কোন কাননে ফুটিবে ফুল পর্ব -০৬

#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_06
#Writer_NOVA

সকাল থেকে বৃষ্টি। ভাদ্রর তাল পাকা গরমে সবার জীবন যখন অতিষ্ঠ তখুনি ধরনীর বুকে বৃষ্টি কন্যার আগমন। বৃষ্টির ছোঁয়ায় নেতানো গাছের পাতাগুলো সতেজ হয়ে গেছে। চারিদিকে ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজ। ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধে মোহিত করে দেয় মন-প্রাণ। জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে গুণ গুণ করে রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে উঠে ফুল।

“আমারো পরানো যাহা চায়,
তুমি তাই, তুমি তাই গো,
আমারো পরানো যাহা চায়।
তোমা ছাড়া আর এ জগতে,
মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো,
আমারো পরানো যাহা চায়।”

রিমঝিম বৃষ্টি যেনো গানের সাথে তাল দিচ্ছে। ফুল উদাস মনে বাইরে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টির ছিটেফোঁটা এসে তার চোখ, মুখে বারি খাচ্ছে। ফুলের মুখে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু পানি কণা গুলোকে দেখলে কোন কাব্যিক পুরুষ হয়তো মুক্তো দানা বলে আখ্যায়িত করতো৷ অদূরে একটা শালিক কাঁঠাল গাছে বসে কিচিরমিচির করছে৷ ফিঙে পাখিটার বাসায় যাওয়ার বেশ তাড়া। সে আমগাছের ডালে বসে একটুখানি জিড়িয়ে আবার ফুড়ুৎ করে উড়াল দিলো৷ পাশের বাড়ির দুলাল চাচার গরুটা একঘেয়ে সুরে হাম্বা, হাম্বা করে ডাকছে৷

ফুলের কামরাটা পূর্ব মুখো। তার খাটের পাশের জানালা খুললে দূর থেকে দূরান্তের ধানের ক্ষেত দেখা যায়৷ সেখান প্রায় এক কি.মি হাঁটলে নদী। বাড়ির বাউন্ডারি ঘেঁষে ইটের রাস্তা। সেখান দিয়ে পা চালিত ভ্যান, রিকশা,সাইকেল চলে। কিছু সময় এসব দেখতে দেখতে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে গিয়েছিলো ফুল। ধ্যান ফিরলো ঝুমুরের ডাকে৷

‘চাচী, তোমারে ডাকে ফুল!’

‘হু!’

‘তুমি কি আমার কথা হুনছো?’

ঝুমুরের ডাকে হকচকিয়ে যায় ফুল। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,

‘হ্যাঁ, শুনছি বলো।’

‘চাচী ডাকে।’

‘কেনো?’

‘বেলা গড়ায় যাইতাছে রানতে হইবো না?’

‘ওহ, হ্যাঁ! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। তুমি যাও আমি আসছি।’

ঝুমুর পা বাড়ালো রান্নাঘরের দিকে৷ দরজা অব্দি গিয়ে আবার ফিরে এলো।

‘কিছু বলবে?’

‘হো, একটা কথা জিগাইতাম।’

‘হুম বলো।’

‘তুমি কোন কেলাশ তরি (ক্লাশ পর্যন্ত) পরছো?’

‘আয়ে পাশ করেছি।’

চোখ মুখ বড় করে ঝুমুর প্রায় চিৎকার দিয়ে বললো,
‘তুমি তাইলে অনেক শিক্কিত।’

ঝুমুরের কথা বলার ধরনে ফুল মুচকি হাসলো। কথা বাড়ালো না। দেরী হলে চাচী আবার একদফা কথা শুনাতে পারে৷ ঝুমুরের বাহু ধরে রান্নাঘরে রওনা দিলো।

