জল ফোয়ারা পর্ব -০৩

#জল_ফোয়ারা |৩|
#লেখনীতেঃ Liza Bhuiyan

৪.
সদর দরজায় কেউ কড়া নাড়তেই নুর খুব বিরক্ত হলো, চোখ গুলো পিটপিট করে রোহিণীর দিকে তাকিয়ে রইলো। রাজিয়া বেগম বাসায় নেই বলে রোহিণীকে যেতে দেয়নি নুর, জোর করে রোহিণীকে খাইয়েছে নিজ হাতে তারপর নিজের চুল বেণী করেছিলো এমন সময় বুঝলো কলিং বেল বাজাচ্ছে।রোহিণীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। রোহিণী নুরের আলসেমি ধরতে পেরে নিজেই উঠে গেলো, দরজা খুলতেই মুগ্ধর সামনাসামনি পড়ে যাবে তা ভাবতে পারেনি। চোখ নামিয়ে দরজার এক পাশে নিশ্চুপে দাঁড়ালো।

মুগ্ধ হচকিত হয়ে এদিক ওদিক তাকালো, মাকে না দেখতে পেয়ে আরো কিছুটা বিব্রত হলো। আঙুল দিয়ে চুলগুলো পিছনে নিতে নিতে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। রোহিণী সদর দরজা বন্ধ করে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো, নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হলো তার। কতোটুকু দুরত্বে মানুষটা? দশ থেকে বারো ফিট? অথচ সেই দুরত্বে ঘুচে দেয়ার সাহস কিংবা অধিকার কোনটিই তার নেই।

চোখের পানিগুলো নিঃশব্দে মুছে রান্নাঘরে গেলো, প্লেট হাতে ভাত-তরকারি সব নিয়ে রান্নাঘরের বেসিনের পাশে রাখলো। এপাশ ওপাশে শুকনো মরিচ খুঁজতে লাগলো, রাজিয়া বেগম একদিন খুব হেসেই বলেছিলেন তার ছেলে নাকি লাউ শাকের সাথে শুকনো মরিচ ছাড়া খেতে পারেনা। কন্টেইনারে শুকনো মরিচ পাওয়ার পর তা তেলে ভেজে প্লেটের পাশে রাখলো তারপর গুটি গুটি পায়ে মুগ্ধর দরজার সামনে গিয়ে আলতো করে টোকা দিলো। কেউ দরজা না খুলায় ভেতরে ঢুকে খাঁটের উপর খাবারের প্লেট রেখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো।

মুগ্ধ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রোহিণীকে দেখে আরেকদফা অবাক হলো, চোখ নামিয়ে খাঁটের উপর গিয়ে বসে পড়লো। প্লেট হাতে তুলে নিয়ে বসে রইলো কতক্ষণ, দরজার দিকে আবারো তাকিয়ে বুঝলো রোহিণী সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। মুগ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে খেতে শুরু করলো, খাওয়ার মাঝেই রোহিণী বলে উঠলো

“কাজের চাপ কি আজকে কম?”

মুগ্ধ না তাকিয়েই বললো

“কিছুটা, গোডাউনে তেমন জিনিসপত্র নেই তাই অর্ডার করতে হয়েছে নতুন অনেক কিছু। সামনের কয়েকদিন হয়তো বেশ ব্যস্ততায় কাটবে।”

স্বাভাবিক! খুব স্বাভাবিকভাবে কথাগুলো বলে শেষ করলো সে অথচ শরীরের মৃদু কাঁপন সে ঠিকই উপলব্ধি করতে পারছে। কতদিন পর কথা হলো তাদের? একবছর? দুবছর নাকি আরো বেশি? সময়ের হিসেব নেই মুগ্ধর কাছে, শুধু জানে হুট করে একদিন তারা আর কথা বলেনা, তুমুল ঝগড়া হলেও যেইটুকু কথা হতো তাও একসময় ফুরিয়ে গেছে। আগে চোখাচোখি হলেও রোহিণী এখন আর ওর দিকে তাকায় না, অবশ্য তাকালে হয়তো ও নিজেই হয়তো দৃষ্টি এড়িয়ে চলতো।
ছোট্ট করে ‘হুম’ বলে রোহিণী চলে যেতে নিলেই মুগ্ধ দ্রুততার সাথে বললো

“বিয়ের প্রস্তাবগুলো ফিরিয়ে দিচ্ছো কেনো?”

