চন্দ্রপুকুর পর্ব -০৮

#চন্দ্রপুকুর
||৮ম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
তীব্র ভীতি নিয়ে বেগম লুৎফুন্নেসার কক্ষের দোয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে যামিনী। প্রহরী তাকে দেখে খবর দিতে কামরার অভ্যন্তরে গমন করে।

“বেগম চন্দ্রমল্লিকা, আপনাকে বেগম লুৎফুন্নেসা ভিতরে প্রবেশ করতে বলেছেন।”

দোয়ার খুলে দেওয়া হয়। দুরুদুরু কম্পিত হৃদয় নিয়ে কক্ষের গহীনে প্রবেশ করে যামিনী।

কক্ষের থেকে একটি কাঠের দেয়ালের সহায়তায় পৃথককৃত পার্শ্বে নরম শিমুল তুলার গদি ও বড় চৌপায়া আসবাব বসানো বৈঠকের সুবিধার্থেই হয়তো।

সেখান থেকেই ডাক দিয়ে উঠেন বেগম লুৎফুন্নেসা,
“চন্দ্রমল্লিকা! এদিকে আসো মেয়ে।”

যামিনী ধীর পদক্ষেপে আভিজাতিকচিহ্ন বহনকারী নারীটির সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে ঝুঁকে বলে উঠে,
“আসসালামু আলাইকুম দাদীজান। আপনি ডেকেছিলেন শুনলাম।”

“হুম, ডেকেছিলাম অবশ্যই। কী করবো বলো কন্যা? তুমি আমার পৌত্রের ললাটে লেপিত কলঙ্ক, এমন কলঙ্ক যা আমার সিংহ সাদরে গ্রহণ করেছে। যতোই হোক বিবাহ তো সম্পন্ন হয়েছে। এমন একটা পরিস্থিতি আমি চাইলেও এই কালিমা মুছতে পারবো না।

যেহেতু আমার সিংহের স্ত্রী হয়েছো এখানে থাকবে, তার সঙ্গ দিবে, সুস্বাস্থ্যবান, উত্তম ও সুন্দর শাহাজাদি ও শাহাজাদাকে দুনিয়াতে আনবে। কিন্তু ভুলক্রমেও এই বাড়ির পুত্রবধূ কিংবা জমিদারনি হওয়ার স্বপ্ন বুনো না। অন্যথায় তোমার এই স্বপ্ন আমি আয়নার ন্যায় ভেঙে চুরমার করে দিব।”

যামিনী নীরব। নত আঁখি অশ্রুতে টইটম্বুর।

“কী বলেছি বুঝতে পেরেছো কন্যা? আমার কিন্তু তোমার থেকে কোনো সমস্যা নেই। তুমি হিন্দুত্ব সংস্কৃতিতে বড়ো হয়েছো বা কৃষ্ণ রঙা বা বংশ পরিচয় হীনা তা নিয়ে আমার কোনো রূপ প্রশ্ন নেই। তোমার একটাই ত্রুটি, তোমার মাঝে ঐ কূটনীতিক শিক্ষাদীক্ষা, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা, দক্ষতা ও সম্ভ্রান্ততন্ত্র নেই যা শেরপুরের জমিদারনি হতে প্রয়োজন।”

এবার চোখ উঠিয়ে বেগম লুৎফুন্নেসার পানে তাকায় যামিনী। হাঁটু গেড়ে বসে প্রশ্ন করে উঠে,
“আমি যদি যোগ্য হয়ে উঠি দাদীজান, তবে…? তবে কি পাবো না জমিদারনির মর্যাদা?”

“সেটা সময় বলবে। যোগ্যতা অর্জন করা সহজ কথা নয়। এই জমিদারির সাথে অসংখ্য রহস্য মাটিচাপা পড়ে আছে। তাদের রক্ষা করতে হবে। আর রক্ষা করতে হলে জানতে হবে তোমায়, যার জন্য বিশ্বাস অর্জন করা অত্যাবশ্যক।

এখন যাও, তৈরি হয়ে নেও। আমাদের বংশের নিয়ম নব বিবাহিত বধূ গোটা গ্রামে খেজুর, নতুন চাল আর রাজকীয় বাসন নিজ হাতে বিলিয়ে দেয় গ্রামবাসীদের মাঝে। আয়েশা খাতুন, যেয়ে দেখো এসপি সাহেব হয়িতো অপেক্ষারত অন্দরমহলের প্রবেশপথে। তাকে নিয়ে আসো।”

