায় গেছিলাম।’

সোহেলী বেগম মুখটাকে তাতিয়ে প্রায় চেচিয়ে ক্ষুব্ধ গলায় বললো,

‘আমার কথা কি হুনে? বাড়িতে একটা কালসাপ আইনা লইছি। হেই মাইয়া তাবিজ কইরা তোর বাপেরে আর ভাইয়েরে বশ কইরা রাখছে৷ আমার কথার থিকা ঐ মাইয়ার কথা ভালো হুনে।’

‘তাড়াইতে পারো না? ঘাড়ে উডায় রাখছো কেন? আমি হইলে এতোদিনে গলা ধাক্কা দিয়া বাইর করতাম। এরে দিয়া বিশ্বাস নাই। কহন কি করে কে জানে? চোখে চোখে রাইখো।’

‘দুইদিনের লিগা বাপের বাড়ি আহোস। চুপচাপ থাকবি, খাবি তারপর যাবিগা। আমগো বাড়ির পোদ্দারি করতে হইবো না।’

চোয়াল শক্ত করে বলে উঠলো শুভ। নূরজাহান অবাক হয়ে মা কে হাত দিয়ে ঠেলা দিয়ে বললো,

‘হুনছো মা হুনছো, কি কয়? আমি যে ওর বড় বোইন তাও মানে না।’

‘তুই হোন। আমি নিত্যি দিন হুনি। তাবিজ করছে আমার পোলাডারে। হারাদিন ওর নাম জপে। বাড়িতে আইয়া ওরে ডাকবো।’

শুভ দাঁড়ালো না। অসময়ে ক্যাচাল তার ভালো লাগে না। এর জন্য বাসায় থাকতে চায় না সে। সারা বাড়িতে একটা চক্কর মেরেও পেলো না। ঘাটের দিকে যেতে নিয়েও গেলো না। গেলে হয়তো কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে পেয়ে যেতো।

সন্ধ্যার পর শুভর বন্ধু-বান্ধবরা দেখা করতে এসেছে। সাথে হরেকরকম ফলমূল, পথ্য। খন্টা খানেক গল্প করলো তারা। রাতের খাবারের সময় হতেই ফুল মাথায় ওড়না টেনে ইতস্তত ভঙ্গিতে ভেতরে প্রবেশ করলো।

‘চাচী সবাইকে খেতে যেতে বলছে।’

মেয়ালি রিনরিনে কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলো সবাই। একসাথে দৃষ্টি দিলো দরজার দিকে। ফুল তখন নতমুখে দাঁড়িয়ে আঙুল দিয়ে ওড়না পেঁচাচ্ছে। হানিফ আবাক চোখে শুভর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘মাইয়াডা কেডা রে শুভ?’

গলা মিলালো হাসানও।
‘তোদের আত্মীয় নাকি? আগে কখনো দেহি নাই তো।’

শুভর চোখ দুটো নিষ্পলক।ধীরে ধীরে কঠিন হচ্ছে। সে কঠিন চোখের ভাষা বোঝা কারো পক্ষে এখন সম্ভব নয়। মুখের বলিরেখাগুলো ফুটে উঠেছে। ঘর কাঁপিয়ে ধমক দিয়ে বললো,

‘তুই এইহানে আইছোত কেন? ঝুমুররে পাঠাইতে পারলি না?’

শুভর ধমকে সবার পিলে কম-বেশি চমকে উঠলো। হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারণ কেউ খুঁজে পেলো না। ফুল হাত মুষ্টি করে দুই পাশের জামা শক্ত করে ধরে কিছুটা তোতলানো সুরে বললো,

‘ঝুমুর আপা কাজ করছে।’

‘তাইলে নুরজাহানকে পাঠাতি।’

‘সে রুমে বসে আছে।’

‘এক্ষুনি এইহান থিকা যাবি। তোরে যেন আর না দেহি।’

ফুল নীরবে বেরিয়ে গেলো। বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। এতগুলো মানুষের সাথে এভাবে অপমান করার কি কোন দরকার ছিলো? হ্যাঁ, ছিলো। কারণ শুভ জানে তার বন্ধুরা কেমন। তাই ফুলকে সে আড়াল করে রেখেছে তাদের থেকে। সেই ফুল নিজে এসে ধরা দেওয়ায় বেশ রাগ হয়েছে তার। তাদের নজর যে এখন সর্বক্ষণ চেয়ারম্যান বাড়িতে থাকবে তাও জানে শুভ। তাই মেজাজটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। হাতের কাছে থাকলে ফুলের গাল দুটো চড় মেরে ফাটিয়ে ফেলতো।

পলক বিব্রত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,
‘কে রে মাইয়াডা? এমন কইরা কথা কইলি কেন ওর লগে?’

শুভর ফটাফট উত্তর,
‘তোর জাইনা কাম নাই।’

হাসান কৌতুকতার সহিত ভ্রু নাচিয়ে বললো,
‘আমার জাইনা কাম আছে। তোগো বাড়িতে এমন একটা পরী আছে আমগো কইলি না কেন শালা? তাইলে তো এতদিনে অনেক কিছু হইয়া যাইতো।’

হাসানের কথার ইঙ্গিত কোনদিকে ছিলো তা বুঝতে পেরে শুভর চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। এক ঝাটকায় হাসানের শার্টের কলার ধরে শাসিয়ে বললো,

‘কু*** বাচ্চা, নজর দিবি না ওর দিকে। চোখ তুইল্লা ফালামু।’

শুভর এমন অগ্নিগিরি রূপ আগে কখনো দেখিনি তার বন্ধুরা। সবাই ভয়ে, বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। কারো মুখ দিয়ে টুঁশব্দ বের হলো না।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here