জল ফোয়ারা পর্ব -শেষ

#জল_ফোয়ারা |শেষ পর্ব|
#লেখনীতেঃ Liza Bhuiyan

নিষ্কলা বিহঙ্গী আমি,নীড় ছেড়েছি মানে
কতশত কথা জড়িয়ে আছে, ঘরে ফেরার গানে।
(লিজা ভুঁইয়া)

কপলে হাত রেখে ভাবনায় মস্ত সৌহার্দ্য, চিন্তায় কপালে ভাজ পড়ছে বারংবার। আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেলো নুরের দেখা নেই। অদিতাও বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে তার কথা কিন্তু সৌহার্দ্যের কাছে জবাব ছিলো না। রোহিণী ফিরে আসাতে অদিতার বেশিরভাগ সময় ওর সাথেই কা!টে, হয়তো রোহিণীই সামলে নিচ্ছে।ওর ভাবনার একমাত্র বিষয় হচ্ছে নুর। সেদিন নুরকে অনেকগুলো প্রশ্ন করলেও তার কোন জবাব মিললো না সৌহার্দ্যের, নুর শুধু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়েই ছিলো। ওর কথা কতোটুকু ধরলো, কতোটুকু শুনলো তা বুঝা গেলো না। শুধু তাকিয়েই রইলো কতোক্ষন। মনে হলো অনেককিছুর হিসেব মিলালো,অনেক কিছু বলতে চাইলো। হাতের মৃদু কাঁপনে সৌহার্দ্যের হাত চেপে ধরতে চাইলো, দেখাতে চাইলো রা*গ, ক্ষো*ভ বা ক্লে*শ কিন্তু শেষমেশ নিশ্চুপতাকেই বেছে নিলো। নিষ্কলা বিহঙ্গীর মতো কা!তরা!তে কা!তরা!তে দূরে সরে গেলো। পিছু চাইলো একবার তারপর দ্রুত পায়ে ঘরের বাইরে। সৌহার্দ্যের হৃদয়ে চিনচিন ব্যথা শুরু হলো, এই শব্দহীন শা!স্তির সমাপ্তি কোথায়?

দুদিনের মাথায় রোহিণীকে নুরের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেও রোহিণী দৃষ্টি লুকিয়ে বললো জানেনা, হয়তো বলতে চাইলো না। ও বুঝাতে পারলো না যে ও শুধু জানতে চায় নুর ভালো আছে কিনা, সুস্থ আছে কিনা কিন্তু সবাই যেনো ইচ্ছে করেই ওকে কিছু বলছে না। টেনশনে মাথা ব্যা!থা শুরু হওয়ায় উঠে দাঁড়ালো, অদিতাকে নিজের মায়ের সাথে দেখে স্বস্তি পেলো। সবকিছু এখানে শিফট হওয়ায় মাকে ঢাকা থেকে এখানে নিয়ে এসেছে, ওখানে একা একা রাখতে ভরসা পায়নি। দুনিয়ায় একমাত্র পরিবার বলতে শুধু ওর মা আর অদিতাই আছে ওর!

আজ শুক্রবার, বেলা বারোটায় মসজিদে খুৎবা শুনতে বসলো। দ্বিতীয় সারিতে মুগ্ধকে দেখে ভরসা পেলো, নামাজ শেষে মুগ্ধর পিছু নিলো। ফাঁকা স্থানের কাছে আসতেই মুগ্ধ দাঁড়িয়ে গেলো, পেছনে তাকিয়েই বললো

“কি চাই তোর?”

সৌহার্দ্য দ্রুত পায়ে মুগ্ধর বরাবর এসে দাঁড়ালো, আমতাআমতা করে বললো

“দুটো প্রশ্নের জবাব”

মুগ্ধকে সম্মতিসূচক মাথা নাড়তে দেখে সৌহার্দ্য আবারো বলা শুরু করলো

“নুর কোথায়, ওর শরীর ভালো আছে?ও আসেনা কেনো এখন আমাদের এদিকে?বদ্ধ পরিবেশ তো ভালো নয় ওর জন্য, ও ঘরেই থাকছে?”