শুভদের বাড়িটা দোতলা। পুরনো আমলের বাড়ি। একপাশে সিমেন্টে ঢালাই দেওয়া কলপাড়। তার সাথে দুটো ল্যাট্রিন। একটু দূরে ঢেউ টিনের রান্নাঘর। বৃষ্টির দিনে রান্নাবান্নায় অসুবিধা হয়ে যায়। ঘর থেকে রান্নাঘরের মধ্যে মাঝারি আকারের উঠোন। বৃষ্টিতে তা কাঁদা হয়ে আছে। রমিজ মিয়া উঠোনে সারি করে ইট বিছিয়ে দিয়েছে। তাতে সাবধানে পা ফেলে রান্নাঘরের যেতে লাগলো ফুল। পা ফসকে পরলে কোমড় শেষ। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি এখনো পরছে।

‘আইতে এতোক্ষণ লাগে? কহন ঝুমুরে দিয়া খবর পাডাইছি। আমার তো মনে হইছিলো আপনেরে আনতে পালকি পাডান লাগবো।’

‘আমি এক মিনিটও দেরী করেনি চাচী।’

‘আবার মুখে মুখে কথা কস। চোপা কম চালাবি। মেজাজ খারাপ আছে আমার।’

‘আপনার মেজাজ খারাপ, আমি কি করবো? অন্যের মেজাজ আমার ওপর দেখাতে এলে আমি নিশ্চয়ই ছেড়ে দিবো না।’

সোহেলী বেগমের রাগটা বাড়লো। দাত পিষে রাগটাকে দমন কর ফুলের কথা হজম করে নিলো। কোমড়ে হাত রেখে ফুলের দিকে অগ্নি চক্ষু করে তাকালেন। তাতে ফুল পাত্তা দিলো না। সামনে থাকা চাল, ডাল মিশানো পাতিল তুলে ছোট টেপে ধুতে চলে গেলো। সোহেলী বেগম কিছু বললেন না। সে আজ কাজ করবে না বলে মনস্থির করেছে। বৃষ্টির দিন কাজ করতে তার ঢেঢ় আলসেমি লাগে৷ ফুলকে দিয়ে সব কাজ করাতে চাইলে এতটুকু কথা সহ্য করতেই হবে।

সকালে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়েছিলো শুভ। মায়ের আদেশ শুনেনি। জ্বর থেকে ভালো হতে না হতেই তার ঘুরাঘুরি আরম্ভ হয়ে গেছে। দুপুরের কিছু পর আনোয়ার সর্দার ছাতা মাথায় ফিরলেন। চেয়ারম্যানদের কি ঝড়, বৃষ্টি হলে বসে থাকার জো আছে৷ এলাকার মানুষের বিপদ হলে সব ফেলে ছুটে যেতে হবে৷ নয়তো সে আদর্শ চেয়ারম্যান কি করে হবে? দালানের ভেতর ঢুকেই আনোয়ার সর্দার চেচিয়ে উঠলো,

‘ফুল কইরে?’

ফুল তখন গরম খিচুড়ির ডেকচি কাঠের মিটসেফে রাখছিলো। চাচার গলার স্বর পেয়ে ডেকচি রেখে ওড়না টেনে দৌড়ে এলো।

‘কিছু লাগবে চাচা?’

‘খিদা লাগছে। খাওন দে।’

‘হাত-পায়ে কাদা মাখামাখি। যাও গিয়ে হাত, মুখ ধুয়ে আসো। আমি ততক্ষণে খিচুড়ি বেড়ে নিয়ে আসি।’

‘খিচুড়ি রান্না হয়েছে?’

‘হ্যাঁ! খিচুড়ির সাথে বেগুন ভাজা, ডিম ভুনা ও জলপাইয়ের আচার।’

‘জিভে পানি আইয়া পরলো। আমি এহুনি যাইতাছি কলপাড়ে হাত-পা ধুতে। তুই জলদী প্লেটে বার।’

আনোয়ার সর্দার কলপাড়ে চলে গেলেন। ফুল খুশমেজাজে ডেকচি থেকে বোলে খিচুড়ি বাড়তে লেগে পরলো। আনোয়ার সর্দার ও শুভর খিচুড়ি ভীষণ পছন্দ। সকালে উঠে শুভ কোথায় গেছে কে জানে! এখন থাকলে তো গরম গরম খিচুড়ি খেতে পারতো৷ শুভ গরম খিচুড়ি খেতে পারবে না ভেবে ফুলের মনটা খারাপ হয়ে গেলো।

শীতল পাটি বিছিয়ে খাবার দেওয়া হয়েছে আনোয়ার সর্দারকে৷ সাথে রমিজ মিয়া আছেন। আনোয়ার সর্দার ভাতিজির খিচুড়ির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মাঝে মাঝে রমিজ মিয়াকেও জিজ্ঞেস করছে,

‘কি রমিজ কেমন হইছে রান্ধা?’

