জল ফোয়ারা পর্ব -০২

#জল_ফোয়ারা |২|
#লেখনীতেঃ Liza Bhuiyan

” তবু তোমাকে ভালোবেসে
মুহূর্তের মধ্যে ফিরে এসে
বুঝেছি অকূলে জেগে রয়
ঘড়ির সময়ে আর মহাকালে
যেখানেই রাখি এ হৃদয় ”
জীবনানন্দ দাশ

১.
কালবৈশাখী ঝড়ের পর গ্রীষ্মের ভ্যাঁপসা গরমে যেমন অস্থির অস্থির লাগে, নুরের ভেতরটায় ঠিক তেমনই অনুভুতি কাজ করছে। খুব বেশি গরম না থাকলেও নুর অজানা ভয়ের রেশ কাটিয়ে উঠতে পারছে না। কপালে, নাকের ডগায়, চিবুকে বিন্দুবিন্দু ঘাম জমেছে। ওড়না দিয়ে মুছতে মুছতে নিজেকে বিচ্ছিরিভাবে বকা দিতে ইচ্ছে হলো, মা বলেছিলো ছাতা নিয়ে আসতে কিন্তু তা অগ্রাহ্য করে অনেকটা ভাব নিয়ে বলে এসেছে

‘এইটুকু রোদ আমায় পুড়ে ফেলবে না মা, শুধু শুধু চিন্তা করছো তুমি’

বলেই খপ করে বেরিয়ে পড়েছিলো, রুমালটা সাথে করে নিয়ে আসার কথা কুলক্ষণেও মনে পড়েনি। পার্কের গেটে দুই-তিনবার নজর দিয়ে খাতায় মনোযোগ দিলো। সামনে এসাইনমেন্ট পড়াশুনো সবকিছুর বেশ চাপ থাকলেও সে কবিতা লিখার চেষ্টায় ব্যস্ত, একের পর এক লিখেই যাচ্ছে কিন্তু পরিতুষ্ট না হওয়ায় ছিড়ে দলা পাকিয়ে অদূরে ছুড়ে মারছে। এভাবে কতোটুকু সময় পেরিয়ে গেলো নুরের জানা নেই, ভ্রু কুঁচকে লাইনের পর লাইন মেলাতে ব্যস্ত সে।

নুরের ঠিক পাশটায় রোহিণী ঘাপটি মেরে বসে পড়লো নিশ্চুপে, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝলো আড়াইটা বাজে। রোহিণী আশেপাশে তাকিয়ে অনেকগুলো কাগজের দলা দেখতে পেলো, নিঃশব্দে একটি উঠিয়ে আস্তে করে খুললো। এলোমেলোভাবে তাতে কিছু শব্দের কবিতা লিখা,,

‘অনুভুতিগুলোকে ভাসিয়ে দিলাম তারুণ্যের জোয়ারে
ভাটায় হেলেদুলে তারা হারিয়ে যায় বহুদুরে,
মাঝে মাঝে পাড়ে ঘেসে তারা উঁকিঝুঁকি দেয়
পাড়ের ধারের আমিকে নিশ্চুপে দেখে যায়’
(লিজা ভুঁইয়া)

রোহিণী আরো কিছু কাগজ তুলে তুলে পড়তে লাগলো, একসময় হাতের নাগালে আর না আশায় হাল ছেড়ে দিলো। শরীর খুব একটা ভালো নেই, পিঠের ব্যথাও চাড়া দিয়ে উঠছে। পাশে থাকা নুরের দিকে তাকাতেই রোহিণী ব্যাথা ভুলে গাল দিয়ে দেখলো কিছুক্ষণ তাকে তারপর হাত বাড়িয়ে কাঁধে কয়েকটা চাপড় দিতেই নুর সতর্ক হয়ে গেলো, চোর ধরা পড়ার মতো দ্রুত খাতা বন্ধ করে লুকিয়ে ফেললো। পাশে তাকিয়ে রোহিণীকে দেখে ক্যাবলা হাসি দিয়ে বললো

“আরে রোহু আপু, তুমি কখন এলে?”

রোহিণী স্বাভাবিক ভাবেই বললো

“হলো কিছুক্ষণ, তা কবি হচ্ছিস বুঝি? কিন্তু লিখার তো উন্নতি হলো না। বেশি বেশি কবিতার বই পড়, তাহলে কবি না হলেও বড় কবিতা লিখে ফেলতে পারবি”

নুর কিছুটা লজ্জা পেলো, হাতের তালুতে মুখ লুকিয়ে ফেলে বললো

“কি যে বলো না, আমি জাস্ট টাইম পাস করছিলাম”

বলেই পার্কের গেটের দিলে আরেকদফা তাকালো কিন্তু বরাবরের মতোই হতাশ হলো। রোহিণী নুরের তাকানো দেখে সেদিকে তাকালো, ঘটনা বুঝতে পেরে হাল্কা কেশে বললো

“যার অপেক্ষায় আছিস সে আজ আসবে না, আসার সময় শুনেছি কি কাজে যেনো বেরিয়েছে। বলতে হয়তো ভুলে গেছে তোকে”

নুর মন খারাপ করে ফেলে বললো

“একবার জানিয়ে দিলেই তো হতো, আমি কি আর মাকে মিথ্যে বলে আসতাম”

পরক্ষণেই আবার হাসি দিয়ে বললো

“থাক পার্কের পরিবেশ ভালো ছিলো, সবুজের মাঝে নুরের একদিন। ভালো বইয়ের নাম হবে না বলো?”