তড়িৎগতিতে বেগম লুৎফুন্নেসার খাস বাঁদী ও অন্দরমহলের হিসাবরক্ষক আয়েশা খাতুন বেড়িয়ে যান। কয়েক মিনিট পেড়িয়ে যেতেই আয়েশা খাতুনের আগমনের জানান দেয় প্রহরী। দাসীরা কক্ষ হতে পৃথককৃত এই অংশের যতোটুকু অনাবৃতি ছিল ততোটুকুও পাতলা পর্দার দ্বারা আবৃত করে দেওয়া হয়।

“আসসালামু আলাইকুম, বেগম লুৎফুন্নেসা। আল্লাহ আপনাকে সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু দান করুক। নবাববাড়ির মর্যাদা আরও বাড়ুক।”

“হুম, তোমাকে ক্যানো ডাকা হয়েছে তা নিশ্চয়ই আমার চিঠির দ্বারাই বুঝতে পেরেছো। অনুষ্ঠানটি সঠিক ও সুষ্ঠুতার সাথে সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব। কোনো রূপ অঘটন ঘটলে আমি তোমাকে দায়ী মনে করবো এসপি।”

“বেগম লুৎফুন্নেসা, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। ভরসা করুন আপনার এই ভৃত্যের উপর, আপনাকে একদণ্ড সুযোগ দিব না হতাশ হওয়ার।”

“তুমি এখন যেতো পারো।”

এসপি সাহেব নৈশব্দে বের হয়ে যান। বেগম লুৎফুন্নেসা যামিনীকেও তৈরি হওয়ার তাগিদ দিলে, সেও বেড়িয়ে যায়।

জমকালো কাজের আলখাল্লা পরানো হয় তাকে। নিকাবের আড়ালে ঢেকে যায় তার মুখশ্রী। মাথায় পরানো জমিদার মেহমাদ শাহের দেওয়া জমিদারনির মুকুট।

নিজেকে আয়নায় দেখে নিজেই যেন আশ্চর্যান্বিত হয়ে যাচ্ছে যামিনী। কে জানতো এই কৃষ্ণকায়া অভাবে বড়ো হওয়া রমণী জীবনের এক অধ্যায়ে এমন পর্যায়ে চলে যাবে যে সে-ই দু’হাতে দান করবে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে।

“আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, কী আনন্দ দিলে তুমি আমায় আল্লাহ! সম্পূর্ণ মর্যাদা না পাই, আজ সকলের চোখে জমিদারের স্ত্রী হওয়ার মর্যাদা তো পাচ্ছি, সামনে ইনশাআল্লাহ সবকিছুই পাবো।”

মনে মনে আল্লাহকে বারবার শুকরিয়া জানাচ্ছে রমণী। তবে সে আদৌ জানে তার উদ্দেশ্যে অপেক্ষারত পরিস্থিতি মঙ্গলকর না অমঙ্গলকর?

___

অন্দরমহলের সদরদরজার দিকে দিলরুবার সাথে হাসাহাসি ও গল্পগুজবে মেতে এগিয়ে যাচ্ছে যামিনী। তখনই সদরদরজার সম্মুখে হাসিমাখা মুখশ্রী নিয়ে দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখে গম্ভীর হয়ে যায় যামিনীর মুখশ্রী।

“অভিনন্দন বেগম চন্দ্রমল্লিকা। শুনলাম, আজ আমাদের বংশের রীতি পালন করতে যাচ্ছো। কী অদ্ভুৎ না যামিনী মানে বেগম? কিছু দিন আগে ছিলে সেই জন-সাধারণ চাষাদের একজন, আজ বেগম হয়ে গিয়েছো কোনো যোগ্যতার বিনাই।”

আজ আর মেহনূরের তিক্ত বাণী বিনা কোনো শব্দের উচ্চারণে গলাধঃকরণ করতে পারে না যামিনী। বরং, মিথ্যে হাসি দেয়।

“কী করবো বলেন শাহাজাদী! ভাগ্য বলেও একটা বিষয় আছে। এই যেমন আমার ক্ষেত্রেই দেখেন কোনো প্রচেষ্টা, যোগ্যতা, রূপ ছাড়াই শাহের হৃদয় এবং সম্রাজ্যের ধর্মীয়ভাবে এবং সামাজীকভাবে একমাত্র সম্রাজ্ঞী আমি। আর কেউ কেউ তো যোগ্যতা, বংশপরিচয়, শিক্ষা, শত প্রচেষ্টার পরও ব্যর্থ। তাদের হস্ত শূণ্য, হৃদয় ঈর্ষার আগুনে পরিপূর্ণ। ”

