প্রিয় পরিণতি পর্ব শেষ

গল্প: প্রিয় পরিনতি!
পর্ব: ১৫! (শেষপর্ব)
লেখক: তানভীর তুহিন!

দারোগা রাতুলকে ফোন দিয়ে থানায় আনিয়েছে। রাতুল থানায় বসে আবিদের বাবার অপেক্ষা করছে। প্রায় সাড়ে নয়টা নাগাদ রাশেদ তালুকদার আর তামান্না থানায় ঢুকলো। থানায় ঢুকেই দারোগার সামনে একটা চেনা মুখ দেখতে পেলো রাশেদ তালুকদার। রাতুলও এদিকে ফিরে রাশেদ তালুকদারকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো, ” আসসালামু আলাইকুম স্যার, কেমন আছেন? ” সাথে দারোগাও চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো রাশেদ তালুকদারকে।
– ” ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো রাতুল বাবা? ”
– ” এইতো স্যার আলহামদুলিল্লাহ, স্যার আপনি থানায় এই সময়ে? ”
– ” আরে বলিও না আর, আমার ছেলে আবিদের নামে নাকি বিশৃঙ্খলতার অভিযোগ আছে। আর সেজন্য নাকি পুলিশ রাতে আবিদকে থানায় নিয়ে এসেছে। সে ব্যাপারেই অভিযোগকারীর সাথে কথা বলতে এলাম! ”

কথাটা শোনা মাত্রই রাতুলের পায়ের তলা থেকে মাটি উধাও হয়ে যাবার উপক্রম। কী আবিদ তাহলে রাশেদ স্যারের ছেলে? কীন্তু রাশেদ স্যারের ছেলে এরকম অসামাজিক কীভাবে হতে পারে? যেখানে আমি নিজে রাশেদ স্যারকে আমার আদর্শ হিসেবে মানি!
দারোগা পাশ থেকে বলে উঠলো। ওহ তাহলে তো দেখছি আপনারা আগের থেকেই পরিচিত। দারোগা রাশেদ তালুকদারকে বললো, ” স্যার ইনিই রাতুল রহমান। মেঘ রহমানের ভাই, আপনার ছেলে আবিদের নামে অভিযোগ ইনিই করেছেন!! ”

রাশেদ তালুকদার খুব ঠান্ডা মাথার মানুষ। পরিস্থিতি যেরকমই হোক উনি ঠান্ডা মাথায় সবটা পর্যালোচনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নেয়!!

রাতুলের কেমন যেনো ইতস্ততা বোধ হচ্ছে, নিজেকে খুব অপ্রস্তুত লাগছে তার। রাতুল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রাশেদ তালুকদার দারোগাকে বসতে বলে, একটা চেয়ার টেনে তামান্নাকে বসতে বললো তারপর রাতুলকে উদ্দেশ্য করে বললো, ” রাতুল বাবা বসো। বসে সবটা নিয়ে কথা বলা যাক! ”

রাতুল না বসে মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে বললো, ” আসলে স্যার আমি জানতাম না যে আবিদ আপনার ছেলে। তাছাড়া স্যার আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে আবিদ আপনার ছেলে! ”

রাশেদ তালুকদার চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ” কিন্তু বাবা কষ্ট হলেও বিশ্বাস করতে হবে। আবিদ আমারই ছেলে,ছেলে কম বন্ধু বেশি।এখন তুমি সবটা খোলসা করে নিরপেক্ষ ভাবে বলো। আমি কথা দিচ্ছি ন্যায়বিচার হবে! ”

রাতুল ইতস্তত হয়েই সবটা বলা শুরু করলো। রাতুলের কথা শুনে তামান্নার গা জ্বলে যাচ্ছিলো। তামান্না মাঝখান থেকে উঠে বললো, ” দেখুন ভাইয়া আপনি এভাবে আবিদের নামে আবোলতাবোল বলতে পারেন না! ”
রাশেদ তালুকদার কপাল ভাজ করে তামান্নাকে বললো, ” আহ, তামান্না। বড়দের কথার মাঝখানে ঢুকিস না। রাতুলকে সবটা বলতে দে! ” রাশেদ তালুকদারের কথাকে সম্মান করে তামান্না বসে যায়।

