#ঝরা পাতার দিন গুলো
#পান্না হাবিব
পর্ব -১৬
অনেক রাত অব্দি কবরের পাশে শুয়ে ছিলাম। আহা!! কি যে শান্তি লাগছিলো !! রাতে এসে আম্মু আব্বুর খাটে শুয়ে পড়লাম। চোখে একফোটা ঘুমও নেই। চা খেতে ইচ্ছে করছে খুব। চা অনেক পছন্দ বলে আগে আমার জন্যে সবসময় আব্বু চা, গুড়ো দুধ নিয়ে এসে রাখতো। ভাবতেই ভিতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো।
অনেক খেটেখুটে একমগ চা বানিয়ে নিয়ে বাইরে এলাম।বাইরে কি সুন্দর বাতাস আর মনে হচ্ছে আকাশ ভেঙে চাঁদের আলো উপচে পড়ছে !!!!! ওহ আজকে তো ভরা পূর্ণিমা!!
এই মুহুর্তে সবার আগে সাব্বিরকে পাশে পাওয়ার অাকাঙ্ক্ষায় নিজেই হেসে উঠলাম। ইশ আমার ঠিক কোথায় ওর জায়গাটা ওকে যদি দেখাতে পারতাম!!
ছোট থাকতে এমন ভরা জোছনায় আব্বু আম্মু আমাদের ভাইবোনদেরকে নিয়ে উঠোনে পাটি বিছিয়ে শুয়ে শুয়ে গল্প বলতো।কতোরাত এমন উঠোনেই ঘুমিয়ে পরেছি!! মনে হচ্ছে চোখের সামনে ভাসছে সবকিছু।
আজকে বাড়িঘর সব আছে, শুধু মানুষগুলোই নেই। আর আমি সেই বিশাল বাড়িতে একা একা সেই উঠানে মাদুর পেতে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছি!!
কি হতো যদি সাব্বির আমার সাথে আসতো এইখানে? ও যদি এইমুহূর্তে এখানে চলে আসতো আমার জন্য!! ইশ!! ওর বাকি জীবনের আমার প্রতি করা সব অনুচিত কাজ গুলো মাফ করে দিতাম।
কিন্তু এটাতো আর গল্প নয়। অবশ্য গল্প না সেটাও বলা যাবে না। নিজের জীবনের গল্প। যার গল্পের পরবর্তি পর্ব শুধু উপরওয়ালাই জানেন।
ওর আমার সাথে এমন আচরণের কোন মানেই খুজে পাচ্ছি না। এমন তো না যে ও আমাকে পছন্দ করতো না। ওর জন্যই উল্টো আমি কতো কথা শুনেছি। কতোবার আমাদের বাসায় বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে এসেছে ফুপি। কিন্তু আব্বু আর আম্মু বার বার মানা করে দিতো।
আবার সেই আমার সাথে রাগ দেখাচ্ছে। তাহলে কি সেদিনের আমার প্রতি ওর দেখানো ভালোবাসা শুধুই বয়সের দোষ ছিলো?
কিন্তু ওর প্রতি আমার ফিলিংসটা তো অল্প বয়সের বাতাস ছিলো না। সেই অনুভূতিগুলো এখনো সাব্বিরকে দেখলে মাথাচারা দিয়ে উঠতে চায় কিন্তু ওতো আমায় ডিভোর্স দিয়ে দিবে!!!
নিস্তব্ধ রাতের ব্যঘাত ঘটিয়ে ফোনটা তীব্রস্বরে বেজে উঠায় চমকে উঠলাম ভীষণ!! উফফ, এখন শোয়া থেকে উঠে যেয়ে ঘর থেকে ফোন নিয়ে আসতে হবে। বিরক্তিকর ব্যাপার একটা।
একবার রিং হয়ে থেমে আবার বাজতে শুরু করেছে। নাহ এবার যেতেই হবে। নাহলে আশেপাশের মানুষ যদি চলে আসে? তখন আরেক অসস্তিকর মুহুর্ত তৈরি হবে।
ফয়সাল ফোন করেছে!!!!!!!
ধরবো কি ধরবো না ভাবতে ভাবতে আবার কেটে গেলো। আবার বাজতে শুরু করলো।
-আসসালামু আলাইকুম স্যার। কোনো দরকার স্যার?
কোনো উত্তর নেই। এমন সম্মোধন হয়তো আমার থেকে আশা করেনি তাই বোধহয় কথা বলতে ভুলে গিয়েছে।
এই ছেলেটার লজ্জাশরম আসোলেই নাই। না হলে কোন মুখ নিয়ে আমাকে আবার ফোন দেয়।
-ভালো আছো জান?
-স্যরি স্যার? কি বললেন শুনতে পাইনি।
-জান, স্যরি বলার মুখ আমার নেই। কি বলবো বুঝতে পারছি না।
-স্যার আপনি ভুল করে আমাকে কল করেছেন। আমি বিবাহিত।
-তোর যে ডিভোর্স হয়ে যাবে আমি জানি মেহের। তোরে তো আগেই বলছি, তুই যদি আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করিস তাহলে তোর ১বছরের মাথায় ডিভোর্স হবে তারপর তোকে আমি বিয়ে করবো, বলি নাই তোরে?
