ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_১০
.
অনিকের কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে বিরক্ত হয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল আফরা। তবুও শেষ রক্ষা পেল না। দুইটার দিকে তার বাবা-মা এসে হাজির। কলিংবেলের শব্দ শুনে ইভা প্রথমে ভেবেছিল অনিক ভাই এসেছেন। সে আগ্রহ নিয়ে দরজা খুলে দিতেই সুফিয়া বেগম ইভার দিকে ক্ষীণ সময় তাকিয়ে রইলেন। তারপর এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘মাইয়াটা কি মিষ্টি দেখো, তোমার মা-বাপ ভালা তো মা?’
ইভা অস্বস্তিতে পরে গেল। সে সালাম দেয়নি৷ এখন দিলে কি কোনো সমস্যা হবে? না-কি দেরি হয়ে গেছে? তবুও সালাম দিয়ে বললো, ‘জি ভালো আছেন, ভেতরে আসুন।’
মিরাজুল সাহেব এবং সুফিয়া বেগম ভেতরে এলেন। ছুটির দিন হওয়াতে সবাইই বাসায় ছিল। শুধু অনিক বাইরে। আফরা এসে সালাম দিল। সুফিয়া বেগম তাকালেন না ওর দিকে। ছেলেটার মাথা খাওয়া মেয়ে। নাঈমকে একেবারে আঁচলে বেঁধে রেখেছে। বউ ছাড়া এখন কিচ্ছু বুঝে না সে৷ আরে ব্যাটা তুই পুরুষ মানুষ। তোর এত পুতুপুতু স্বভাব কেন থাকবে! বিয়ের আগে তো এমন ছিল না এই ছেলে। আসল হচ্ছে বউয়ের ছলাকলা। বিয়েটাও বসেছে সেভাবে৷ বিয়ের পর বাড়িতে একবার গেল। টেবিলে খাবার দেয়ার পর নাঈম সবার সঙ্গে বসবে না। তার বউয়ের মাথা ধরেছে। খেতে চাচ্ছে না। তাই রুমে নিয়ে দিলে খেতে পারে। সে নিজে দুজনের প্লেট সহ সবকিছু রুমে নিয়ে গেল। তিনি বিস্মিত হলেন। এবং খানিক পর পর্দার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন নাঈমের মতো ছেলে বউকে মুখে ভাত তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। দু’জনের চোখ-মুখ থেকে আহ্লাদ চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। দেখে রাগে শরীরটা জ্বলে যাচ্ছিল সুফিয়া বেগমের। বেশি আহ্লাদ পেলে মেয়ে মানুষের মাথা ধরা পা*ছা ধরা যে বেড়ে যায়, এই জ্ঞানটুকুও কি ছেলেটার নেই? বিয়ের পর তারা নাঈমকে বললেন, ‘মেয়েকে গ্রামে রেইখা যা, বউকে নিয়া শহরে চাকরি করা লাগবে এইটা আবার কেমন কথা? আর কেউ কি এসব ব্যাঙের চাকরি করে নাই?’
না সে তার বউকে নিয়েই শহরে আসবে। এসে কি হয়েছে? এখনও একটা বাচ্চাও পয়দা হয়নি। আর হবেই বা কি করে? ব্যাটাদের মতো চাকরিও না-কি করে। তোর কেন চাকরি করা লাগবে? তুই মেয়ে মানুষ, ঘরে থাকবি, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা-যত্ন করবি, জামাইকে সম্মান করবি। তার ধারেকাছেও নাই। এইযে শ্বশুরের সামনে চলে এসেছে, ওড়নাও ঠিকঠাক মতো মাথায় নাই। সালাম করছে মুখ দিয়ে। পায়ে হাত দিলে কি হয় তোর? কোমরে ব্যথা? ইভা নামের এই মেয়েটা কিরকম হবে কে জানে! নাঈমের বাপের এক কথা৷ এই মেয়েকে যদি অনিক পছন্দ করে ফেলে তাহলে তাড়াতাড়ি বিয়ে করিয়ে দিতে হবে। বিয়ে করলেই ব্যাটা মানুষ একেবারে সোজা হয়ে যায়। কেচ্ছা-কাহিনি লেখার রঙঢঙ ছেড়ে তখন ঠিকই চাকরি-বাকরি করবে৷ তিনিও ভাবছেন তাই হোক৷ আফরার ফুফাতো বোন যেহেতু। তাহলে ছলাকলার বংশধর। একমাত্র এই মেয়েই পারবে অনিককে বিয়ের জন্য পাগল করতে। এসব মেয়েরা ছেলেদের মাথা নষ্ট করতে ওস্তাদ। আফরা ট্রে-তে ড্রিংক নিয়ে এসে গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘আম্মা নিন।’ সুফিয়া বেগম ভাবনা থেকে বের হয়ে গ্লাস নিলেন। কিন্তু কোনো কথা বললেন না। মিরাজুল সাহেবকেও গ্লাস দিয়ে আফরা সুফিয়া বেগমের পাশে বসে বললো, ‘আপনার শরীরটা ভালো আছে তো আম্মা?’
– ‘তা দিয়া আর তোমাদের কি? তোমরা তিনটা মানুষ যে এখানে থাকো। বুড়া-বুড়ি গ্রামে কিরকম থাকে, কিভাবে চলে, তা নিয়া তোমাদের চিন্তা আছে বইলা তো মনে হয় না।’
– ‘কিযে বলেন মা, নাঈম তো সারাক্ষণ আপনাদের নিয়ে কথা বলে।’
– ‘অনিক কই?’
