গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব -১২+১৩

#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_বারো

হসপিটালের সবার সামনে আচমকা ফাইজা’র গালে থা’প্প’ড় পড়তেই ফাইজা ছিটকে পড়ে যেতে নিলে নীরব ছুঁ মে/রে ধরে ফেললো। হঠাৎ, ঘটনা’টা ঘটে যাওয়ায় উপস্থিত সবাই অনেক’টা অবাক হয়ে আছে। ফাইজা এখনো বুঝতে উঠতে পারলো না থা’প্প’ড়’টা ও’কে কে মা/র/লো? নীরব ফাইজা’কে দাড় করিয়ে বললো…..

–ঠিক আছো তুমি?

ফাইজা ছলছল চোখ মাথা নাড়ালো। সায়মা খানম রেগে সামনে তাঁকাতে’ই রেজওয়ান’কে দেখে আরো রেগে গেলো। রেজওয়ান সেদিকে ধ্যান না দিয়ে ফাইজা’র সামনে এসে ফাইজা’র গালে আরেক’টা থা’প্প’ড় দেওয়ার জন্য হাত উঠাতেই নিরব ধরে ফেললো। রেজওয়ানের দিকে রাগী চাহনী নিক্ষেপ করে বললো……

—ফারদিন আজ ও’টি রুম’টায় আছে বলে আপনি এত বড় একটা স্পর্ধা দেখাতে পারলেন আংকেল? নয়তো, ওর ভালোবাসার গায়ে হাত তোলার অপরাধে দেখা গেলো আপনার হাত’টাই আর রইলো না……

বলেই রেজওয়ানের হাত’টা ছিটকে ফেলে দিলো। ফাইজা ভয়ে চোখ মুখ খিচে আছে। নিরবের কন্ঠ স্বর শুনতেই চোখ মেলে দেখলো নিরব আর রেজওয়ান দুজন দুজনের দিকে রাগী দৃষ্টি’তে তাঁকিয়ে আছে। সায়মা খানম তাড়াতাড়ি এসে ফাইজা’কে জড়িয়ে নিয়ে চেঁচিয়ে বললো……

–তোমার সাহস দেখে আমি অবাক রেজওয়ান। কোন সাহসে তুমি ওর গায়ে হাত তুললে? কে দিয়েছে তোমাকে এই সাহস?

সায়মা খানমে’র কথা শুনে রেজওয়ান কান্নার ভঙ্গী’তে বলে উঠলো……

–মা আপ……

রেজওয়ানের কথা শেষ না হতেই সায়মা খানম পূর্বের তুলনায় দ্বিগুন চেঁচিয়ে বললো……

—খবরদার তুমি আমাকে মা বলে ডাকবে না? তোমার ওই পাপী মুখে মা ডেকে মা শব্দ’টাকে অপবিত্র করো না প্লিজ…….

সায়মা খানমের কথা শুনে রেজওয়ানের মুখ’টা থমথমে হয়ে গেলো। সে পূর্বের মতো কান্না মাখা আদুরে গলায় বলতে লাগলো…….

—আপনি জানেন না এই মেয়ে’টার জন্য আমার ছেলে’টার আজ এই অবস্থা। এই মেয়ে’টাকে আমি কিছুতেই ছেড়ে দিব না।

বলেই ফাইজা’র দিকে রেগে এগিয়ে যেতেই নিরব রেজওয়ানের বুকে হাত দিয়ে থামিয়ে বললো……

–আপনি আমার বাবার বয়সী বলে এতক্ষনে নিজের হাত-মুখ দুটো’ই সামলে রেখেছিলাম। ডোন্ট ক্রোস ইউর লিমিট আংকেল। তাহলে, আপনার গায়ে হাত তুলতেও একবার ভাববো না।

রেজওয়ান রেগে নিরবের এপ্রোন দুই হাতে শক্ত করে ধরে বললো….

–তোমার সাহস তো কম না। তুমি এই রেজওয়ান’কে থ্রেট করছো।

নিরব হালকা হেসে রেজওয়ানের হাত দুটো ধরে জবাব দিলো…..