‘জে চেয়ারম্যান সাব মেলা ভালা।’

‘ভালো হইতেই হইবো৷ দেখতে হইবো না কার ভাস্তি রানছে।’

আনোয়ার সর্দারের মুখ প্রশংসার ছটা। গর্বের সহিত কয়েকবার বুক ফুলালেন। রমিজ মিয়া আঙুল চেঁছেপুঁছে খেতে খেতে মাথা নাড়ালো। তা দেখে ফুলের মনটা আনন্দে নেচে উঠলো৷ এতবড় ডেকচি ভর্তি করে আগে কখনো রান্না করেনি৷ যদি খারাপ হয় সেই ভয়ে, চিন্তায় অস্থির ছিলো৷ এখন মনে হচ্ছে বুক থেকে পাথর নেমে গেলো।

‘ফুল মা, রমিজরে আরেকটু খিচুড়ি দে।’

‘রমিজ চাচা, আরেকটু দিবো?’

‘না মা, এতটুকু আগে খাইয়া নেই। তুমি বরং আমারে একটু পানি দাও।’

এলুমিনিয়ামের জগ থেকে স্টিলের মগে পানি ঢেলে দিলো ফুল। খিচুড়ি মুখে পুরতে পুরতে আনোয়ার সর্দার জিজ্ঞেস করলো,

‘তোর চাচী, দাদী,ঝুমুর কই?’

‘চাচী বোধহয় নামাজ পরে। ঝুমুর আপা গোসলে গেছে।’

‘আর তোর দাদী?’

‘কে জানে! সকাল থেকে দেখিনি। আজ বৃষ্টি নেমেছে না সে নিশ্চয়ই খাটে পটের বিবি সেজে বসে আছে। আজ ঘর থেকে নামবে না।’

‘আমার নবাবজাদা কই?’

‘সকালে বেরিয়েছে এখনো ফিরেনি।’

‘তাইলে তুই খাইয়া নে মা।’

‘না চাচা, সবার সাথে বসে একসাথে খেয়ে নিবো।’

আনোয়ার সর্দার জোর করলেন না। ফুলকে সে তার নিজের মতো স্বাধীনতা দিয়ে দিয়েছে। বড় আদরের ভাতিজী বলে কথা।

শুভর জন্য অপেক্ষা করতে করতে রাত নয়টা বেজে গেলো। সারাদিনে বাসায় ফিরেনি সে। দুপুরের দিকে বৃষ্টি কমলেও বিকেলে এক পশলা হয়ে গেছে। এখন আবার কমে গিয়ে টিপটপ করে পরছে৷ সাথে এলোমেলো বাতাস। সাগরে নিম্নচাপ হয়েছে কিনা তা জানে না ফুল। তবে তার মনে হলো এমন কিছু হবে। নয়তো এলোমেলো বাতাস বইতো না৷ বাড়ির সবাই খেয়ে ঘুমিয়ে পরেছে আধা ঘন্টা আগে৷ বিদ্যুৎ নেই, তারমধ্য বৃষ্টির দিন। এতো জেগে থেকে কি করবে? কিন্তু শুভর কারণে ফুলের জেগে থাকতে হচ্ছে। চোখ দুটো ঘুমে জ্বলছে। তাকিয়ে থাকতে পারছে না। ছোট ঘুলঘুলি দিয়ে হু হু করে ঠান্ডা বাতাস প্রবেশ করে ভেতরটাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। কুপির আলো হালকা কেঁপে কেঁপে উঠছে।

‘কইতরির মা!’