রাতুলের সব কথা শোনার পরে রাশেদ তালুকদার ঠান্ডা মাথায় বলে, ” আচ্ছা বাবা তোমায় আমি মোটেও অবিশ্বাস করছি না। কিন্তু আমি আবিদকেও কীভাবে অবিশ্বাস করি বলো? আবিদের কাছ থেকেও সবটা শুনি তারপর ঠিক করি যে কী করবো! আর কি করা উচিৎ! ”

রাতুল কিছুই বললো না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রাশেদ তালুকদার আবিদকে টেনে বসিয়ে দিলো। তারপর দারোগাকে বললো, ” আচ্ছা দারোগাবাবু। আবিদকে একটু এখানে ডাকা যাবে? আমি শুধু কথা বলবো। আবিদের দোষ থাকলে আমি অন্যায় ভাবে ওকে আমার সাথে নিয়ে যেতে চাইবো না। রাশেদ তালুকদার অন্যায়ের সাথে আপোশ করে না সেটা নিশ্চই আপনি জানেন? ”
দারোগা মৃদু হেসে বললো, ” আরে স্যার এভাবে বলে আমাকে লজ্বা দেবেন না। আপনি কতটুকু সৎ আর ন্যায়পরায়ণ তা পুরো জেলা জানে । আমি এখনি আবিদকে এখানে আনানোর ব্যাবস্থা করছি! ”

দারোগা একজন হাবিলদারকে ডেকে বললো,” কাল মধ্যরাতে যে ছেলেটাকে বেহুশ অবস্থায় নিয়ে এসেছিলাম তাকে এখানে নিয়ে এসো”।

খানিকবাদে হাবিলদার আবিদকে নিয়ে এলো। আবিদ এখনো সম্পুর্ন হুশে ফেরে নী। রাতের নেশা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারে নী।টলমলা পায়ে চোখ ডলতে ডলতে সামনে এলো আবিদ। রাশেদ তালুকদার আবিদের এই অবস্থা দেখে লজ্বায় মরে যাচ্ছে। সে আবিদকে বললো, ” আবিদ ঠিকমতো দাড়াও! ”
বাবার আওয়াজে আবিদের অনেকটা ধ্যান ফিরে। আশপাশটা তাকিয়ে দেখে যে এটা থানা। কিন্তু সে থানায় কেনো? তামান্না,বাবা,রাতুল ভাইয়াই বা থানায় কেনো? তারপর আবিদের আস্তে আস্তে কাল রাতের কথা মনে পড়ে। মেঘকে জড়িয়ে ধরে কাদার কথা, মেঘেকে চুমু খাওয়া, আর মেঘের সেই শক্ত করে ভালোবাসা মাখানো আখড়ে ধরা। কিন্তু আমি থানায় কেনো? আমায় থানায় আনলো কে? তখনই আবিদের মনে পড়ে কাল রাতে রাতুলের দেওয়া হুমকির কথা,” তুমি এখনই বেড়িয়ে না গেলে আমি পুলিশ ডাকবো! ” এবার আবিদের কাছে সবটা পরিষ্কার হয়। তারমানে সে সারাটারাত বেহুশ অবস্থায় থানায় রাত কাটিয়েছে? মন চাচ্ছে রাতুলকে ধরে ছিড়ে ফেলতে। কিন্তু তার বাবা এখানে। এমনিতেই থানায় রাত কাটিয়ে সে তার বাবার মান-সম্মান ডুবিয়ে দিয়েছে। তাই সে আর তার বাবাকে অসম্মান করতে চায় না। আবিদ দারোগার টেবিল থেকে পানির জগটা নিয়ে দেওয়ালের পাশে গিয়ে মুখে পানি ছিটিয়ে আসে। আবিদকে দেখে এখন অনেকটাই স্বাভাবিক লাগছে,এখন আর পা টলছে না বা চোখ পিট-পিট করছে না আবিদের। রাশেদ তালুকদার আবিদকে জিজ্ঞেস করলো, ” আবিদ তোমায় থানায় আনা হয়েছে কেনো? ”

