#ঝরা পাতার দিনগুলো
#পান্না হাবিব
পর্ব-৫
চোখ খুলতেই দেখি বিছানায় আমি। পাশে কেউ নেই। ধাতস্থ হয়ে গত রাতের কথা মনে করার চেষ্টা করলাম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুই প্যাকেট সিগারেট শেষ করে রুমে আসি। তারপর ফ্লোরে শুয়ে শুয়ে আরও ৪টা। তারপর আর মনে নাই। তার মানে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। আচ্ছা আমি বিছানার উপরে আসলাম কিভাবে!! ধুরো।
সকাল ১১.৩০ বাজে!!!
এতো টেনশনেও আমার ঘুম ঠিক আছে!! বাহ আমিতো লিজেন্ড।
খুশি মনে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে যেতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। প্রিমা বসে সাব্বিরের সাথে গল্প করছে।
লাস্ট পনেরো মিনিট ধরে ছাদের উপরে আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রিমা কান্নাকাটি আর বিলাপ করছে।” তুই কেমনে কবুল বলতে পারলি রে মেহের!! তুই তো পাথর হয়ে গেছিস! এতো সুন্দর একটা রিলেশনশিপ!! কিভাবে কি হয়ে গেলো রে মেহের!!! তুই কেমনে সহ্য করে আছিস রে মেহেরের বাচ্চা। তোর বাবা থাকলে আজকে এইরকম কিছুই হতোনা।”
আমি ওকে বসে বসে সান্ত্বনা দিচ্ছি। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টো!!
প্রিমার কান্না থামার পর চুপচাপ দুজন বসে আছি।
-তুই পালিয়ে গেলি না কেন? কিংবা আমার বাসাতেই চলে আসতি?
-যার ভরসায় গিয়েছিলাম সেইতো রাখতে চায়নি। তোর বাসায় গেলে ঠিক ধরে নিয়ে আসতো আমাকে।
-পালিয়ে গিয়েছিলি? তাহলে আবার আসলি কেন?
-বিয়ের আগের দিন রাত ২টা অব্দি ফুপিদের বাসায় মিটিং চলে। সকালে ভাবি ঘুম থেকে ডেকে তুলে হাতে মেহেদী দেয়ার জন্যে। তখনই জানতে পারি যে আজকে আমার বিয়ে।
-তারপর?
-বড় আপুকে ম্যানেজ করে ২ ঘন্টার জন্য বাসা থেকে বের হই। সিএনজি করে ডিরেক্ট ফয়সালের বাসায় যাই। ব্রেকাপ হবার কারণে ২দিন ধরে ফয়সালের সাথে কোনো যোগাযোগ ছিল না।
-কি বলিস? ব্রেকাপ হয়ে গিয়েছিল?
-আরে এই ঘোড়ার ডিমের ব্রেকাপ ৫ বছরে কম করে হলেও একহাজার বার হইছে। বড়জোর ৩দিন। এরপরেই ঠিক হয়ে যেত।
-ওদের বাসায় তোদের ব্যপারে না জানতো সবাই?
-হুম জানতো।
-তো তুই চলে এলি কেন?
– ফয়সাল বাসায় ছিলো না। ওর আব্বু আম্মু ওর ব্যপারে কিছুই বলে নি আমাকে । আরো অনেক কথাই বলছে। ভালো লাগছেনা এগুলো বলতে। বাদ দে।
“আর কি বলছে মেহের? বল আমাকে?”শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো ও
-বাবা মা মরা মেয়েকে নাকি তারা তাদের ছেলের বউ করবে না। আমাকে আমার ভাইবোন ঠিকভাবে মানুষ করতে পারেনি। তার ছেলে ভার্সিটির টিচার হবে তাই আমি তাকে প্রেমে ফাসিয়েছি।
জানিস প্রিমা, জীবনে প্রথম কারো পায়ে ধরেছি আমি। অনেক কান্নাকাটি করেছি আমি সবার পায়ে ধরে। এর জন্যে মনে হয় আর কাঁদতে পারছি না, চোখ ভর্তি পানি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম আমি।
আমাকে জড়িয়ে ধরে আবার কান্না শুরু করলো। কিন্তু আমি আর পারছি কই।
-তুই কান্না বন্ধ কর নারে বোন,প্লিজ!!! কান্নাকাটি করে যদি কিছু হতো তাহলে সব থেকে বেশি কাঁদতাম আমি। সবার আগে আম্মু আর আব্বুকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতাম। বাপ মা ছাড়া ভালোবাসার মানুষের কাছেও দাম নাই। তারপর চোখের পানির সাগর বানাইতাম। সেই সাগর পাড়ে আমি আর তুই বিকিনি পরে সাগরবিলাস করতাম। মাঝে মধ্যে না হয় শিশিরের মতো সুন্দর পোলা দেখে শিস দিতাম। নাহ তোরে সালয়ার কামিজ পরাতাম। তুই তো আমার চেয়েও মোডা। তোরে বিকিনি পরা দেখলে কোন পোলা আর আসবেই না।
কান্নার মাঝেও প্রিমা ফিক করে হাসি দিয়ে ফেললো।
-শোন শিশিরকে আগেই জিজ্ঞেস করে নিস যে তোর বাপ মা মারা গেলে তোরে ছেড়ে দিবে কি না।
প্রিমা ছলছল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো
-তুই ফয়সাল ভাইকে জিজ্ঞেস করবি না কেন এমন করলো?
