ছুয়ে_দেখো_আমার_শহর পর্ব ৩৭+৩৮

#ছুয়ে_দেখো_আমার_শহর
#লেখিকা_হৃদিতা_আহমেদ

পর্ব-৩৭

সূর্যর হাত সরিয়ে দিতেই পুতুলের চোখ পড়ে হাতে পেচানো ব্যান্ডেজের দিকে।চট করে সূর্যর হাত ধরে সামনে নিয়ে সূর্যর দিকে করুন চোখে তাকায় পুতুল।সূর্য কিছু বলবে তার আগেই পুতুল কুয়াশা ভেজা রাস্তার উপর বসে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করে।সূর্য দ্রুত হাঁটু ভেঙে পুতুলের সামনে বসে বলল,
– ” পুতুল পাগলামি বন্ধ করো, ভিজে যাবে ওঠো বলছি।”
সূর্যর কথায় পুতুল কান্নার গতি সমান্তরাল রেখেই দু’হাতে সূর্যকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালায়।
আশেপাশের দু একজন পথচারী তাদের দিকে তাকিয়ে ফুসুরফাসুর করে চলে যাচ্ছে।
সূর্য কিছুক্ষণ পুতুলের দিকে তাকিয়ে থেকে দুবাহু ধরে দাড় করিয়ে টেনে ধরে গাড়ির মধ্যে বসিয়ে দেয়।পুতুল তখনও শব্দ করে কাঁদছে।সূর্য গাড়িতে বসে পুতুলের দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো।ব্যর্থ হয়ে দু’হাতে পুতুলের মুখ ধরে চেচিয়ে বলল,
-” এই মরা কান্না বন্ধ করো বলছি নইলে,,,,,,,, ”
পুতুলের বরফ শীতল মুখের শীতলতা বুঝতে পেরে দ্রুত দুহাত ধরে তাপমাত্রা চেক করে সূর্য।গাড়ির কাচগুলো তুলে হুডির জিপার খুলে চট করে পুতুলকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে।পুতুলের দুহাত ঘষে দিয়ে নিজেই পুতুলের হাত দুটো টেনে হুডির ভেতর দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে নেয় সূর্য।পুতুল ছাড়ানোর জন্য ছটফট করলেও সূর্য শক্ত করে পুতুলের মুখটা নিজের গলার খাঁজে চেপে ধরে বসে থাকে।
-“ছাড়ো,একদম ধরবে না আমাকে।ছাড়ো বলছি, ছাড়ো।”
বলেই সূর্যের বা কাঁধে নিজের দন্ত চিহ্ন বসিয়ে দেয় পুতুল।সূর্য কোনো শব্দ না করে চুপচাপ দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকলো।কিছুক্ষণ বাদে পুতুল নিজে থেকেই সূর্যকে জাপটে ধরে গলার খাঁজে মুখ রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-” আমার কষ্ট হচ্ছে অবাক, অনেক কষ্ট।আমার তোমাকে চায় অবাক, শুধু তোমাকে চায়।প্লিজ দিয়ে দাও, প্লিজ।”
বলে আবারও কাঁদতে থাকে পুতুল।সূর্য পুতুলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাথায় টুপ করে একটা চুমু খেয়ে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে বসে থাকে।

চার বছর আগে ফয়সাল মারওয়ার তিনটা বুলেট তার বুকের থেকেও জীবন পাতাগুলো কে বেশি ক্ষত বিক্ষত করছে।ভেবেই ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সূর্যর।