মুগ্ধ হাল্কা হেসে বললো,

“দুটো প্রশ্ন করার কথা ছিলো”

সৌহার্দ্যের চুপ করে থাকা দেখে বললো

“নুর কোথায় আছে, কি করছে সেটা বলতে পারছি না। নুর মানা করেছে আমাকে বলতে। শুধু এইটুকু বলতে পারি ও ভালো আছে কিংবা ভালো থাকার প্রয়াস করছে।”

সৌহার্দ্য আরো কিছু কথা বলতে চাইলো, নুর কোথায় আছে তা জানার জন্য মন আনচান করতে থাকলো কিন্তু মুখে বললো অন্য কথা,

“তোকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারি দোস্ত?”

মুগ্ধ হচকিত হয়ে পড়লো, কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো তারপর আস্তে করে মাথা নাড়লো। সৌহার্দ্যর জন্য ওইটুকু সম্মতি অনেক, মুগ্ধকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো যেনো ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। মুগ্ধ শুধু দাঁড়িয়ে রইলো, বিপরীতে জড়িয়ে ধরলো না। সৌহার্দ্য হাল্কা করে পিঠ চাপ\ড়ে চলে গেলো দ্রুততার সাথে। মুগ্ধ ধীরে সুস্থে বাড়ি ফিরলো, খাঁটের উপর বসে সামনে থাকা নারীমূর্তিকে বললো

“আমি কি আবারো ভুল করছি রোহিণী?”

রোহিণী নিশ্চুপে পাশে এসে বসলো, মুগ্ধর দ্বিধা বেশ বুঝতে পারছে। কাঁধে মাথা রেখে ধীরেধীরে বললো

“আমি ভাগ্যে খুব বিশ্বাস করি জানো তো! যদি কারো কিসমতে কিছু থাকে তবে বহুকাল পরেও সে ওটা পায় তাই চিন্তা করো না। মাঝেমাঝে হাপিয়ে উঠলে একটু ব্রে!ক দরকার, নুরের সেটা এখন বড্ড প্রয়োজন। ও এই কয়দিন কেমন ছিলো দেখেছো তো! ওর নিজেকে গুছাতে কিছুটা সময় দাও, আট বছরের জমানো স্মৃতিতে মানিয়ে নেয়ার সুযোগ দাও একটু প্লিজ। ট্রাস্ট মি, এটার থেকে ভালো অপশন আর কিছু হতেই পারে না।”

মুগ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেললো, রোহিণী ঠিক বলছে।নুরের সবকিছু মানিয়ে নেয়ার সময় দরকার। ও রোহিণীর হাত নিজের হাতের ভাজে নিয়ে আঙুলের সাথে খেলতে লাগলো। রোহিণী মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে রইলো, মুগ্ধর বিয়ে ২১ই মে তেই হয়েছে। নুরের জন্য পিছাতে চাইলেও নুর অনেকক!ষ্টে সবাইকে মানিয়েছে সব সঠিক সময়ে করার জন্য। পাত্রী ছাড়া সকল কিছুই এক ছিলো, ও জানেনা মুগ্ধ সকলকিছু কি করে ম্যানেজ করেছে। হয়তো দুই পরিবারই ভয়ে ছিলো, ওর নিজের পরিবার তো যে কারো সাথে বিয়ে দিতে প্রস্তুত। মেয়ের বয়স তো আর কম হয়নি। গতবারের মতো এবার রোহিণী ফিরিয়ে দেয়নি, হয়তো আবারো হারিয়ে ফেলার ভয়ে। সময়ের সাথে সাথে ক্ষত শুকিয়ে যায় কিন্তু মান অভিমানে কাছের মানুষকে হারা\নোর প্রশ্নই উঠে না। ও মুগ্ধকে এভাবেই আগলে রাখবে, নাহয় ওর সুপুরুষ বরের উপর কারো যদি নজর লেগে যায়?

১৮.
এক বছর পর~~

বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কিছু কাগজ দেখায় ব্যস্ত ছিলেন। ঠিক এমন সময় মৃদু শব্দে দরজায় নক করায় উনি চেঁচিয়ে ভেতরে আসতে বললেন। একজন শাড়ি পরিধান করা নারী ভেতরে আসলো, ঠোঁটে হাসি টেনে বললো

“ক্লাস টুয়ের অদিতা রায়হানকে নিতে এসেছি আমি, ওর বাসায় কিছু সম!স্যা হয়েছে বলে এক্ষুনি যেতে হবে”

প্রধান শিক্ষক কপাল কুঁচকে বললেন

“আপনি অদিতার কে হোন?”