– ‘বাইরে।’
তারপর আশেপাশে তাকিয়ে দেখলেন ইভা এখানে নেই। ফিসফিস করে বললেন, ‘তোমার শ্বশুর বললেন নাঈম নাকি বলছে এই মেয়ের লগে অনিকের অনেক ভাব?’
– ‘হ্যাঁ মা তাই তো দেখি।’
– ‘তোমার শ্বশুর অনিককে নিয়া অনেক টেনশন করে। কেন করে বলে না। ওর বিয়াটা দিতে পারলেই যেন বাঁচে।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘শুধু ও আচ্ছা বললেই হইব না৷ তুমি তার ভাবি৷ তোমারও একটা দায়িত্ব আছে৷ ওরে বিয়েতে রাজি করাও। ইভা মেয়েটাও তো দেখতে মাশাল্লাহ।’
– ‘হ্যাঁ আম্মা আমি চেষ্টা করবো।’
মিরাজুল সাহেব গ্লাস রেখে বললেন, ‘অনিককে রাজি করাও, তাহলে মেয়ের বাপ-মায়ের লগেও কথা বলবো।’
– ‘জি আচ্ছা, আমি চেষ্টা করবো।’
রাতে অনিক টিউশনি থেকে ইভাকে নিয়ে বাসায় ফেরে। মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে রুমে চলে এসেছে সে৷ তখনই আফরা চা নিয়ে আসে, অনিকের দিকে একটা কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বিছানায় বসে সে। অনিক চুমুক দিয়ে বললো, ‘কিছু বলবে?’
– ‘ভোরে যা বলতে চাইছিলাম সেটাই।’
– ‘বলো।’
– ‘তুমি কি ইভাকে পছন্দ করো?’
– ‘হ্যাঁ, তা না করার কি আছে?’
– ‘তাহলে ওর বাবা-মায়ের সাথে কথা বলি?’
অনিক মুচকি হেঁসে বললো, ‘কি বলবে?’
– ‘বিয়ের কথা। আমরা বিয়ের কথা বলি। তুমিও জব-টব কিছু করার চেষ্টা করো।’
– ‘যাও তো, আমার রুম থেকে বিদায় হও। আসছে বিয়ের আলাপ করতে।’
– ‘পাগলামি করো না। বিয়ে-শাদি করো, দেখবে লেখালেখি আরও ভালো হবে। জীবনের, চিন্তার গভীরতা আসবে। আরও অনেক অভিজ্ঞতা হবে।’
– ‘তার দরকার নাই।’
– ‘আব্বা কিন্তু খুবই চিন্তা করেন তোমার বিয়ে নিয়ে। সংসার নিয়ে।’
– ‘তা কেন? মানুষ মেয়ের বিয়ে নিয়ে করে। আমি মেয়ে না-কি!’
– ‘এত চিন্তার কি তা আমিও জানি না৷ তবুও সন্তান চাকরি-বাকরি করবে। বিয়ে-শাদি করে সংসারী হবে। মা-বাবা এটাই চায়।’
– ‘যাও তো ভাবি, বই পড়বো এখন। আমি বিয়ে করতে হলে এমনিই করতাম। এত বুঝানোর কিছু নেই।’
– ‘বুঝি না, তোমার কি মেয়েদের প্রতি খুব অনিহা? আগ্রহ নেই? কাউকে ভালো লাগে না?’
– ‘কি যে বলো, মেয়েদের প্রতি আমার অনেক আগ্রহ আছে৷ আর ভালো লাগবে না কেন, তোমাকে লাগে, ইভাকে লাগে। এবং রাস্তাঘাটে কত মেয়েকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি।’
– ‘তাহলে নিজের মানুষ থাকলে ভালো না? মুগ্ধ হয়ে নিজের মানুষকে দেখবে।’
– ‘সেটা কেন হতে হবে? একজন নারী মাত্রই যেকোনো সুদর্শন পুরুষকে দেখে মুগ্ধ হবে। স্বামী থাকলেও হতে পারে। পুরুষও তেমন। এই দেখাদেখি, ভালো লাগার সঙ্গে বিয়ের সম্পর্ক কি?’
– ‘কি আজব! নিজের স্ত্রী বা স্বামী রেখে বাইরের মানুষ দেখে তাকিয়ে থাকবে কেন? চরিত্র খারাপ যাদের তারাই এমন করে।’
অনিক চায়ের কাপ রেখে বললো,
– ‘তাহলে মানুষ মাত্রই চরিত্রহীন। কারণ তুমি কি নাঈম ভাইকে ভালোবাসো বলে রাস্তা-ঘাটে কোনো ছেলে দেখে ভালো লাগেনি? বা সিনেমার কোনো নায়ককে দেখে ভালো লাগে না? আর পুরুষ মানুষদের কি লাগে না? লাগে, কিন্তু সবাই মিথ্যে বলে।’
– ‘কিসব উদ্ভট কথা তোমার।’
– ‘উদ্ভট কথা না৷ এটাই সত্য এবং স্বাভাবিক৷ হয়তো মানুষ বিরত থাকে। এসব ভালো লাগা এড়িয়ে চলে। তাই বলে লাগে না তা কিন্তু না।’
– ‘আচ্ছা সে যাই হোক। তুমি মূল কথা ছেড়ে অন্যদিকে চলে যাচ্ছ। আমার কথা হলো রাস্তাঘাটে না দেখে ঘরে বউ তুলো।’
– ‘না, তাহলে রাস্তাঘাটেও দেখবো না।’
– ‘হ্যাঁ বাইরে গেলে, চোখে কালো চশমা পরে নিয়ো।’
– ‘ঘরে পরবো না? তুমি যে শাড়ি পরে আছো। দেখে যে ভালো লাগছে। তার কি হবে?’