★★★
অতীত,
চার বছর আগের সেইদিনে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনটা বুলেট তার বুকে-পিঠে গেথে দিয়েছিল ফয়সাল।দীর্ঘ বাহাত্তর ঘন্টা পরে চোখ মেলে যখন সকল আপনজনের সাথে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত মুখ দেখেছিল সূর্য, খুশিতে চোখ বেয়ে নোনাপানি গড়িয়ে পড়েছিল।
-“ছোট বাবার এতো গুণ সৃষ্টিকর্তা তোমাকে দিয়েছেন তাতেও কী কম পড়ে গেছিল বাবু? যে তার গুনের ষোলো আনা পূর্ণ করতে তার প্রফেশনটাই বেছে নিয়েছো।”
ছোট মায়ের কথায় সূর্য চট করে হাতে ব্যান্ডেজ জড়িয়ে দূরে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকা পুতুলের দিকে তাকায়।মিসেস প্রীতি সূর্যর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-” ছোট বাবার মতো স্বার্থপর হোস না বাবু।”

হাসপাতালে থাকাকালীন সকলে দেখা করে কথা বললেও পুতুল একবারের জন্যও সূর্যর সাথে কথা বলেনি।নিয়মমাফিক প্রতিদিন মাম্মার সাথে এসে সূর্যকে দেখে যাওয়া ছাড়া একটা কথাও বলতো না।সেটা কেউ বুঝতে না পারলেও দুজন ব্যক্তি গভীর ভাবে বুঝতে পেরেছিল।তারা হচ্ছেন মিসেস মধুমিতা ও টুকটুকি।সূর্য হসপিটালে থাকতেই পুতুল মাম্মার সাথে অর্কদের বাসায় থাকা শুরু করেছিল।মি. এন্ড মিসেস মাহবুব অনেক বুঝিয়েও ছোট মাকে বাড়িতে ফেরাতে পারেনি।সূর্য ফোন দিলেও রিসিভ করতো না পুতুল।পুতুলের কথা না বলা,ইগনোর করা সবকিছু মিলিয়ে সূর্য নিজেও অভিমানের পাহাড় তৈরি করে নেয়।এক সপ্তাহ পরে অনেকটা সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফেরার পরও পুতুলকে দেখতে পায় না সূর্য।

