জানি দেখা হবে পর্ব ১

#জানি_দেখা_হবে
#Tanjima_Islam

★প্রথম পর্ব★

কিচেনে চা বানাতে ব্যস্ত তনু, ইহসান নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে আসার সময় হয়ে গেছে প্রায়।
বিয়ের পর থেকে তার এক অভ্যেস হয়েছে, প্রতিদিন ভোরে তনুর হাতের চা খাওয়া।

তনুও বেশ মন দিয়ে ইহসানের জন্য চা বানায়। কোনোদিন দুধ চা, কোনোদিন রং চা তো আবার কোনোদিন মশলা চা।
চায়ের যে এতো প্রকারভেদ আছে, তা হয়তো তনুর সাথে বিয়ে না হলে জানতেই পারতো না ইহসান।

কলিংবেলের শব্দে চুলার আচ কমিয়ে ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিল তনু।
ইহসান ভেতরে ঢুকে তনুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল কপালে।
তনু মিষ্টি হেসে বলল, ” ব্যালকনিতে গিয়ে বসো, আমি চা নিয়ে আসছি।

ইহসান মাথা থেকে টুপি খুলে দু’হাতে মাথার ঝাকড়া চুল গুলো ওল্টাতে ওল্টাতে রুমে গেল। প্রশান্তি মাখা চোখে কিছুক্ষণ ইহসানের দিকে তাকিয়ে থেকে কিচেনে গেল তনু।

প্রায় দেড় বছর হতে চলেছে ইহসানের সাথে বিয়ে হয়েছে তার।
ইহসানকে বিয়ে করে তনুর জীবন পালটে গেছে। বলা যায়, তার নতুন জীবন শুরু হয়েছে।

ইহসানের সাথে প্রথম দেখা করার আগেও ভাবতে পারেনি, তার রংচংহীন মলিন জীবনে আবারও রঙিন সূর্য উদয় হতে চলেছে।

দুকাপ চা বানিয়ে ট্রেতে করে ব্যালকনিতে গিয়ে বসল তনু।
ইহসান ফোনে কথা বলছে, চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,” আচ্ছা আচ্ছা, কাল ভোরের ট্রেনে রওনা হবো।

বলেই কল কেটে দিল ইহসান, তনু জিজ্ঞেস করল, ” কাল ভোরে কোথায় যাচ্ছো!?

ইহসান চা রেখে সোফায় হেলান দিয়ে বলল, ” শুধু আমি না, তুমিও যাচ্ছো।

তনু জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকালো ইহসানের দিকে।
ইহসান ব্যালকনিতে সাজানো অর্কিড গুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, ” দাদুর নাকি শরীর ভালো না, তাই আম্মু বারবার যেতে বলছে। তাই ভাবছি অফিস থেকে দুইদিন ছুটি নিয়ে দাদুকে দেখে আসবো।

তনু চা রেখে বলল, ” হুম, তাহলে তো যেতেই হবে। এমনিতেই গতবার আসার সময় দাদু তো আমাকে আসতেই দিতে চাচ্ছিলো না।

চা খেয়ে ইহসান রুমে যেতে যেতে বলল,” ছাদে যাচ্ছি, দরজাটা লাগিয়ে দাও।

তনু দরজা লাগিয়ে ব্রেকফাস্ট রেডি করতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
ইহসান ছাদে এক্সারসাইজ করতে গেছে, এসে একবারে গোসল করে ব্রেকফাস্ট করে অফিসে যাবে।
এই সময়ের মধ্যেই ব্রেকফাস্ট রেডি করতে হবে তনুকে।
.
.
.
.
.
.
আরাফ গোসল করে বেরিয়েছে মাত্র, ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে শার্টের বোতাম লাগাচ্ছে সে।

বডি স্প্রেটাও খুজে পাচ্ছেনা, ড্রেসিং টেবিলটা ভর্তি বউয়ের কসমেটিকে! বেশ কয়েকটা পারফিউম নজরে পড়ল তার, শেষমেশ কি সে পারফিউম মেখে অফিস যাবে আজ!!