আফরা উঠে যেতে যেতে বললো,
– ‘ফা*জিল, বিয়ে করে বউকে এনে এগুলো বললে, কত খুশি হত।’
আফরা এখানে ব্যর্থ হয়ে গেল ইভার কাছে। ইভা বিছানায় শুয়ে মোবাইলে তাকিয়ে আছে। সে বিছানায় বসে বললো, ‘কি করিস ইভা?’
– ‘হোয়াটসঅ্যাপে অনিক ভাইয়ের লেখা পড়ছি। পড়ে জানাতে হবে কেমন হয়েছে।’
– ‘কেমন লাগে পড়তে?’
– ‘ভীষণ ভালো, ভাবছি উনার এটা শেষ হয়ে গেল বই পড়বো। মনে হচ্ছে এতদিন বোকার জগতে ছিলাম।’
আফরা ওর পাশে শুয়ে বললো,
– ‘আচ্ছা অনিককে তোর কেমন লাগে?’
ইভা মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে বললো,
– ‘এই প্রশ্ন কেন করছো?’
– ‘বল না।’
– ‘সিগারেটখোর, উদ্ভট, উম্মাদ লাগে।’
– ‘সত্যি করে বল।’
– ‘তা দিয়ে কি হবে? তোমার কি ধারণা তোমার দেবরের প্রেমে আমি হাবুডুবু খাচ্ছি?’
– ‘খেলে খুব খুশি হতাম।’
ইভা চোখ পাকিয়ে বললো,
– ‘ছি, কি বলো এসব?’
– ‘তুই জানিস তোকে কত পছন্দ করি আমি? তুই আমার জা হলে কত ভালো হতো।’
– ‘কি বলো এগুলো৷ মাথা কি গেছে?’
– ‘আরে না সত্যি। তোর দুলাভাইও বলে। আর আজ আমার শ্বশুর-শাশুড়িও তোকে দেখে পছন্দ হয়েছে। কিন্তু তাদের ছেলেটাই যে বিয়ে-শাদি করতেই চায় না।’
– ‘যাও তো আপু এখান থেকে৷ কি আজেবাজে কথা বলছো।’
আফরা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– ‘অনিক ছেলেটা কিন্তু খারাপ না। দেখতে ভালো, লেখালেখি করছে। এখন একটা জব করলে। ওর মতো বর পাওয়া কি ভাগ্যের ব্যাপার না বল?’
ইভা পুনরায় পড়তে শুরু করে বললো,
– ‘তা শুনে আমি কি করবো!’
আফরা ওর পেটে চিমটি দিয়ে বললো,
– ‘ওকে পটাতে পারিস না?’
– ‘ছি আপু, তুমি আমাকে কি ভাবো? আর তোমার দেবর কি সালমান খান যে তাকে পটাতে লেগে পড়বো?’
– ‘এরকম ভাবিস কেন? অনিক বিয়ে-শাদি করতে চায় না৷ তোর যদি ভালো লাগে তাহলে একটু অন্যভাবে চলাফেরা করে দেখ, যদি সেও পছন্দ করে বিয়ে দিয়ে দিলাম।’
– ‘তুমি এরকম বলতে পারলে? আমি কি এরকম মেয়ে? তোমার দেবরের কাছে বিয়ে বসতে আমাকে এখন অন্যভাবে চলাফেরা করতে হবে।’
‘তুই দেখি আরেকটা ঘাড়ত্যাড়া’ বলে আফরা উঠে চলে গেল৷ নাঈম খেলা দেখছে। সে পাশে গিয়ে বসে বললো, ‘অনিকের সঙ্গে তো কথায় পারিই না৷ একটা বললে সে আরেকটা বলে। আগামাথা বুঝি না৷ আর ইভাও আরেক ঘাড়ত্যাড়া। আমার দ্বারা সম্ভব না।’
নাঈম ওর পিঠের দিকে হাত নিয়ে বাহুতে ধরে বললো, ‘এটুকু তো করতেই হবে তোমার। মেয়েদের পটাতে যত কঠিন, ছেলেদের তেমন না। ইভা একটু অন্যভাবে চলাফেরা করুক। দেখবে অনিক প্রেমে পড়ে, তোমাকেই নিজে এসে বলবে বিয়ে করতে।’
– ‘কি জানি এসব বুঝি না।’
– ‘অধৈর্য্য হচ্ছ কেন? সিম্পল বিষয়।’
আফরা কোনো জবাব দিল না। কিছু একটা ভাবছে৷ অনিক তাকে শাড়ি পরনে দেখে ভীষণ প্রশংসা করেছিল। তাহলে ইভাকে শাড়ি পরালে কেমন হয়? সে আবার মোবাইল হাতে নিয়ে ইভার রুমে গেল। ইভা আগের মতোই শুয়ে আছে। সে পাশে বসে বললো, ‘এই তুই রাতারগুল জলাবনে গিয়েছিলি?’
– ‘না তো।’
– ‘আমিও যাইনি। অথচ কাছেই। দেখ ছবিগুলো, কি সুন্দর।’
ইভা একটা একটা করে দেখো বললো,
– ‘ওয়াও সত্যিই সুন্দর তো। নৌকা দিয়ে ঘুরাঘুরি করা যাবে।’
– ‘ভাবছি কাল যাব। যাবি তুই?’
– ‘কখন?’