-ও তাহলে সব নষ্টের মূলে তুই। কুত্তার বাচ্চা,খা** মা*।
সব শেষ করেও তোর শান্তি হয়না তাই না? এখন আবার অশান্তি করতে আসছিস। দেখ আমার বাপও নাই মাও নাই। আর কোনো ঝামেলা করিস না তুই প্লিজ।
-তোর বাপ মা নাই তো কি হয়ছে, আমি আছি না। তোর ভাইরা যে কেমন সেটাও জানি। নাহলে এতো কিছুর পরেও কিভাবে তোকে সাব্বিরের সাথে বিয়ে দেয়। তোর বিয়ে সব প্রব্লেম সলভ করে দিবো। কয়টা দিন সময় দে আমাকে।
আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। ওকে এখন কোনো কিছু বলেই বুঝানো যাবে না। নিজে যা বুঝে তাই ওর কাছে ঠিক। যেটার কারণে ওর সাথে ঝগড়া করতাম আর ব্রেকাপ। লাস্ট ব্রেকাপটাও এই কারণেই হয়েছিলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
-আমার উপর তোর অনেক রাগ তাই না বাবু? তুই যে কিছুই বলবি না আমাকে সেটাও আমি জানি। তোর কোনো কিছু না বলে শাস্তি দেয়াটা যে আরও ভয়ংকর। সবসময় একটা অসস্তির মধ্যে থাকাটা অনেক বেশি কস্টের।
শান্ত কন্ঠে বললাম তুমি আমার সাথে কেন এটা করেছ সে ব্যাপারে আমি কিছুই বলবো না ফয়সাল। তুমি চলে গিয়ে কার সবথেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে সেটা সময়ই বলে দেবে। আগে তো কল না ধরলে বাসায় বলে দেয়ার ভয় দেখাতে। কত রকমের মেন্টাল টর্চার করতে আমাকে। এখন ওসব করে লাভ নেই। তোমার কথা বাসার সবাই জানে। আর যেহেতু ডিভোর্স হয়েই যাবে সো শশুরবাড়িতে বলেও লাভ নেই। সাব্বিরকে কি বলেছ সেটা তুমিই ভালো জানো। আরও বলতে মন চাইলে বলিও। ভার্সিটির টিচার হয়েছো, ভালো করে সেদিকে মন দাও। এমন কিছু করোনা যেনো তোমার মান সম্মান নিয়ে টানাটানি পরে যায়। আমার কিন্তু এখন হারানোর কিছুই নেই। মাথায় রেখো কথাগুলো। আর কখনো আমাকে ফোন করবে না তুমি।
বায় বলেই ফোনটা অফ করে দিলাম।
কারণ আমি জানি এই ছেলে সারারাত ফোন দেতেই থাকবে। একটা নাম্বার ব্লক করলে আর একটা থেকে।
একবার তো হলে থাকতে ৮৯টা নাম্বার থেকে কল করেছিলো!!!!!
তারপর বিরক্ত হয়ে ফোন অফ করে রাখতেই হলের পিছনে থাকা খালি জায়গায় এসে আমাদের রুম বরাবর নিচে দাঁড়িয়ে গান গাইতো!!
আর আজ!!!
ওর বাসা থেকে আমাকে কি বলেছে সেটা নিয়ে কোনো কস্ট আমার নেই। আমি ওকে না জানিয়ে বিয়ে করলে কি হবে পরিনামে সেটা খুব ভালো করেই জানতাম। সেখানে ওর পুরো উল্টো আচরণ দেখে খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছি যে ফয়সাল জানতো যে আমার বিয়ে হয়ে যাবে।
অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা বাকি। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয়া যাবে না।
সারারাত উঠোনে শুয়েই কাটিয়ে দিলাম। ভোরের দিকে সূর্য উঠার একটু আগে বাড়ির বাইরের উঠানে গেলাম। তারপরে সামনে বিশাল এরিয়া নিয়ে নিচু জমি শুরু। প্রথম দিককার জমিগুলোতে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ হচ্ছে আর পরের গুলোতে ধান। এমনি ভোরে এসব খেতের আইল দিয়ে হেটে হেটে ছোটোবেলায় মক্তবে যেতাম কুরআন পড়া শিখতে। কতো মজার ছিলো আমার লাইফটা। আর এখন!!!
খালি পায়ে কি শান্তি লাগছে হাটতে!!! বুক ভরে ঠান্ডা বাতাস নেয়ার আনন্দটাই অন্যরকম! রাতের ডিসিশনটা নেয়ার পর খুব হালকা লাগছে। এতো সুন্দর সকাল অনেকদিন পর উপভোগ করলাম। হয়তো আর উপভোগ করার সময় পাবো না তাই।
কারণ গতকালকে রাতে আম্মুর আম্মুর কবরের মাঝখানে থাকাকালীন সময়ে আমার ফোনে একটা মেইল এসেছে অস্ট্রেলিয়ার নামকরা এক বিশ্বব্বিদ্যালয়ের
একুয়াকালচার ইন্সটিটিউটের এক বিখ্যাত প্রফেসর থেকে। আমার পাঠানো সুপারভাইজার ম্যামের রেফারেন্স সহ একটা রিসার্চ প্রপোজাল তার খুব পছন্দ হয়েছে এবং তিনি আমাকে তিন সেমিস্টারের মাস্টার্স ফুল স্কলারশিপ সহ অফার করেছেন!!!! এবং চাইলে আমি পরবর্তীতে পিএচডিও করতে পারি!!! মা বাবার থেকে এর থেকে বড় দোয়া আর কি হতে পারে।
আর একটু রিশাদ ভাইয়াকে আসতে মানা করে দিয়েছি। সাব্বিরের ঘটনা আবার বাড়ির কাহিনি এইগুলো ফুপিরা জানলে অশান্তি হবে শুধু শুধু । সাব্বির যদি বাসায় না যায় তাহলে কোথায় গেলো ও!! কি লাইফ আমার!!! ইনশাআল্লাহ, খুব শিগ্রই এসব থেকে মুক্তি পাবো!!