–জানেন তো বেস্ট ফ্রেন্ড মানে ভাইয়ের চেয়ে কম না। ফারদিনের বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে না ওর ভাই হয়ে ওর আমানত’কে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার।

বলেই রেজওয়ানের হাত নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। ফাইজা ছলছল চোখে সব দেখছে। কি হচ্ছে কিছুই ওর মাথায় ঢুকছেনা। সায়মা খানম এত ক্ষন চুপ থাকলেও এখন আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। ফাইজা’কে ছেড়ে রেজওয়ানের সামনে এসে রেজওয়ানের গালে ঠা’স করে একটা থা’প্প’ড় বসিয়ে দিয়ে জোরে বললো…..

—ছেলের জন্য দরদ উথলে পড়ছে তাইনা। এত বছর কোথায় ছিলো এই দরদ? সাত বছরের বাচ্চা’টাকে একা রুমে বন্দী করে যখন প্রেমিকা’কে নিয়ে চলে গিয়েছিলে তখন কোথায় ছিলো এই দরদ? এটা হসপিটাল আমার মুখ’ খুলিও না রেজওয়ান এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে বের হয়ে যাও? নয়তো……

আর বলতে পারলো না তার আগেই রেজওয়ান অপমানিত থমথমে মুখ নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। কয়েক-পা সামনে এগিয়ে ফাইজার দিকে এক ভয়ংকর চাহনী নিক্ষেপ করে চলে গেলো। সায়মা খানমের বুক চিড়ে এক ফালি দুঃখী নিশ্বাস আছড়ে পড়লো। ফাইজা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাড়িয়ে আছে। নিরব ফাইজার সামনে এসে দাড়িয়ে শান্ত কন্ঠে বললো……

–ভয় পেও না। ফারদিনের অনুপস্থিতিতে আমি থাকতে কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তুমি তো আমার ছোট্ট বোন…..

বলেই ফাইজার কাঁধে ভরসাপূর্ন এক হাত রাখলো। ফাইজা সব দিকে ছেড়ে ছলছল চাহনী নিক্ষেপ করে বললো…..

–উনি এখন কেমন আছে নিরব ভাইয়া?

ফাইজার কন্ঠস্বর যেনো জমাট বেধে আছে। কিছুতেই শব্দ বের হচ্ছেনা।।বুকের ভেতর ঝড় বইছে। সারাদিন গড়িয়ে অন্ধকার এসে গ্রাস করেছে চারদিকে। ফাইজা এখনো হসপিটালে। অনেক খোজাখুজির পর ও’নেগেটিচ [O-] রক্তের খোঁজ পাওয়া গেছে। ফাইজার কথা শুনে সায়মা খানম ও শান্ত দৃষ্টি’তে তাঁকালো নিরবে’র দিকে৷ নিরব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে থমথমে কন্ঠে বললো…..

–ফারদিনের মাথায় বড় একটা চো’ট লেগেছে। হাতে পায়ে বিভিন্ন জায়গায় অজস্র ছোট-বড় ইঞ্জুরি হয়েছে। প্রচুর ব্লাড’লস হয়েছে। কিন্তু….

নিরব থামতেই ফাইজার মনে হলো ওর দম এক্ষুনি বন্ধ হয়ে যাবে। কাতর স্বরে বললো….

–বলো না নিরব ভাইয়া???

নিরব শান্ত স্বরে জবাব দিলো….

–ঠিক বুঝতে পারছিনা৷ ৭২ ঘন্টা অবজারভেশনে রাখা হয়েছে ও’কে। ৭২ ঘন্টার মধ্যে সেন্স ফিরলে আলহামদুলিল্লাহ। আর না ফিরলে?

একটু থেমে আবার বলে উঠলো…..

–কোমায় চলে যাবে….

বলেই নিরব আর দাড়ালো না। বড় বড় পা ফেলে ওদের সাইড কাটিয়ে চলে গেলো। ফাইজা কয়েক পা পিছিয়ে দেয়াল ঘেষে বসে পড়লো তৎক্ষনাৎ। সায়মা খানম পাশে থাকা চেয়ারে ধপ করে বসে চেয়ারের হাতল চে’পে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ফাইজা’র শান্ত হয়ে বসে আছে। পাশের চেয়ার গুলোতে দুই হাত রেখে তার উপর মাথা রেখে শান্ত হয়ে রইলো। ফুঁপানোর একটা শব্দ ভেসে আসচ্ছে ফাইজার থেকে। সায়মা বেগম কপালে হাত দিয়ে একাধারে কেঁদে যাচ্ছে।
____________________________________________
রেজওয়ান বাড়ি’তে রাগে কিড়মিড় করছে। কাকন সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে বসে নখে নেলপলিশ লাগাচ্ছে। রেজওয়ানের রাগ দেখে কাকন দায়সারা ভাবে বলে উঠলো…..