রোহিণী থমকে গেলো, পিছু ফিরে দেখলো মুগ্ধ ওর দিকে তাকিয়ে নেই। তাকাবেই বা কেনো? যাকে বিয়ে করার জন্য অপ্সরীরা বসে আছে সে কেনো ওর দিকে তাকাবে? রোহিণী মলিন হেসে বললো

“এই খবর বুঝি আপনি পর্যন্তও পৌঁছেছে? আপনি আমার বিষয়ে খবর রাখেন শুনে খুশি হলাম”

আপনি! কখন যে তুমি থেকে আপনি হয়ে গেছে তা হয়তো ওর জানা নেই। মুগ্ধ এই প্রথমবার রোহিণীর দিকে তাকালো, চেহারা শুকিয়ে মলিন হয়ে আছে। এখনো কিছু খেয়েছে কিনা কে জানে? আচ্ছা আজ তো ওকে দেখতে আসার কথা ছিলো, সেখানে না গিয়ে ও এখানে কি করছে? আজো ওর মায়ের হাতে মার খেয়েছে? মুগ্ধ বাকি ভাত খাওয়ার রুচি হারিয়ে ফেললো। আস্তে করে বললো

“বিয়ে করে নিলেই তো পারো, তাহলে তো এতো ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে না। নতুন সংসার, নতুন মানুষ! ভালোই থাকবে তুমি”

রোহিণী দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ালো, আনমনা হয়ে বললো

“নতুন মানুষেই তো বড্ড ভয়, আমি যে নতুনত্ব গ্রহণ করতে পারিনা। আচ্ছা বিয়ে ছাড়া কি জীবনে আর কিছু থাকে না?মা আমাকে বিয়ে দিতে চায়, আমার নতুন সংসার গড়তে চায়। তবে তারা এটা বুঝে না যে বেঁচে থাকা মানুষকে নাহয় বিয়ে দেয়া যায় কিন্তু জীবন্ত লাশের কি বিয়ে হয়?”

মুগ্ধ চোয়াল শক্ত করে ফেললো। ও জানে রোহিণী যতো বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিবে ওর ফ্যামিলি ওকে ততো জোর করবে আর সাথে শারীরিক-মানসিক অত্যাচার তো আছেই। মুগ্ধ তাদের দোষ দিতে চায়না, বাবা-মা হিসেবে হয়তো তারা মেয়ের সম্মানের কথা ভেবেই বিয়ে দিতে চাইছে কিন্তু তাই বলে এতো বড় মেয়ের গায়ে হাত তোলা… শান্তস্বরেই বললো

“তোমার বিয়ে করেই নেয়া উচিৎ রোহিণী, এভাবে তো জীবন চলে না”

রোহিণী কথাটা শুনে বেশ ক্ষিপ্ত হলো, কড়া গলায় বললো

“আপনি আমাকে এসব কথা বলতে পারেন না, যারা মাঝপথে হাত ছেড়ে দেয় তাদের মুখে সংসারের কথা মানায় না”

মুগ্ধ এবার বেশ চটে গেলো, কিছুটা জোরেই বললো

“আমাদের মাঝে কখনোই প্রেম ছিলো না রোহিণী, কোন কমিটমেন্ট ছিলো না। নিজের প্রেমিকার হাত ছেড়ে দেয়ার মতো পুরুষমানুষ আমি নই! অন্তত তোমার এটা ভালো করেই জানা। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলে, ফিরিয়ে দেয়া জিনিস সবসময় ফিরে পাওয়া যায়না রোহিণী!”

পাশের ঘর নুর ছুটে আসলো, যদিও কি হয়েছে বুঝতে পেরে উঠছে না কিন্তু রোহিণীর চোখে জল দেখে ও দ্রুত তার হাত চেপে ধরলো। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললো

“তুমি আপুকে বকেছো ভাইয়া? সমস্যা কি তোমার? আপু! তুমি মনে কিছু নিও না, ভাইয়াটা না এমনই। অল্পতে চটে যায়, দেখো কি যাচ্ছে তাই অবস্থা করে ফেললো”

রোহিণী কিছু না বলেই নুরদের সদর দরজা দিয়ে বাড়ি চলে গেলো, পিছু ফিরে তাকালে হয়তো বুঝতে পারতো মুগ্ধ কতো ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর পানে। নুর নিজের ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো

“যাকে ভালোবাসো তার সাথে এমন করো কেনো? কালও তো সব ঠিকঠাক ছিলো তোমাদের মাঝে, হুট করে কি হলো বলোতো?”