সামনে থাকা নারী হেসে বললো,

“আমি অদিতার মা হই”

প্রিন্সিপাল মাথা নেড়ে একজনকে ডাক দিলেন অদিতাকে ডেকে আনার জন্য, সামনে থাকা নারীর হাসি তখনও প্রগাঢ়।
স্কুলে চতুর্থ ঘন্টা চলছে, অদিতা মনোযোগ নোট করতে ব্যস্ত। এমন শিক্ষক ডেকে বললেন

“অদিতা! ব্যাগ গুছাও। তোমার মা এসেছে তোমাকে নিতে।”

অদিতা কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ গুছালো, ক্লাস থেকে বের হওয়ার পর মনে হলো ওর তো মা নেই। তবুও কেনো জেনো প্রিন্সিপালের কক্ষ পর্যন্ত হেঁটে গেলো, কাছাকাছি আসতেই পরিচিত মুখ দেখে অদিতা দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। ফিসফিসিয়ে বললো

“তুমি এসেছো, কতো অপেক্ষা করেছি তোমার জানো। আর কখনো ছেড়ে যাবে না আমায়”

সামনের নারী মুচকি হেসে সম্মতি জানিয়ে বললো

“আর কক্ষনো যাবো না, এবার বাড়ি চলো”

—————-

চলন্ত গাড়িতে ব্যস্ত শহর দেখছে সৌহার্দ্য, একের পর এক গাড়ি পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। জীবন থেকে চলে যাওয়া সময়গুলোও এমন, একসময় হয়তো টিকটিক শব্দের ঘড়িও থেমে যায় কিন্তু সময়কে বেঁধে রাখা যায়না। এই যে নুরকে ছাড়া একটা বছর দেখতে দেখতে চলে গেলো। ও তো এইটুকুতেই স্বস্তি পায় যে নুর ভালো আছে। কি ভেবেই যেনো ব্যাগ খুললো হঠাৎ। ব্যাগের পকেট থেকে একটা হলদে খাম বের করলো। ভেতরে কয়েকটা সুন্দর দৃশ্যের আঁকা ছবি, সাথে সেই মার্জিত হস্তশিল্পে লিখা,

“প্রিয় অদি,
শুনেছি তুমি নাকি রিডিং পড়তে শিখে গেছো, নতুন ক্লাসে তোমার বন্ধু হয়েছে কিছু। ঈর্ষান্বিত হয়ে শেষমেশ চিঠিটা লিখেই ফেললাম, নতুন বন্ধু পেয়ে যদি আমাকে ভুলে যাও! সেই রি!স্ক কিন্তু নিচ্ছিনা, আমি কিন্তু তাদের নাম জানি। অনিক, মাহিয়া আর রাঈসা! কি মিষ্টি নাম তাদের, আমাদের যখন দেখা হবে তখন ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে ভুলবে না যেনো। আমরা সবাই সেদিন সারাদিন ঘুরবো আর অনেক মজার খাবার খাবো। তোমার বাবাইকে বলো না কিন্তু, তার সাথে ঘুরবো না। শুধু আমি আর তুমি কিংবা সাথে তোমার বন্ধুরা। তুমি পড়াশুনা ঠিকমতো করো তো? দিদাকে একদমই কষ্ট দিয়ো না, বয়স হয়েছে তো তার। বাবাই এর কথা শুনো, তোমার রোহু আন্টিকে বলো নিজের খেয়াল রাখতে নাহয় বাবু ক\ষ্ট পাবে! ভালো থেকো, দেখা হওয়া পর্যন্ত আলবিদা।
ইতি,
নুর”

এই খামটি এসেছে আজ একমাস কিন্তু অদিতাকে দেখাবে দেখাবে বলেও দেখায়নি। নিজের কাছেই লুকিয়ে রেখে দিলো, চিঠিটা দেখলে আশ্বাস পায় যে নুর ভালো আছে হয়তো কোথাও একটা। গাড়ি স্কুলের গেটের সামনে আসতেই সৌহার্দ্য চিঠি ব্যাগে রেখে দিলো।
অদিতা ক্লাস টু তে উঠলো সবে,শান্ত স্বভাবের হওয়ায় বন্ধু বানাতে বেগ পেতে হচ্ছিলো। এই খবরও নুর জানে! হয়তো রোহিণী বলেছে। গাড়িতে বসে অদিতার অপেক্ষাই করছিলো কিন্তু ড্রাইভার হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললো

“সাহেব, অদিতা আফামনিরে নাকি কে অলরেডি নিয়ে গেছে।”