– না।
-তাহলে আমি কথা বলবো?
– না।
– “কেনো?” ও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে
– একটু চুপ থেকে বললাম,অনেক বেশি ভালোবাসি ওকে। যদি উত্তরটা এমন কিছু হয় যেটা শুনে আমি ওকে ঘৃণা করবো সেদিন হয়তো বেচে থাকার ইচ্ছেটাই আমার মরে যাবে। আমার ভালো কিছুর জন্যে আমাকে ছেড়ে গিয়েছে এই প্রত্যাশাটা নিয়েই বাঁচতে চাই আমি।
-তাহলে তুই সাব্বির ভাইয়ার সাথে সংসার করবি?
– কি করবো জানি না। তবে সবাইকে ভালো রাখার চেষ্টা করবো।
-আর তুই?
– জানিসতো প্রিমা, আমি বাসা থেকে বের হবার সময় মেজো ভাইয়া দেখেছিল, কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করেনি আমাকে। খারাপ কিছু করবো না সেই ভরসায় হয়তো যেতে দিয়েছিল।আমার ইচ্ছে ছিলো ফয়সালকে সাথে করে নিয়ে এসে সব খুলে বলবো। এইটুকু বিশ্বাস ছিলো সব শোনার পর আর যাই হোক এখন অন্তত বিয়ে দিবে না।
ভরসা রাখার জায়গাটা হারিয়ে যাবার কস্ট ওরা কেনো পাবে বলতো!! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম আমি।
-সাব্বির ফয়সাল ভাইয়ার সম্পর্কে জানে?
– হুম। কিন্তু কতটুকু জানে তা জানি না।
– কি বললো তোকে?
আমি বিরক্ত চোখে ওর দিকে তাকালাম।
-আচ্ছা সরি সরি। আর কিছু জিজ্ঞেস করবো না। জাস্ট এইটার উত্তর টা দে, সাব্বির ভাইয়ার সাথে সব ঠিক আছে তো?
আমি অন্যদিকে তাকিয়ে হুম বললাম।
এইপ্রথম প্রিমাকে কোন মিথ্যে বললাম। একবার মনে হলো এই হুম টা সত্যি হলে হয়তো খারাপ হতোনা।
বেচারি সবটা শোনার পর কি করে বসবে ঠিক নেই। হয়তো ফয়সালের হাতে পায়ে ধরে আমাদের বাসায় নিয়ে আসবে। কিন্তু ওর কাছে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছেটা আমার মরে গিয়েছে।
“দুজনতো একসাথেই যেতে পারো। ক্যাম্পাস তো খুব বেশি দূরে না তোমাদের। ট্রেনের টিকিট কেটে দিচ্ছি চলে যাও একসাথে”। মেজো ভাইয়ার কথা শুনে আর কিছু বলতে পারি নি।
৫ বছরে ফয়সালকে ছাড়া কখনো চট্টগ্রাম আসা যাওয়া
করিনি। মনে পরতেই কেমন জানি বুকটা ভারি হয়ে গেলো। কস্টের ওজনটা মনে হয় অনেক বেশি। না হলে কি আর এতো ভার ভার লাগে! !
-আমি আর ঐ বাসায় যাবো না এখন। এখান থেকেই চিটাগং চলে যাবো। ওকে বলো যাওয়ার সময় আমাকে নিয়ে যেতে।
“হায় হায় মেয়ে বলে কি? বিয়ে করেছ শশুড় বাড়ি যাবে না? সারাজীবন কি ভাইয়ের বাড়ি থাকবে নাকি?” মেজো ভাবি খুব মিস্টি হাসি দিয়ে কথা গুলো বললো আমাকে।
-তাহলে কি আর করবো বলো ভাবি, আমাদের গ্রামের বাড়ি চলে যাবো। ঐটা তো আমার নিজের বাড়ি।
“আহ থাকতে চাইছে যখন থাক না। এতো কথা বলার কি আছে। ঠিক আছে তুই এইখানেই থাক। আমি ফুপুকে বলে দিচ্ছি।” বলে মেজো ভাইয়া ফুপুকে ফোন করার জন্য উঠে গেলো। আর মেজো ভাবি মুখ গোমড়া করে উঠে চলে গেলো।
কি অদ্ভুত ব্যাপার!! বিয়ের ২দিনের মাথায় নিজের বাসায় পর হয়ে গেলাম!!!
নিজের মাথার উপর পারমানেন্ট ছাদের ব্যবস্থা করার প্রয়োজন খুব ভালো ভাবেই বুজতে পারে