আবিদ এই প্রশ্ন শুনে মাথা নিচু করে উত্তর দেয়,” বাবা আমি গতকাল রাতে মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় মেঘের বাসায় গিয়েছিলাম। মেঘের সাথে দেখা করতে। কিন্তু আমি শুধু মেঘের সাথে কথা বলার জন্যই গিয়েছিলাম, একটা অহেতুক ভুল বোঝা-বুঝির জন্য মেঘের সাথে এক সপ্তাহ যোগাযোগ না করে ছিলাম। তাই আমার মাথার ঠিক ছিলো না! ”
– ” বুঝলাম। কিন্তু আমার জানামতে তুমি মদ খাও না! ”
– ” কাল খেয়েছিলাম বাবা, সহ্য হচ্ছিলো না আর তাই! ”
– ” ওহ। আচ্ছা বাদ দাও তুমি বড় হয়েছে তোমার সিদ্ধান্তে তোমার পয়সায় তুমি মদ খেয়েছো সেখানে আমি বাধা দেবার কে? ”
– ” প্লিয বাবা এভাবে বলিও না। আসলেই খুব কষ্ট হচ্ছিলো আর অস্থির লাগছিলো সহ্য হচ্ছিলো না আমার! ”
– ” যতটুকু জিজ্ঞেস করছি ততটুকুরই জবাব দাও।তা তুমি নাকি সপ্তাহখানেক আগে ভরা রাস্তায় একটা পুলিশকে মেরেছো অকারনে? রাস্তার মাঝে অসামাজিকের মতো নাকি ঝামেলা করেছো? ”

কথাগুলো শোনার পরে আবিদের মেজাজ তিরীক্ষা হয়ে যায়। আবিদ তার বাবাকে বলে, ” বাবা তুমি যারতার কথাই কী বিশ্বাস করে নেবে? ”
– ” তোমার উপরে বিশ্বাস আছে বলেই তো জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে নাকি? নাহলে তো আমি শুনেই চলে যেতাম। এখন যা সত্যি সেটা বলো! ”

আবিদ সেদিনের পুরো ঘটনাটা সংক্ষেপে বললো, তারপর ক্যাফেতে মেঘের সাথে ঘটে যাওয়া ঝগড়ার কথাও বলে।কিন্তু আবিদ ড্রাগের ব্যাপারটা এড়িয়ে যায়। কারন ড্রাগের কথা শুনলে তার বাবা তাকে ক্ষমা করতে পারতো না। আর আবিদ তো জেনেশুনে ড্রাগ নেয় নী। তারপর আবিদ বলে, ” গতকাল তামান্না মেঘের কান্না করা একটা ভয়েস রেকর্ড আমায় পাঠায়। সেটা শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারি নী। মদ খেয়ে ফেলি তারপর মদ খাবার পরে বারবার মেঘের কান্নাটাই মনে পড়ছিলো তাই মেঘের সাথে সবটা ঠিক করার জন্যই অতোরাতে ওখানে গিয়েছিলাম। আমার হুশ ছিলো না হুশ থাকলে কখনোই অতোরাতে ওখানে গিয়ে ওনাদের এভাবে অপ্রস্তুত করতাম না! ”
– ” বুঝলাম সবটা। তা তামান্না তুই ওকে কোনো রেকর্ড পাঠিয়ে ছিলি? ”
– ” হ্যা, চাচ্চু। মেঘ প্রত্যেকদিনই ফোন করে কান্নাকাটি করতো। কিন্তু আবিদ তা জানতো না, আবিদ অভিমান করে ছিলো মেঘের উপরে। আমি জানতাম মেঘের কান্নার ওই রেকর্ড শুনে আবিদ আর রাগ পুষে রাখতে পারবে না কিন্তু এটা বুঝি নী যে এতো কিছু হয়ে যাবে! ”
– ” দারোগাবাবু। যারা ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকে তাদের সবাইকে একটু ডাকুন তো।”

