#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||১৪তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
বেলা বিকেল যখন নায়িমের গোপণ শত্রুর পাঠানো লোকগুলো বাড়িতে পা রাখে। তাদের বড়ো সাহেব তাদের অপেক্ষাতেই ছিলেন।
“বড় সাহেব আমরা আপনার আর নূর ভাইয়ের কথা মোতাবেক হাসপাতালে গিয়েছিলাম, কিন্তু…”
“কিন্তু কী? ”
“হাসপাতালে কাউকে পাইনি। আর হাসপাতালে একজনের ডেলিভারি গতকাল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার নাম-ঠিকানা কেউই জানে না। আমরা অনেক চেষ্টা করেও কিছুই জানতে পারিনি।”
রাগে সামনে পড়ে থাকা চেয়ারে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে লাথি মারেন তিনি।
“আমি নিশ্চিত ঐটা নিয়াজের ছেলের বউই ছিল। ওদের যত দ্রুত সম্ভব খুঁজে বের করতে হবে, নাহলে আমার খুব বড় ক্ষতি হতে চলেছে।”
মধ্যবয়স্ক পুরুষটির উত্তেজনা যেন সীমা হারিয়ে যাচ্ছে। নূর তা খেয়াল করে শুধায়,
“সাহেব, সবই তো আপনার হাতের মুঠোয় ঐ দুই দিনকার ছেলে আর কী করতে পারবে?”
“নূর, খরগোশ আর কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতায় খরগোশ ভেবেছিল খেলা তার হাতেই, সে-ই জিতবে, আর এই ভাবনাই তাকে হারিয়েছে। শত্রু যতই ছোট হোক নিজের চেয়ে, তাকে খতম করাই শ্রেয়। কখন যে কচ্ছপ থেকে বাঘ হয়ে কামড়ে ধরে বলা যায় না। এখন তো মূল হোতা পৃথিবীর মুখ দেখেছে।”
তাঁর কথায় চুপ হয়ে যায় নূর। লোকটা খাণিকটা সময় নিয়ে কী যেন ভাবতে শুরু করেন। তারপর বলেন,
“তোরা আরও খোঁজ লাগা। বাংলাদেশে প্রতি প্রান্তের পরিচিত গুপ্তচরদের টাকা দে নিয়াজের ছেলেকে খুঁজতে। আর বলে দিস পাওয়ার সাথে সাথে যেন তাকে আর তার সন্তানকে… বুঝতে পেরেছিস তো?
বাঁকা দৃষ্টিতে তাকান তিনি নূরের দিকে। নূর মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে প্রস্থান করে।
___
ইন্টারভিউ শেষ করার বেশ অনেকটা সময় পড়ে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ভিন্ন গাড়ি করে ধানমণ্ডির এপার্টমেন্টের উদ্দেশ্যে রওনা হয় অনিমেষ ও নায়িম।
পৌঁছে বেল বাজাতেই দরজা খুলে চৈতালি।
“এসেছো তবে? তোমাকেই কল করতে নিচ্ছিলাম এখন নায়িম। বাবুর জন্য একটা প্যাকেটজাত দুধ এনিয়ে রাখো নায়িম। তোমরা থাকো না সবসময়, কখনো লাগলে…”
আমতা আমতা ভাব চৈতালির। নায়িম কিছুটা কপাল ভাজ করে অনিমেষকে বলে নিয়ে আসতে। আর সে কোনোদিকে না তাকিয়েই বেডরুমে ঢুকে যায়।
বাসন্তী তাকে দেখে চোখ-মুখ খিঁচে হালকা চেঁচিয়ে উঠে। বস্তুত, বাসন্তী বাবুকে খাওয়াচ্ছিল। নায়িম কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না, সে তার মতো দরজা আটকে টিশার্ট খুলতে শুরু করে প্রতিদিনকার ন্যায়।
বাসন্তী পিটপিট করে তাকিয়ে দেখে যুবক নিজের মতো কাজ করছে, আর এদিকে তারও আগের মতোই অবস্থান। নাহিবাকে সরাবে এমন ভাব, তখনই রাম ধমক দেয় নায়িম।
“ভুলেও না। নাহিবাকে খাওয়াও চুপচাপ। কিছুই তো আমার অদেখা নয়, তাহলে তো আর বাচ্চার মা হতে না। সো এইসব ফালতু কারণে আমার প্রিন্সেসের খাওয়াতে বিন্দুমাত্র সমস্যা চলবে না।”
নায়িমের হুমকিতে ভেঙচি কাটে বাসন্তী। আপন মনে বিড়বিড়ায়,
“এখন দরদ একদম উতলিয়ে পড়ছে।”
“কিছু বললে মনে হলো?” অস্পষ্ট কিছু একটা শুনে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাল নায়িম।
জিহ্বায় কামড় দেয় বাসন্তী। নত দৃষ্টিতে জবাব দেয়,
“না, না, তেমন কিছু না। আমি বলছিলাম নাহিবা, এত সুন্দর নামটা কে রাখল? নিশ্চয়ই অনিমেষ দা?”
“আজব তো! অনিমেষ কেন আমার মেয়ের নাম রাখবে? আমি কী মরে গেছি না কি?”
