চাদোঁয়া মহল পর্ব -০৬

#চাদোঁয়া_মহল
পর্বঃ০৬
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা

চন্দ্ররেখা কিছুটা চমকালো।অশ্রুভেজা আঁখি নিয়ে মানুষটির দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকালো।লোকটি পুনরায় বলা শুরু করলো।কন্ঠে যুক্ত হলো অঢেল নমনীয়তা।

—–“বিয়ে এই জাহানের সব থেকে বিশুদ্ধ বন্ধন।স্বামী স্ত্রীর চারপাশে তৈরি অদৃশ্য এক বেষ্টনী হলো বিয়ে। যে বেষ্টনী চাইলেই সহজে ভেঙে ফেলা যায় না।একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ একজন বিবাহোপযোগী মেয়েকে বিয়ের জন্য কী প্রপোসড করতে পারে না!!এটা কি তার হীন মানসিকতার পরিচয় বহন করে?আজকে আপনার বাবা সুস্থ থাকলে তার কাছে আপনার হাত চাইতাম।কেবলমাত্র পরিস্থিতির প্রতিকূলতার জন্য আপনার কাছেই আপনাকে চেয়ে বসেছি।”

চন্দ্ররেখা ক্ষীণ কন্ঠে বললো,

—–“আমি বিয়ে করতে পারবো না।আপনি আমার এবং আমার পরিবার সম্পর্কে জানলে হতো এই কথা বলতেন পারতেন”…….

——-“আমি আপনার ব্যাপারে যতোটুকু জানি ততোটুকুই আমার জন্য এনাফ।আমি কেবল আপনাকে চাই!!আপনি না চাইলেও, আমি চাই।”কন্ঠে এক সমুদ্র সমান আকুলতা মিশিয়ে লোকটি বলে উঠলো।

মানুষটির মুখনিঃসৃত বাণী কিছু একটা ছিলো যা রেখার হৃদয়ে ধা*ক্কা মারলো!!কিছু না বলে,, সে চুপ করে রইল।কি বা বলবে সে!!রেখা এতোটুকু বুঝতে পেরেছে বাবাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হলেও যে তার এই মানুষটির সাহায্য দরকার।মানুষটি উঠে দাঁড়ালো, চন্দ্ররেখার দিকে একটা কার্ড এগিয়ে দিলো। রেখা প্রথমে বুঝতে পারলো না!!মানুষটির যখন চোখের ইশারায় নিতে বললো,স্বাভাবিকভাবে হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিলো।

—–“আশা করি, আপনি আমার দেওয়া প্রপোজালটা বিবেচনা করে দেখবেন!!আর বিবেচনা না করলেও সমস্যা নেই।আমার কাছে অন্য উপায় আছে।”
কোনোরকম জড়তা নেই কন্ঠে।একদম স্বাভাবিক। তারপর মুচকি হাসি দিয়ে সামনে থাকা মানবীর দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলে উঠলো,

—-“নিজের খেয়াল রাখবেন!আল্লাহ হাফেজ।”

মানুষটি এসেছিলো ঝড়ের বেগে।ঠিক ঝড়ের ন্যায় সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়ে চলে গেল। দীর্ঘকায় সেই মানুষটির পেছন পেছন আরিফ নামের লোকটিও হাঁটা শুরু করলো।চন্দ্ররেখা কিছু সময় বিধ্বস্ত মন নিয়ে রেস্টুরেন্টে বসে রইলো।মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গেছে তার!!নিজেকে যতোই শক্ত করার প্রয়াস চালাক না কেন,ছোট্ট এই জীবনের সবকিছু যে তার কাছে বেশ দুর্বোধ্য ঠেকছে!!!বড়ই নিঃসঙ্গ লাগছে !নিজেকে প্রশ্ন করল,আজকে মা পাশে থাকলে কি তাকে সামলে নিতো পারতো?পরক্ষণেই জবাব পেয়ে গেলো,মায়ের পাশে থাকার হলে তো আর তাকে ছেড়ে যেতো না।

চন্দ্ররেখা হাতে থাকা কার্ডটিতে নজর বোলালো।বামপাশে লেখার দিকে তাকিয়ে রইলো।”Mirza kintwear and Mirza Housing”লেখাটির কিছুটা নিচে ফোন নম্বর ও এড্রেস দেওয়া।কার্ডটির ডানপাশে কোম্পানির ছোট্ট একটা লোগো আঁকা। লোগোর কিছুটা নিচে বড়ো করে লেখা ” Sharaf Mirza” তার নিচে লেখা CE0!! চন্দ্ররেখার বিরবির করে নামটি নিজের মনে কয়েকবার আওড়ালো।

