কোন কাননে ফুটিবে ফুল পর্ব -০৫

#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_05
#Writer_NOVA

সেদিনের পর থেকে ফুল আজকাল শুভকে বেশ এড়িয়ে চলে। নূরজাহান দুদিন থেকে চলে গেছে। এই তো কিছু সময় আগে রান্নাঘরে শুভ কয়েকবার চক্কর দিয়ে গেলো। তবুও ফুল ঘুরে তাকায়নি। সুফিয়া বিবি একবার হাতের লাঠি উঁচিয়ে মা’রার ভয় দেখিয়ে খেঁকিয়ে উঠেছিলেন।

‘এইহানে কি তোর? পাকের ঘরের সামনে ঘুরঘুর করতাছোত কেন? লক্ষ্মণ ভালা ঠেকে না। শরীর ভালা থাকলে সারাদিন বাড়িত থাকে না। এহন অসুস্থ তো। তাই বাড়ির বাইরে যাইতে পারো না।’

‘বুঝোই যহন বুড়ি, এতো কথা কও কেন?’

‘ঐ তুই কারে বুড়ি কস? এহনও তোর থিকা বহুত জুয়ান আছি। রোগে ধরতে পারে না। তুই তো একটু জ্বর আইলে কাইত হইয়া যাস। আবার আমার লগে টক্কর দেস।’

শুভ বেতের মোড়াটা টেনে বসলো। আড়চোখে একবার ফুলের দিকে তাকালো। ফুল বটি দিয়ে লাউয়ের খোসা ছাড়াচ্ছে। দাদীকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘হইছে বাড়ায় কথা কইয়ো না। আমার মতো জ্বরে পরলে তোমারে খুইজা পাওয়া যাইতো না। পটল তুলতে যাইতা গা।’

‘ঐ ছেমরা কি ভাবোস তুই আমারে? এহনো তোর মতো পুচকের লগে লড়নের শক্তি আছে আমার।’

‘হাহ আইছে। বাতের ব্যাথায় উটলে বইতে পারে না, বইলে উটতে পারে না। হেয় নাকি আমার লগে লাগবো৷ কৌতুক ভালোই পারো।’

নাতি-দাদির কথা শুনে ঝুমুর রান্না রেখে ফিক করে হেসে উঠলো। তা দেখে সুফিয়া বিবি চোখ পাকালো। তবে ফুলের কোন হেলদোল নেই। সে যেনো পণ করে বসে আছে সারা দুনিয়া উল্টে গেলোও শুভর দিকে ফিরে তাকাবে না। ফুলের এড়িয়ে যাওয়া স্বভাবটা শুভর ভালো লাগছে না। ভেতরটাকে অস্থির করে দিচ্ছে।

সকালের পর ফুলকে আর দেখিনি শুভ। সকালের খাবার খাওয়ার পর ভালো লাগছিলো না। কামরায় এসে ঘুমিয়ে পরেছিলো। সোহেলী বেগম একবার এসেছিলো ডাকতে। ছেলে ঘুমিয়ে আছে দেখে ডাকেনি। শুভর ঘুম ভেঙেছে যোহরের পর। উঠে কলপাড়ে গোসল করে নিয়েছে। অন্য সময় ফুল কল চেপে বালতি ভরে দিলেও আজ সেই কাজটা ঝুমুর করেছে।

‘ফুল কই ঝুমুর আপা?’

‘কইতে পারি না। রান্ধনের পর আর দেহি নাই। কি জানি হইছে ওর। কারো লগে বেশি কথা কয় না।’

‘তোমার লগেও না?’

‘না!’

উত্তরে আশাহত হলো শুভ। ক্ষীণ শ্বাস টেনে মগ দিয়ে শরীরে পানি ঢালতে লাগলো। খাবারের সময় ফুল লাপাত্তা। ভাতের প্লেটে হাত দিয়ে এদিক সেদিক তাকাতেই সোহেলী বেগমের তিরিক্ষি মেজাজী স্বর শোনা গেলো।

‘খাইতে বইছোত চুপচাপ খাবি। এদিক-সেদিক তাকাস কেন? কারে খুঁজোস এতো? শরীর সুস্থ থাকতো তো তোর টিকিটাও দেহা যায় না। এহন অসুস্থ গামলা ভইরা ভাত খাবি। তইলে না তাড়াতাড়ি সুস্থ হবি।’

‘হো আমি তো গরু। গামলা ভইরা ভাত খামু।’

‘গরুই, নইলে ঐ অপয়া মাইয়ার কথায় কি উঠতি বইতি নাকি?’

