জেদ পর্ব -০৯

#জেদ(A Conditional LoveStory)
#পার্ট০৯
#আফরিন_ইনায়াত_কায়া
.
.
আমি সামনের দিকে পা বাড়াতেই আমার মাথায় ফুলের বৃষ্টি হতে লাগল। অসংখ্য লাল গোলাপ এর পাপড়ি ছড়িয়ে পরছে আমার মাথার উপর।চোখ তুলে দেখি আরদ্ধ দুহাত পকেটে গুজে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর ঠোটে শোভা পাচ্ছে এক অপূর্ব সুন্দর হাসি।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
-তুমি না কাজে বাইরে গিয়েছিলে!
-হ্যা গিয়েছিলাম আবার চলেও এসেছি।Did you miss me?
কথাটা বলে আরদ্ধ এগিয়ে এসে আমার কপালে একটা গাঢ় চুমু দিল।
-Happy Birthday My Love.Sorry for not being there with you.
-এটলিস্ট কল তো রিসিভ করতে পারতে?কি এমন ব্যস্ততা ছিল শুনি?
মুখ ঝুলিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি
-কোন ব্যস্ততাই ছিল না।আমি ফোন হাতে নিয়ে বসে আছিলাম।আর স্ক্রীনে তোমার ছবি দেখছিলাম।
-তার মানে তুমি ইচ্ছে করেই আমার ফোন ধরনি?
কপট রাগ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
-জ্বি ম্যাডাম।ইচ্ছে করেই ধরিনি।
-কেন?
-কারন আমি যখন তোমার সাথে থাকি না তখন তুমি আমাকে মিস কর।তোমার চোখ দুটো খুব করে আমাকে খোজে। তুমি জানো আমি তোমার কাছে নেই তবুও তুমি তৃষ্ণার্তের মত সব জায়গায় আমার অস্তিত্ব খুজে বেরাও।ব্যাপারটা আমাকে খুব ভালোলাগে। তোমার এই আকুলতা, তোমার চোখের সেই তীব্র চাওয়া আমাকে বাধ্য করে তোমাকে খুব করে ভালোবাসতে।
আমি অবাক হয়ে আরদ্ধের কথাগুলো শুনছি।ছেলেটা কিভাবে এত বুঝে আমাকে?আচ্ছা কোন মানুষের পক্ষে কি কাউকে এতোটা বোঝা সম্ভব?নাকি এটা শুধু আরদ্ধই পারে!
-অনেক হয়েছে।তোমাকে আবার সন্ধ্যার মধ্যেই বাসায় ড্রপ করে আসতে হবে।নাহলে আপনার আব্বাজান রাগ করবে।অই রুমে ড্রেস রাখা।Go and get ready quickly. আমি অপেক্ষা করব।
আরদ্ধ আমাকে হাতের ইশা করে উপরের একটা রুম দেখিয়ে দিল।
.
.
রুমটা বেশ সুন্দর করে সাজানো৷পুরো রুম জুড়ে ছোট ছোট লাল সাদা মরিচ বাতি জ্বলছে।রুমের একপাশে একটা বিছানার উপর বেশ কিছু গিফটবক্স রাখা আছে।আমি এগিয়ে গিয়ে সবচেয়ে বড় বক্সটা হাতে নিলাম।বক্স খুলতেই আমার চোখ আটকে গেল।কালো আর ম্যাজেন্ডা কালারের স্টোন বসানো একটা শাড়ি। এই শাড়িটাই মাস ছয়েক আগে একটা ফ্যাশন শোতে দেখেছিলাম আমি আর আরদ্ধ।
আমরা তখন নিউলি মেইড কাপল।আরদ্ধের সাথে কোথাও যেতে বা ঘুরতে আমার বেশ অড লাগত।এমনটা নয় যে আমরা আগে কখনো কোথাও একসাথে যাইনি বা ঘুরিনি।অফিশিয়াল কাজের জন্যে আমি আর আরদ্ধ বেশ কয়েকবার অনেক জায়গাতে গিয়েছি।কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই মানুষ আমাদেরকে নিয়ে সমালোচনা করত।কারন ছিল আরদ্ধের হাই প্রোফাইল ,যান্ত্রিক এটীচিউড আর আমার সাদামাটা গেটাপ।
আরদ্ধর হাই ক্লাস দুনিয়ার যে কারোর চোখে তার পাশে আমার উপস্থিতি বেমানান লাগাটা অস্বাভাবিক কিছুই না।তবে সেবার বেমানানের মাত্রাটা যেন একটূ বেশিই ছিল।
আমার সেদিন অফিস হলিডে ছিল।আলমারি ঝারতে গিয়ে আম্মুর বেশ কয়েকটা পুরোনো শাড়ি খুজে পেলাম।বলা বাহুল্য পুরোনো হওয়ায় আর অনেকদিন আলমারিতে অযত্নে পড়ে থাকার কারনে শাড়িগুলো অনেকটাই মলিন হয়ে গেছে।অনেকদিন পর শাড়ীগুলো দেখে খুব ইচ্ছে হল একবার গায়ে পেচাবার।যেই ভাবা সেই কাজ।কুচি গুজে আচল ঠিক করছি তখনি ফোনটা বেজে উঠল।কল রিসিভ করে লাউড স্পীকার অন করলাম আমি।
-হ্যালো আসসা……
-Fashion city এর সাথে আমাদের একটা ইম্পরট্যান্ট মিটীং আছে।ওরা তাদের ফ্যাশন শো দেখার জন্যে আমাদেরকে ইনভাইট করেছে।ফ্যাশন শো শেষ করে আমরা ডীল ফাইনাল করব।Get ready quick.আমি ১০ মিনিটে তোমার বাড়ির গলির সামনে আসছি।Come fast.