সৌহার্দ্য গাড়ি থেকে নেমে পড়লো, খোঁজ নিয়ে জানলো অদিতার মা নাকি ওকে নিয়ে গেছে। বিষয়টা ভালো ঠেকলো না ওর, বাড়িতে ফোন দিয়ে জানলো অদিতা ফেরেনি। ভয়ে কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম জমতে শুরু করলো। মুগ্ধকে ফোন দিয়ে বললো

“দোস্ত, অদিকে খুঁজে পাচ্ছিনা। কে যেনো ওকে নিয়ে গেছে”

মুগ্ধ ওপাশ থেকে স্বাভাবিক গলায় বললো

“বাসায় আয়, অদিতা এখানেই আছে”

সৌহার্দ্য দেরি না করে দ্রুত মুগ্ধদের বাসায় আসে, ঢুকতে দেখে রোহিণী চেয়ারে বসে অদিতাকে খাইয়ে দিচ্ছে। প্রায় সাত মাস চলায় বেবি বাম্প অনেকটাই দেখা যায়, হাঁটাচলা করতে কিছুটা কষ্ট হয় এখন। ও অদিতার সামনে দাঁড়াতেই ও খুব উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলে

“নুর মামনি চলে এসেছে বাবাই, বলেছে আর ছেড়ে যাবেনা আমাদের”

সৌহার্দ্য থমকে গেলো।কিছু না বলে অদিতার কথা শুনতে লাগলো, এভাবেই অনেক সময় চলে গেলো। ঢোক গিলে উঠে গিয়ে নুরের দরজায় আস্তে করে টোকা দিলো। সাথে সাথে নুর দরজা খুললো। সৌহার্দ্য ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকে দেখলো নুর মেরুন রঙের একটা শাড়ি পরা। ওর দিকে মুচকি হেসে বললো

“ভালো লাগছে আমায়?”

সৌহার্দ্য আস্তে করে মাথা নাড়লো, নুর তাতে দুষ্টু\মির ছলে বললো

“এখানে আসবো বলে সেজেছি, ভালো তো লাগতেই হবে।”

সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো

“কোথায় ছিলে এতোদিন?”

নুর কপালের টিপ খুলে আয়নায় লাগালো, সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে বললো

“আমি কোথায় ছিলাম সেটা তো জানার কথা তোমার!

সৌহার্দ্য আসলেই জানে সেটা। মুগ্ধর সাথে প্রায়ই কথা হয় এখন, প্রায় অনেকদিন পর নিজে থেকেই বলেছে নুরের অবস্থার কথা। নুরের হিপ্পোক্যামপাস ড্যা!মে*জের সাথে পোস্ট ট্র!মা*টিক স্ট্রে!স ডি/জঅ\র্ডার ও ছিলো। তার জন্যই ওর মস্তিষ্ক নির্দিষ্ট সময়ের স্মৃতি ভুলে ছিলো, ওর হিপ্পোক্যামপাসের টিস্যু গঠন শুরু হওয়াতে বিষয়টা আরো খা!রা!প দিকে যায়।
নুরের সাথে যেদিন শেষ কথা হয় সেদিন ও বাসায় গিয়ে জিনিস নিচে ফেলা শুরু করে দেয় এমনকি কিছু জিনিস ভাং\চু!রও শুরু করে। তারপরই ওর প্যা\নি\ক এ!টা!ক হয়। মুগ্ধ ভয় পেয়ে ডাক্তারকে কল করতেই উনি আসেন কিন্তু ততসময়ে নুর একদম অনুভুতি শুন্য হয়ে বসে থাকে, চোখ দিয়ে জল বেয়ে পড়ছে কিন্তু ও সাড়া\শব্দহীন। ডাক্তার এসে নুরের সাথে অনেকক্ষণ কথা বলার পর নুর স্বাভাবিক হয়, অবস্থা অস্বাভাবিক দেখে ডাক্তার নিলা নুরকে সাইকোথেরাপি দেয়ার পরামর্শ দেয়। অদ্ভুতভাবে নুর রাজি হয়ে যায় আর তারপরই ও রি\হা\ব সেন্টারে থাকা শুরু করে অন্যান্য
রো!গীদের মতো। গত একবছর প্রতি সপ্তাহে নুরের সাথে দেখা করতে যেতো মুগ্ধ, শুরুতে রোহিণীও যেতো কিন্তু প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকে আর যায়না। সৌহার্দ্য চেয়েছিলো নুরের সাথে দেখা করতে অনেকবার কিন্তু নুর সরাসরি বলেছে ও কোনপ্রকার যোগাযোগ রাখতে চায়না। বিষয়টাতে কষ্ট পেলেও নুরের সিচুয়েশন ও বুঝে। হয়তো ও নিজেও একই কাজ করতো। এখন নুর সামনে থাকায় মুখ ফসকে বলেই ফেললো

“তুমি আমার সাথে এই একবছর দেখা করোনি কেনো নুর?”

