চন্দ্রপুকুর পর্ব -০৯

#চন্দ্রপুকুর
||৯ম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
যামিনী শুভ্র ঘরে শুভ্র বিছানায় শায়িত। ঘরের দ্বারে দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামছেন এসপি সাহেব। বেগম লুৎফুন্নেসার নিকট ইতিমধ্যে এ খবর পাঠিয়ে দিয়েছেন। গর্দান না যায় তাঁর এই অসতর্কতার কারণে।

ঘটিয়ে নবাব বাড়ির বিশেষ বৈদ্যশালায় প্রবেশ করেন কালো বস্ত্রে দেহ আবৃত বেগম লুৎফুন্নেসা। তাঁকে দেখেই দিলরুবা ও এসপি সাহেব সহ বৈদ্য এবং তাঁর সহকারীরা ঝুঁকে সালাম জানায়।

কোনোরকম ‘হু’ উচ্চারণ করে ভিতরে প্রবেশ করেন তিনি। যামিনীর অচেতন, পাণ্ডুর মুখখানা দেখে বুক ধ্বক করে উঠে তাঁর, সেই সাথে বাড়ে দুশ্চিন্তা ও ক্রোধ।

মনে মনে ভাবে,
– এবার তার সিংহকে কী জবাব দিবে সে?

“অবস্থা এখন কেমন বেগম চন্দ্রমল্লিকার?”

“চিন্তা করবেন না বেগম লুৎফুন্নেসা। জমিদার নবাব শাহের বেগম খুব দ্রুতোই সুস্থ হয়ে উঠবেন। সৌভাগ্যের বিষয় ছুড়িটা বিষ মাখানো ছিল না এবং খুব বেশি ভেদ করে অভ্যন্তরে যেতে পারেনি।”

“আলহামদুলিল্লাহ। আমার সামান্যতমও ত্রুটি চাই না আমার শাহের প্রিয় মনোরঞ্জিনীর চিকিৎসায়। খুব দ্রুতোই তার সুস্থতা চাই। আমার সিংহ এই নবাববাড়িতে চরণ ফেলার পূর্বে যেন এই ক্ষতের নাম ও চিহ্ন মিলিয়ে যায়।”

“ইনশাআল্লাহ বেগম লুৎফুন্নেসা। আমি আমার সর্বোচ্চ দিব, আপনি নিশ্চিত থাকুন। এখন বেগমকে ঔষধ দেওয়ায় ঘুমিয়ে আছেন, তবে অচিরেই উঠে যাবেন।”

আরেক দফা পর্যবেক্ষণ করে নিলেন যামিনীর প্রাণশক্তি শূণ্য হয়ে পড়ে মুখমণ্ডল। কক্ষ থেকে বের হয়েই ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন এসপি সাহেবের উপর। পুরুষটির দৃষ্টি নত, লজ্জিত ভঙ্গিমা।

“সামান্য একটা অনুষ্ঠানের দায়িত্ব দিয়েছিলাম তোমাকে এসপি, তাও সামলাতে পারলে না। আর তুমি কি না দায়িত্ব নিয়ে বসে আছো শেরপুরের থানার, নবাববাড়ির রহস্য রক্ষার। আজ থেকে তুমি চাকরিচ্যুত হলে, চাকরিচ্যুত!”

“বেগম…!”

“চুপ! একদম চুপ! আমি তোমার মুখ থেকে একটা শব্দও শ্রবণ করতে চাই না। আয়েশা খাতুন চলো।”

এসপি সাহেব ভেবে পাচ্ছেন না কী করবেন তিনি। এই চাকরি তাঁর কাছে সোনার ডিম পাড়া মুরগি বৈকী কিছুই নয়, এই যোগ্যতায় মাসিক বেতনই তিন লক্ষ মুদ্রা। যেহেতু বেগম লুৎফুন্নেদার মুখমণ্ড থেকে যেহেতু এ বাণী উচ্চারিত হয়েছে, তাই আর চাকরি বাঁচানোর সম্ভাবনা শূণ্যের কোঠায়। তবুও শেষবার একটা সুযোগ নিতে চান তিনি, তাই সকলের আড়ালে যেয়ে পকেট থেকে বের করেন জাদুকরী বাক্সটি।

___

“শাহাজাদি! শাহাজাদি মেহনূর! শুনেছেন জমিদার বাড়িতে চলমান গুঞ্জন?”

শাহাজাদি মেহনূরের বিশেষ দাসী রত্না আনন্দ ও উত্তেজনাপূর্ণ মন নিয়ে কক্ষে ঢুকে। সে তখন নিজের প্রিয় হরিণের গোশত খেতে ব্যস্ত।

“ওহহো রত্না! এতো কী খুশির খবর জেনেছো যে এমন ভাবে উত্তেজিত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! একটু সবুর করো, শান্ত হও, তারপর জানাও।”

“আরে শাহাজাদি সংবাদই এমন। আপনিও প্রাণোচ্ছল, সতেজ হয়ে পড়বেন। ঐ চন্দ্রমল্লিকাত উপর হামলা হয়েছে অনুষ্ঠানে, বৈদ্যশালায় অচেতন হয়ে পড়ে আছে এখন। একদম ঠিক হয়েছে, খুব সখ ছিল বাঁদী থেকে বেগম হওয়ার! হুহ!”

তড়িৎগতিতে শাহাজাদি মেহনূর আহার করা থামিয়ে দেয়। স্তব্দ তার চাহনি, ভঙ্গিমা।

“কী বললে রত্না? আবার বলো তো মেয়ে। আমি কি ভুল শুনলাম?”

“না আমার শাহাজাদি, আপনি একদম সঠিক শুনেছেন। নবাবের কর্ণ ও আঁখিতে পর্দা লাগানো নারীর ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ক্ষত-বিক্ষত!”

