চন্দ্রপুকুর পর্ব -০৭

#চন্দ্রপুকুর
||৭ম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
নিশুতি রাত্রি, দিলরুবা যামিনীর সিক্ত চুলগুলো অতি যত্নের সাথে শুকিয়ে দিচ্ছে ধোঁয়ার সহায়তায়। রাত্রির নীরবতা গ্রাস হয় ঠক-ঠক শব্দে। চমকে উঠে যামিনী।

নিজের কোমরে শাড়ির ভাজে গুঁজে রাখা ছোট্ট ছুরিটা হাতে চেপে ধরে দিলরুবাকে ইশারা করে দরজা খোলার জন্য। দরজা খুলে দিলরুবা। হেলেদুলে প্রবেশ করেন সেই অপরিচিত মাঝবয়সী নারী।

“কী গো কন্যা ভীতিগ্রস্ত হয়েছিলে না কি অর্ধরাত্রিতে কারো আসার শব্দ পেয়ে?”

হো হো করে হেসে উঠেন তিনি। বেশ কাছাকাছিও এসে পড়েন কিশোরীর। তাঁর গা থেকে নির্গত লাগামছাড়া দুর্গন্ধের সহ্যে করতে না পেরে পিছিয়ে যায় যামিনী।

দিলরুবা বলে উঠে,
“আদব বজায় রাখুন। বেগম থেকে দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলুন।”

“যে পেলো না শেরপুর, জমিদারি সে আবার হবে জমিদারনি? ভালোই রসিকতা করতে পারো দাসী।”

“কী চান আপনি আমার নিকট? কেন এসেছেন এখানে? বের হন, নাহলে আমি প্রহরীদের ডাকতে বাধ্য হবো।”

দমিত ভয় নিয়ে চোখ রাঙায় যামিনী। তাতেও যেন দমার নয় এই নারী।

বরং, একদম নিকটে যেয়ে ফিসফিসিয়ে শুধায়,
“আমার সব শেষ করে দিয়েছে এই নবাববাড়ি, বাকি রেখেছে শুধু রহস্য হৃদয়ে গেঁথে রাখা আমাকে। ডাকো কাকে ডাকার। আমি গুলবাহার খাতুন, অমবস্যার ঐ কালরাত্রি আমি যাকে সমাপ্ত করতেও কেউ তার সম্মুখে আসতে চায় না।

তোমাকে পোড়াতে আমার বেশ লাগে। মনে হয় যন্ত্রণা ভাগাভাগি করছি। কন্যা, জমিদারি চাইলে জমিদারকে খুশি রাখা আর জমিদার চাইলে জমিদারিকে যথার্থ রাখা আবশ্যক। আজ পূর্ণিমার এই রজনীতে শাহের কক্ষ যে শূণ্য রেখেছো না যেয়ে, অন্যকেউ পূর্ণ করছে কি না তাও চিন্তা-চেতনায় রেখো।”

গুলবাহার খাতুন তাঁর মতোই একই পথ দিয়ে হেলেদুলে চলে যান। যামিনী তাঁর যাওয়ার পানে তাকিয়ে দিলরুবাকে প্রশ্ন করে,
“জানো কে এই নারী?”

“না, বেগম। এতোটা সময় অন্দরমহলে ঘুরাঘুরি করেছি, উনাকে মাত্র দু’বার দেখলাম। উনার বিষয়ে দাসীরাও কিছু জানে না, আর খাদিমরা মুখ খুলে না। আমার তো মনে হয় তিনি মানসিক বিকারগ্রস্ত মাতাল। মদের কী বাজে গন্ধই না আসছিল তাঁর দেহ থেকে!”

“আমি জানতে চাই উনার পরিচয়। সাধারণ কেউ তো এতোটা দুঃসাহসিকতা দেখাতে পারবে না। তুমি চেষ্টা করো জানার উনি কে? তবে উনি যা বললেন তা নিয়ে তোমার কী মনে হয় দিলরুবা?”