–কে বলেছিলো ওদের কাছে গিয়ে সিমপ্যাথি চাইতে যেতে….

রেজওয়ান কাকনের দিকে অগ্নী ঝড়া চাহনী নিক্ষেপ করে বললো…..

—তোমাকেই কে বলেছিলো এক্সিডেন্ট’টা করাতে। ফারদিন যদি বেঁচে যায় তাহলে সবার আগে তোমাকে মা-র-বে?

রেজওয়ানের কথা শুনে কাকন মুচকি হেসে বললো….

— তুমি ওর প্রান ভ্রমরার রাগে হাত তুলেছো আজ। এতদিন তোমাকে বাবা বলে মা/রতে চেয়েও পারেনি। কিন্তু, যদি শুনে তুমি এই কি যেনো নাম( একটু মনে করার চেষ্টা করে) ওহ হ্যা, ফাইজা না ফিজা ওর গাঁয়ে হাত তুলেছো তাহলে আর কি? তোমার হাত’টাই গায়েব করে দিবে…….

কাকনের কথা শুনে রেজওয়ান টেবিলের উপরে থাকা ভাঁজ’টা ছুড়ে ফেলে বলে উঠলো…..

–আমার জীবনের সব থেকে বড় ভুল ছিলো তোমাকে বিয়ে করা আর তোমার কথায় সনিয়া’কে……

সনিয়া নাম’টা শুনতেই কাকন চোখ গরম করে রেজওয়ানের দিকে তাঁকাতেই রেজওয়ান রাগে বড় বড় পা ফেলে উপরে চলে গেলো। আর কাকন একটু রহস্যময় হাসি দিয়ে নিজে নিজেই বললো….

–এত বছর তোমাকে সহ্য করেছিলাম শুধুমাত্র তোমার এই বিশাল বাড়ি, সম্পত্তি’র জন্য। কিন্তু, এখন তো এইসব কিছু আমার। তাই তুমি বাঁচলে কি ম-রলে আই ডো’ন্ট কেয়ার। আমি তো এক সপ্তাহের মধ্যেই এই দেশ ছেড়ে সবার নাগালের বাইরে চলে যাব।

বলেই শব্দ করে হাসলো।
____________________________________________
ঘড়ির কাটা ১২ টা ছুঁইছুঁই। চারদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। সায়মা খানম দূর্বল হয়ে সেন্সলেস হয়ে যাওয়ায় তাকে পাশের কেবিনে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। ফাইজা’র বাড়িতে নিরব খবর দিয়ে দিয়েছে৷ ফাইজা’র বাবা-মা দুজনেই সারাদিন চিন্তায় ছিলো ফাইজা বাড়ি ফিরে’নি বলে। যখন খবর টা শুনেছে তারা এক প্রকার ছুটে হসপিটালে চলে এসেছে। এসেই ফাইজা’কে বিধ্বস্ত অবস্থায় ফারদিনের কেবিনের দরজার বাইরে বসে থাকতে দেখে ফাইজার মা হাঁউমাঁউ করে কেঁদে দিলো মেয়েকে জড়িয়ে। হাসনাত সাহেব দূর থেকে অসহায় দৃষ্টি’তে তাকিয়ে আছে ফাইজা’র দিকে। ফাইজা কাঁদছে না। ওর চোখ জোড়া স্থির। চোখ দিয়ে পানি পড়ে গালে মোটা করে পানির দাগ বসে গেছে। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে। ফাইজা’কে দেখতে এই মুহূর্তে পা’গলের থেকে কম লাগছে না। নিরব ফাইজা’র মাকে ড্রেস নিয়ে আসতে বলেছিলো। কারন সাদা জামা’টা রক্তে মাখামাখি অবস্থা। ফাইজার মা জোর করে ও’কে নিয়ে গেলো চেঞ্জ করা’তে। নিরব বসে বসে হাসনাত সাহেবের সাথে কথা বলছে। চেঞ্জ করে ফাইজা নিরবের সামনে এসে দাড়িয়ে করুন স্বরে বললো…..

–একবার একটু তাকে দেখতে দিবেন নিরব ভাইয়া……

নিরব ফাইজার দিকে অসহায় চাহনী দিয়ে বললো….

–ফারদিনের জীবন এখনো ঝুঁকিতে রয়েছে। এই মুহূর্তে ওর কেবিনে ঢোকা সম্পূর্ণ নিষেধ বোন….