নুর কিছুক্ষণ শান্ত থেকে বললো

“করার ইচ্ছে হয়নি তাই। মনে আছে শেষদিন তুমি আমাকে অনেকগুলো প্রশ্ন করেছিলে। আমি কেনো সব জানার পরও কিছু বলিনি। আসলে আমার সবকিছু মনে পড়েনি শুধু কিছু কিছু নতুন তথ্য মাথায় সেভ হচ্ছিলো। একটা সময় এটাও বুঝতে পারি যে আমরা একসাথে ছিলাম না, আমাদের মাঝে কিছুই ঠিক নেই। তাই আমি ভয়ে কিছুই বলিনি, শুধু ভাবছিলাম যদি কিছু বললে তুমি আবার দূরে সরে যাও! হয়তো অভিনয় করছো আমার সাথে ভালো থাকার কিন্তু সেই অভিনয়েও তুমি আমার পাশে আছো। আমি বাস্তবতা থেকে পালাতে চেয়েছিলাম কিন্তু শেষে আর পারিনি। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি নিজেকে সময় দিবো। যতোদিন না আমি মরিচিকার পিছনে ছুটা বন্ধ করবো ততোদিন কিছুই ঠিক হবে না, আমাকে নিজের কাছে সবকিছু স্বিকার করতে হবে, অতীতের ল্যুপে তো বাঁচা সম্ভব নয়। তাই দূরে সরে গিয়েছিলাম।”

নুর থেকে আবারো বলতে শুরু করলো,

“এই একবছর ওই সেন্টারে থেকে আমি অনেককিছু শিখেছি, নতুন করে বুঝেছি। কিভাবে কাউকে নিজের ভালোর জন্য ক্ষমা করে দিতে হয়। কারণ ক্ষমা না করে আমি নিজেই কষ্ট পাচ্ছলাম, আমি নিজেই সব মনে করছিলাম আর কান্না করছিলাম। প্রথমে আমি ওই কষ্টগুলোকে এক্সেপ্ট করেছি তারপর তোমাকে ক্ষমা করে দেয়ার প্রয়াস। নিজের তোমার জায়গায় রেখে বুঝার চেষ্টা করতাম। প্রথমে মনে হতো আমি যদি তুমি হতাম তবে কখনোই ছেড়ে যেতাম না, আবেগের বশের ভাবনা ছিলো সেগুলো। তারপর ধীরেধীরে তোমাকে বুঝতে শুরু করলাম, তোমার পরিস্থিতি বুঝলাম। তখন মনে হলো যে বাবা-মা আমার জন্য এতোকিছু করেছে, তাদের কথার অবাধ্য হয়তো আমিও হতে পারতাম না।তারপরই তোমাকে ক্ষমা করতে পেরেছে, বলতে পারো নিজের স্বার্থেই এমনটা করা।”

নুর কথাগুলো বলে থামলো। দুজনের মাঝে এরপর পিনপিন নিস্তব্ধতা। নিরবতা কাটাতেই নুর আবার বলে উঠলো

“আমি কিন্তু তোমার লিখা চিঠিগুলো পেয়েছি, তুমি প্রতি সপ্তায় পাঠাতে একটি করে। এই কয়দিন কি করলে, অদিতা কি করলো। প্রথম প্রথম রাগে ছিঁড়ে ফেলতে মন চাইতো কিন্তু পরে পুরো সপ্তাহ জুড়ে তোমার চিঠির অপেক্ষায় থাকতাম। সেই চিঠিগুলো তোমাকে ক্ষমা করতে অনেক সাহায্য করেছে। মনে হতো এতোদিনেও তো তুমি হাল ছাড়োনি, চাইলেই তো আমাকে আমার হালে ছেড়ে দিতে পারতে কিন্তু এমনটা তো করোনি। হয়তো শুরুতে তোমার হাতে সবকিছু থাকলে ছেড়েও যেতে না।”

নুর কথাগুলো বলে মুচকি হাসলো তারপর বললো

“নিজেকে ক্ষমা করে দাও সৌহার্দ্য, তোমার অনুশোচনা তোমাকে ভালো থাকতে দিবে না। এইযে দেখো আমি কিন্তু ভালো আছি। যা হয়েছে তাতে তোমার একার দোষ না। আমি ওইদিন তোমায় সাথে দেখা না করতে গেলেই হয়তো কিছু হতো না”

সৌহার্দ্য মাথা নাড়িয়ে বললো

“তোমার এতে কোন দোষ নেই, আমি হালিশহর না ছাড়লে এমন কিছুই হতো না। নিজেকে দোষ দিও না নুর!”

নুর সৌহার্দ্যকে থামিয়ে বললো

“ঠিক বলেছো দোষ আমার নয় আর না তোমার। দোষ ওই ড্রাইভারের যে কিনা ড্রাং/ক হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলো। আমি তোমার ঠিকানা জোগাড় করেছিলাম রোহিণী ভাবি থেকে, রিক্সায় করে সেখানেই যাচ্ছিলাম কোন কিছু না ভেবেই।সেই গাড়িওয়ালা আমাদের রিক্সার সাথে এ\ক্সিডে\ন্ট করে। সেই রিক্সাওয়ালা ওইখানেই…আমাকে কে ওখান থেকে নিয়েছে জানিনা তবে সেটাই আমার শেষ স্মৃতি ছিলো। ডি/প্রেশ/ন আর তোমার চলে যাওয়া অলরেডি আমার কাছে অনেক বড় ধাক্কা ছিলো, ওই ঘটনা আমার মস্তিষ্ক নিতে পারেনি। তাই তোমার এতে কোন হাত ছিলো না সৌহার্দ্য, নিজেকে ধীরেধীরে ক্ষমা করে দাও। অন্তত আমার জন্য হলেও, প্লিজ!”

সৌহার্দ্য সম্মতি জানালো কিন্তু নুরের দিকে তাকালো না। নিজেকে এতো সহজে ক্ষমা কখনোই করতে পারবে না ও, হয়তো এটা ওর শা*স্তি! নুর সবটা বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো,

“তুমি বলেছো আমাদের নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, সেই অফার কি এখনো আছে নাকি সময়ের সাথে সাথে ইচ্ছে বদলে গেছে?”

সৌহার্দ্য জবাব দেয়নি, শুধু মুচকি হাসলো। কিন্তু নিজের প্রশ্নের জবাবে নুর নিজেই খিলখিল করে হেসে দিলো। সৌহার্দ্য গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে দেখলো সেই হাসি, কি জবাব ছিলো সেই হাসিতে! সমাপ্তি নাকি সম্ভাবনা?
সৌহার্দ্য জানার সাহস পায়নি, হয়তো চলার পথে অনেককিছুই বদলাবে কিন্তু এইমূহুর্ততে ও ভালো আছে। ওর পরিবার আর ভালোবাসার মানুষের মাঝে ওকে বেছে নিতে হচ্ছে না।সেই বিশ বছরের সৌহার্দ্য সবার হাত আঁকড়ে বাঁচতে চেয়েছিলো, আজ এই সৌহার্দ্য সবাইকে নিয়ে ভালো থাকবে বলে সেই হাতগুলো শক্ত করে ধরে আছে। মানুষ ঠিকই বলে, নিরাশ হইয়ো না, তুমি যতোটুকু চাইছো উপরওয়ালা তার থেকে ভালো তোমার জন্য তুলে রেখেছেন। সময়টা শুধু ভালো সময়ের অপেক্ষার….

~~~(সমাপ্ত)~~~

(এই গল্পের সমাপ্তি এখানেই। আমি হয়তো নুরের এবং সৌহার্দ্যের মিলের দৃশ্য দেখাতে পারতাম কিন্তু তাতে মনে হলো সৌন্দর্য হারিয়ে যায়। গল্প কিন্তু স্যাড এন্ডিংয়ে শেষ হয়নি, বরং একটা সম্ভাবনায় শেষ হয়েছে যেখানে ওরা খুব ভালো থাকবে একসাথে। বাকিটুকু আপনাদের কল্পনায় ছেড়ে দিলাম, নুর-সৌহার্দ্যের সংসার গুছানোর দায়িত্ব আপনাদের। ভালো থাকবেন সবাই। নতুন কোন গল্পের দুনিয়ায় নতুন করে কথা হবে। আল্লাহ হাফেজ!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here