মেহনূরের তেজস্বী মুখশ্রী রাগের উত্তাপে দগ্ধিত হতে দেখা যায়, যদিও অন্তরালে রাখার যথাসম্ভব প্রচেষ্টা। যামিনী এই দৃশ্য দেখে সাহারা মরুভূমির মাঝে জমজমের জল পানের নেয় তৃপ্তি পেল।

একজন দাসী এসে উপস্থিত হয় ঘটনাস্থলে।
“আসসালামু আলাইকুম, বেগম চন্দ্রমল্লিকা। আপনার বাহন প্রস্তুত করে হয়েছে, এখন যাত্রা করার জন্য একদম তৈরি।”

“চলো দিলরুবা, যাওয়া যাক। নবাব মহলে ফেরার পর হুজুর অথবা শিক্ষিকার নিকট যেয়ে আমার জন্য পানিতে ফুঁ দিয়ে এনো। আজকে অনেকের হৃদয় পুড়বে হিংসার অনলে, আমার না অনিষ্ট হয়ে যায়!”

দিলরুবা বুঝতে পেরে চাপা হেসে উত্তর দেয়,
“অবশ্যই বেগম। কথায় আছে, হিংসা ও প্রশান্তি কখনই একসাথে থাকতে পারে না। সুতরাং, আপনার অনিষ্ট কামনাকারী যে শতভাগ একজন অশান্তিপূর্ণ মানুষ।”

মেহনূর আর সেখানে স্থির থাকে না। অপমানের বিপরীতে হৃদয়ে পুঞ্জিভূত তীব্র আক্রোশে হনহন করে নিজের দাসীদের নিয়ে স্থান ত্যাগ করে।

যামিনীর পালকি উঠে, যাত্রা শুরু হয় রহমতপুরের উদ্দেশ্যে। তার পালকি ঘেরাও করে রেখেছে পঞ্চাশের অধিক দেহরক্ষী এবং পুলিশদের গাড়ি।

অবশেষে ঘণ্টা দু’খানেকের ভ্রমণের অন্তে গন্তব্যে পৌঁছায় রমণীর পালকি। দিলরুবা ও অন্য একজন দাসী নেমে পর্দা সরিয়ে হাত এগিয়ে দেয় নামার সুবিধার্থে। যেই গ্রামে ছেলেবেলা থেকে ঘৃণ্যদৃষ্টি ও অবজ্ঞাসূচক বচনের মাঝে বেটে উঠা তার, সেই গ্রামেই আজ জমিদারনির বেশে পা রাখছে সে।

সে নিচে নামতেই প্রায় প্রতিটি গ্রামবাসী একই সুরে বলতে শুরু করে,
“জয়, বেগমের জয়! জয়, নবাববাড়ির জয়!”

এসপি সাহেবের পথপ্রদর্শনে দিলরুবার সঙ্গে সবার সম্মুখে এসে দাঁড়ায় যামিনী। একে একে সকলে আসতে শুরু করে। মুখে তেজস্বিনী হাসি নিয়ে খাদিমদের ধরে রাখা সিন্দুক থেকে একে একে সকলকে অন্ন ও বস্ত্র তুলে দেয় যামিনী।

“আপনাকে সুখী করুক আল্লাহ বেগম। শত সূর্যের ন্যায় তেজস্বী সন্তানের জননী করুক।”

“আল্লাহ আপনাকে মেক হায়াত দান করুন বেগম। নবাবের সাথে আপনার সম্পর্ক সদা আনন্দ ও সুখে ভরে থাকুক।”

সবাই নিজেদের মতো হৃদয় শান্তিদান করার মতো দোয়া করছিল রমণীর উদ্দেশ্যে। কারো কারো কথায় তৃপ্তি পেয়ে সে তার গায়ের অলংকার খুলে দিয়ে দেয়।

কিন্তু সবার মাঝেই এমন ওড়নার আড়ালে লুকোয়িত একজন তার নিকট আসে। ত্রাণ হাতে তুলে নিয়ে শুধায়,
“চালচুলোহীন ঘুঁটেকুড়ানির ভাগ্যে রাজপুত্র মানায় না; রক্ত মানায়, মৃত্যু মানায়।”

বিপরীত কোনো শব্দ উচ্চারণের পূর্বেই তার কৃষ্ণ চামড়া ভেদ করে ঢুকে পড়ে তীক্ষ্ণ ছুড়ি। মুহূর্তেই লাল রক্তে ভেসে যায় তার অঙ্গ। হইচই পড়ে যায় জনসমুদ্রে, ভীড়ের মাঝেই হারিয়ে যায় সেই মুখোশধারী মানুষটি। তবে এ-ই কি যামিনীর অন্ত ছিল?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here