আরাফের হাতে ল্যাভেন্ডারের পারফিউম দেখে ভ্রু কুচকে তাকালো রিয়া।
গলা খাকারি দিয়ে বলল, ” পারফিউম মাখবে বুঝি!?

আরাফ চমকে উঠল, তাড়াতাড়ি পারফিউম রেখে জিজ্ঞেস করল, ” আমার বডি স্প্রে কোথায়!?

রিয়া বুঝল তার স্বামী বডি স্প্রে খুজে না পেয়ে পারফিউম মাখতে যাচ্ছিলো।
মুখ টিপে হেসে বলল, ” ওখানেই আছে, জানি খুজে পাবেনা। ওয়েট, আমি দেখছি।

রিয়া বডি স্প্রেটা এগিয়ে দিল আরাফের দিকে। আরাফ স্প্রের সাথে রিয়ার হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে বলল, ” সন্ধ্যায় রেডি থেকো, অফিসে পার্টি আছে।

রিয়া হাত ছাড়িয়ে আরাফের টাই ঠিক করতে করতে বলল, ” ঠিকাছে জনাব, এখন রেডি হয়ে তাড়াতাড়ি আসুন। টেবিলে ব্রেকফাস্ট, ঠান্ডা হয়ে যাবে।

রিয়া রুম থেকে বেরিয়ে গেল, আরাফ রেডি হয়ে ডাইনিং এ গিয়ে বসল।
টেবিলে সাজানো বিভিন্নরকম আইটেম। ডালিমের জ্যুস, সিদ্ধ করা কোয়েলের ডিম, চিকেন থাই স্যুপ, অল্প তেলে ভাজা পরোটা আর সবজি।

বিয়ের আগে রিয়া রান্নার ‘র’ও জানতো না। আরাফ তো ভেবেছিলো বিয়ের পর অনলাইন ফুড অর্ডার করতে করতেই ফকির হয়ে যাবে সে।
কিন্ত ঘটল তার বিপরীত! বিয়ের পর থেকে ইউটিউবে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন রান্নার রেসিপি দেখে দেখে রিয়া প্রায় অনেক রান্নাই শিখে নিয়েছে!
আর নিত্যনতুন সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করছে!!

আরাফ ব্রেকফাস্ট করে অফিসে চলে গেছে, রিয়া দরজা লক করে রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। সন্ধ্যায় পার্টি, বিকালে রেডি হতে হবে। দুপুরে ঘুমানোর সময় পাবেনা, তাই এটাই তার ঘুমানোর পার্ফেক্ট সময়।

ফোনের রিংটোন পেয়ে ঘুম ভেঙে গেল রিয়ার। ফোন হাতে নিয়ে দেখল আরাফ কল করেছে। রিসিভ করে কিছুক্ষণ কথা বলে রেখে দিল রিয়া।
পরশু আরাফের মামাতো বোনের বিয়ে।
কাল ভোর ছটার ট্রেনে ঢাকা থেকে যশোরে যাবে আরাফ আর রিয়া।

রিয়া ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল বেলা বারোটা তেইশ বাজে।
এখনও ঘরদোর গোছাইনি সে, দুপুরের রান্নাও তো করতে হবে।
তড়িঘড়ি করে উঠে কাজে লেগে পড়ল রিয়া।
.
.
.
.
.
ইহসান বেডে বসে ল্যাপটপে অফিসের কিছু কাজ করছে।
পাশে বসে লাগেজ গোছাচ্ছে তনু, কাল ভোর ছটায় ট্রেন।
ঢাকা থেকে পাবনায় যাবে, অফিস থেকে দুইদিনের ছুটি নিয়েছে ইহসান।

তনুর শ্বশুরবাড়ি বাপেরবাড়ি পাবনাতেই, বিয়ের পর ফ্ল্যাট নিয়ে ঢাকায় আছে ।

ইহসানের ডাকে সম্বিত ফিরল তনুর, ইহসান হেসে বলল, “এতো কাপড় নিয়ে কি করবে তনু!? মাত্র তো দুদিন থাকবো।

তনু মুখ ভেংচি কেটে বলল, ” কোথায় এতো কাপড়!?