– ‘বিকেলে বের হলেই হবে, কাছেই।’
– ‘আচ্ছা।’
– ‘অনেকদিন হলো ছবিও তুলিনি। জব-টব করে ক্লান্ত। দু’বোন শাড়ি পরে যাব।’
– ‘শাড়ি আমি পরতেই পারি না।’
– ‘আমি পরিয়ে দেবো। দেখবি কি সুন্দর লাগে।’
– ‘দুলাভাই যাবে?’
– ‘হ্যাঁ, তুই আমি আর তোর দুলাভাই।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
আফরা উঠে চলে গেল। ইভা বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ছাড়লো। সে একটু আগে অনিক ভাইয়ের হোয়াটসঅ্যাপ প্রফাইল দেখছিল। তখনই হঠাৎ আফরা আপু চলে এসেছে। ভাগ্যিস দেখতে পায়নি। দেখলে সর্বনাশ হয়ে যেত। আসলে দুলাভাই আপু এবং অনিক ভাইয়ের মা-বাবা তাকে পছন্দ করেছে শোনার পর থেকে কেমন যেন লাগছে৷ অনিক ভাই তার বর হবে? এটা ভাবতেই বারবার গা কাটা দিয়ে উঠছিল। ছবি বের করে অনেকটা আনমনেই। আসলে মানুষটাকে তার হয়তো ভালোই লাগে, বেশ ভালো লাগে। রিকশা দিয়ে রোজ সন্ধ্যায় ফেরার পথে মাঝে মাঝে কেমন যেন অনুভূতি হয়ে। একদিন আসার পথে বললেন,
– ‘ইভা চলো নদীর পাড়ে যাই। অনেক সুন্দর জায়গা। নদীর কাছ ঘেঁষে সরু পিচঢালা রাস্তা গেছে। মধু ভাইয়ের ভ্রাম্যমাণ চায়ের দোকান আছে। নদীর পাড়ে বসে তোমার হাত ধরে চা খেতে খেতে গল্প করব।’
সে ফিক করে হেঁসে বললো, ‘আমি কি আপনার প্রেমিকা যে হাত ধরে বসবেন?’
উনি মুচকি হেঁসে বললেন, ‘হাত ধরার কথা বলেছি না-কি?’
– ‘হ্যাঁ এইতো বললেন।’
– ‘ও আচ্ছা, তা হাত ধরতে হলে প্রেমিকা বা স্ত্রী হতে হয় না।’
– ‘তাই না-কি?’
– ‘বিপরীত লিঙ্গের যেকোনো সুন্দর মানুষের প্রতিই মানুষের এরকম অনুভূতি থাকে। স্বামী-স্ত্রী ছাড়াও। এটাই স্বাভাবিক।’
– ‘উদ্ভট কথাবার্তা।’
– ‘খুবই সহজ কথা। যাইহোক একজন তরুণীর সঙ্গে এসব কঠিন আলাপ করতে ইচ্ছা করছে না৷’
– ‘আপনি কবে থেকে তরুণীদের বুঝে কথা বলেন?’
অনিক ভাই মুচকি হাসলেন। তারপর আবার চোখ ফিরিয়ে নিল। সেদিন তারা নদীর পাড়ে গিয়ে চা নিয়ে বসেছিল। শহরের উঁচু উঁচু ভবনের রঙিন বাতিগুলো জলের ভেতর ঢেউয়ের সঙ্গে মৃদু কাঁপছে। অনিক ভাই তাকে বললেন, ‘একটা কবিতা পড়বো না-কি ইভা?’
সে মাথা নেড়ে বললো, ‘আচ্ছা।’
– ‘জয় গোস্বামীর ‘হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে’ পড়ি?’
ইভা আবারও মাথা নড়ালো। অনিক তখন পড়তে শুরু করলো,
“অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে
হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে
করো আনন্দ আয়োজন করে পড়ো
লিপি চিত্রিত লিপি আঁকাবাঁকা পাহাড়ের সানুতলে
যে একা ঘুরছে, তাকে খুঁজে বার করো
করেছো, অতল; করেছিলে; পড়ে হাত থেকে লিপিখানি
ভেসে যাচ্ছিল–ভেসে তো যেতই, মনে না করিয়ে দিলে;
–’পড়ে রইল যে!’ পড়েই থাকত–সে-লেখা তুলবে বলে
কবি ডুবে মরে, কবি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে।।”
সেদিন কবিতাটা যে খুব বুঝতে পেরেছিল ইভা, তা কিন্তু না। তবুও বুকটা কেমন করে যেন উঠলো, সত্যিই সত্যিই ইচ্ছা করেছিল অনিক ভাই হাতটা ধরে বসুক। সে আলগোছে মাথাটা পাশে বসা অগোছালো মানুষটার কাঁধে রাখবে।
ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_১১
.
পরেরদিন অনিক বাইরে থেকে এসে গোসল করে লিখতে বসেছে৷ আফরা এসে পেছনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘তোমার কথাই ঠিক, বিয়ে-শাদি করে কি লাভ।’
অনিক পিছু ফিরে তাকিয়ে বললো, ‘গতকালই বিয়ের গুরুত্ব নিয়ে বক্তব্য ঝাড়লে আর আজ এই কথা! এক রাতেই কি এমন লোকসান হলো তোমার?’
– ‘আর বলো না, অনেকদিন থেকে কোথাও যাই না৷ ক্লান্ত লাগছে। তাই তোমার ভাইকে বলেছিলাম রাতারগুল থেকে ঘুরে আসি। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নৌকায় ভ্রমণ ব্যাপারটা তো ভালোই। সে এখন যাবে না। তার ভালো লাগছে না। এটা কিছু হলো?’