অর্কদের বাড়ি থেকে কলেজ দূরে হওয়ায় পুতুল দুদিন বাদেই নিজের বাড়িতে ফিরে আসে।কিন্তু নিজেকে রুম বন্দী করে নেয় পুতুল।পুতুল বাড়িতে ফিরেও সূর্যর সাথে দেখা না করায় সূর্যর অভিমানেরা ভয়ংকর রাগে পরিণত হয়।রাতে খাবার সময় যখন জানতে পারে পুতুল আগেই খেয়ে নিয়েছে তখন রাগ,অভিমান সকলে একসাথে হানা দেয় মনে।কোনরকম খেয়ে উঠে পা বাড়ায় পুতুলের রুমের দিকে।দরজায় হাত দিয়ে বুঝতে পারে ভেতর থেকে বন্ধ,দাঁতে দাঁত চেপে দরজা নক করে সূর্য। কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলতেই চট করে ভেতরে ঢুকে পুতুলকে দরজার সাথেই চেপে ধরে সূর্য।পুতুল ভয়ে ভয়ে সূর্যর দিকে তাকাতেই সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-” সমস্যা কী তোমার?সাহস কী করে হয় আমাকে ইগনোর করার? আমার ফোন নম্বর ব্লক করেছো কেন?”
সূর্যের রণমুর্তি দেখে পুতুল ভয় পেলেও কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
-” আ্ আমার ই্ ইচ্ছে।”
পুতুলের কথাটা আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করলো, সূর্য খপ করে পুতুলের গাল চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-” ইচ্ছে, তো হঠাৎ এমন ইচ্ছে হবার কারণ টা কী?”
সূর্যর লালটে চোখ-মুখ আর গালে ব্যাথা পেলেও পুতুল কোনরকম কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
– ” আপনি আপনার নোংরা জবটা না ছাড়লে আমি আর কোনদিনও আপনার সাথে কথা বলবো না, কোনদিনও না।”
সূর্য পুতুলের গাল থেকে হাত সরিয়ে পুতুলকে ধরে তার টলটলে চোখে চোখ রেখে বলল,
-” নোংরা জব! আমি নোংরা জব করি?”
-” হ্যা নোংরা জব,ভয়ংকর নোংরা জব বিশ্রী নোংরা জব।(কেঁদে বলল) এই নোংরা জবের জন্যই বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, আপনিও,,,,,,”
এটুকু বলেই সূর্যকে জড়িয়ে ধরে জোরে কেঁদে বলল,
-” আপনি ওই নোংরা গন্ধ জবটা ছেড়ে দিবেন, কালই ছেড়ে দিবেন। বলুন ছেড়ে দিবেন?”
সূর্য ঠিক কী বলে পুতুলকে বোঝাবে বুঝতে পারছে না।পুতুল তখনও বাচ্চাদের মতো অঝোরে কেঁদে কেঁদে বলছে,
-“আপনি আপনার বাজে জবটা না ছাড়লে আমি চলে যাবো।আর মাম্মা কখনও আপনাকে মেনে নেবে না।প্লিজ ছেড়ে দেন, আমার কিচ্ছু চায় না শুধু আপনাকে চায়।”
সূর্য পুতুলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দাড়িয়ে থাকলো।সে কীভাবে বোঝাবে ছোট বাবার মৃত্যুটা কোনো দুর্ঘটনা ছিল না।সম্পূর্ণ পরিকল্পনা করে ছোট বাবাকে মারা হয়েছিল।একজন স্পেশাল ফোর্সের ক্যাপ্টেনের নিজেকে বাঁচানোর সম্পূর্ণ দক্ষতা থাকে,সে যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে বাচাতে সক্ষম।কিন্তু ছোট বাবার মৃত্যুর ঘটনা এতো বছর পরে সামনে আনলে তার খুব কাছের বিশেষ একজনকে হারানোর সম্ভবনা রয়েছে।সে কিছুতেই সেই বিশেষ একজনের কষ্ট দেখতে পারবে না।সবকিছু ভেবে একটা বড় নিশ্বাস নেয় সূর্য।পুতুলকে সামনে এনে ভেজা গালটা মুছে কপালে চুমু দিয়ে বিছানায় বসিয়ে দেয়।পুতুলের দুহাত ধরে ফ্লোরে হাঁটু ভেঙে বসে পুতুলের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আমার কথা গুলো মন দিয়ে শুনে বোঝার চেষ্টা করবে পুতুল,কেমন?
সূর্যর কথায় চোখে টইটম্বুর পানি নিয়ে ভ্র কুঁচকে সিরিয়াস ভাবে তাকিয়ে আছে পুতুল।সূর্য পুতুলের দু’হাতে চুমু দিয়ে বলল,
– ” আমার প্রফেশনটা আমার পেশন।বুঝতে শেখার পর থেকে এই প্রফেশনটাকে আমি গভীর আবেগে ভালোবেসেছি।বলতে পারো বাবা,ছোট বাবাকে দেখেই ছোট্ট থেকে এই প্রফেশনটাকে আপন করে নিয়েছি।বাবা-মার ইচ্ছে ছিল আমাকে ডাক্তারি পড়াবে কিন্তু আমি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মা-বাবাকে রাজি করিয়ে ক্যাডেট কলেজ ভর্তি হয়েছিলাম।বলতে পারো এই প্রফেশন টা আমার রক্তে মিশে আছে।”
এটুকু বলেই একটু থেমে সূর্য আবারও বলতে শুরু করলো,
-“আর তুমি আমার জীবনের বিশেষ একটা অংশ।তুমি বা প্রফেশন কোনটাই আমার জীবনে অপশন হতে পারে না পুতুল, দুটোই আমার জীবনে অবিচ্ছেদ্য অংশ।তাই প্রফেশনের জন্য তোমাকে বা তোমার জন্য প্রফেশন কোনটাই ছাড়বো না আমি।”
-” তাহলে আমি আপনাকে ছেড়ে চলে যাবো।”
নাক টেনে বলল পুতুল।সূর্য মৃদু হাসলো পুতুলের কথা শুনে।পুতুল সূর্যকে হাসতে দেখে কেঁদে বলল,
-” আমি কিন্তু সত্যি সত্যি চলে যাবো, আপনাকে বিয়েও করবো না।”
সূর্য পুতুলের নাক টেনে হেসে বলল,
-” তাই নাকি? তো কাকে বিয়ে করবো?”
-” মাম্মার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করবো।যে আপনার মতো নোংরা জব করবে না, আমার কথা শুনবে।”
সূর্য সোজা হয়ে দাড়িয়ে হাত ভাজ করে বলল,
-” ঠিক আছে। বিয়েতে আমাকে ইনভাইট করো, কেমন?”
উত্তরে সেদিনও পুতুল সূর্যর হাতে কামড় বসিয়ে দিয়েছিল।তারপর কামড়ের দাগ দেখে কেঁদেকেটে সূর্যর টিশার্ট ভাসিয়েছিল।
★★★