নিরবের কথা শুনে ফাইজার চোখের অবাধ্যজল গুলো গড়িয়ে পড়লো। ভেতরের জমাট বাধা কান্না গুলো বেড়িয়ে আসতে চাইলো। ফাইজা কান্না নিবারন করার চেষ্টা করে বললো…..

–প্লিজ ভাইয়া একবার একটু দেখে চলে আসব। একটুও কাঁদব না। একটুও শব্দ করব না। তাকে ধরব ও না। দূর থেকে দেখব। এই যে এই যে দেখুন আমি এক্ষুনি চোখের পানি মুছে নিচ্ছি। কারন, সে জেগে যদি দেখে আমি কাদঁছি তাহলে রেগে না জানি একটা থা’প্পড় বসিয়ে দেয়…..

বলেই হাসতে হাসতে কেদে দিলো। ফাইজার অবস্থা দেখে ফাইজার মা মুখে আঁচল গুঁজে নিঃশব্দে চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে। হাসনাত সাহেবের ও চোখের কোনে পানি জমে আছে। নিরব কোনো মতে নিজেকে সামলে ফাইজা’কে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিলো। অনুমতি পেয়েই ফাইজা দৌড়ে ফারদিনের কেবিনে চলে আসলো। ফারদিনের কেবিনে ঢুকে ওর দিকে তাঁকাতেই ফাইজার হার্টবিট কমতে শুরু করলো। শ্বাসকষ্ট শুরু হবে কিছুক্ষন পর এমন মনে হচ্ছে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো ফারদিনের বেডের সামনে। এই তো এই ছেলে’টাই আজ ওর সাথে রেগে চলে এসেছিলো। এই ছেলে’টাই কাল রাতে হাসচ্ছিলো। আর আজ.. ভাবতেই ফাইজা’র চিৎকার করে কান্না আসচ্ছিলো ভেতর থেকে। বুকের ভেতর থেকে হাহাকার ভেসে আসচ্ছে। স্তব্ধ হয়ে থমকে দাড়ালো ফাইজা। নিশ্বাস যেনো ক্রমশ বন্ধ হয়ে আসচ্ছে। পা জোড়া স্থির হয়ে রইলো। নির্বাক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে ফারদিনের দিকে। মাথা সম্পূর্ণ পাষান সাদা ব্যান্ডেজে আবৃত। মুখে অক্সিজেন মাস্ক। কাঁদের দিক’টা পুরোটাই ব্যান্ডেজ প্যাচানো। গাল’টা রক্তিম হয়ে আছে। হাতের মধ্যে ব্যান্ডেজ প্যাচানো। ডান পায়েও সাদা ব্যান্ডেজ ঘিরে রেখেছে। এই ছেলে’টাকে সাদা রঙে চোখ ধাধানো সুন্দর লাগতো। তাহলে, আজ কেনো এই সাদা রঙ’টা এই ছেলে’টার গায়ে বড্ড বেমানান লাগছে। ফাইজা আর ভাবতে পারলো না বেডের সামনে বসে বেড’টাকে দুই হাতে শক্ত করে ধরে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। অস্পষ্ট স্বরে বলতে লাগলো……

–একবার উঠবেন প্লিজ। আপনাকে এইভাবে দেখতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। একবার উঠুন না প্লিজ। আমি আপনার সাথে কোনো দিন অভিমান করব না। প্লিজ উঠুন আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। উঠুন না প্লিজ উ…..

আর বলতে পারলো না ধপ করে নিচে পড়ে গেলো সেন্সলেস হয়ে………
#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_তেরো

এত সিকিউরিটির মাঝেও ফারদিন’কে মা/রার চেষ্টা করা হয়েছে। এর মুখের থেকে অক্সিজেন মাস্ক খুলে দিয়েছিলো কেউ। হসপিটালের প্রত্যেকজন নার্স, সার্ভেন্ট, এমন’কি ডাক্তার’রা অব্দি নিরবের সামনে মাথা নিঁচু করে দাড়িয়ে আছে। সায়মা খানম ও আজ বেশ সুস্থ বোধ করেছেন। কিন্তু ফাইজার অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। সেন্স ফিরলে’ই পা’গ’লের মতো আচরণ করছে। তাই বাধ্য হয়ে ও’কে ঘুমের ইঞ্জেকশন পুশ করে দিয়েছে নিরব। সকাল থেকে এখন অব্দি মেয়ে’টার হাতে স্যালাইন চলছে। ফারদিনের পাশের কেবিনে ই ফাইজা’কে রাখা হয়েছে। ফারদিনে’র জন্য বরাদ্দ ৭২ ঘন্টার মধ্যে কেটে গেছে প্রায় ২৫ ঘন্টা। বাইরে সবার চেঁচামেচি শুনে সায়মা খানম আর ফাইজা’র মা হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে এসে দেখে। নিরব সবার সাথে রাগারাগি করছে। সিকিউরিটি গার্ড মাথা নিঁচু করে কিছু বলতে’ই নিরব রেগে চেঁচিয়ে বললো…..