——–

রেখা ভেবেছিলো সারাফ নামের লোকটি হয়ত তাকে বিরক্ত করবে।কিংবা তার সাথে পুনরায় যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে।কিন্তু তার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে, মানুষটি একেবারে লাপাত্তা হয়ে গেলো।এর মধ্যে ছয়দিন অতিবাহিত হয়ে গেল।এতে রেখার চিন্তা কমার বদলে যেন আরো বেড়ে গেলো।সারোয়ার নামের সেই লোকটির জবানবন্দির জন্য যে সেই ভিডিওটা ভীষণ প্রয়োজন!! বারোদিন পরে কোর্টের শুনানি,কি করে বাবাকে সে নিরপরাধ প্রমাণ করবে!!এসব ভাবতে ভাবতে রেখার প্রচন্ড মাথা ব্যথা শুরু হলো।অতিরিক্ত চিন্তায় তার মাথা ফেটে যাওয়া উপক্রম।এসবের মধ্যে একটি ভালো জিনিস হলো,তার দাদি আগের চেয়ে বেশ সুস্থ। হাঁটাচলার গতি যেন আগের চেয়ে বেড়ে গেছে।চন্দ্ররেখা ইদানীং আরো একটা বিষয় লক্ষ্য করেছে, তার দাদি কার সাথে যেন ফোনে ফুসুরফাসুর কথা বলে।কথা বলার সময় তাকে বেশ উৎফুল্লই মনে হয়!!চন্দ্ররেখা যতোবার জিজ্ঞেস করেছে, ততোবারই বলেছে তার স্কুল জীবনের বান্ধবীর সাথে নাকি কথা বলে।চন্দ্ররেখা অবশ্য এ নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় নি।

ফ্লাটের ছোট বারান্দায় বসেছিলো চন্দ্ররেখা।বিকেল প্রায় শেষের পথে,পাখির কলকাকলীতে চারপাশ মুখরিত!!এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো।লাগাতার বেজেই চলসে!এতে রেখা বিরক্তির সীমা যেনো অসহ্য মাত্রায় যেয়ে ঠেকলো!অন্য সময় হলে ডোর ভিউ দিয়ে কে এসেছে,সেটা আগে দেখে নিতো।আজকে না দেখেই দরজা খুললো সে।দরজার অপরপাশের তিনজন মানুষকে দেখে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো!!তড়িঘড়ি করলে বুকে ছড়িয়ে রাখা সুতি ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে নিলো।এরই ফাঁকে শারাফ ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লো।তার পেছন পেছন আরিফ নামের লোকটি,আর হুজুর গোছের একজন লোক ঢুকলো।বিনা দ্বিধায় তারা ড্রইং রুমের সোফায় বসে পড়লো। হুজুর গোছের লোকটির হাতে বেশ কাগজপত্র, সে একটু পর পর তার আধাপাকা লম্বা দাঁড়িতে হাত বোলাচ্ছে। ঘটনার আকস্মিকতায় চন্দ্ররেখা হতভম্ব।সে এখনো দরজায় সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হুশ আসতে ব্যস্তসমস্ত পায়ে শারাফের দিকে এগিয়ে গেল।ভেবেই নিয়েছিলো কিছু কড়া কথা শোনাবে সে,পূর্বেই তার দাদি ইয়াসমিন চৌধুরী মুখে হাসি নিয়ে হেলেদুলে এগিয়ে এলো!!চন্দ্ররেখাকে এক প্রকার টেনে ঘরে নিয়ে গেলো।তারপর রেখার দুই বাহুতে হালকা করে হাত রেখে শক্ত কন্ঠে বলতে লাগলো,

—“দেখ রেখা!!আমার কসম লাগে কোনো তামাশা করবি না,আজকেই তোর বিয়া হইবো।তোর মায় তো নাগ*রের লগে ভাগছে,তোরে নিয়া আমি কোনো ঝামেলা নিতে পারমু না!!তোরে বিয়া দিয়া আমি মনজুর বউয়ের সাথে হের গ্রামে যামু। আর নিজের বাপের জন্য হইলেও এখনই এই বিয়া করবি,না হইলে আমার মরা মুখ দেখবি।”

চন্দ্ররেখাকে নিঃশেষ করার জন্য এতোটুক কথাই যথেষ্ট ছিলো।সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। দাঁড়ানো অবস্থা থেকে ফ্লোরে বসে পড়লো। ইয়াসমিন চৌধুরীর মুখের বচন তার কাছে এসিডের ন্যায় ঠেকলো,তার হৃৎপিণ্ড দগ্ধ হয়ে গেলো!রেখার মনে হলো তার দেহের সর্বাঙ্গে বিষাক্ত কিছু পোকা আক্রমণ চালিয়েছে যাচ্ছে। তার হৃদয় যেনো স্তব্ধ ও বিমূঢ় হয়ে গেছে!!জোরে জোরে সে শ্বাস নিতে লাগলো।কান্নার দমকে মুখ লাল হয়ে গেলো।তার দাদী যে কতোটা নিরুপায়,সে একবার তার মুখের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলেই হয়তো বুঝতে পারতো।চন্দ্ররেখা উঠে দাঁড়ালো, ক্রোধে সে দিশেহারা। ধপধপ শব্দ করে এগিয়ে গেল সোফার রুমের দিকে।ইয়াসমিন চৌধুরী রেখার যাওয়া দিকে তাকিয়ে চোখ থেকে পানি ছেড়ে দিলো।