– ‘বুঝতে পারছি। রেডি হও, রেডি হয়ে ডাক দিয়ো।’
– ‘মানে?’
– ‘মানে আবার কি? আমিই নিয়ে যাব। রূপবতী নারীদের কষ্ট সহ্য করতে পারি না।’
আফরা হেঁসে বললো,
– ‘থ্যাঙ্কিউ মাই সুইট দেবর।’
– ‘এখন রুম থেকে বিদায় হও, লিখবো।’
আফরা বের হয়ে এলো রুমে। নাঈম শুয়ে আছে। শুক্র-শনিবারে তাদের দু’জনের অফিসই বন্ধ থাকে। আফরা বিছানায় বসে বললো, ‘অনিক নিয়ে যাবে, ওদের আমি বলেছি তোমার যেতে ভালো লাগছে না।’
– ‘গুড, ভালো বুদ্ধি করেছো।’
– ‘যাই, ইভাকে গোসল করতে বলে আসি। তুমি আব্বা-আম্মাকে সময় দিয়ো। ওরা একা থাকবে বাসায়।’
– ‘আচ্ছা যাও।’
আফরা ইভার রুমে এসে গাল ফুলিয়ে বললো, ‘তোর দুলাভাই এত ঘরকুনো মানুষ, কি আর বলবো। সে যাবে না।’
ইভা আলনার কাপড় ভাঁজ করতে করতে বললো, ‘ওমা, তাহলে কি আমরা একা যাব?’
– ‘দেখি, অনিককে বলেছি। ও গাঁইগুঁই করে। না গেলে আমরা দু’জনই চলে যাব। তুই গোসল কর, শাড়ি পরাবো। আমিও পরবো। শোন, তুই ভালো ছবি তুলতে পারিস তো? তোর দুলাভাইয়ের একদম ধৈর্য্য নাই, দুয়েকটা তুলেই শেষ। আর একটাও ভালো হয় না। আজ দুই বোন প্রচুর ছবি তুলবো।’
– ‘তুমি ছবি তোলা নিয়ে এত ব্যস্ত কেন?’
– ‘আরে ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম কোনো কিছুতে অনেকদিন হলো নতুন ছবি নাই। তুইও তুলিস। সুন্দর করে সাজিয়ে দেবো আমি।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
– ‘তুই গোসল করে তাড়াতাড়ি চলে আয় আমার রুমে।’
– ‘আচ্ছা।’
আফরা আজও ভোরে গোসল করেছে।
গোসল না করে সকালে রান্নাঘরে যেতে তার অস্বস্তি লাগে। সবকিছু যেন অপবিত্র করে ফেলছে মনে হয়। রুমে এসে নাঈমকে বললো, ‘এই তুমি সিটিং রুমে গিয়ে বসো। ইভা এখানে আসবে। আমি শাড়ি পরিয়ে দেবো।’
– ‘আসুক, তারপর যাব।’
– ‘না যাও, আমি এখন পরবো।’
– ‘তো আমি থাকলে অসুবিধা কি?’
– ‘কোনো অসুবিধা নাই, তবুও যেতে বলছি, যাও।’
‘তোমাদের আরও কত ঢং, বাড়ি ছেড়েই চলে যাচ্ছি। দরজা লাগাও।’ আফরা হেঁসে পিছু পিছু এসে বললো, ‘কোথায় যাচ্ছ?’
– ‘বাইরে থেকে আসি, টাকা তো তোমার কাছে আছেই।’
– ‘হ্যাঁ তা আছে, তুমি যাও।’
আফরা দরজা লাগিয়ে এসে কাপড় পালটে নিল। ইভা এলো অনেক্ষণ পর। ওকে নিজ হাতে সাজাবে। আয়নার সামনে বসিয়ে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে দিল। চোখে কাজল, কপালে টিপ, মুখে মেকাপ, হাতে নীল চুড়ি সবই ইভা সাদরে গ্রহণ করেছে। কিন্তু শাড়ি পরানোর স্টাইল সে মেনে নিতে পারলো না। অবাক হয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আশ্চর্য! আপু আমার পেট আর ঘাড় তো পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে।’
আফরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘তুই আছিস পেট নিয়ে। তোকে যে নীল পরী লাগছে সেটা দেখেছিস? নীল চুড়ি, নীল শাড়ি, নীল ব্লাউজ। কি সুন্দর যে লাগছে তোকে ইভা।’
– ‘সেটা তো বুঝলাম আপু। কিন্তু এভাবে পেট, পিঠ দেখিয়ে কখনও পরিনি।’
– ‘আরে থাকুক, শহরে এগুলো কে খেয়াল করতে বসে আছে?’