দারোগা সব ট্রাফিক হাবিলদারকে ডেকে পাঠায়। তারপর আবিদ সেদিনের ট্রাফিক হাবিলদারকে দেখিয়ে দেয়।দারোগা সেই হাবিলদারকে রেখে সবাইকে পাঠিয়ে দেয়। রাশেদ তালুকদার সেই হাবিলদারকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” শোনো তুমি যা সত্যি সেটাই বলো। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি তোমার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহন করা হবে না! ”
হাবিলদার সেদিনের সবটা নিরপেক্ষভাবে বলে। তারপর হাবিলদারকে সেখান থেকে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আবিদ কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই রাশেদ তালুকদার বলে উঠে, ” আমায় কথা বলতে দাও আবিদ! ”

হাবিলদারের মুখে কথাগুলো শোনার পরে রাতুলের লজ্বায় মাটিতে মিশে যাবার অবস্থা। কীভাবে বলদের মতো এতোগুলো মানুষকে হয়রানি করেছে সে!

রাশেদ তালুকদার রাতুলকে বলে, ” দেখো বাবা রাতুল সবটাই তো শুনলে। আমার ছেলের স্বমন্ধে আমি কোনো গুণকীর্তন করবো না। আমার ছেলে রাগী আর তারকিছু খারাপ অভ্যাস আছে সেটা আমি জানি। কিন্তু ওর মন মাটির। এভাবে মাতলামো করে অন্যের মান-ইজ্জ্বত মারার ছেলে আমার আবিদ না। তাই আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত যে ওর জন্য তুমি দূর্ভোগ পোহাইছো! ”

এগুলো শুনেই রাতুল রাশেদ তালুকদারের হাত ধরে ফেলে, ” স্যার এভাবে বলবেন না। সব দোষটা আমারই স্যার। আমি নিজেই নিজের মতো করে সবটা ভেবে এতোসব কিছু করে ফেলেছি। মাফ করে দিন স্যার। আমার বোনটা পাগলের মতো ভালোবাসে আবিদকে। তাই এসব ভুলে যদি ওদের বিয়ের জন্য মত দিতেন! ”
– ” থানায় কীসের বিয়ের মত? আমি আর আবিদের মা বিকালে তোমার বাসায় যাবে। ওখানে তোমার মায়ের সাথে কথা বলবো এ ব্যাপারে! ”
রাতুল গিয়ে আবিদকে সোজা জড়িয়ে ধরে, ” আবিদ ভাই বুঝতে পারি নাই রে। মাফ করে দিস আমায়! ” সবটা মিটে যাওয়ায় আবিদও স্বাভাবিকভাবে বলে, ” আরে ভাইয়া আপনি সবটা না বুঝে করেছেন। আপনার যায়গায় থাকলে আমার বোনের কথা ভেবে হয়তো আমিও এসবই করতাম। কিন্তু আপনার একটু কথা শোনা উচিৎ ছিলো। আমি আপনাকে বারবার বলেছিলাম ভাইয়া! ”
– ” মাফ করে দে রে ভাই। ভুল হয়ে গেছে! ”