“না, না, আমি তা বলতে চাইনি তো।”
“চুপ থাকো তুমি! আর একটা কথাও বলবে না। অসহ্যকর!”
নায়িম ট্রাউজার নিয়ে বাথরুমে চলে যায় গোসল করতে। বাসন্তী তৃপ্তির হাসি দেয়। আনমনেই বলে,
“আল্লাহ আমি চেয়েছিলাম আমার স্বামী আমার বাচ্চাকে যাতে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, পিতৃত্ব যাতে তার হৃদয়-মস্তিষ্ক ছোঁয়৷ তুমি আমার দোয়া কবুল করেছো আল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ! ”
কিন্তু বাসন্তী কি জানে নায়িমের মনে জাগ্রত পিতৃত্বই তার মাতৃত্বের জন্য কাল হতে পারে?
বাসন্তী নাহিবাকে শোয়াতে গেলে আবারও ব্যথায় কোঁকিয়ে উঠে। নায়িম বাথরুম থেকে ছুটে আসে।
“বেশি ব্যথা করছে না কি? ডাক্তার ডাকব?”
“না, আমি ঠিক আছি। এমন তো হয়ই।”
নায়িম কী যেন মনে করে ফোন হাতে নেয়। কিছু একটা বেশ খাণেক ক্ষণ সময় নিয়ে ঘেটেঘুটে দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। একটু বাদে ফেরত আসে গরম পানির ব্যাগ নিয়ে।
“এটা পেটে দাও আরাম লাগবে। আমি চেক করেছি বেশি গরম না, তারপরও তোমার সয় না কি দেখো।”
বাসন্তী কথা মোতাবেক ব্যাগ হাতে নিয়ে উদরের উপর রাখে। সত্যিই অনেক আরাম লাগছে তার। সারাটা সময় যন্ত্রণায় থেকে এখন একটু স্বস্তি পেয়ে চোখ বন্ধ হয়ে আসে তার আরামে।
“তুমি কিছু খেয়েছো?”
“হ্যাঁ, চৈতালি আপু স্যুপ দিয়েছিল।”
“আচ্ছা, তাহলে এখন ঘুমানোর চেষ্টা করো। তোমার পা নিশ্চিয়ই ব্যথায় ধরে আছে। আমি তেল দিয়ে মালিশ করে দিচ্ছি।”
পা টিপে দিতে শুরু করে নায়িম, চেহারা সবসময়কার মতোই গাম্ভীর্যপূর্ণ। বাসন্তী অবাক হয় না। সামনের পুরুষটা এমনে যতই নিষ্ঠুর হোক, বাসন্তীর অসুস্থতায় বাসন্তীকে রাণী ভিক্টোরিয়া বানিয়ে ফেলতে বাদ রাখে না। মাঝে মাঝে আফসোস হয় বাসন্তীর। লোকটা কেন সবসময় এমন যত্নশীল, ভালোবাসাময় থাকে না?
___
“বড় সাহেব, একটা খবর দেখলাম। কাজের বা সম্পর্কিত না কি জানি না, তবুও আপনাকে বলতে হবে মনে হচ্ছে।”
“হেয়ালি না করে বলে ফেলো তো নূর। এমনেই কম চিন্তা নেই যে এখন তোমার ধাঁধা নিয়ে ভাববো।”
“নায়িম নায়ক এক গায়কের একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। উনি একজন ছেলে ও দুইজন নারী সমেত আমাদের এখানকার সদর হাসপাতালে গিয়েছে। আর তার মাঝে একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীও ছিল, যার সদর হাসপাতালেই ডেলিভারি হয়েছে।
ভিডিওটি খুব সম্ভবত গতকালেরই। আর আমাদের তথ্য মতে সেদিন হাসপাতালে একজনেরই বাচ্চা হয়েছিল, সে খান বাড়ি থেকে যাওয়া মেয়েটি।”
“মোস্তফাকে ডাকাও। দেখো এটা খান বাড়িতে ঢুকা গাড়ি কি না। গাড়ি হাসপাতালে গিয়েছে তা শোনা কথা হলেও গাড়ি খান বাড়িতে ঢুকতে তো ও দেখেছে।”
মোস্তফা নামক যুবককে ডাকানো হয়। সে আমতা আমতা করে বলল,
“আসলে সাহেব আমি তো গাড়ির নম্বর তুলতে পারিনি। আবার খান বাড়িতে ঢুকতে দেখেছিলাম সন্ধ্যার আবছা আলোয়, তাই দেখেছি অস্পষ্ট। তবে যত দূর মনে হচ্ছে গাড়িটা এমন আকার আর এমন ধরনেরই ছিল৷ রঙটাও তো কালোই।”
মোস্তফাকে কয়েকটা হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিছু সময় নীরব কাটিয়ে নূর জিজ্ঞেস করে,
“এখন কী করবেন বড় সাহেব?”
“এই ছোকরাকে বাড়ি থেকে যত ক্ষমতা ব্যয় করে পারো তুলে আনো আমার আস্তানায়। সাথে ওর বাড়িতে যারা যারা থাকবে সবাইকে তুলে আনবে। একবার আমার আস্তানায় তুলে আনলেই সন্দেহ পরিস্কার হয়ে যাবে।”
চলবে…