– ‘তবুও, অনিক ভাই বা দুলাভাই এভাবে দেখলে লজ্জা পাব।’
– ‘আরে ধুরো, কিসের লজ্জা। আর তোর দুলাভাই বাইরে, অনিক যাবে কি-না ঠিক নাই। তোর ছবি-টবি তুলবি না? থাকুক এরকম। তাছাড়া তুই আগে বের হয়ে যা৷ আমি অনিককে শুধু বলে চলে আসবো৷ সে না যাওয়ার সম্ভবনাটাই বেশি।’
ইভা আয়নায় নিজেকে দেখছে। চিনতেই যেন পারছে না৷ অসম্ভব সুন্দর লাগছে৷ অনিক ভাই গেলে ভালোই লাগতো। শাড়ি পরনে আজ দেখলে নিশ্চয় মুগ্ধ হয়ে যাবে। উনি যাবে কি-না কে জানে। সে শাড়ির কুঁচি ধরে আস্তে-আস্তে হেঁটে বললো, ‘তাহলে আমি বাইরে যাই। তুমি আসো।’
– ‘আচ্ছা যা।’
আফরা অনিকের দরজায় নক দিয়ে বললো, ‘অনিক আসো।’
– ‘তোমরা কি বের হয়েছো?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘ওকে আসছি।’
অনিক শর্ট প্যান্ট পালটে নিয়েছিল আগেই। এবার কেবল কালো মেগি হাতা গেঞ্জির ওপরে একটা শার্ট পরে হাত গুটিয়ে নেয়। মোবাইল, মানিব্যাগ পকেটে পুরে চুল ঠিক করতে করতে বাইরে এসে বললো, ‘চলো ভাবি।’
আফরা মিরাজুল সাহেবকে ডেকে বললো, ‘বাবা দরজা লাগিয়ে নিয়েন। আমরা যাচ্ছি।’
– ‘আচ্ছা মা যাও।’
তারা বাইরে এলো। ইভা গেইটের সামনেই ছিল। চনমনে রোদ উঠেছে৷ সে দাঁড়িয়ে আছে গাছের ছায়ায়। অনিককে দেখেই লজ্জায় শরীরে কেমন গরম স্রোত বয়ে গেল। পিছু ফিরে নিয়ে গাছের দিকে তাকিয়ে আছে। অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে। উনি আসায় সে ভীষণ খুশি হয়েছে৷ তবুও কেমন যেন লজ্জা লাগছে। মিশ্র এক অনুভূতি। অনিক এগিয়ে এসে বললো, ‘আরে ইভা না-কি, ওদিকে কি দেখো।’
সে নিজেকে সামলে নিয়ে আত্মবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বললো, ‘হ্যাঁ চলো।’
অনিক ওর দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে বললো, ‘বাবা, হুজুরনি দেখি পেট বের করে শাড়ি পরেছে আজ।’
আফরা মুচকি হেঁসে বললো, ‘কেন? আমার বোনটাকে দেখে বুঝি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে?’
– ‘হ্যাঁ পুরাই মাথা নষ্ট, ও না হিজাব পরে ভার্সিটি যায়। আজ হঠাৎ পেট, পিঠ বের করে শাড়ি পরায় দেখে অবাক হয়েছি।’
আফরা খানিক রূঢ় গলায় বললো, ‘অনিক তুমি এমন মুখকাটা কেন বলো তো? পেট, পিঠ নিয়ে শুধু পড়ে আছো? বেচারি প্রথম শাড়ি পরেছে। সুন্দর লাগছে কি-না তাই বলো।’
ইভার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। সে একহাতে কুঁচি ধরে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। কানে বারবার একই শব্দ যেন বাজছে ‘হুজুরনি দেখি পেট বের করে শাড়ি পরেছে আজ।’
এই মুহূর্তে দুনিয়া থেকে মিলিয়ে যেতে পারলে খুশি হত সে। আফরা কাছে এসে বললো, ‘কিরে চল।’
ইভা ফিসফিস করে বললো, ‘আপু আমাকে প্লিজ রুমে দিয়ে আসো। আমি যাব না, আমার শরীর কেমন করছে।’
.
পদ্য রাতে ইউটিউবে গিয়ে পুরাতন বাংলা ছায়াছবির গান খুঁজছিল। ভীষণ ইচ্ছা করে মাঝে মাঝে শুনতে। তখন অনিকদের বাড়িতেই কেবল বিটিভি ছিল। শুক্র-শনিবারে ছবি শুরু হলেই অনিক এসে তাকে ডেকে নিয়ে যেত৷ ঘর অন্ধকার করে টিভি দেখতে বসতো তারা৷ আহা ভীষণ মনে পড়ে সেই সুনালী দিনগুলো। অনিক রোজ ছবি শুরু হওয়ার আগেই তাকে নেয়ার জন্য এসে বসে থাকতো। সেরকমই এক শনিবার অনিক এসে বসে আছে। সে তখন নাইনে পড়ে। অনিক সেভেনে উঠেছে নতুন। স্কুল থেকে এসে খেতে বসেছে পদ্য৷ অনিক অপেক্ষা করছে তাকে টিভি দেখতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। পদ্যও তাড়াতাড়ি খেয়ে এসে দরজার সামনে থমকে দাঁড়ায়। দেখে আলনায় সদ্য খুলে মেলে রাখা তার স্কুল ড্রেস অনিক হাতে নিয়ে শুকছে। তখনও মানব-মানবীর মধ্যকার সকল রহস্য বুঝে ফেলার বয়স হয়ে উঠেনি পদ্যের। তবুও অবাক হয়ে এগিয়ে গিয়ে অনিকের হাত থেকে টান দিয়ে ড্রেস নিয়ে বললো, ‘কি করছো তুমি অনিক? তোমার ঘেন্না লাগে না? এটা শুকছো কেন?’