রাশেদ তালুকদার রাতুলকে বলে। তা আমার ছেলে আবিদের সাথে তোমার বোন মেঘের বিয়েতে তোমার সত্যিই মন থেকে মত আছে তো?
– ” আরে স্যার এভাবে বলবেন না প্লিয। আমার কৃতকর্মের জন্য আমি লজ্বিত। আপনি আমার আত্মীয় হবেন, আমার বোন তার ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করতে পারবে। আর তাছাড়াও আবিদের মতো ছেলেকে আমার বোনজামাই হিসেবে পাবো এটা সত্যিই আমার সৌভাগ্য স্যার! ”
– ” আচ্ছা তাহলে এখন আর তোমার কোনো অভিযোগ নেই তো আবিদের বিরুদ্ধে? ”
– ” আরে না স্যার একদমই না! ”
– ” দারোগাবাবু তাহলে আবিদকে আমি নিয়ে যেতে পারি? ”
দারোগাবাবু বললেন,
– ” অবশ্যই অবশ্যই স্যার! ”

– ” আচ্ছা রাতুল বাবা তাহলে বিকাল ৩ টায় আমি আর আমার পরিবার তোমার বাসায় আসছি বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে! ”
– ” আচ্ছা স্যার! ”
– ” আচ্ছা তাহলে এখন আসি আমরা। ” তারপর রাশেদ তালুকদার আর রাতুল দারোগাবাবুকে বিদায় জানিয়ে একসাথেই থানা থেকে বের হয়।

আবিদ,তামান্না আর রাশেদ তালুকদার এখন গাড়িতে। রাশেদ তালুকদার ড্রাইভারের পাশে বসা। আবিদ আর তামান্না পিছনে বসা। রাশেদ তালুকদার আবিদকে জিজ্ঞেস করলো, ” এতোকিছু হয়ে গেলো আমায় জানালি না কেনো? আর তুই মেঘের ব্যাপারেও তো আমায় কখনো বলিস নী! ”
– ” মেঘের ভাইয়ার সাথে দেখা করার পরেই বলবো বলে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেলো তাই আর বলা হয় নাই! ”
– ” তা বিয়ে কবে করতে চাচ্ছিস? ”
– ” কাল শুক্রবার। কালকেই করিয়ে দাও! ”
পাশ থেকে তামান্না আবিদের বাবাকে বলে, ” দেখছো চাচ্ছু। হারামাজাদাটা কেমন বিয়ে পাগলা! ”

এটা শুনেই রাশেদ তালুকদার জোরে হেসে ফেলে। আবিদ পাশ থেকে তামান্নার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। আবিদকে এভাবে দেখে তামান্না আবিদের বাবাকে বলে, ” চাচ্চু বিয়েটা বরং কালই দিয়ে দাও। এতো কিছু হলো আর ধুমধামের দরকার নাই। যা ধুমধাম সব নাহয় রিসেপশনে আর বৌভাতে করে নিবো আমরা! ”
– ” আরে কী বলছিস? এতে মেঘের সমস্যা থাকতে পারে! “। আবিদ বললো, ” মেঘ ওরকমের না বাবা। ও শুধু বিয়েটা হলেই খুশি হবে, আর ওর এতো ধুমধাম পছন্দও না। কিন্তু ওর ফ্যামিলির আপত্তি থাকতে পারে নাকি সেটা জানি না! ”
– ” আচ্ছা আচ্ছা বিকালে কথা বলবো এসব নিয়ে মেঘের ফ্যামিলির সাথে! ”

এদিকে মেঘ সেই রাত থেকেই রুমে বন্ধ। সকালে অবশ্য ওর মা খাবার দিতে গিয়েছিলো কিন্তু মেঘ খাবার ছুয়েও দেখে নী। ওভাবেই মরার মতো পড়ে ছিলো রুমে। রাতুল রুমে ঢুকে মেঘের সামনে গিয়ে দাড়ালো। মেঘের কোনো নড়াচড়া নেই। নিজের আদরের বোনটাকে এভাবে দেখে রাতুলের নিজেকে খুব নিকৃষ্ট মনে হচ্ছিলো। রাতুল মেঘের সামনে বসে থানায় ঘটে যাওয়া সবটা বলে। আর এটাও বলে যে আবিদেরা বিকালে ওকে দেখে বিয়ের কথা পাকা করতে আসবে। কথাগুলো শোনা অবস্থাতেই মেঘের চোখ থেকে পানি পড়ছিলো। সবটা শোনার পরে মেঘ চোখ বন্ধ করে ফেলে সাথে সাথে কয়েকফোটা পানি গড়িয়ে নিচে পড়ে যায়। এতো ঝড়তুফানের পরে এতো ভালো খবর পেয়ে মেঘ খুশি হওয়ার ভাষাই যেনো ভুলে গেছে। তাই হয়তো চোখের জলের মাধ্যমেই খুশি হচ্ছিলো মেঘ যাকে বলে আনন্দঅশ্রু। রাতুল মেঘকে জড়িয়ে ধরে বলে, ” মাফ করে দিস রে বোন। আমি নিকৃষ্ট, ক্ষমারও অযোগ্য! ” মেঘ রাতুলকে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে কিন্তু মুখে কিছুই বলে না।