–আপনারা এত দায়িত্ব জ্ঞানহীন কি করে হতে পারেন? আপনাদের বার বার করে বলেছিলাম এদিক’টায় সারাদিন রাত নজর রাখতে। আপনারা সবাই কি ঘুমাচ্ছিলেন? ঘুমানোর জন্য আপনাদের রাখা হয়েছে…..

সায়মা খানম কিছু বুঝতে না পেরে নিরবের সামনে এগিয়ে গিয়ে কি হয়েছে জানতে চাইলে? নিরব জানালো কেউ ফারদিনের কেবিনে ঢুকে ও’কে মা/রার চেষ্টা করেছে? কথা’টা শুনেই ফাইজার মা আর সায়মা খানম দুজনেই ভয়ে কেঁপে উঠলো। ভয়ার্ত কন্ঠে বললো….

–ফারদিন ঠিক আছে তো নিরব? ওর কোনো ক্ষতি হয়নি তো।

প্রতিউওরে নিরবের থেকে অভয় বানী পেয়ে তারা দুজন শান্ত হলো। পরক্ষনেই সায়মা খানম হতাশ ভঙ্গী’তে বলে উঠলো….

—কিন্তু, এত সিকিউরিটির মাঝেও কে এত বড় একটা স্পর্ধা দেখালো? তাকে খুঁজে বের করে প্রাপ্য শাস্তি দিবে। দায়িত্ব’টা তোমাকে দিলাম…..

বলেই সে ফাইজা’র কেবিনের দিকে পা বাড়ালো। সাথে ফাইজা’র মা ও গেলো।

–সিসি টিভির ফ্রুটেজ গুলো চেক করুন দ্রুত। অনলি টেন মিনিট টাইম দিলাম আপনাদের কে বা কারা এসেছিলো ওই কেবিনে সব ডিটেইলস আমার চাই???

নিরব সবাই’কে আরো বেশি এলার্ট থাকতে বলে চলে গেলো। সিসি টিভি ফ্রুটেজ’টা পাঠিয়ে দিতে বললো ওর কেবিনে। নিরব চলে যেতেই ওদের মাঝে একজন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। যে করেই হোক সিসি টিভির ফ্রুটেজ ওর হাতে পৌঁছাতে দেওয়া যাবেনা। ভেবে নিলো। ফোন’টা বের করে কারোর নাম্বারে একটা নেক্সট করে দিয়ে আড়ালে সরে এলো……
____________________________________________
–একদম কাঁদবে না। চোখের পানি তাড়াতাড়ি মুঁছে নাও। নয়তো কিন্তু…..

ফারদিনের কথা শুনে ফাইজা কাঁদতে কাঁদতে বললো…..

–কাঁদব। একশো বার কাঁদব। আপনার কি? আপনি আমার উপর অভিমান করে কেনো জোরে গাড়ি চালিয়েছিলেন? যদি আমার উপর অভিমান করে ওইভাবে গাড়ি না চালাতেন তাহলে আজ আপনার এই অবস্থা হতো না। এইসব কিছুর জন্য আমি দায়ী। আমার জন্যই আজ আপনার এই অবস্থা……

বলেই আবারো কেঁদে দিলো। ফারদিন আর সহ্য করতে না পেরে স’পাটে একটা থা’প্প’ড় বসিয়ে দিলো ফাইজার গালে। তারপর নিজেই আবার ওর চোখের পানি গুলো মুছিয়ে দিয়ে ও’কে বুকের সাথে চে’পে ধরলো। থা’প্প’ড় খেয়ে অটোমেটিক ফাইজার কান্না থেমে গেলো। ঘটনা’টা বুঝতে ওর কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো। যখন বুঝলো তখন ফারদিনের থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য হাত-পা ছু’ড়তে লাগলো। ফারদিন ও’কে আরো জোরে চে’পে ধরে বলে উঠলো …..