রোহিণী হেসে বললো

“আর বইটা বুঝি তুই লিখবি?”

নুর সেই কথায় পাত্তা না দিয়ে বললো

“তুমি না সুন্দর দেখতে রোহু আপু”

রোহিণীর মুখটা মলিন হয়ে গেলো, অন্যদিকে ফিরে বললো

“মিথ্যে বলিস কেনো রে? আমার থেকে আমাকে ভালো আর কে চিনে”

নুর রোহিণীর কাঁধে হাত রেখে বললো

“সত্যি বলছি আপু, তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে। কালও তোমাকে…তুমি নিজের যত্ন নেওনা কেনো? চেহারার কি অবস্থা করেছো! খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করোনা? আর তোমার চুলগুলো কবে কাট-”

রোহিণী নুরকে থামিয়ে দিলো, অশ্রুসিক্ত নয়নে বললো

“দেখতে কুৎসিত লাগছে বললেই পারিস, এতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলার প্রয়োজন ছিলো না ”

নুর কিছু বলতে নিয়েও বললো না, কথা বাড়ালে হয়তো রোহিণী ভুল বুঝে আরো কষ্ট পাবে। ও গেটের দিকে আরো কয়েকবার তাকালো। দ্রুত ফোন বের করে লুকিয়ে কয়েকটা মেসেজ দিলো কিন্তু মেসেজ ডেলিভারড হলো না। নুর কপাল ভাজ করে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো, অজানা ভয়টা আবার নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলো। রোহিণী নুরের দিকে আবার তাকিয়ে ভাবলো,
কিছু কিছু অপেক্ষার শেষ হয়না, কেউ হয়তো অহোরাত্র কারো অপেক্ষায় থেকে যায় অথচ সেই মানুষটাই দৃষ্টিগোচর হয়না!
ও আনমনেই বলে ফেললো

“কখনো কাছের কাউকে হারিয়েছিস নুর?”

নুরের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো, হাটুতে মাথা রেখে মিষ্টি করে বললো

“নাতো! আমি যাকে কাছের ভাবি সেও আমাকে খুব করে চায়। হারিয়ে ফেলার অনুভুতি আমার জানা নেই। মাঝেমাঝে ভয় হয় জানো! যদি যা আছে তা একমুহুর্তে সব মিথ্যে হয়ে যায়? কিন্তু তাকে দেখলে সেই ভয়টা কেটে যায়”

কথাগুলো শুনে রোহিণীর খুব রাগ হলো হুট করে নুরের উপর, কড়া করে কিছু কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো কিন্তু রোহিণী নিশ্চুপে তাকিয়ে বললো

“চল বাসায় ফিরে যাই, অনেক বেলা হয়ে গেলো”

নুরও দাঁড়িয়ে গেলো সাথে সাথে, আরো দেরি হলে বাসায় গেলে মা হয়তো বকবে খুব করে। জামাকাপড় ঝেড়ে সে ব্যাগে সবকিছু ঢুকিয়ে নিলো তারপর হাসিমুখে রোহিণীর পিছু নিলো। রোহিণী খেয়াল করলো নুরের হাসিমাখা চেহারায় একরাশ ক্লান্তি, হাসিখানা যেনো মুখেই লেগে আছে কিন্তু ওর চোখদুটো হাসেনা। বড্ড কৃত্রিম মনে হয় ওকে! মানুষ কষ্ট পেয়ে বিমর্ষিত হয়, বিরোহে দিন যাপন করে কিন্তু যে কষ্ট পেয়েও উপলব্ধি করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তার চেয়ে বড় অভাগা আর কে হয়?

২.
সোমবার রাতে সৌহার্দ্যর বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হলো, কিছু বড় বড় কোম্পানিতে রেট হয়েছে আজ। সেখানে সব হিসেব নিকেশ শেষ করে বেরুতে বেরুতে রাত সাটটা। কিছু বড় অফিসারের দুবছর পরিমাণ জেল হয়েছে সাথে পাঁচ লাখ করে জরিমানা, শাস্তি ও নিজেই ফাইনালাইজ করে এসেছে। সৌহার্দ্য জানে এটা করার কারণে তার জীবনের ঝুঁকি হয়তো বেড়ে গিয়েছে কিন্তু অন্যায়ের সাথে কোন আপোষ নয়। ঝিনাইদহ থেকে ঢাকায় ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত সাড়ে বারোটা। ঢুকতেই দেখলো মা সোফায় বসে ঝিমোচ্ছে, ওকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বললো

“এতো দেরি হইয়া গেলো?”