তামান্না আর আবিদ ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। তামান্না মেঘকে ফোন দিয়েছে। মেঘ ফোন ধরে চুপ করে আছে। তামান্না বললো, ” কীরে বদমাইশ। খুশির খবর শুনছিস তো? ” মেঘ “হুম” বলেই শব্দ করে কেদে দেয়। তামান্না অবাক হয়ে বলে, ” আরে পাগল কাদছিস কেনো তুই? ” মেঘের কান্না থামে না। আসলে আবিদ তো চাইলেই মদ বা সিগারেট খেয়ে নিজের কষ্টটা ভুলতে পারতো। কিন্তু মেঘ? মেঘ তো সব কষ্টগুলোই অনিচ্ছাকৃতভাবে গুছিয়ে রাখতো নিজের বুকে। আর সেগুলোর মধ্যেই লড়াই করে থাকতো একটু প্রিয় পরিনতির আশায়। মেঘ কান্না থামাতেই পারছিলো না। এতোদিনের চুপকরে থাকাটা ভেঙে যেনো আজ চোখের পানি যুদ্ধে নেমেছে। ফোনটা লাউড স্পিকারে ছিলো মেঘের কান্নার শব্দে আবিদের চোখেও পানি চলে এসেছে। ফোনটা তামান্নার কাছ থেকে নিয়ে আবিদ বলে, ” কাদছে কেনো মেঘবানুটা? টেম্পার আবিদের সাথে বিয়ে করতে নারাজ নাকি? খুশি হও নী আমাদের বিয়ের কথায়? মেঘ আরো শব্দ করে কান্না করে দেয়। মেঘের কান্নার আওয়াজে আবিদও কান্না করে দেয়। তামান্না আবিদকে জড়িয়ে ধরে ফোনে বলে, ” এই বদমাইশের দলেরা কাদতেসস কেনো তোরা? তোদের কান্না দেখে আমি নিজেও কান্না করে ফেলছি!” আসলেই তামান্নাও কান্না করছিলো। তামান্নার কথা শুনে মেঘ কান্না থামিয়ে বলে, ” আমি মোটেই কাদতেসি না। আবিদ কাদতেসিলো! ” এটা শুনে তিনজনই একসাথে হেসে দেয়। আবিদ কানের কাছে ফোন রেখে দাঁড়িয়ে আছে, দুজনই নিশ্চুপ। মেঘ নিরবতার সীমানার দাড়ি মুছে দিয়ে বললো, ” আচ্ছা রাখছি। বিকালে দেখা হবে। ক্ষুধা লাগছে খুব। এখন খেয়ে, গোসল করে সাজতে বসবো! ”
– ” আজ বিয়ে যে সাজবা? ”
– ” মেয়েদের দেখতে আসলেও সাজতে হয় হাদারাম একটা! ”
– ” গোসল করে এসে ভিডিও কল দিও। তোমার সাজ দেখবো! ”
– ” উহু, ধৈর্য্য ধরে বাসায় আসবা তারপর দেখবা। সবুরে মেওয়া ফলে, তুমি এতো অধৈর্য্য কেনো বলো তো? ”
– ” অধৈর্য্য হলে কী তোমার সাথে সাতদিন কথা না বলে থাকতে পারতাম? ধৈর্য্য আছে দেখে বলেই পেরেছি! ”
– ” আবার বলতেসো এইটা? এই সবকিছুর শোধ আমি বিয়ের পরে তুলবো গুনে গুনে একদম। জাস্ট বিয়েটা হতে দাও! ”
– ” তাহলে আমি বিয়েই করবো না তোমায়! ” বলেই হেসে ফেলে আবিদ।
– ” তুমি করবা তোমার ঘাড় করবে। আর আমি ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে তোমায় বিয়েও করবে না। তোমার মতো পাগলকে কেউ বিয়ে করতে পারে নাকি? ”
– ” অন্যকেউ লাগবে না। আমার মেঘবানু হলেই হবে! ”
– ” এইতো পথে আসছো চান্দু। শোনো রাখছি এখন! ”
– ” আই লাভ ইউ! ”
– ” আই লাভ ইউ টু থ্রি ফোর ফাইভ সিক্স! ”