-But sir… আজকে তো আমার………হ্যালো…হ্যালো…
আমি কিছু বলার আগেই আরদ্ধ যান্ত্রিক গলায় সবটা বলে খুট করে ফোনটা কেটে দিল।
আরদ্ধকে সেই মুহুর্তে নিষেধ করার সাধ্য আমার ছিল না।আরদ্ধ খুব ভালো করেই জানত সেদিন আমার অফ ডে ছিল।আগের দিন সব ফাইল রেডী করে কাজ গুছিয়ে এসেছিলাম আমি ।তাই খুব ইম্পরট্যাট কাজ না হলে এভাবে আর্জেন্টলি ডাকাটা আরদ্ধের স্বভাব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পরে না ।বাসা থেকে গলির মুখে পৌছাতেই আমার ৫ মিনিট লাগে।ড্রেস বদলানোর সময় আমার হাতে মোটেও ছিল না।তাই চুলগুলো কোন রকম খোপায় গুজে আমি ফাইল হাতে ছুট লাগালাম।আমি গলির মুখে গিয়ে পৌছাতেই আরদ্ধ গাড়ী নিয়ে হাজির হল।পার্ফেক্ট টাইমিং।
দরজা খুলে গাড়ীতে উঠার সময় আরদ্ধ এক দফা আমার দিকে চেয়ে সামনে মুখ ঘুরিয়ে নিল।আরদ্ধ যে মনে মনে আমার উপর হালকা পাতলা বিরক্ত হয়েছিল ব্যাপারটা বুঝতে আমার খুব একটা বেগ পেতে হয় নি।অন্য সময় হলে হয়তো দু চারটার কথাও শুনিয়ে দিত।কিন্তু আমার অফ ডে তে হঠাত এভাবে ডাকায় নিজেই ব্যাপারটা চেপে গিয়েছিল।তখন পর্যন্ত সবকিছুই ঠিক ছিল।বিপত্তি ঘটলো ফ্যাশন শোতে হাজির হয়ে।
.
.
ফ্যাশন সিটির প্রায় প্রতিটা এক্সিবিসশনেই গ্যালারী ভর্তি মানুষের আগমন ঘটে।পা ফেলার জন্যে তিল পরিমান জায়গাও খুজে পাওয়া দায়।কিন্তু আরদ্ধের জন্যে আগে থেকেই দুটো গোল্ডেন সিট রিজার্ভ করা ছিল।ফ্যাশন দুনিয়ার জমকালো রঙ্গিন সজ্জার মধ্যে আমার বছর পনেক পুরানো ফ্যাকাশে শাড়ি যেকারওই নাক শিটকানোর কারন হয়ে উঠছিল।আমি এ নিয়ে বেশ কয়েকবার তাকালাম।কিন্তু আশেপাশের কোন কিছু নিয়ে তার তেমন কোন ভাবান্তর নেই।সে নিজের কাজে মগ্ন।আরদ্ধের এই একটা ব্যাপার শুরু থেকেই আমার খুব পছন্দের।সে নিজের দুনিয়ার বাইরে কাউকে চিনে না।কে কি বলল,কে নিয়ে সমালোচনা করল সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর অবকাশ নেই তার।
কিন্তু আশেপাশের মানুষের বাকা দৃষ্টি আর লুকোচুরি কথা আমাকে সেদিন বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল।আমি খালি আপেক্ষায় ছিলাম কখন ফ্যাশন শো শেষ হবে আর আমি এই চাকচিক্যের মায়ামহল থেকে বের হব।
নিজের এক্সিবিশন পার্ট শেষ করে ফ্যাশন সিটির ওনার মিস মেহরিন খান এলেন আরদ্ধকে স্বাগত জানাতে।আরদ্ধের সাথে হ্যান্ডশেক করে আমার দিকে তাকাতেই উনি যেন ভুত দেখার মত চমকে উঠলেন।মুখ বাকিয়ে বলতে লাগলেন
-মি. আরদ্ধ আপনি অনেক ডাউন টূ আর্থ মানুষ বাট এরকম একটা হাই ফ্যাশান্ড পার্টিতে নিজের হাউজ মেকারকে নিয়ে আসাটা বেশ ফানি।
বেশ তাচ্ছিল্যের সুরেই উনি কথাটা বললেন।এরকম কিছু একটা হবে আমি ব্যাপারটা অনেকক্ষন ধরেই আচ করছিলাম কিন্তু এত খারাপভাবে ব্যাপারটা ঘটবে সেটা আমি ভাবতে পারিনি।
মিস মেহরিনের কথা শেষ হতেই আরদ্ধ বলে উঠল
-Miss Mehrin If you broden your outlook you’ll know that she is my colleague.Miss Inayat.