অনিক কেমন ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে বলেছিল, ‘তোমার কোনোকিছুই আমার ঘেন্না লাগে না।’
পদ্য হেঁসে ওর গাল টেনে দিয়ে বললো, ‘তুমি অনেক পচা তো অনিক। চলো তাড়াতাড়ি। ছবি শুরু হয়ে গেছে হয়তো।’
তারপর চলে যায় তারা ছবি দেখতে৷ পদ্য এখন প্রায়ই এই ছোট্ট ছোট্ট ঘটনাগুলো মনে করে বিস্মিত হয়। অনিক হয়তো তাকে সেই ছোটবেলা থেকেই ভালোবেসে ফেলেছিল। ছেলেদের ঠিক কত বছর বয়স থেকে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ শুরু হয় কে জানে৷ অনিকের লেখালেখির চর্চা শুরু হওয়ার ব্যাপারটাও অদ্ভুত। পদ্যের বই পড়ার অভ্যাসটা তার স্কুল মাস্টার বাবার কাছ থেকেই পায় সে। উনার সংগ্রহে ছিল সকল ভারী-ভারী বই। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়দের।
এগুলো ছোটবেলাতেই পদ্য একাধিকবার পড়ে শেষ করে ফেলে। অনিক শুরু করে সেভেনে উঠে। রবীন্দ্রনাথের “চোখের বালি” উপন্যাস পড়ে পাগল হয়ে গিয়েছিল৷ প্রথম কয়েকবার পড়তে পারেনি৷ কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে রেখে দেয়। পদ্য বইটার প্রশংসা করায় পুনরায় পড়তে চেষ্টা করে সে। খানিক এগুতেই তার ভালো লাগতে শুরু করে। তারপর মতিন মাস্টারের সংগ্রহের সবগুলো বই ধীরে ধীরে পড়ে ফেলে। তখন এই অজপাড়া গ্রামে বই পাওয়া যেত না। পদ্য যখন ইন্টারে উঠে। তখন একজন বইওয়ালা আসতে শুরু করে স্কুলে। প্রতি বৃহস্পতিবার আসতো। সেই থেকে অনিক আর তার পুনরায় বই পড়া শুরু হয়। বইগুলোও ছিল সহজ ভাষার। রোমান্টিক, হরর, গোয়েন্দা উপন্যাস। গ্রোগাসে সেসব গিলতে শুরু করে তারা। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় টাকা। পড়ালেখা রেখে এসব বই পড়ার জন্য টাকাও দিচ্ছিল না৷ অনিক বাবার পকেট থেকে টাকা চু*রি করতে গিয়েও একদিন মা*র খেল। সামনে পরীক্ষা। আর সে ভূ*তের বই কিনে এনে ঘর ভরে ফেলছে দেখে এমনিতেই সবাই রেগে ছিলেন। তার উপর শেষ অবধি চু*রি। বেশ কয়েক মাস দু’জনই বই থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল। একদিন সন্ধ্যায় সে সাদা দিস্তা খাতা নিয়ে এলো। তখন এলাকায় বিদ্যুৎ চলে এসেছে। পদ্য ঘরে টেবিলে বসে বাতির আলোয় পড়ছে। অনিক এসে বললো, ‘আপু পড়ে দেখো তো কেমন হয়েছে।’
পদ্য পৃষ্ঠা উলটে-পালটে বললো,
– ‘কি এটা?’
‘তুমি পড়ে দেইখো রাতে, ভালো লাগলে জানাবে৷ আরও দেবো’ বলেই অনিক চলে গিয়েছিল। পদ্য ক্লাসের পড়া রেখে তখনই পড়তে শুরু করে। পড়তে পড়তে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করে একটা গল্প। আর তার ভালোই লাগছে পড়তে। পদ্য বুঝতে পারছিল না সাদা কাগজে আবার গল্প কিভাবে এলো? কোনো বই থেকে কি লিখে এনে দিয়েছে অনিক? তাহলে বই না দিয়ে খাতা কেন? পদ্য উঠে তখনই অনিকদের বাড়ি চলে যায়। অনিক আর তার ভাই নাঈম একসঙ্গেই টেবিলে বসে পড়ছে। পদ্য তাকে ইশারায় ডেকে উঠানে চলে আসে৷ অনিক বাইরে এসে পদ্যের হাতে খাতা দেখে লাজুক হেঁসে বললো, ‘কি হয়েছে?’
– ‘খাতায় গল্প কিসের?’
সে মাথা চুলকে বললো, ‘আমিই লিখেছি।’
পদ্য প্রচণ্ড অবাক হয়ে বললো, ‘বলো কি অনিক? তুমি লিখেছো মানে? মিথ্যে বলো না আপুকে। কোনো নতুন বই এনেছো, তাই না?’
– ‘কি বলো আপু, তোমাকে মিথ্যে বলবো আমি? এটা আমারই লেখা।’
– ‘কিন্তু তুমি তো ভূ*তের গল্পের পাগল। এটা দেখছি রো*মান্টিক।’
– ‘কেন আমি তো রোমান্টিক বইও পড়ি।’
– ‘অনিক আমি জানি তুমি রোমান্টিক বই কিনে আনো আমার জন্য। তোমার পছন্দ হ*রর। আমার কাছে টাকা নাই যেদিন। খেয়াল করেছি তুমি সেদিনই রোমান্টিক বই আনো।’
– ‘আচ্ছা এগুলো বাদ দাও। আমি রোমান্টিক গল্প তোমার জন্যই লিখেছি।’
– ‘কি আশ্চর্য! তুমি গল্প লিখে ফেলেছে আমি পড়ার জন্য?’
– ‘হ্যাঁ, অবাক হওয়ার কি আছে। তুমি জানো না, বই, টেলিভিশন যখন ছিল না তখন বাচ্চারা দাদা-দাদীর কাছে গল্প শুনতো। তারা বানিয়ে কেচ্ছা-কাহিনি বলতো বাচ্চাদের। তাহলে আমি তোমার আনন্দের জন্য লিখতে পারবো না কেন?’
– ‘আমি সেটা বলিনি। তুমি পারলে কিভাবে লিখতে?’