ইহসান স্মিত হেসে বলল, ” আমার সাথে যাচ্ছো আমার সাথেই ফিরে আসবা। ওখানে যেয়ে আবার বাপেরবড়ি যাওয়ার বায়না ধরোনা যেন।

তনু হেসে বলল, ” আচ্ছা আচ্ছা ধরবো না বায়না। এখন খেয়ে নেবে চলো।
.
.
.
.
.
অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে আরাফের, পাশে রিয়া ঘুমে অচেতন।
ঘুম ভেঙে প্রতিদিন প্রায় আধঘন্টা ধরে রিয়ার মায়াবী এই মুখ দেখাটা আরাফের অভ্যেসে পরিণত হয়েছে।

আজও তার বিপরীত হলনা, প্রায় আধঘন্টা অপলক তাকিয়ে থেকে রিয়ার কপালে চুমু খেল আরাফ।

আরাফের স্পর্শ পেয়ে হালকা কেপে উঠল রিয়া।
পিটপিট করে চোখ মেলে, স্নিগ্ধতায় ভরা আরাফের মুখটা দেখে রিয়া স্মিত হাসল।

দু’হাতে আরাফের গলা জড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “কয়টা বাজে!?
রিয়ার কপালে আসা চুল গুলো সরিয়ে আরাফ বলল,” চারটা বিয়াল্লিশ!

টাইম শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল রিয়া, মৃদু চেচিয়ে বলল, ” চারটা বিয়াল্লিশ! আর তুমি আমাকে এখন ডাকছো!?

আরাফকে ঠেলে সরিয়ে বেড থেকে নেমে গেল রিয়া, ওয়াশরুমে ঢুকে চেচাতে লাগল, ” ছটায় ট্রেন! আমি রেডি হবো কখন, বের হবো কখন আর স্টেশনে পৌছাবো কখন!!?

রিয়ার সাথে আরাফের বিয়ে হয়েছে প্রায় একবছর হতে চলেছে।
এই তো ডিসেম্বরেই তাদের ফার্স্ট ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি।
রিয়াকে পেয়ে খুব সুখেই আছে আরাফ।

রিয়ার সাথে বিয়ের আগেও ভাবেনি, সে আবারও কারও প্রেমে পড়বে।
বিয়ের আগে রিয়ার সাথে কথা বলতেও যতটা অস্বস্তি বোধ ছিলো, বিয়ের পর তা কেটে গিয়ে ধীরে ধীরে মধুর প্রেমে পরিণত হয়েছে।
.
.
.
.
.
ঘড়িতে ভোর পাঁচটা চল্লিশ বাজে, ট্রেন ছাড়তে এখনও বিশ মিনিট বাকি।
তনুকে একটা বেঞ্চে বসিয়ে কিছু শুকনো খাবার কিনতে গেছে ইহসান।

বাসা থেকে বেরোনোর আগে পাতলা চাদর গায়ে জড়িয়ে এনেছে তনু।
সেটা নিয়েই বিপাকে পড়েছে সে, গায়ে দিলে গরম লাগছে আবার না দিলে শীত করছে!

এখন নভেম্বর মাস, অথচ শীতের কোনও হদিস নেই! বোধহয় এবার আর শীত আসবেনা!!

হটাৎ পরিচিত কন্ঠঃ পেয়ে চমকে উঠল তনু! এদিক ওদিক তাকিয়ে সেই কন্ঠের মানুষটিকে খুজতে লাগল।
এখন ভিড় কম, তাই হয়তো মানুষটাকে খুজে পেতে দেরি হয়নি তার!!

সেই চিরচেনা মুখ! মনকাড়া হাসি!! চোখেমুখে চাঞ্চল্য!!!
তনুর মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এল, “ফাহাদ!!!

তনুর চোখ ঝাপসা হয়ে এলো, চোখ বন্ধ করে আবার খুলল সে।
না এটা কল্পনা নয়, বাস্তব! তনুর যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছেনা।

ফাহাদের সাথে চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো তনু।
এতগুলো বছর পর আবার কেন!? আবার কেন দেখা হল!!?

একটা সময় ছিলো যখন তনু খুব করে চাইতো, ফাহাদ ফিরে আসুক।
হুট করে একদিন কল দিয়ে বলুক, তনু আমি তোমার বাসার সামনে!

কিন্ত এখন তো সে আর চায়না, তাহলে কেন আবার দেখা হল!?

সেই পরিচিত কন্ঠঃ পেয়ে হালকা কেপে উঠল তনু।
চোখের পানি আড়াল করে স্বাভাবিকভাবে তাকালো।
ফাহাদ এসে দাড়িয়েছে তার সামনে!

দুটি চেনা মানুষ এতো কাছে দাঁড়িয়েও তাদের মাঝে আজ কত দূরত্ব!!!

তনু স্বাভাবিকভাবেই বলল, ” আরে ফাহাদ ভাইয়া! কেমন আছেন!?

ফাহাদ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে তনুর দিকে। এতো আঘাত দেওয়ার পরো তনুর এমন স্বাভাবিক আচরণ বোধহয় আশা করেনি সে।

তনুর ভেতরে ভেতরে ভিষণ অস্বস্তি হচ্ছে, লোকটা কিছু বলছেনা কেন!? ইহসানটাও যে কোথায়!! আচ্ছা, ফাহাদ এখানে কি করছে!? বিয়েশাদি করেনি নাকি!? বউ কোথায়!?

ফাহাদ গলা খাকারি দিয়ে বলল, ” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, তুমি কেমন আছো তনু!?

তনু কিছু বলার আগেই ইহসান এসে দাড়ালো সেখানে, তনু ইহসানের হাত জড়িয়ে বলল,” মিট মাই হাসব্যান্ড ইহসান।

ফাহাদকে দেখিয়ে বলল, ” আর ইনি হলেন আমার এক্স টিচার, ফাহাদ ভাইয়া। মেডিকেলে পড়াকালীন আমার হোম টিউটর ছিলেন।

ইহসান হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করল ফাহাদের সাথে। দাঁড়িয়ে টুকটাক কথা বলছে ইহসান আর ফাহাদ।
কথা বলার মাঝেমাঝে তনুর দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে ফাহাদ।
তনুর মনটা খুচখুচ করছে ফাহাদের বিয়ের ব্যাপারে জানার জন্য।
অবশেষে জিজ্ঞেস করেই ফেলল,” তা আপনি এখানে!? ভাবি কোথায়!?

প্রশ্নটার জন্য বোধহয় প্রস্তুত ছিলোনা ফাহাদ, কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,” তোমার ভাবি বাপেরবড়ি বেড়াতে যাচ্ছে, তাই ট্রেনে তুলে দিতে এলাম।

মুহুর্তেই তনুর ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল, এই অনুভূতির নাম জানেনা তনু। আগে কখনও এমন হয়নি তার।
আস্তে করে জিজ্ঞেস করল,” কবে বিয়ে করেছেন!?

ফাহাদ কিছু বলল না, হয়তো শুনেও না শোনার ভান করছে।
হটাৎ হাতে হ্যাচকা টান অনুভব করল তনু। ফাহাদকে বিদায় জানিয়ে ইহসান তনুকে নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়েছে!

নিজেদের সিট খুজে নিয়ে বসল ইহসান, ঘড়িতে পাঁচটা চুয়ান্ন বাজে! আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ছেড়ে দেবে।

তনু জানালার সাইডে বসেই বাইরে তাকালো। ভিড় বেড়েছে, কিন্ত সেই ভিড়েও ফাহাদকে ঠিক দেখতে পেল তনু।

কি এক অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে তনুর ভেতর, ফাহাদ একবার তনুর দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল স্টেশন থেকে!
ফাহাদের এই চাহনির অর্থ ঠিক বুঝতে পারছেনা তনু।
কেন জানি খুব ইচ্ছে করছে, এখনই ট্রেন থেকে নেমে ছুটে গিয়ে ফাহাদের হাতটা ধরতে!!!

কিন্ত তা আর সম্ভব নয়, সময়ের সাথে সাথে সবকিছু পালটে গেছে, পালটে গেছে তনু।
সেও তো এখন আর অতীতের স্মৃতি মনে করে, গভীর রাতে চোখের জলে বালিশ ভেজায় না!!!
.
.
.
.
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here