কথা গুলো ভেবে মৃদু হাসলো সূর্য।চোখ মেলে পুতুলের দিকে তাকিয়ে দেখে ঘুমিয়ে গেছে।ভালবাসার খেলায় দুজন দুজনকে কষ্ট দেওয়ার কঠোর খেলায় মত্ত হয়েছে,যেখানে চারটা বছর যাবত কেউ পিছু পা হচ্ছে না।পুতুলকে আরেকটু শক্ত করে আঁকড়ে ধরে সিটে হেলান দিয়ে আবারও চোখ বন্ধ করে নেয় সূর্য।তার এখন ঘুমনো প্রয়োজন, শান্তিপূর্ণ ঘুম। ভালবাসার কঠোর খেলায় ক্লান্ত সে, বড়ই ক্লান্ত।
#ছুয়ে_দেখো_আমার_শহর
#লেখিকা_হৃদিতা_আহমেদ

পর্ব-৩৮

চিরচেনা বুকের ধুকপুকানি, মিষ্টি গন্ধে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চিরচেনা ব্যক্তিটাকে জাপটে ধরে পড়ে থাকলো পুতুল।হঠাৎই কিছু মনে পড়ায় ঝট করে চোখ খুলে তাকায় পুতুল।সোজা হয়ে বসে সূর্যর কাঁধ থেকে কালো টিশার্ট টা সরাতেই নিজের উপহার দেওয়া চিহ্নটা সাদা চামড়াতে রক্তিম হয়ে ফুটে ওঠে।চিহ্ন টার উপর আলতো করে হাত বুলিয়ে সূর্যের মুখের দিকে তাকায় পুতুল।সূর্য তখনও তার হুডি সমেত পুতুলকে আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে।পুতুল আলতো করে সূর্যের গালটা ছুয়ে দেয়।একটা ছোট্ট অপরাধে এই বরফ শুভ্র রাজকুমারের অসীম ভালবাসাকে প্রত্যাখ্যান করেছে সে।আসলেই কী প্রত্যাখ্যান করেছে? না প্রত্যাখ্যান করতে পারছে, না গ্রহণ করতে পারছে।ভাবতেই চোখটা আবারও ভরাট হতে শুরু করে পুতুলের। হালকা উঁচু হয়ে খোচাখোচা দাড়ি ভর্তি গালে আলতো করে ভালবেসে নিল। ফিসফিস করে বলল,

-” আমার চোখের সকল নোনাজলের স্রোত তোমার অপরাধের কঠোর শাস্তি রাজকুমার,কঠোর শাস্তি।”

বলে আর একবার আলতো করে জড়িয়ে ধরলো সূর্যকে।সাবধানে সূর্যর হাত সরিয়ে শব্দহীন ভাবে গাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় পুতুল।দরজা বন্ধের সাথে সাথে চোখ বন্ধ করেই গালে হাত রেখে মৃদু হাসলো সূর্য।মনে মনে বলল- আপনার কঠোর শাস্তি গ্রহণের জন্যই আমার পদার্পণ রাজকুমারী।