বিকালে তিনটার দিকে আবিদ,তামান্না,আবিদের বাবা-মা, আর ইশু যায় মেঘের বাসায়। সেখানে রাতুল আর রাতুলের মা কথা বলতে থাকে ওদের সাথে। রাতুলের মা আবিদ আর তার পরিবারের কাছে ক্ষমা চায় রাতুলের ভুলের জন্য। আবিদের বাবা বলে,” আরে ভাবি বাদ দিন এসব অতীত বলে কোনো ফায়দা নেই। বরং ভবিষ্যত নিয়ে আগাই! ”

আবিদের মা জিজ্ঞেস করে মেঘ কোথায়?

রাতুল বলে,” এইতো আন্টি আসছে। ” বলেই সে তার বউকে ডেকে বলে মেঘকে নিয়ে আসতে। একটা কলাপাতা রঙের শাড়ি পরে বের হয় মেঘ। মাথায় ঘোমটা, দু হাতে গোটাকতক চুড়ি, লিপস্টিকবিহীন ন্যাচারাল ঠোট, মনে হচ্ছিলো চোখে কাজল দিয়েছে কিন্তু এগুলো কাজল না এতোদিনের জীবনঝড়ের ছাপ। ফর্সা মুখে চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে মেঘের। মেঘকে দেখে রাশেদ তালুকদারের খুব পছন্দ হয়েছে। আর রিনা তালুকদার আগে থেকেই মেঘকে পছন্দ করতেন। তাই মেঘ আসার সাথে সাথেই রিনা তালুকদার বলে, “মাশাল্লাহ।তা ভাবি আমরা চাচ্ছিলাম যে আজকে আংটিটা পড়িয়ে কাল্কেই বিয়ের কাজটা সেরে ফেলতে যেহেতু কাল শুক্রবার। আর কম ঝড়তুফান তো হলো না। তাই বিয়েটা ফেলে রাখতে চাই না যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে আরকি! ”
মেঘের মা বললো, ” আপনাদের ঘরের বউ আপনারা যখন ইচ্ছা নিয়ে যেতে পারেন আমাদের কোনো আপত্তি নেই! ”

রাশেদ তালুকদার আবিদের হাতে একজোড়া আংটি দেয়। মেঘ আবিদকে আর আবিদ মেঘকে আংটি পড়িয়ে দেয়। মেঘ রুম থেকে বের হওয়ার পড় থেকেই আবিদ মুগ্ধতামিশ্রিত অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে। আর আবিদকে এভাবে দেখে মেঘও লজ্বা পেয়ে মিটিমিটি হাসে। তামান্নার চোখে এসব পড়তেই তামান্না আবিদের বাবাকে কানে কানে বলে, ” চাচ্চু হবু বউ জামাইকে একটু আলাদা ছাড়লে হয় না? ”