বিরক্তিতে নাক কুঁচকে গেলো শুভর। সবকিছুতে ফুলকে টানা পছন্দ করে না সে। অথচ তার মা প্রতি মিনিটে মিনিটে সেই কাজটাই করে।

‘আমারে যা খুশি কও। তার মধ্যে ফুলেরে টানো কেন?’

‘ঐ তো লাইগা গেলো? মাইয়ারে কিছু কইলেই গায়ে ফোস্কা পরে। আমারে যহন কয় তহন তোরা বাপ বেটা তো কিছু কস না। যত দোষ আমারই।’

‘ধ্যাত! খামুই না। দুইডা খাইতে বইছি হেও শান্তি নাই।’

শুভ উঠে হাত ধুয়ে চলে গেলো। সোহেলী বেগম আঁচলে মুখ গুঁজে তেজী বাঘিনীর মতো করে চেচিয়ে বললো,

‘হো খাইবা কেন? আইজকা তো তোমগো ভালোবাসার ফুল ভাত বাইরা দেয় নাই। আমি দিছি না! মায়ের থিকা অন্যের মাইয়ার সেবাযত্ন ভালো লাগে। বিয়ার আগেই এই পরিবর্তন। বউ আইলে তো বোধহয় আমারে দেখতেই পারবি না।’

শুভ শেষ সিড়িতে পা রেখে বিরক্তিতে একবার মায়ের দিকে তাকালো। তারপর যথারীতি পা চালিয়ে নিজের কামরায় চলে গেলো।

খাটের ওপর বসে যাতি দিয়ে সুপারি কাটছেন। সোহেলী বেগম তার থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে পান সাজাচ্ছেন। দুজনে নিরব। হঠাৎ সুফিয়া বিবি প্রথম কথা বলে উঠলো।

‘ছোট পোলাডারে এট্টু চোখে চোখে রাখিস অভির মা। ওর হাবভাব ভালো ঠেকে না আমার কাছে। সারাক্ষণ দেহি ঐ ছেমরির আশেপাশে ঘুরঘুর করতে। কওন তো যায়না কহন আবার মায়ের মতো আমার নাতীডারে নিয়া পোলায়।’

‘এই চিন্তা কি আমার হয় না মা? আমারো হয়। আপনের পোলার ওপর মাঝে মধ্যে বহুত রাগ উডে আমার। বাড়িতে বিয়া লর উপযুক্ত একটা পোলা থাকা সত্ত্বেও হেই কেমনে পারে ভাইয়োর মাইয়ারে ঘরে তুলতে? কান্ডজ্ঞান হের আসলেই লোপ পাইছে। এহন ঐ অপয়া মাইয়া যদি ছলেবলে, ফুসলাইয়া আমার পোলাডারে নিয়া ভাগে তাইলে কার ক্ষতি হইবো কোন তো? নিজের ভালো তো পাগলেও বুঝে।আপনের পোলায় বুঝে না৷ আমি কিছু কইলে ধমক দিয়া কয় তুমি চুপ থাকো। বেশি বুইঝো না।’

‘ছোট পোলাডারে আমিও ভালোবাসতাম। বিয়ার লিগা দশ গেরাম খুইজা একখান পরীর মতো মাইয়া পাইছিলাম। হেই হারামজাদায় কি করলো? পরী হালায় থুইয়া কামের বেডির মাইয়া নিয়া ভাগলো। আমগো মান-সম্মান সব শেষ কইরা দিলো। তোর শ্বশুর তো রাইগা তাজ্য পুত্র কইরা দিলো। কিন্তু বড় পোলাডার তার ভাইয়ের প্রতি টান কমলো না।’

‘এই টানই তো বিপদে হালাইবো আম্মা। হেইডা হেয় বুঝে না। আমার কি মনে হয় জানেন আম্মা? এই মাইয়ারে তার মায় ইচ্ছা কইরা পাডাইছে।যাতে কইরা বাপের সয় সম্পত্তি হাত করতে পারে।’