★★★
আঠারো তম জন্মদিন পুতুলকে মনে প্রাণে সর্বসাকুল্যে বড় করে দিয়েছিল।পুতুলকে জীবনের এক কঠিন মোড়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল আঠারো তম জন্মদিন।বোর্ড পরীক্ষার দুমাস পরেই ছিল পুতুলের আঠারো তম জন্মদিন।

সূর্যকে কোনভাবেই তার সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে না পেরে পুতুল বোর্ড পরীক্ষার পরই মাম্মার কাছে চলে আসে।তারপর থেকে পুতুলের সাথে সম্পূর্ণ দেখা, যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় সূর্যর।সূর্য চাইলেও পুতুল তার অভিমানের দেয়াল দিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিতো। ততদিনে পুতুল মাম্মার সাথে অর্কদের বাসায় প্রায় সেটেল্ড হয়ে গেছে।নিজের অবাধ্য মনকে না অভিমানে দমিয়ে রাখতে পারতো পুতুল, না প্রানখুলে ভালবাসতে পারতো।তার অভিমানের দেয়াল টপকেই সূর্য প্রায়ই এসে দেখা করে যেতো পুতুলের সাথে।কিন্তু তার আঠারো তম জন্মদিনে সবাই তাকে গাড়ি গাড়ি শুভেচ্ছা জানালেও সবথেকে অপেক্ষিত ব্যাক্তিটির শুভেচ্ছাই পেল না পুতুল।

জন্মদিনে বড় আব্বু, বড় আম্মু, টুকটুকি সশরীরে উপস্থিত হয়ে তাকে উপহার সমেত শুভেচ্ছা জানালো।মাইল মাইল দূরে বসেও অর্ক ভাইয়া শুভেচ্ছা জানাতে ভুললো না, এমনকি সকাল সকাল তার পছন্দের ড্রেস টাও পাঠাতে ভুলে নি অর্ক ভাইয়া।গভীর রাতে মাম্মা, খালু-খালামনি সকলে মিলে তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে।প্রতীক আর তিতিয়াও বাড়ি বয়ে এসে শুভেচ্ছা জানিয়ে গেছে।বলতে গেলে এটাই তার শ্রেষ্ঠ জন্মদিন হওয়া উচিত।কিন্তু একটা মানুষের অনুপস্থিতিতে তার কাছে এই শ্রেষ্ঠ জন্মদিনই সবথেকে বাজে করলার জুসের মতো লাগছে।রাগে দুঃখে সূর্যর সব যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে এক-সাগর বিষন্নতা নিয়ে নিজের রুমে বসে থাকে পুতুল।

অন্যদিকে মিসেস প্রীতি মেয়েকে তার বিশেষ দিনে বিষন্ন দেখে বেশ চিন্তিত।দেশে ফিরে পর্যন্ত পুতুলের বেশ পরিবর্তন বুঝতে পারলেও সেটা কী জানতে পারেন নি।তবে জন্মদিনেও এতো কেন মন খারাপ ভেবে পাচ্ছেন না মিসেস প্রীতি।তার পছন্দের খাবার গুলোও না খেয়ে রুমে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে।এসব ভাবনার মাঝেই ফোন টা বেজে উঠে মিসেস প্রীতির।

রাত দশটায় সূর্যকে তার বন্ধুদের সাথে দেখে বেশ অবাক হন মিসেস প্রীতি।গায়ের ইউনিফর্ম দেখে বোঝায় যাচ্ছে অফিস থেকে সোজা এখানেই এসেছে সবাই।কপালের ইনজুরি টেপের সাথে ঠোঁটের এক চিলতে হাসিই যথেষ্ট মিহিরের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে।
-” ছোট মা,বার্থডে গার্ল কই? ”
-” রুমেই আছে ঘুমচ্ছে মনে হয়।”
-” ও, শুনলাম ব্যাপক আয়োজন করেছো তাই মিসকিন গুলোকে নিয়ে এলাম খাওয়াতে।মিসকিন গুলোর খাবার দাও তো ছোট মা। আমি যায় বার্থডে গার্লকে একটু উইশ করে আসি।”
কথাগুলো বলেই দ্রুত পায়ে পুতুলের রুমে চলে যায় সূর্য।পিছনে তাকালেই হয়তো দেখতে পেতো আটটা চোখ তাকে ভস্ম করার মতো তাকিয়ে আছে।নিজের স্বার্থে চারজনকে টেনেটুনে নিয়ে এসে এখন মিসকিন বানিয়ে দিলো! সেটা অবশ্যই বাকি চারজন ভুলবে না।