“বেগম, ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন। আমি জানি আমি কেউ না আপনাকে উপদেশ দেওয়ার, তবুও আমি একমত এই খাতুনের সাথে।”

“হুম। আমার এ পর্যন্ত আসা পোশাক থেকে মৃদু গোলাপি বর্ণের মোলায়েম উত্তরীয়টি বের করো। রাণী গোলাপি শালটাও। আমার সেবায় নিয়োজিত দাসীদের ডাকাও। এতোটা মোহনীয় ভাবে সাজাও আমায়, যাতে মায়াজালে ফেঁসে যান বাবু মশাই।”

যামিনী অত্যন্ত মনযোগ দিয়ে তৈরি করে নিজেকে তার বাবু মশাইয়ের জন্য। অতঃপর মাথা ওড়নায় ঢেকে সে দাসীদের সাথে অগ্রসর হয় মেহমাদ শাহের কক্ষের দিকে।

মেহমাদ শাহ আগামীকাল শহরে যাওয়ার জন্য কাগজপত্র প্রস্তুত করতে ব্যস্ত। প্রহরী এসে জানায়,
“জমিদার নবাব শাহ, বেগম চন্দ্রমল্লিকা এসেছেন। আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছেন তিনি।”

“তাকে বলো আমি ব্যস্ত…”

বলতে বলতেই থেমে যায় যুবক। এই নারীটিকে কেন যেন সে প্রত্যাখ্যান করতে পারে না প্রতিবারই। গোপণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়।

দরজা খোলা হয়। ধীর পায়ে প্রবেশ করে রমণী। দরজা আটকানোর শব্দে মেহমাদ শাহ চোখ তুলে তাকান। তাৎক্ষণাৎ নিজের গায়ের শাল ছেড়ে দেয় যামিনী। মেহমাদ শাহের নিকটে যেয়ে নতজানু হয়ে তার হাত দুটো ধরে আবেগপ্রবণ চাহনি নিক্ষেপ করে।

“আগামীকাল, আমার নিকট থেকে আবার মাইল মাইল দূরে চলে যাবেন আপনি। বিরহ নামক অসহ্যকর যন্ত্রণা আবারও ভোগ করতে হবে আমাকে। এই যন্ত্রণায় ডুবার পূর্বে সান্ত্বনা স্বরূপও কি আপনার ছোঁয়ায়, চুম্বনরসে সিক্ত হতে পারি না আমি?”

মেহমাদ উপেক্ষা করতে পারে না। উঠে দাঁড়িয়ে বক্ষে জড়িয়ে নেয় নিজের চন্দ্রমল্লিকাকে। তাদের জীবনের আরেকটি রঙিন রাত্রির রচনা হয়।

___

মেহমাদ শাহ চলে গিয়েছে সবার থেকে বিদায় জানিয়ে। কক্ষে এসে মুখে আঁচল চেপে কাঁদছে যামিনী। দিলরুবা তাকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টারত।

“আপনি এভাবে ভেঙে পড়বেন না বেগম। এখনও অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া বাকি, অনেকটা যুদ্ধ করা বাকি। এই সামান্য কথায় অশ্রুর মতো দামী মুক্তোদানার বর্ষণ করলেই অচিরেই ব্যর্থতার মুখ দর্শন করতে হবে।”

যামিনীর হৃদয়ের যন্ত্রণা আজ কথার বাণেও হ্রাস পাচ্ছে না। তীব্রতর হচ্ছে বটে। এমন সময় দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেন মোর্শেদা খাতুন।

“কী ব্যাপার? তুমি এভাবে কাঁদছো ক্যানো চন্দ্রমল্লিকা? তোমার কি কোনো অসুবিধা বোধ হচ্ছে? কোনো অসুবিধা হলে আমাকে এক্ষনই জানাও, আমার পুত্র বিশেষ ভাবে তোমাকে আমার নিকট গচ্ছিত রেখে গিয়েছে। আমি তাকে অভিযোগের সুযোগ দিতে চাই না।”

তাঁর আতঙ্কিত কণ্ঠে স্তম্ভিত হয়ে ক্রন্দন থামিয়ে দেয় কিশোরী। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থাকে।

দিলরুবা মুখশ্রীর হাসি চাপিয়ে মাথা নত করে শুধায়,
“এমন কিছু হয়নি মোর্শেদা খাতুন। জমিদার বাবু চলে যাওয়ায় বেগমের কান্না।”

মেহমাদ শাহের প্রিয় আম্মাজান খিলখিল করে হেসে দেন। এগিয়ে এসে কপোলের অশ্রু মুছে ললাটে চুমু খান।

“কী প্রগাঢ় ও উত্তেজনাকর ভালোবাসা! মাশা আল্লাহ! নজর না লাগে কালো হৃদয়ের অধিকারীদের। তবে বেগম আপনার ভালোবাসার মানুষ একজন জমিদার। সে ঘরে বসে থাকবে কি? সে তো এ প্রান্ত যাবে, ও প্রান্ত যাবে দেশের, শহরে যাবে। তাই বলছি, ক্রন্দনরত্ন এমন বিফলে যেতে দিয়ো না।”

“ক্রন্দনরত্ন?”

জিজ্ঞেসু দৃষ্টি যামিনী। এক গাল হাসেন মোর্শেদা খাতুন। কন্যাটি যে বড়োই অনঘ (নিষ্পাপ), নির্মল এই জমিদার বাড়ির জন্য।

“নারীদের জন্য সময়, পরিস্থিতির সাপেক্ষে ক্রন্দন শুধু অনুভূতির প্রকাশই হয় না, হয় মুখ্য হাতিয়ারও সবার ভাবনার উর্ধ্বে যেয়ে।

এসব এখন থাকুক। নিজের মন, বাহ্যিকতা শুধরাও, জমিদার গিন্নিদের এভাবে মানায় না।সামান্য শহরে গেলে কাঁদার কিছু নেই। আবার তো তোমার কামরাতেই ফিরবে তাই না?”

“জী, বেগম। মোর্শেদা খাতুন একদম ঠিক বলেছেন। এবার তো একটু হাসি ফুটান মুখমণ্ডলে।”

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানায় যামিনী। ভাবুক গলায় বলে,
“আচ্ছা দিলরুবা, তুমি কখনো শহরে গিয়েছো? শহর কেমন হয় দেখতে?”

“তওবা, তওবা, কী যে বলেন না বেগম! আমরা সাধারণ গ্রামবাসীরা আবার শহুরে যেতে পারি না কি? জানেন না গ্রামবাসীদের উপর অভিসম্পাত আছে শেরপুরের বাহিরে না যেতে পারার। যারা যারা এই গ্রাম ত্যাগ করে শহরের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে তিন-চারদিন পর তাদের সবার লাশ পাওয়া গিয়েছে সীমানায়। কেউ তো জীবনের ভয়ে বহু অর্থের সুযোগ পেয়েও এ দুঃসাহস দেখাবে না কখনও।”

শঙ্কায় আত্মা কম্পিত হয় রমণীর। ভীতচিত্তে মুখ খুলে,
“কী বলছো এসব দিলরুবা? বাবু মশাই তো সবে শহরের উদ্দেশ্যে বের হলো। তার কোনো ক্ষতি হবে না তো?”

“না, না, বেগম। তাঁর ক্যানো ক্ষতি হবে? জমিদার বংশের সকলেই তো আল্লাহর বিশেষ রহমত প্রাপ্ত। তাঁদের কখনও কোনো বিপদ বা বাধা আসেনি শহুরের পথে। এ অভিসম্পাত শুধুমাত্র সাধারণ মানুষদের উপরেই।”

“অদ্ভুৎ অভিসম্পাত! মর্যাদার ভিত্তিতে পরিণাম পরিবর্তন…”

“নীরব হও উভয়ে!”

আচমকাই ধমক দিয়ে উঠেন মোর্শেদা খাতুন। তাঁকে যেন বিচলিত হতে দেখতে পেল যামিনী। অবাককর লাগলো বিষয়টি।

হয়তো অসামঞ্জস্য পূর্ণ আচারণ করে ফেলেছেন তিনিও বুঝতে পেরেছেন। তাই ঠোঁট ভিজিয়ে মৃদু হেসে উপদেশ করেন,
“আসলে যোহরের আজান দিবে একটু বাদে। তবে এখনও স্নান নেওনি চন্দ্রমল্লিকা, তাই বলছিলাম। যোহরের সালাতের পরই ভোজনশালায় এসে পড়বে পরিবারের সদস্যেরা। তাই দিলরুবা গল্প-গুজুব বাদ দিয়ে বাকি দাসীদের নিয়ে চন্দ্রমল্লিকার জন্য হাম্মামখানা প্রস্তুত করো।”

হ্যাঁ বোধক ইশারা করে দিলরুবা। তিনি বিদায় জানিয়ে বেড়িয়ে যান। যামিনীর অদ্ভুৎ লাগছে এ বাড়িকে, সব কিছুই কেমন যেন বেমানান, রহস্যঘন, ছদ্মবেশী।

___

বাগানে বসে শরবতের স্বাদ নিতে নিতে গৌধূলী লগ্ন উপভোগ করছে যামিনী। তার মনোরঞ্জনে বাধাদান করে একজন দাসী এসে উপস্থিত হয়।

জানায়,
“বেগম চন্দ্রমল্লিকা, আপনাকে অতি শিঘ্রই তাঁর কক্ষে উপস্থিত হতে আদেশ করেছেন বেগম লুৎফুন্নেসা।”

প্রতিটি কোষ কোষ কম্পিত হয় যামিনীর। শঙ্কিত সে, কী হতে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here