সৌহার্দ্য কোট খুলতে খুলতে বললো

“কিছু কাজ ছিলো মা, অনেক চেষ্টা করেও তাড়াতাড়ি আসতে পারলাম না”

সৌহার্দ্যের মা দাঁড়িয়ে বললেন

“তোর আপিস থেকে কি জানি চিঠি আশসে, আমি টেবিলের উপর রাইখা দিসি”

সৌহার্দ্য টাই খোলার মাঝ পথে থমকে গেলো,মাথা নাড়িয়ে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো

“মা অদি খেয়ে ঘুমিয়েছে?”

রহিমা বেগম মাথা নাড়িয়ে বললেন

“অদিতারে তো চিনস, তোরে ছাড়া কিছুই করতে চায়না। তাও ঘুমানোর আগে দুধ খাইওয়াসি আমি। মেয়েটা না খেয়ে শুকাইয়া যাইতাসে, ওর মাও তো ওরে ছাইড়া চইলে গেলো”

বলেই তিনি অশ্রুজল নিয়ে আঁচলায় মুখ গুঁজলেন। সৌহার্দ্য মাকে জড়িয়ে ধরলো, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো

“আমি তো মরে যায়নি না, এখন থেকে আমি ওর প্রতি আরো যত্নশীল হবো। তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”

রহিমা বেগম ঘরে যেতেই সৌহার্দ্য নিজের কামরায় গেলো, গোসল করে বেরিয়ে আগে কিছু খেয়ে নিলো। এরপর অদিতার রুমে গিয়ে তাকে সাবধানে কোলে করে নিজের ঘরে নিয়ে আসলো। ঘুম থেকে উঠিয়ে কিছু খাওয়ানোর ইচ্ছে থাকলেও সেই ইচ্ছে চেপে গেলো। অদিতাকে ঘুম থেকে উঠালে অযথা কান্নাকাটি করে এরপর ওর প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করে। অদির মাথায় অধর ছুঁইয়ে সৌহার্দ্য অফিসরুমে গেলো, টেবিলের উপর একই রঙয়ের খাম থেকে খুলে দেখবে কিনা দ্বিধান্বিত হলো। শেষমেশ চিঠিটা নিয়ে অদির পাশে এসে শুয়ে পড়লো, খাটের পাশে ল্যাম্প জ্বালিয়ে চিঠিটা খুললো।
চোখের সামনে ভেসে আসলো সেই সুন্দর হস্তশিল্পের লেখনী,

‘প্রিয় তুষার,

আমার দিনগুলো আজকাল রংহীন ফানুসের মতো, গন্তব্যহীনতায় ভুগে তারা। সময়ের হিসেব মিলে না খুব একটা, বিষাদ লাগে সবকিছু। আজ বাবা মায়ের সাথে প্রচুর ঝগড়া হয়েছে আমার। তাদের ভাষ্যমতে এখন আমার বিয়ে করার সঠিক সময়। নাহয় এলাকায় এরপর মুখ দেখানো দায় হয়ে পড়বে। কিন্তু তোমায় ছাড়া অন্যকাউকে কি করে মেনে নেই?আমি তো অন্যকাউকে বিয়ে করার কথা ভাবতেই পারিনা। মা বলেছে বেয়াদব বানানোর জন্য আমাকে লেখাপড়া শিখায়নি, বিয়ের পরও নাকি পড়াশুনো করা যায়।আমি জানি তুমি তো আর চাইলেই এখন বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে পারবে না আর বাবা-মা রাজিও হবে না। তাদের সাথে রাগ করে আমি সারাদিন কিছু খাইনি, কিন্তু খালি পেটে তো বেশিক্ষণ থাকতে পারিনা। বড্ড কষ্ট হচ্ছে জানো! আমিও কিসব বলছি,তোমার এতো শত ঝামেলার মাঝেও আমিও আরো কম্পলেইন করছি। রাতে কল দিও ঠিক আছে? মোবাইল আমার কাছে রাখবো আজ!

ইতি,
তোমার শুভ্রি’

সৌহার্দ্যর হুট করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো, ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখলো অস্পষ্ট তারিখ ‘১১/০৬/১৪’। সৌহার্দ্য তারিখটায় হাত বুলালো কয়েকবার। এই চিঠিখানা আসতে আসতে আটবছর লেগে গিয়েছে! আচ্ছা এখনো কি তার কাছে মোবাইল রাখতে দেয়? সেই নাম্বারে কল দিলে কি তাকে পাওয়া যাবে?সেদিন কি সে ওর কলের অপেক্ষায় ছিলো সারারাত? কল না দেওয়াতে খুব কষ্ট পেয়েছিলো?

সৌহার্দ্য মুখস্থ থাকা নাম্বারটা মোবাইলে উঠিয়েও কল দিলো না, আটবছর পরও সব একই থাকবে তা ভাবাটাই হাস্যকর। সে হয়তো এখন অন্যকারো তুমি হয়ে তার গল্প সাজাতে ব্যস্ত, পুরোনো স্মৃতি মনে রাখার সময় হবে তার?

#চলবে…

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here