কল্লোলের নাম্বার থেকে সূর্যর দেওয়া হুমকি মূলক মেসেজ টা পড়ে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে পুতুল।সে মোটেও সূর্যের ফোন তুলবে না, সূর্য যা পাড়ে করবে।দরজা বন্ধের শব্দে চোখ খুলে তাকায় পুতুল।সূর্যকে দেখে ফট করে উঠে বসে পুতুল।পুতুলকে এদিক ওদিক তাকিয়ে পালানোর পায়তারা করতে দেখে সূর্য চট করে যেয়ে পুতুলকে বসা অবস্থায় বিছানার সাথে চেপে ধরে। কটমট করে বলল,
-” ফোন নাম্বার ব্লক করে শান্তিতে ঘুমনো হচ্ছে?কল্লোল এতোবার ফোন দিল ফোন তুলো নি কেন?”
কল্লোল না কে ফোন দিয়েছিল পুতুল তা ভালো করেই জানে,,,,, সে কেন ফোন তুলবে? তুলবে না।কথা গুলো ভেবেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয় পুতুল।
পুতুলকে অন্যদিকে তাকাতে দেখে সূর্য শয়তানি হাসি দিয়ে পট করে পুতুলের গলায় চুমু বসিয়ে দেয়।অনুভূতির আন্দোলন বুঝি একেই বলে, সূর্যর ছোঁয়ায় অনুভূতিরা তরতর করে সমস্ত শরীরে শিহরণের বান ছাড়িয়ে দেয়।পুতুল ছটফট করে সূর্যকে ছাড়িয়ে ওঠার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়।সূর্য পুতুলের কানে ফিসফিস করে বলল,
-” তোমাকে আঠারো তম জন্মদিনের বিশেষ গিফট দিতে এসেছি, চোখ বন্ধ করো নইলে বিশেষ গিফট দেওয়া যাবে না।”
সূর্যের কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকায় পুতুল।সূর্য ঠোঁট কামড়ে হেসে তার মুখের দিকে আগাতেই ঝট করে চোখ বন্ধ করে ফেলে পুতুল।ইসস,,,,এই সূর্য তাকে অনুভূতির আন্দোলনে আজই মেরে দেবে।এক পায়ের আঙুল দিয়ে আরেক পায়ের আঙুলে চেপে, সূর্যের বুক পকেট খামচে শক্ত করে চোখ বন্ধ করে রাখে পুতুল।

অনেকক্ষণ হলো সূর্যের কোনো সাড়া না পেয়ে চোখ মেলে তাকায় পুতুল।সূর্য তার দিকে তাকিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হাসছে।পুতুলকে তাকাতে দেখেই ঠুস করে পুতুলের লালচে নাকের ডগায় চুমু বসিয়ে দেয় সূর্য।তারপর পকেট থেকে কিছু একটা বের করে ঝটপট পুতুলের গলায় পড়িয়ে দিয়ে বলল,
-” অষ্টাদশীর শুভেচ্ছা টুনটুনি।”
পুতুল সূর্যের দেওয়া লকেট টা হাতে বলল,
-” আমার এই গিফট চায় না।”
পুতুলের কথায় সূর্য ভ্রু কুঁচকে কিছু চিন্তা করে দুষ্টু হেসে বলল,
-” কী গিফট চায়? ভয়ংকর চুমু?”
সূর্যের কথা শেষ হতেই পুতুল দুমদাম করে তার বুকে কিল বসাতে শুরু করে।সূর্য হেসে পুতুলকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-” তো কি গিফট চায়?”
-” আপনাকে চায়, উইথ আউট ইউর মেসি জব।শুধু আপনাকে চায়।”
সূর্য পুতুলকে সামনে এনে বলল,
-” আমি তো তোমারই।আর আমাকে চাইলে আমার পুরোটা মিলেই চাইতে হবে পিচ্চি, পুরোটাই।”
বলেই নাকটা টেনে দেয় সূর্য।পুতুল সূর্যের কপালে হাত দিয়ে টলটলে চোখে বলল,
-” আমার এসব চায় না,একদম চায় না।”

সারাদিনের বিষন্নতা অবাককে দেখেই উধাও হয়ে পুতুলের চোখে ভেসে উঠেছিল একরাশ স্নিগ্ধ ভালবাসা।যার সবটুকুই ধরা পড়েছিল মিসেস প্রীতির চোখে।মেয়ের চোখের ভাষা পড়তে সেদিন দু’সেকেণ্ডও লাগেনি মিসেস প্রীতির।”মায়ের কপালে মেয়ের কপাল” কথাটা কিছুতেই সত্যি হতে পারে না।তিনি অন্তত সেটা সত্যি হতে দেবেন না।রাত বারোটা নাগাদ অবাক আর তার বন্ধুরা বেরিয়ে যেতেই মিসেস প্রীতি শক্ত করে মেয়ের হাত ধরে রুমে চলে আসেন।

ভালবাসার অদৃশ্য শক্তি মানুষকে কোমল থেকে কঠোর করতে পারে আবার কঠোর থেকে কোমলও করতে পারে।আর সেই অদৃশ্য শক্তি প্রভাব ফেলে পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। ভালবাসার সেই অদৃশ্য শক্তি মিসেস প্রীতিকে কঠোর করেছিলেন,ভীষণ কঠোর।

জীবনের প্রথম মাম্মার হাতে থাপ্পড় খেয়ে গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে পুতুল।গাল বেয়ে টুপটুপ করে পানি ঝরছে। মিসেস প্রীতি চোখ ভর্তি নোনাপানি নিয়ে পুতুলের দুবাহু ধরে রেগে বললেন,
-” আমি অথবা অবাক।যেকোন একটা বেছে নিবি।অবাককে চাইলে এখনই তোর স্বার্থপর বাবার বাড়িতে চলে যাবি,এখনই।”
পুতুল তখনও মাথা নিচু করে ফুপিয়ে কাঁদছে।মিসেস প্রীতি হন্তদন্ত হয়ে কাবার্ড থেকে পুতুলের কাপড় নিয়ে ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বললেন,
-” তোদের কাউকে দরকার নেই আমার।তোর স্বার্থপর বাবা তো আগেই গেছে।তুইও যা,চলে যা।”
পুতুলের হাত ধরে ব্যাগ নিয়ে রুম থেকে বের হতে নিলেই পুতুল হাত ছাড়িয়ে মাম্মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে বলল,
-“আমার তোমাকে চায় মাম্মা, তোমাকে চায়।আমি কোথাও যাবো না মাম্মা, আমি তোমার সাথেই থাকবো।আমার অবাক কে চায় না মাম্মা, চায় না।”
★★★

বরফ শীতল পানির নিচে ফ্লোরে শাড়ী লেপ্টিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে থরথর করে কাপছে পুতুল।একহাতে হাঁটু জাপটে আরেক হাতে গলায় থাকা লকেট টা মুঠো করে ধরে ঝরনার পানির সাথে চোখের পানি গুলো গড়িয়ে দিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
-” আমার তোমাকে চায় না অবাক, চায় না।”
বলেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠে পুতুল।

চলবে
চলবে
কোন এক্সকিউজই দিবো না, আর কোনো কথাও দিবো না।সরি,সরি,সরি😞।

সমস্যায় আছি ভীষণ সমস্যা। 😢😢 বলা যাবে না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here