মুগ্ধ কপালে তর্জনী আঙুল ঘষতে ঘষতে বললো

“কিছু হয়নি, তুই তোর রুমে যা”

নুর আরো কিছু বলতে চেয়েও বললো না, যতোই কড়া কথা বলুক না কেনো ভাইকে ভেতরে ভেতরে প্রচুর ভয় পায় ও। মনে মনে ঠিক করলো রোহিণীর থেকে ঠিক বের করে নিবে কি হয়েছে। নুর চলে যেতে নিবে তখন মুগ্ধ শান্ত গলায় বললো

“রেডি হয়ে নে, ডাক্তারের কাছে যাবো আমরা”

নুর বিরক্ত হয়ে নিজের রুমের দিকে যেতে লাগলো, বিড়বিড় করে বললো

“উফফ আবারো! আমিতো ঠিকই আছি, তারপরও এমন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় কেনো?”

নুর চলে যেতেই মুগ্ধ রান্না ঘরে এলো হাত ধুতে, জানালা দিয়ে পাশের বিল্ডিংয়ে তাকিয়ে ভাবলো রোহিণীর কথা। খুব সহজেই রোহিণীকে বলে ফেললো ওদের মাঝে প্রেম ছিলো না। প্রেম কি তবে স্বীকৃতি পাওয়া সম্পর্কগুলোতেই থাকে? একে অপরকে ভালোবাসা বাসি বলার মাধ্যমেই বুঝি কমিটমেন্ট হয়? কিন্তু ওর মনেও তো প্রেম ছিলো, অনুভুতি ছিলো। ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা পর্যন্ত গড়িয়েছিলো, দু বেণী করে মুক্তঝরা হাসি দিয়ে সে যখন স্কুলের পথে বের হতো তখন ঠিকই তাকিয়ে থাকতো সে। সেটা কি তবে প্রেমানুভুতি ছিলো না? ওদের মাঝে তো শুধু ওই স্বীকৃতি পাওয়াটাই বাকি ছিলো!

৫.
সৌহার্দ্যর হাতে যখন পরের চিঠিটা পৌঁছায় তখন চিঠির সংখ্যা সাত। চিঠিটা আট বছরের পুরোনো, এটা সেই দিনগুলোর যা ওকে বিষাক্ত শূলের মতো তাড়া করে বেড়ায়। মাথায় ঘুরপাক খেলো কিছু অগোছালো কথা

‘সমবয়সী সম্পর্ক টিকছে এমন দেখছস কখনো? শুধু শুধু সময় নষ্ট।’

‘ফল মিষ্টি হলে গাছ লাগানোর কষ্ট রকার মনে থাকেনা’

‘ক্যারিয়ারে মনোযোগ দাও, তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সামনে’

‘আমরা তোর পিছনে টাকা পয়সা খরচ করি এই রেজাল্টের জন্য? দিন দিন বাজে ছেলে হচ্ছিস তুই, কার সাথে মিশিস আজকাল?’

সৌহার্দ্য মাথা চেপে ধরলে, মাইগ্রেনের ব্যাথাটা আবারো বেড়েছে খুব। হাতে দলা পাকানো চিঠিটা খুলে আরো একবার পড়তে শুরু করলো,

প্রিয় তুষার,

আমাদের কথা হয়না আজ তিনদিন, আমি যে খুব চেষ্টা করেছি তা কিন্তু নয়। তুমি বরাবরই শান্ত মেজাজের মানুষ, কিন্তু রেগে গেলে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হও। তোমার শান্ত হওয়া প্রয়োজন বলেই আমি তোমাকে বিরক্ত করিনি।কোচিংয়ে যাওয়ার সময় তোমাদের বাসায় তালা দেখে ভাইয়াকে ইনিয়ে বিনিয়ে জিজ্ঞেস করতে সে বললো তোমরা নাকি বাড়ি বিক্রি করে ফেলেছো। কোথায় গেছো তার জানা নেই, অনেকটা রেগেই কথাগুলো বলেছিলো ।আমি তার কথায় কান দেয়নি জানো! আমাদের ওই সামান্য ঝগড়ায় তুমি আমায় ছেড়ে চলে যাবে? বিষয়টা ভাবতেই হাসি পাচ্ছে। আমি জানি তুমি রাগের মাথায় ব্রেকাপ করতে চেয়েছো কিন্তু আমি তো রাজি হয়নি। আমাদের সম্পর্ক তো শেষ হয়ে যায়নি। আমি তো তোমাকে আমায় ছেড়ে যাওয়ার সম্মতি দেয়নি! কল দিও প্লিজ। তোমার কন্ঠ শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব!