– ‘পুরোটা পড়ে দেখো কিছু হইল কি-না। অনেকদিনে লিখেছি।’
– ‘তুমি কি আরও পারবে লিখতে?’
– ‘জানি না। আচ্ছা এটা পড়ো। ভালো লাগলে চেষ্টা করবো।’
– ‘বলো কি! ভালো লাগলে তুমি আরও লিখে ফেলতে পারবে? আমি তো ছোটবেলা থেকে বই পড়ে একটা চিঠিও লিখতে পারি না।’
– ‘আপু যাও তো, গিয়ে পড়ো।’
– ‘সত্যি করে বলো তো ঘটনা কি।’
– ‘ভূ*তে লিখে দিছে আপু এটাই ঘটনা। তোমার পড়ার দরকার৷ পড়ে ভালো লাগলে বলবে।’
পদ্য ‘আচ্ছা’ বলে চলে এলো। এসেই সে খাতা মেলে আবার পড়তে শুরু করলো। পুরো গল্প শেষ করে সে অবাক হয়ে যায়। গল্পটা তাদের গ্রামের রঞ্জু চাচার সঙ্গে কিছুটা মিল। যে এখন পাগল। রাস্তায় রাস্তায় ভ্যাপসা গরমে সোয়েটার পড়ে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে শোনা যায় রঞ্জু চাচা এই এলাকায় প্রথম বিএ পাস ব্যক্তি। এলাকায় সকলের চিঠি লিখে দিতেন। অনিকের গল্পেও সেরকম এক তরুণ। নাম অমল। লোকে অমল দা বলে ডাকে। গ্রামের সবাই চিঠি-পত্র লেখার জন্য ডাকে তাকে৷ সেভাবেই একটা সম্ভান্ত্র মুসলিম পরিবারের মেয়ের সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠে তার। শেষদিকে এক করুণ পরিণতি ঘটে৷ যার ফলস্বরূপ অমল দা পাগল হয়ে যায়৷ গল্পটা শেষ করে পদ্যের চোখ ভিজে গেছে। কেন অমল দা তার প্রেয়সীকে পায়নি এই কষ্ট, অভিযোগ, অভিমানে ভেতর ফেটে যাচ্ছে পদ্যের। তখনই অনিক এসে হাজির। সে তেড়ে যাচ্ছিল ওর দিকে। অনিক ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললো, ‘চুপ’ থাকতে। তারপর ফিসফিস করে বললো, ‘পড়েছো?’
পদ্য বললো, ‘হ্যাঁ, কিন্ত..।’
সে আবার ঠোঁটে আঙুল রেখে বললো, ‘বাইরে আসো।’
পদ্যকে উঠানের মাথায় শিম গাছের আড়ালে নিয়ে গেল। তারপর চারদিকে তাকিয়ে বললো, ‘তুমি এত জো*রে জো*রে কথা বললে কি আর পড়তে পারবে? সবাই বলবে নিজের পড়ালেখা রেখে এগুলো করছি। আর তুমি ক্লাসের পড়া রেখে পড়ছো।’
– ‘বুঝেছি, কিন্তু শেষে অমল দা’র সঙ্গে এমন করেছো কেন?’
– ‘এরকম প্রশ্ন করলে হবে না আপু। তুমি ভাববে রাইটার আমি না। তাহলে মজা পাবে।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘তোমার ভালো লেগেছে?’
– ‘হ্যাঁ তা লেগেছে।’
– ‘তাহলে আদর করে দাও।’
– ‘কি?’
– ‘আদর। এতবড় একটা কাজ করলাম, তুমি আদর করে দেবে না?’
– ‘তুমি বড়ো হয়ে গেছো অনিক। দেখো আমার সমান এখন। দাঁড়াও পাশে।’
অনিক গাল ফুলিয়ে বললো, ‘একটা চুমু অথবা জড়িয়ে ধরো। দু’টার মাঝে একটা। আদর করে দিলে আমার উৎসাহ আসবে লেখার। আমি এখনও তেমন বড়ো হইনি। মাত্র এইটে পড়ি।’
– ‘ছোট কেউ এরকম গল্প লিখতে পারে বুঝি?’
– ‘আচ্ছা থাক, লাগবে না।’
পদ্য ফিক করে হেঁসে ওর হাত ধরে গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে এনে ঠোঁটে ছুঁয়ে বললো, ‘দিলাম আদর করে, হয়েছে তো?’
সে রসিকতা করে দীর্ঘশ্বস ছেড়ে যেতে যেতে বললো, ‘চলার মতো হয়েছে, তুমি অনেক কিপটে।’
এই যে ব্যাপারগুলো। পদ্যের কাপড় শুকে ঘ্রাণ নেয়া৷ আদর পেতে চাওয়া। তখন কোনোকিছুই পদ্যের মনে খুব বেশি খটকা লাগাতে পারেনি। এখন প্রায়ই ভাবে। হয়তো অনিক তখন থেকেই তাকে অন্যভাবে দেখতো। এখন ভাবতে বসলে অনিকের প্রতিটি কাজের প্রবল ভালোবাসা খুঁজে পায়। সেই ভালোবাসাটা ভিন্ন। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানব-মানবীর যে প্রেম, কাম, ভালোবাসার মাধ্যমে বংশ বিস্তার করিয়ে আসছেন। অনিকের ভালোবাসা সেটাই। সে কখনও হয়তো আপুর চোখে দেখেনি তাকে। আপু তার মুখে কেবলই একটা সম্মোধন ছিল। অনুভূতি ছিল ভিন্ন।
__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম
__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম