#ডায়েরি_পর্ব_১
জান্নাতুল জান্নাত
তারিখ ২রা আগস্ট ২০১৫, স্থান: ওয়ারী চারদেয়ালের একটি স্ট্যাডি রুম৷
আমি অঞ্জনা৷ পেশায় অভিনয়শিল্পী৷ বয়স আটাশ৷ খুব কমও নয়৷ দুই বাচ্চার মা হয়েছি, সংসার সামলাতে শিখে গেছি বহু আগেই কিন্তু নিজেকে সামলানো আজও শিখে উঠতে পারিনি৷ একটা সংসার, সন্তান নারীর স্বপ্ন৷ আমারও ছিলো এই স্বপ্ন৷ ছোটবেলায় যখন পুতুল বিয়ে দিতাম তখনই ভাবতাম আমারও ছেলে মেয়ে হবে তাকে বিয়ে দিবো৷ খুব ভালো মা আর শ্বাশুড়ি হবো৷ আমার মায়ের মতো বকবো না৷ হ্যাঁ, মা হয়েছি কিন্তু ভালো মা হয়তো হতে পারিনি মানে পারছি না৷ মা হিসেবে ওদের যে পরিবেশ দেয়া উচিত তা দিতে পারছি না৷ কেন পারছি না? কেন নিজের জীবনটাকে কল্পনার জীবনের মতো সাজাতে পারছি না? আসলেই কি উপন্যাস মানুষের জীবনের মতো হয়? জীবন কেন উপন্যাসের মতো হয় না? এতোবছরের জীবনে অনেকের কাছে শুনেছি জীবনটাকে নিজের মতো সাজাও৷ তাদের কথামতো চেষ্টাও করেছি তবুও পারিনি নিজের মতো সাজাতে৷ সত্যি মনে হয় সাজানো যায় না৷ ভাগ্য তো ভাগ্যদেবতা লিখে রাখেন সেখানে আমাদের হাত কই? তেত্রিশ কোটি দেবতার নাম নিয়ে কতো পূজোই না করেছি, শুনেছিলো কি দেবতারা আমার আর্তি? শুনেনি৷ বুদ্ধি হবার পর থেকে শিবের মতো স্বামী পাওয়ার উদ্দেশ্যে পূজো করে গেলাম পেয়েছি কি শিবের মতো স্বামী? পাইনি৷ প্রতিদিন কত ফুল কত পূজো অথচ আমার ভাগ্যের শিকে আর ছিড়ে না৷ ভালো পরিবারের মেয়ে, ভালো পরিবারের বউ৷ মার্বেল পাথরে এসির ঠান্ডা হাওয়াতে ঘেরা আমার জীবন৷ কত লাইটের ফ্লাশ আমার উপরে পড়ে, মেকআপের পরতের পর পরতে ঢেকে দেয়া হয় আমার চেহারা ছোট্ট ছোট্ট গর্ত আর দাগগুলো৷ কোথাও কোন খুত নেই, শরীরের একফোটা মেদও জমতে দিতে পারিনা৷ ফিগারেই তো ব্যবসা৷
কখনো আমি শিক্ষিকা সেজে বাচ্চাদের পড়াই, কখনো ডাক্তার সেজে মানুষের ভিতর থেকে নতুন জীবন বের করার নাটক করি, কখনো পুলিশ সেজে বুলেটে ঝাঝড়া করি অপরাধীর বুক আবার কখনো অশরীরী সেজে আমার খুনীর কলিজা চিবিয়ে খাই৷ আহ্ কি তৃপ্তি তাতে!! কখনো সিল্কের শাড়ির সাথে পড়ি স্লিভলেজ ব্লাউজ যার ৯০% অংশই খোলা৷ পরিচালককে বহুবার বলেছিলাম এমন পোশাকে আমার অসস্তি হয় কিন্তু কি আর করার চুক্তিবদ্ধ যে আমি৷ শরীরের যতটা অংশ বের করে রাখা যায় ততটাই নাকি আমি আকর্ষণীয় হবো আর সাথে হবে ছবির দর্শকপ্রীতি৷ আচ্ছা দর্শক কি আসলে অভিনয় দেখে? নাকি শরীর দেখে নিজেকে উত্তেজিত করতে আসে? শরীরই যদি দেখার হয় তবে পাড়ার মেয়েরা তো কয়েকশো টাকার বিনিময়ে সব খুলে ফেলে দেয় ওখানেই তো দেখতে পারে৷ এই যা টাকার কথা বলতেই মনে পড়ে গেলো৷
তখন আমার সবে ষোলো৷ শরীরে যৌবণের আলো ঠিকরে পড়ে, লাল টমেটোর মতো গাল, হরিণীর মতো চোখ আর মেঘকালো ঘন চুলে ঢেউ খেলতো৷ সেবার পূজো আমরা পিসির বাড়িতে করেছিলাম৷ পিসতুতো দাদা অয়ন সেদিন আমাকে নিয়ে ঠাকুর দেখতে গিয়েছিলো৷ কত যে মন্দির তাদের এলাকায় হিসেব করা যায় না৷ আমি মুগ্ধ নয়নে দাদার সাথে ঠাকুর দেখছি৷ হঠাৎ অনুভব করলাম কেউ আমার কোমড়ের ধার ঘেষে হাত বুলাচ্ছে সযতনে৷ কেঁপে উঠে সরে গেলাম৷
-অয়নদা? কি করছিলে তুমি?
-কিছু নারে৷ কি সুন্দর তোর কটিদেশ তাই ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হলো৷
-ছিহ্ দাদা আমি না তোমার বোন?
-তাতে কি বোকা মেয়ে৷ মেয়ে তো? বোন বলেই তো কেউ কিছু সন্দেহ করবে না৷ আয় তো কাছাকাছি দাঁড়া৷
-না৷
দূরে দূরে থাকতে লাগলাম৷ কিছুক্ষণ পর শাড়ির মধ্যে দিয়ে হাত দিলো৷ আবার সরে গেলাম৷ চোখে ঘৃণার দৃষ্টি৷
-দাদা আবারও?
-এটা কিছু না৷ তুই আমাকে ধরতে দে আমি তো ৫০ টাকা দিবো৷ এখানে অনেক মেয়েরা এভাবে রোজগার করে৷ একবার ধরতে দিলে ৫০ টাকা৷ তুই যদি প্রতিদিন ১০ জনকে ধরতে দিস তোর ৫০০ টাকা হবে৷ কেউ জানবে না কিন্তু দেখ তুই কতগুলো টাকা পেয়ে যাবি৷ টাকাগুলো ইচ্ছেমতো খরচ করতে পারবি৷ কাউকে কোন কৈফিয়ত দিতে হবে না৷
-না দাদা আমার টাকার দরকার নেই৷ আমার শরীরে হাত দিয়ে টাকা দিবে এটা আবার কেমন কথা?
-তুই শুধু শরীরেই বড় হয়েছিস বুদ্ধিতে হোসনি৷ মেয়েদের শরীরে হাত দিয়ে ছেলেরা আনন্দ পায়৷ তাই দেয়৷ যেমনি তুই পুতুল খেলে, বই পড়ে আনন্দ পাস তেমনি৷
-বই পড়লে পুতুল খেললে তো কারো ক্ষতি হয় না৷ অন্যের গায়ে হাত দেয়া মোটেও ভালো কাজ নয়৷ তুমি আসলে কেমন যেনো৷ আমি বাসায় যাবো৷
-কেন রে? ঠাকুর দেখবি না?
-না৷ আমার ইচ্ছে করছে না, সাধ মিটে গেছে৷
-আচ্ছা চল৷
ফিরতে গিয়ে এক নির্জন স্থানে থামলো দাদা৷ জোর করে শরীরের আনাচে কানাচে হাত বুলানোর চেষ্টা করছে আর আমি প্রতিহত করছি৷ পরে বললো
-আচ্ছা আমি তোর গায়ে হাত দিবো না কিন্তু একটা কথা দিতে হবে৷
-কি কথা?
-এ কথা তুই কাউকে বলবি না৷ মা বাবাকেও না, মামা মামিকেও না৷ তাহলে কিন্তু আমি একা নই আরো দশজন নিয়ে আসবো৷ কখন আসবো তুই নিজেও বুঝবি না৷
-আচ্ছা বলবো না৷
-মনে থাকে যেনো৷
বলে বাসায় নিয়ে গেলো৷
তারপর থেকে আর অয়ন দাদার সামনে পড়িনি আমি৷ কথাগুলোও কাউকে বলিনি কখনো৷ কি করে বলবো কোন প্রমাণ নেই যে বিশ্বাস করবে না কেউ৷ উল্টো নোংরা সমাজ আমাকেই দোষী সাব্যাস্ত করবে৷ চুপ করে থেকেছি৷ তখনও আমার মানসিকতা এতো পাকা হয়নি তাই অয়নদার সব কথা বুঝিনি৷ কেন যে হয়নি তাও জানিনা৷ আমার বয়সী মেয়েরা কতকিছু বুঝতো, কত গল্প করতো আমি শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতাম৷ আমার পরিপক্কতা সবার থেকে পরেই এসেছিলো৷ অনেকে বলতো আমি আমন জাতের মেয়ে৷ আমি অবাক হতাম আউশ আমন তো চালের জাত৷ আমাকে কেন আমন বলে৷ একজন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে সব মেয়ের মধ্যে পরিপক্কতা তাড়াতাড়ি আসে তাদের আউশ বলে আর যাদের দেরীতে আসে তাদের আমন বলে৷ বিষয়টা মজার ছিলো৷