ইতি
তোমার শুভ্রি’

সৌহার্দ্য চিঠিটা সযত্নে বাকি চিঠিগুলোর পাশে রেখে দিলো, রোজকার মতো আজোও স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো, কিছুটা ঘোরের মাঝে মাথায় আওড়ানো নাম্বারটা ডায়াল করলো। ওপর পাশ রোবটের মতো কেউ একজন বলেই চললো

*আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটা এই মুহুর্তে বন্ধ আছে, অনুগ্রহ করে—*

সৌহার্দ্য তাতে আর কান দেয়নি, চিঠির লিখা নিয়ে ভাবতে লাগলো। সে বলেছে সম্পর্ক শেষ হওয়ার সম্মতি সে দেয়নি অথচ সেই সম্পর্ক ধরে রাখার ক্ষমতা তার তুষারের ছিলো না। যেখানে অভিমতের মূল্য নেই সেখানে সম্মতির প্রাধান্যতা কতোটুকু?
বাবা মায়ের বাধ্য সন্তানরা খুব একটা অবাধ্য হতে পারেনা, তারা অনুশোচনার ভয়ে অনেককিছুই মাথা পেতে নেয়। যেমন এই এলাকা বদলি, নিজের সকলকিছু ছেড়ে নতুনত্বকে বেছে নেয়া। সেদিন বাবার মুখের উপর প্রথম কথা বলেছিলো ও

*ফ্ল্যাশব্যাক*

‘বাবা তোমার ঢাকায় পোস্টিং হয়েছে আর সেটা আমাকে আজকে জানানো হচ্ছে?’

সৌহার্দ্যর বাবা খবরের কাগজ পড়তে পড়তে স্বাভাবিক ভাবেই বললেন

‘এখানে তোমাকে জানানোর তো কিছু নেই, তোমার সবকিছু গোছানোর জন্য যতোটুকু সময় দরকার তা তোমাকে দেয়া হয়েছে।’

সৌহার্দ্যর গলা শুকিয়ে এলো, নিম্নকন্ঠে বললো

‘আমি এই এলাকা ছেড়ে যেতে চাইনা প্লিজ। এখানে আমার বড়ো হওয়া,বেড়ে উঠা সবকিছু।আমার বন্ধুরা…’

সৌহার্দ্যকে না বলতে দিয়ে ওর বাবা দৃঢ় কন্ঠে বললো,

“ক্লাস ফোরে যখন ঢাকা থেকে এখানে এসেছি তখন একই কথা বলেছিলে মনে আছে? কিন্তু পরে ঠিক খাপ খাইয়ে নিয়েছো। নতুন এলাকায় ঠিক সেভাবেই মানিয়ে নিবে, তুমি তোমার পরিবারের সাথে থাকবে। বাইরের কারো সাথে নয়। এমন বন্ধু ওখানে গিয়ে অনেক বানাতে পারবে”

সৌহার্দ্য আর কিছু বলার সাহস পায়নি। খাবার টেবিল ছেড়ে মাথা নিচু করে রুমে চলে যায়। সেদিন যদি চিৎকার করে বলা যেতো

“বাবা সত্যিকারের বন্ধু বারবার বানানো যায়না, আর ভালোবাসা! নিজের থেকেও বেশি শুধু একজনকেই ভালোবাসা যায়, সকল কিছুর রিপ্লেসমেন্ট হয়না”

কিন্তু বাবার বিরুদ্ধে কিছু বলার দৃঢ় কন্ঠ ওর ছিলো না। আট বছর পর এসে সেসব স্মৃতি এখন মলিন ফ্যাকাসে, কতো অভ্যেস কতো স্বপ্ন রয়ে গেছে স্মৃতি হয়ে। বন্ধুদের আড্ডায় গিটারের টুংটাং শব্দ কিংবা চায়ের টংয়ে লুকিয়ে দু একটা সিগার টানা! সেই বন্ধুরা আজ কোথাও একটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিজেদের মতো করে। সবই তো ম্লান অতীত।
আচ্ছা ওর এই ছুটে যাওয়া অভ্যেস গুলোর মতো তার কবিতা লিখার অভ্যেসও কি চলে গিয়েছে? সেকি এখন আর নিজের নোট খাতায় লুকিয়ে কবিতা জমায় না?

#চলবে…

(ভুল ত্রুটি ক্ষমাশীল দৃষ্টিতে দেখবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here