আবিদের বাবা মেঘের মাকে বলে, ” ভাবি আমরা বরং কালকের বিয়ের প্ল্যানিংটা করে নেই। আর হবু বউ জামাই নাহয় নিজেদের মধ্যে একটু কথা বলে নিক! ”
– ” ঠিক বলেছেন ভাই। মেঘ জামাইকে নিয়ে রুমে যা! ”

মেঘ আবিদকে নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। রুমে ঢুকে মেঘ দরজা লাগাতেই আবিদ মেঘকে জড়িয়ে ধরে,” এতো সুন্দর লাগতেছে কেনো তোমায়? মন চাচ্ছে এখনই অসভ্য হয়ে যাই! ”
– ” তুমি এমনিতেই অসভ্য। আবার কী অসভ্য হবে? ”

আবিদ মেঘের কপালে চুমু খেয়ে বলে, ” আমার মতো অসভ্যকে বিয়ে করার জন্য ধন্যবাদ। আমি ভাগ্যবান আমার মেঘবানুকে পেয়ে! ”
মেঘ আবিরের বুকে মাথা রেখে বলে, ” হইসে আর এসব জাদুমাখা কথা বলতে হবে না। আমি বহুত আগে পটে গেছি! ” মেঘের কথায় হেসে ফেলে আবিদ।

পরের দিন দুই পরিবারের কাছের কিছু আত্মীয়দের উপস্থিতিতে বিয়ে হয়ে যায় আবিদ আর মেঘের!

আবিদ আর মেঘ এখন বাসরঘরে। মেঘ বসে আছে আর আবিদ শুয়ে আছে মেঘের কোলে। মেঘের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে চুমু খাচ্ছে আবিদ। আবিদ মেঘের গাল টেনে বললো,” তা আজ রাতের প্ল্যান কী? ”
– ” প্ল্যান হলো। তুমি কান ধরে উঠবস করবে আর আমি গুনবো! ”
– ” কীহ? তা এমন উদ্ভট বাসর প্ল্যান আপনি কেনো করলেন? ”
– ” কম কষ্ট দাও নাই আমায়, তাই এটাই তোমার শাস্তি। বাসর রাতে আদর না করে কান ধরে উঠবস করবা! ”
– ” তোমায় কষ্ট দিয়ে কী নিজে কষ্ট পাই নাই? তবুও যাইহোক আমাদের সম্পর্কের পরিনতি তো ” প্রিয় পরিনতি ” হলো?
– ” হুম। একদম ” প্রিয় পরিনতি ”
– ” এবার বাসরের প্ল্যান শোনো! ”
– ” কী প্ল্যান? ”
– ” আমি সারারাত তোমায় কামড়াবো, শরীরের এক ইঞ্চি পরিমান জায়গাও বাদ দিবো না, তোমার বজ্বাত ভাইটাকে মামা বানানোর ব্যাবস্থা করবো। তারপর আরকি বাসর হয়ে গেলো! ”
– ” হ্যা করাচ্ছি আপনার প্ল্যানিং। চুপচাপ ঘুমাবা একদম! ”
– ” আহারে, আপনি বলবেন আর আমিও ভদ্র হয়ে ঘুমাই যাবো নাকি? ”
– ” ভদ্র হয়ে কী আর ঘুমাবা তুমি? অসভ্য একটা! ”
– ” দেখাচ্ছি অসভ্যতামি কী আর কত প্রকার বলেই আবিদ নিজের শেরওয়ানি খুলে, মেঘের বুক থেকে শাড়ি সরিয়ে মেঘের গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলো। মেঘও কোনো প্রকার বাধা না দিয়ে তাল মেলালো কারন প্রিয় মানুষটার সাথে প্রিয় পরিনতির পরের প্রথম প্রিয় রাতটা এভাবে সে খুয়িয়ে দিতে চায় না!!!

সমাপ্ত!
গল্প পড়ুন, গল্প ভালোবাসুন, গল্পই হোক মূখ্য অনুভুতি!❤

#thetanvirtuhin

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here