–থা’প্প’ড়’টা কি কম হয়ে গেছে। আরেক’টা থা’প্প’ড় খেতে না চাইলে চুপচাপ শান্ত হয়ে যাও। কতবার বলছি তোমার কান্না আমার সহ্য হয়না। নেক্সট টাইম যদি দেখছি বিনা কারনে চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছো তাহলে……

ফাইজা কান্না মাখা কন্ঠে বলে উঠলো….

–তাহলে আবার একটা থা’প্প’ড় মা/রবেন তাইতো। কথা নাই আপনার সাথে আমার। হুউউ রাগ করছি……

ফাইজার বাচ্চা বাচ্চা কথা শুনে ফারদিন একটু মুচকি হেসে ওর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। তারপর পরম যত্নে গালের মধ্যে লেপ্টে থাকা চুল গুলো কানের পাশে গুঁজে দিতে দিতে বললো……

–নাহ তো কে বললো আমি থা’প্প’ড় মা/রব। আমি তো তোমার থেকে বহু দূরে চলে যাব। যেখান থেকে কেউ আর ফিরে আসেনা। তুমি চাইলেও আমাকে ছুঁতে পারবে না……..

ফারদিনের এহেতুক কথায় ভয়ে কেঁপে উঠলো ফাইজা। শক্ত করে দুই হাতে ফারদিনের শার্ট খামচে ধরে ফারদিনের বুকের সাথে মিশে যেতে নিলো। ভয়ার্ত কন্ঠে বলতে লাগলো……

–নাহ আমি আপনাকে কোথাও যেতে দিব না। আপনি কোথাও যাবেন না প্লিজ। আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারব না। থাকতে পারব না আমি…….

বলেই জোরে চিৎকার করে উঠে বসলো ফাইজা। এত ক্ষন স্বপ্ন দেখছিলো ও। ফাইজা’র বেডেই মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলো ওর মা আর একটু দূরের চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছিলো সায়মা খানম। ফাইজার চিৎকার শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠে তারা দুজন। ফাইজা উঠে বসতেই ওর চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। শরীর বেগতিক ভাবে কাঁপছে। ফাইজার অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে তারা দুজনেই দৌড়ে আসলো। তাদের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে মেয়ে’টা দুঃস্বপ্ন দেখেছে। ফাইজার মা মেয়ে’কে পরম আবেশে বুকে জড়িয়ে নিলো। মায়ের স্নেহ পেয়েই মেয়েটা হুহু করে কেঁদে উঠলো। সায়মা খানম দাড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মেয়ের এই অবস্থা কিছু’তেই সহ্য করতে পারছেন না নাদিয়া বেগম। হাসনাত সাহেব রাতে বাড়ি চলে গিয়েছে। হসপিটালে ওরা তিনজনেই ছিলো৷ মেয়ের পা’গ’ল পা’গল অবস্থা দেখে নাদিয়া বেগম মনে প্রানে সবস্র দিয়ে আল্লাহ’র কাছে চাইছে যেনো ফারদিন সুস্থ হয়ে যায়। নয়তো যে তার মেয়ে’টা পা’গল হয়ে যাবে। ফাইজা একনাগাড়ে কেঁদেই চলেছে। ফাইজার মা মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত কন্ঠে বলতে লাগলো……

–সব ঠিক হয়ে যাবে মা। এভাবে ভেঙে পড়িস না। উপর ওয়ালা কাউকে নিরাশ করেন না। ও ঠিক সুস্থ হয়ে যাবে……

মায়ের কথা শুনে ফাইজা কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো……

–পুরো একটা দিনের বেশি চলে গেলো মা। কেনো এখনো উনি ঠিক হলো না? আমি উনা’কে এইভাবে নিতে পারছিনা মা? খুব কষ্ট হচ্ছে আমার…….

বলেই আবার কেঁদে দিলো। তারপর নিজেকে ওর মায়ের থেকে ছাড়িয়ে ওদের বাধা অতিক্রম করেই দৌড়ে চলে এলো ফারদিনের রুমে। ফারদিনের দিকে নির্বাক, অশ্রুসিক্ত চোখে তাঁকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন। কত’টা স্নিগ্ধ লাগছে চেহারা’টা। বুকের মধ্যে কতগুলো যন্ত্র লাগানো। ফাইজার ইচ্ছে করছে এক্ষুনি সব ছিড়ে ফেলে দিতে আর চিৎকার করে বলতে….