শারাফ ফোনে কিছু একটা করছিলো,সামনে কারো উপস্থিতি পেয়ে চোখ তুলে চাইলো।চন্দ্ররেখার চোখের দিয়ে তাকিয়ে তার চোখে জ্বালা হতে লাগলো,এই চোখ যে একদম ভিন্ন। চোখ থেকে যেন দীপ্তিমান রশ্মি নির্গত হচ্ছে।

——“আপনার সাথে আমার একা কিছু কথা আছে।”

শক্ত অথচ কাঁপা কাঁপা গলায় বললে উঠলো রেখা।শারাফ চন্দ্ররেখার পেছন পেছন একটা রুমে প্রবেশ করলো। রেখা স্বাভাবিকভাবেই দরজা ভিড়িয়ে দিলো।তারপর আচমকা দু’হাতে শারাফের শার্টের কলার চেপে ধরলো। চিৎকার করে বলতে লাগলো,

—–“একটা মেয়ের অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে লজ্জা লাগছে না!!বিয়ে না হয় করলেন,কতোদিন আমাকে নিজের কাছে ধরে রাখতে পারবেন?আমার বাবাও আমার মাকে আটকে রাখতে পারি নি,আপনিও পারবেন না।”

চিৎকার এবার আহাজারিতে পরিণত হলো। কান্নার দমকে তার কথা অস্পষ্ট হয়ে আসছে।

—-“আমি পারবো না,বিশ্বাস করেন একদম পারবো না বিয়ে করতে।বিয়ে দুনিয়ায় সবচেয়ে অনর্থক সম্পর্ক। আপনি আমার সাথে কোনোদিন সুুখী হতে পারবেন না।”

রেখার এতোকথার বিপরীতে শারাফ কেবল একটা কথাই বললো।কন্ঠে অদ্ভুত ধরনের শীতলতা।এতেই রেখা সুনিশ্চিত হয়ে গেলো,বিয়ে ছাড়া যে তার আর কোনো উপায় নেই। সে শারাফের শার্টের কলার থেকে হাত নামিয়ে নিলো।তাদের পাশের ফ্লাটে দুটো মেয়ে থাকে, দুজনেই পার্লারে কাজ করে।ইয়াসমিন চৌধুরী তাদের ডেকে নিয়ে এলো।এক প্রকার সাদামাটা ভাবে বিয়ে সম্পন্ন হলো।বিয়ে পর শারাফ যখন রেখাকে প্রথম দেখলো তার মনে হলো,এ যেন এক অনিন্দ্যসুন্দরী পরী মূর্তি। বিদায়ের সময় রেখা একদম চুপ করে রইলো,চোখ থেকে এক ফোঁটা পানিও বের হলো না।ইয়াসমিন চৌধুরীর ক্রন্দন তার অন্তরে বিন্দুমাত্র প্রবেশ করলো না।

———–

মশার কামড়ে হুঁশে আসলো। অস্ফুট নিশ্বাস বের হয়ে এলো।এখানে এসেছে ইতিমধ্যে একদিন হয়ে গেছে।ঝিল্লিপুরে চাঁদোয়া মহলের প্রতিটি মানুষ যে কতোটা সম্মানিত সেটা বুঝতে তার বেশ সময় লাগে নি।আকাশের দিকে তাকিয়ে চন্দ্ররেখা খেয়াল করলো সন্ধ্যা বেশ প্রগাঢ় হয়ে এসেছে।ঘাড় ঘুরিয়ে বাম পাশে তাকাতে সে বেশ হকচকিয়ে গেলো।তার পাশে পা ঝুলিয়ে বসে আছে শারাফ। কেমন যেন এক গভীর দৃষ্টিতে তার মুখে দিকে তাকিয়ে আছে!!এমন মাদকময় দৃষ্টি দেখে রেখার সর্বাঙ্গে শিহরণ বয়ে গেলো। কখন এলো সে?রেখা কেন টের পেলো না!!এমনভাবে বা কি দেখছে??

চলবে
আমি প্রতিদিনই গল্প দেওয়ার চেষ্টা করবো।প্রতিদিন না পারলেও একদিন পর পর অবশ্যই দিবো ইনশাআল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here