‘কি জানি বাপু! তোমগো মন মতলবি বুঝি না।’

শাশুড়ীর হেয়ালি উত্তর পছন্দ হলো না সোহেলী বেগমের। মুখ পানসে করে ফেললো। অপরদিকে সুফিয়া বিবির বুকের বা পাশটা চিনচিন করে উঠলো৷ ছোট ছেলে মনোয়ার তার ভীষণ প্রিয় ছিলো।ছেলের কাজে সেও অসন্তট ছিলো। কিন্তু সে তো মা! মায়ের মন তো ছেলের জন্য কাঁদবে এমনটাই স্বাভাবিক। কত বছর ধরে ছেলেটাকে দেখে না। এক পলক দেখার জন্য মনটা তার বড় আনচান করে।

মাগরিবের আজান দিয়েছে বহু আগে। এশারের আজানের সময় হয়ে গেছে। ওজু করার জন্য কলপাড়ে যেতে হবে ফুলের। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। লোডশেডিং হয়েছে। অজপাড়া গাঁয়ে বিদ্যুৎ আছে এটাই বেশি। দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ৫-৬ ঘন্টা থাকে। কোণার দিকে টিমটিমে আলোতে জ্বলছে হারিকেন। তুরকুলা পোকার ঝি ঝি ডাকে পরিবেশটাকে ভুতুড়ে করে দিয়েছে। হারিকেন হাতে নিয়ে আশপাশটা তে ভীতু নজর দিলো ফুল। গতরাতে ঝুমুরের থেকে জ্বীন-ভূতের গল্প শুনেছিলো। একা থাকায় সেগুলো এখন মনে পরছে৷ একবার ভাবলো ঝুমুরকে ডাকবে। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলো। এখন ঝুমুরকে ডাকলে ঝুমুর নিশ্চয়ই তাকে নিয়ে মজা নিবে। সেটা ফুলের ভালো লাগবে না।

‘ভাউ!’

‘বাবা গো!’

পেছন থেকে কানের কাছে কেউ ভাউ বলতেই ফুল ভয়ে চেচিয়ে উঠলো। হো হো হাসির শব্দ শুনে হারিকেন উঁচিয়ে দেখলো শুভ পেট ধরে হাসছে।

‘এতো ভীতু তুই?’

‘এভাবে ভয় দেখালে কে না ভয় পাবে?’

‘কহন থিকা দেখতাছি তুই হারিকেন নিয়া এইহানেই দাঁড়ায় রইছোত। কলপাড়ে যাওনের সাহস পাইতাছোত না।’

নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে ভাব নিয়ে বললো,

‘হুম বলছে তোমাকে?’

‘বলবি কেন? আমি তো উপরের থিকা সবই দেখলাম।’

‘ভালো করছো। সরো এবার।’

ফুল কপট রাগ দেখিয়ে হনহনিয়ে কলপাড়ে চলে গেলো। এখন যেহেতু শুভ আছে তার কোন ভয় নেই। হারিকেন পাশে রেখে কল চেপে মগ ভরে পানি নিলো দ্রুত হাতে ওজু করতে লাগলো।

‘আরে আস্তে কর। আমি পলাইতাছি না।’

‘আমি কাউকে ভয় পাই না।’

‘হো দেখলামই তো। সামন্য ভাউ কইতেই আত্মা কাইপা গেছে।’

‘চোখের ডাক্তার দেখাও। ভুল দেখছো তুমি।’

ওজু সেরে ফের এক মগ পানি পায়ে ঢেলে নিলো ফুল। শুভ মুখ টিপে হাসলো। যাক, এই ভয় দেখানোর কারণে হলেও ফুল তার সাথে কথা বলেছে। পরক্ষণেই মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো। চেচিয়ে বললো,

‘ঐ দেখ ফুল তোর পিছনে কি!’

‘আল্লাহ গো!’

ফুল হারিকেন নিয়ে দৌড়ে চলে এলো। তাড়াহুড়োর ঠেলায় বারান্দায় থাকা সিমেন্টের খুঁটির সাথে ধরাম করে বারি খেলো। তা দেখে শুভ আবারো উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। ফুল কপাল ডলতে ডলতে মুখ ঝামটা মেরে বললো,

‘তুমি আসলেই খাটাশ, শুভ ভাই।’

#চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here