“তাহলে আমি এখানে কী করছি? আমার নারীটিকে দেখতে যেতে হবে। না, না, সবকিছুর পূর্বে নানীজানের কামরায় যাওয়া লাগবে।”

কথাগুলো বলতে বলতেই উঠে দাঁড়ায় মেহনূর। রত্না চমকিত হয়। অপ্রিয় রমণীর প্রতি এতো কীসের দরদ বোধগম্য হচ্ছে না।

প্রশ্ন করার সুযোগও পায় না সে। তার পূর্বেই উত্তরীয় গায়ে জড়িয়ে কক্ষের দোয়ার খুলে বেরিয়ে যায় শাহাজাদি। পিছন পিছন সেও যায়।

বেগম লুৎফুন্নেসার কক্ষের সদরদরজায় পৌঁছালে সাক্ষাৎ হয় বেগম নুর বাহারের সঙ্গে। সালাম জানায় সে। দু’জনই প্রবেশ করে কক্ষ।

বয়োজ্যেষ্ঠ নারীটি চিন্তিত ও দুঃখিত বেশে নরম গদির উপর বসে।

“আসসালামু আলাইকুম সুন্দরীশ্রেষ্ঠা বেগম। আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘায়ু দান করুক।”

“আমিন। ওয়ালাইকুম আসসালাম। তোমরা এ ওয়াক্তে…?”

“দাদীজান, শুনলাম বেগম চন্দ্রমল্লিকার উপর না কি হামলা হয়েছে। বেশ লাগলো হৃদয়ে। আহারে এটুকু মেয়েটা…! তাই খবর নিতে চলে আসলাম। কেমন আছে সে?”

“সুসংবাদই, চন্দ্রমল্লিকা ঝুঁকি ও বিপদ মুক্তো। তবে কন্যার মুখশ্রী একদম ফ্যাঁকাসে হয়ে গিয়েছে। ইশ!”

বেগম নূর বাহারের ললাটে সূক্ষ্ম ভাঁজ। নিজের অমত ও রাগ টুকু অন্তরালে রেখে শুধায়,
“আম্মিজান, আপনি ঐ অমাবস্যার যামিনীকে নিয়ে এতো চিন্তিত হচ্ছেন কেন বুঝতে পারছি না। ও মরলে মরুক, বাঁচলে বাঁচুক, আমাদের কী? আর মেহনূর তোমার হৃদয় শিশিরের ন্যায় অমলিন আমি জ্ঞাত এ সম্পর্কে। তবে মনে রেখো শত্রুকে দয়া তো দূরে থাকুক সহানুভূতিও দেখাতে নেই।”

বেগম লুৎফুন্নেসা নিজের অধর ভেজায়। ক্ষিপ্ত ভঙ্গিমায় তাকায় পুত্রবধূর পানে।

“তোমার এতো বড়ো স্পর্ধা তুমি আমাকে প্রশ্ন করো! এই ক্ষণে তোমায় তোমার ঐ দু’পয়সার পিতার নিকট ফেলে আসার ক্ষমতা রাখি আমি তা কি ভুলে বসেছো?”

“না, না, আম্মিজান। আপনি মনে কষ্ট নিবেন না। আমি দুঃখিত, আমার ভুল হয়েছে। আমি শুধু কৌতূহলী হয়ে…”

“আমার চেয়ে অধিক বুঝতে এসো না, অনেক বেশি আঘাত পাবে। চন্দ্রমল্লিকা আর যা-ই হোক, তবে আমার সিংহের অতিপ্রিয়। তার উপর একটা আঘাত পড়বে, আমাদের উপর দশটা প্রশ্ন মেহমাদের, হ্রাস পাবে বিশ্বাস। কারণ শুধু মেহমাদ নয়, এই নবাববাড়ির প্রতিটি মানব জ্ঞাত আমাদের চন্দ্রমল্লিকাকে না মেনে নেওয়া সম্পর্কে।”

“দুঃখিত আম্মিজান। আমি প্রকৃতপক্ষেই এভাবে বুঝাইনি।”

“মুখ বন্ধ করে বিদায় হও আমার নজরের সামনে থেকে! আমি একা থাকতে চাই।”

শাহাজাদি মেহনূর ও বেগম নূর বাহার নিয়মানুযায়ী বিদায় জানায়। কক্ষ ত্যাগ করতেই ফোঁস করে এক শ্বাস ফেলেন বেগম লুৎফুন্নেসা।

বিড়বিড়ান,
“তোমরা বুঝবে না ঐ কন্যার মাঝে কী আছে, বুঝবে না।”

___

যামিনীর চোখের সম্মুখে ধীরে ধীরে আলোর উন্মেচন ঘটে। সর্বপ্রথম যে মুখশ্রীটি দেখতে পায় তা হলো দিলরুবার।

“বেগম আপনি ঠিক আছেন তো? কিছু লাগবে আপনার?”

“আমি বেঁচে আছি তবে…? ফিরতে পেরেছি আমার বাবু মশাইয়ের দুনিয়াতে।”

“হ্যাঁ, পেরেছো আমার সোনামুখী রাণী। আমার চন্দ্রমল্লিকা, যার খুশবুতে আমার প্রাণের বাস, সে ফিরে না এসে থাকতে পারে?”

হুট করে মেহমাদ শাহের কণ্ঠ শুনে বহু কষ্টে আশেপাশে তাকায় সে। কিন্তু কোথাও নেই প্রিয় মানুষটি। তখনই নজর স্থির হয় তার কানের নিকটে বিদ্যমান যন্ত্রটির দিকে। বিস্মিত নয়তে তাকিয়ে থাকে শুধু।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here