-Oh I’m so sorry Miss Inayat.But Mr. Aroddho you must admit that আপনার বিজনেস পার্টনারের ফ্যাশন সেন্স অনেক কম।
-Am sorry for interrupting Miss Mehrin .ফ্যাশন সেন্স কারও কম বা বেশি হয় না ।শুধু পরিস্থিতির সাথে মানানসই হতে হয়।আপনার লাইম লাইটের জগতে আমার ড্রেসাপ নিতান্তই বেমানান।But it upholds my simplicity and inner peace.Not the outer beauty.
আমার কথা শুনে মিস মেহরিন যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন।কিছু একটা বলতে যাবেন তার আগেই আরদ্ধ বলে উঠল
-Miss Mehrin I have a meeting in another place.So if you do hurry that will be better.
মিস মেহরিন দমে গিয়ে হাসি মুখে বললেন
-Oh sure.আসুন আমার সাথে।
শুরুর দিকে ব্যাপারটা গোলমেলে লাগলেও মিটীং টাইমে বুঝতে পেরেছিলাম আরদ্ধ কেন অফ ডে তেও আমাকে তুলে এনেছিল।
আরদ্ধের আর আমাদের দুই কোম্পানির গ্রাফিক্স রিলেটেড কাজগুলো প্রায় একই ছিল।মূলত আমাদের কন্ট্রাক্টের কাজের একটা অংশ ছিল গ্রাফিক্স ডিজাইনিং ।যেটা সম্পূর্ন আমার দায়িত্বে ছিল।সে জন্যেই আরদ্ধর এই পদক্ষেপ ।মিটিং শেষে ডিল ফাইনালাইজ করে যখন চলে আসছিলাম তখন হঠাত আরদ্ধ বলে উঠল
-মিস মেহরিন আমি পার্টনার working skill দিয়ে চুজ করি ফ্যাশন সেন্স দিয়ে না।Anyways Nice to meet you .Bye.
আরদ্ধের প্রতি সম্মানটা সেদিন এক ধাপ বেড়ে গিয়েছিল।
আরদ্ধ বের হয়ে ড্রাইভারকে কল দিলে উনি জানালেন গাড়ী পার্কিং এ আছে।বের করতে মিনিট পাচেক সময় লাগবে।অগ্যতা এক্সিবিশন হলে দাঁড়িয়ে ওয়েট করতে লাগলাম দুজনে। ফ্লোরে তখন বাঙালি কর্নার এর এক্সিবিশন চলছিল।তার মধ্যে একটা শাড়ির দিকে তাকাতেই চোখ আটকে গিয়েছিল।কালো আর ম্যাজেন্ডা কালাকের অপুর্ব এক কম্বিনেশন আর স্টোনের ভারী কাজ।এক নজরেই যে কারও ভেলো লেগে যাবে এমন।এক্সিবিশন শেষে ডিজাইনার যখন প্রাইজ বলছিলেন আমার পুরোই দম আটকে যাওয়ার উপক্রম।তবে শাড়ীর সৌন্দর্যের তুলনায় দামটা যৌক্তিক ও বটে
.
.
ঠিক সেই শাড়িটাই এখন হাতে নিয়ে বসে আছি আমি আর স্মৃতিচারন করছি।ঘোর ভাঙ্গল আরদ্ধের গলা শুনে।
-জানতাম এমনটাই হবে।শাড়ী হাতে বসে থাকবা তুমি।
পেছন ফিরে দেখি আরদ্ধ দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।……..
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here