পরিপক্কতা আসার পর বুঝেছিলাম দাদা কি বলেছিলো৷ তবে সেবারই ছিলো পিসির বাড়ি শেষ যাওয়া৷ একবার খবর পেয়েছিলাম পিসি খুব অসুস্থ তারপরও আমি কলেজের দোহাই দিয়ে যাইনি৷ মা বাবা গিয়ে দেখে এসেছেন৷ আমাদের বাসায় মাঝে মাঝে অয়নদা আসতো কিন্তু আমি সামনে যেতাম না৷ আমার বোকা মা’টা কিছুই সন্দেহও করেনি বুঝতেও পারেনি৷ তবে অয়নদার সাথে আমার আর দেখা হয়নি৷ পরে শুনেছিলাম আমার সকল দিদি আর বোনদের সাথে অয়নদা এমনটা করেছিলেন৷ কেউই কারো কাছে বলতো না৷ সবাই লুকিয়ে রাখতো৷ আচ্ছা কেন আমরা লুকিয়ে রেখেছি? সবাই মিলে বললে হয়তো পরিবারের অন্যরা বিশ্বাস করতো৷ বুঝিনি তখন৷
এতোক্ষণে লেখাই হয়নি অয়নদা কিন্তু বিয়ে করেছে৷ সেই রকমের একটা বউ পেয়েছে৷ সারাদিন নাকি মারের উপরে রাখে৷ আমার বড্ড ইচ্ছে হয় বৌদিকে বলি “বৌদি দাদার কিন্তু এক খাবারে পেট ভরে না৷ খবরটা জানেন তো? মাঝে মাঝে মুখরোচক কিছু দিয়েন৷” কেন যেনো আর সাহসে কুলোয় না৷ যে বৌ তিনি হয়তো বলেই বসবেন আমি তার স্বামীকে জোর করেছিলাম তিনি রাজি হয়নি বলে এইসব বানিয়ে বানিয়ে বলছি৷ তাদের আবার দু’টি মেয়েও আছে৷ আচ্ছা মেয়ে দু’টি ভালো থাকবে তো? যেসব পুরুষের কোন বাছবিচার নেই তাদের মেয়েদের চরিত্র ভগবান ভালো করবেন তো? জানিনা৷ ভগবানই ভালো জানেন৷ আমাকেও ভগবান এক ছেলে আর এক মেয়ে দিয়েছে৷ জানিনা ওদের সঠিকভাবে মানুষ করতে পারবো কিনা৷
ছোটবেলা থেকে ডায়েরি লেখার প্রচন্ড ঝোঁক আমার কিন্তু বহুবার লিখতে গিয়েও লিখতে পারিনি৷ কারণ একটাই মা’টা যেনো কেমন!! আমি কিছুই লুকিয়ে রাখতে পারতাম না৷ যখন যেখানে যা লিখতাম তাই পড়ে ফেলতো৷ গোপনীয়তা বলে কিছুই ছিলো না৷ টেবিলের ড্রয়ার, আলমারির সিন্দুক, বাবার ব্রীফকেস সব জায়গাতেই মা খুঁজতো৷ খুব বিরক্ত হতাম কেন এমন করে? আমার কোন ইচ্ছের কথা লিখতে ইচ্ছে হলেও লিখতাম না৷ তখন বেশ তালাচাবি দেয়া ডায়েরি পাওয়া যেতো৷ সেখানে মাঝে মাঝে টুকটাক লিখতাম৷ জানিনা কিভাবে সেটাও পড়ে ফেলতো৷ তারপর ড্রয়ারে তালা দিলাম৷ ওমা কি করে যেনো সে চাবিটাও হাত করলো৷ এরপর ডায়েরি লেখার সুপ্ত বাসনা মনেই লুকিয়ে রাখলাম৷ না! মা আর আমাকে লিখতে দিবে না৷
এখন আর মায়ের সংসার নেই৷ নিজের সংসার৷ আজ সকালে সূর্যোদয়ের মূহুর্তটা খুব অনুভব করেছি তখনই মনে পড়লো অঞ্জনদা আমাকে খুব সুন্দর একটি ডায়েরি উপহার দিয়েছিলেন আমার জম্মদিনে৷ ছোটবেলার সুপ্ত বাসনা জেগে উঠলো মনে৷ তবে আজ থেকেই হোক আমার ডায়েরি লেখার শুরু……
এ পর্যন্ত লিখতেই পিছন থেকে অনিতা ডাকলো৷
-মা, দিপ্তী মাসি ফোন করেছে তোমার নাকি এগারোটায় শ্যুটিং? প্রায় সাড়ে ন’টা বাজে কখন যাবে?
-হ্যাঁ এখনই যাবো৷ তুই যা৷
মেয়েকে সরিয়ে দরজা আটকে দিলাম৷ ডায়েরির কথাটা ওকে জানতে দেয়া যাবে না৷ এ ঘরে আমি একটা গোপন কুঠুরী করিয়েছি৷ কাউকে না বললে কেউ সেটা বের করতে পারবে না৷ সেখানেই ডায়েরিটা লুকিয়ে রেখে বেরিয়ে পড়লাম রুম থেকে৷ গন্তব্য শ্যুটিং স্পট৷
চলবে….
)