ভেতরের দরজায় টোকা পরলো। সাথে নিচু গলায় শুভর ডাক। চকিতে উঠলো ফুল৷ চোখটা লেগে এসেছিলো। তবে উঠে গিয়ে দরজা খুললো না৷ আরো দুবার ডাকের অপেক্ষা করতে লাগলো৷ তিন ডাক না দিলে সে দরজা খুলবে না। গ্রাম এলাকায় নিশির ডাকের ভয় আছে। নিশি রাতে ভূত-প্রেত আপন, পরিচিত মানুষের স্বরে নাম ধরে ডাকে। তারা একবার কি দুইবার ডাকবে৷ তিনবার কখনোই ডাকবে না। এক ডাক কিংবা দুই ডাকে দরজা খুলে বেরুলে কেল্লাফতে। তাকে নিয়ে হয় তালগাছে তুলে আছাড় দিবে নয়তো হাঁটু সমান পানিতে মাথা নিচে দিয়ে পা উপরে করে গুঁজে রাখবে। ছোটবেলায় এরকম গল্প কত শুনেছে ফুল। মা, নানী, আশেপাশের মানুষের কাছ থেকে শুনতে শুনতে তার মনেও এসব নিয়ে ভয়ের দানা বেঁধেছে৷ যদিও এসব লোককাহিনীর ভিত্তি কতটুকু সে জানে না। এতো পড়াশোনা জেনেও ভূত বিশ্বাস করে জানলে মানুষ ফুলকে নিয়ে উপহাস করবে। তাতে ফুলের কিছু আসে-যায় না। সে ভয় কমাতে পারে না।

‘কিরে দরজা খুলবি না? আমি শীতে কাপতাছি।’

মেজাজ দেখিয়ে বললো শুভ।ফুল কাঁপা হাতে কুপি তুলে নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ালো।

‘কে?’

‘তোর জামাই।’

রাগী গলায় বললো শুভ। নিশ্চিত হয়ে দরজা খুলে দিলো ফুল৷ চুল ঝাড়তে ঝাড়তে ভেতরে ঢুকে শুভ বললো,

‘তুই এতো ভীতু কেন? বাইরে কি বাতাস। আমি ঠান্ডায় কাপতাছিলাম। তুই জিগাস কে? আমার কন্ঠ চিনোস না?’

‘চিনবো না কেনো?’

‘আয়ে পাশ করা মাইয়া ভুতের ভয় পায়। বিষয়টা আসলেই হাস্যকর।’

শুভর কথা পাত্তা না দিয়ে, ফুল হাই তুলে দরজার খিল এঁটে দিলো৷ শুভকে তাড়া দিয়ে বললো,

‘খেতে এসো। দুপুরে খিচুড়ি রান্না করেছিলাম। মধ্য রাত হতে চললো। আর তুমি! এখন এসেছো।ভেবেছিলাম দুপুরে আসবে৷ গরম গরম খিচুড়ি খেতে পারবে। সারাদিনে তোমার খবর নাই। সকালে বেরিয়ে এই এলে। তুমি না সেদিন জ্বরের থেকে উঠলে এর মধ্যে আবার অসুস্থ হতে চাও?’

‘বকরবকর করিস না। খিদা লাগছে। সারাদিন অনেক কাম করছি।’

‘কি কাজ করেছো তা আমার জানা আছে।’

‘জানলে ভালো। খাইতে কি দিবি? নাকি গিয়ে হুইয়া থাকমু?’

‘ইস, সারাদিন পর এসে পাকাল (জিদ) দেখায়। খাবারের রুমে আসো।’

‘সব ঘুমে?’

‘জ্বি, আপনি আসছেন কানা রাতে৷ সবাই কি আপনার জন্য জেগে বরণ ডালা নিয়ে বসে থাকবে?’

‘বেশি কথা শিইখা গেছোত।’

বিরক্তি প্রকাশ করলো শুভ। তা দেখে ফুল খিলখিল করে হেসে উঠলো। রাতের নিস্তব্ধতায় হাসির শব্দটা দেয়ালে দেয়ালে বারি খেয়ে মুখরিত হতে লাগলো শুভর কানে৷ হঠাৎ কি যেনো হলো শুভর, মন্ত্র মুগ্ধের ন্যায় ড্যাব ড্যাব করে ফুলের দিকে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে বললো,

‘এতো সুন্দর কেন মেয়েটার হাসি?’

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here