–আপনাকে খুব বাজে লাগছে। আপনি আর কখনো সাদা ড্রেস পড়বেন না। খুব বাজে লাগে……

কথা গুলো ভাবতেই ফাইজা আলতো হাতে ফারদিনের হাত’টা নিজের গালের সাথে চে’পে ধরে কেঁদে দিলো। আর অস্পষ্ট স্বরে বলতে লাগলো…..

–এই হাতের ছোয়া গুলো আমি বড্ড মিস করছি।

আরো কিছু ক্ষন একা একা ফারদিনের দিকে তাঁকিয়ে থেকে কিছু বলতে বলতে ফারদিনের বেডেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে ফাইজা।
____________________________________________
বিপদের সময় গুলো খুব দীর্ঘ হয়। বিপদের রাত’ বড্ড পাষান হয় কিছুতেই কা’টতে চায়না। সময় গড়িয়ে যেতে চায়না কিছু’তেই। তিন দিন যেনো ফাইজার কাছে তিন বছর মনে হচ্ছে। ৭২ ঘন্টা হতে আর মাত্র কিছুক্ষন বাকি। ফাইজা হসপিটালের থেকে এক পাও নড়ে’নি। ফাইজার মা ও মেয়ে’কে রেখে যেতে ভরসা পাচ্ছেনা। সায়মা খানম আজ সকাল সকাল একটু বাড়ি গিয়েছে জরুরী কাজে। ফারদিনের কেবিনে ওর বেডের সামনে চেয়ারে বসে আছে ফাইজা। উদাসীন ভঙ্গী’তে চেয়ে আছে ফারদিনের দিকে। মনের মধ্যে কত শত আশা’রা ঘর বেঁঁধেছে। ফারদিনের হাত’টা দুই হাতে শক্ত করে আকড়ে ধরে আছে। এই তিন’দিনেই ফাইজার চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। চেহারা’টা শুকিয়ে গেছে। চোখ গুলো ফুলে লাল হয়ে আছে। চেহারার মধ্যে এক’টা দুঃখ এসে ভর করেছে। এই ছেলে’টাকে ছাড়া ও কত’টা অসহায় এই তিন দিনে বুঝতে পারছে ও? ফাইজা বসে বসে এইসবি ভাবছিলো। তখনি কেউ একজন অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে…….

—চোখ গুলো বড্ড বেশি ফুলে গেছে। আর কত কাঁদবে?

চেনা একটা কন্ঠস্বর পেতেই ফাইজা’র হার্টবিট বেড়ে গেলো। ও কি ভুল শুনেছে? নাকি স্বপ্ন দেখছে আবার। ভাবতে ভাবতে ভয় ভয় চোখে সামনে তাঁকাতেই দেখে ফারদিন ওর দিকে চেয়ে আছে এক নজরে। ফারদিনের জ্ঞান ফিরেছে? ভাবতেই ফাইজা’র অবাধ্য চোখে শ্রাবন ধারা নেমে আসলো। ফাইজা খুশিতে ফুঁপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। ফারদিন হাত’টা উঠাতে নিয়েও পারলো না। ব্যাথায় নামিয়ে নিলো। কথা বলতে কষ্ট হলেও আস্তে করে বললো……

–আর কেঁদোনা প্লিজ।

ফাইজার কেনো যেনো কান্না থামছেই না। এই কন্ঠস্বর শোনার জন্যই তো তিন দিন ধরে ব্যাকুল হয়ে ছিলো। ওর তো এখন কাঁদার কথা না খুশি’তে হাসার কথা। তাহলেও কেনো কাদছে। ফাইজার কান্না থামার নাম নেই। ফারদিন আবারো বলে উঠলো……

—তোমার কান্না আমার সহ্য হয়না। প্লিজ ডোন্ট ক্রাই…..

বলেই অসহায় চাহনী নিক্ষেপ করলো ফাইজার দিকে। ফাইজা দুই হাতে চোখের জল টুকু মুছে নিয়ে। মুখে হাসির রেখা টানার চেষ্টা করলো। তা দেখে ফারদিন ও একটু মলিন হাসার চেষ্টা করলো। দুজনের মুখেই আজ হাসি ফুটেছে……..

#চলবে

[]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here